কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ
৩১. আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
হাদীস নং: ৩৭৯৪
আন্তর্জাতিক নং: ৩৭৯৪
’’লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ’’ এর ফযীলাত
৩৭৯৪। আবু বাকর (রাহঃ)...... আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ সাক্ষ্য দিয়ে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ বান্দা যখন “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার" বলে, তখন মহান আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা সত্য বলেছে। আমি ছাড়া আর কোন ইলাই নেই এবং আমিই বড়। আর বান্দা যখন বলে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু" তখন আল্লাহ বলেনঃ আমার বান্দা সত্য বলেছে, আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। যখন সে বলেঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লা শারীকালাহু" তখন তিনি বলেনঃ আমার বান্দা সত্য বলেছে, আমি ছাড়া কোন ইলাহা নেই, আর আমার কোন শরীক নেই। আর যখন বলে 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু লাহুলমুলকু ওয়ালাহুল হামদু”, তখন তিনি বলেনঃ আমার বান্দা সত্য বলেছে, আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, আমারই রাজত্ব এবং আমারই জন্য প্রশংসা। আর যখন সে বলেঃ “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়ালা হাওলা ওয়া-লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ" তখন তিনি বলেনঃ আমার বান্দা সত্য বলেছে, আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই শক্তি ও ক্ষমতা শুধু আমারই। রাবী আবু ইসহাক (রাহঃ) বলেন, অতঃপর তিনি 'আগাররু শাইয়ান' একটি বাক্য বলেছিলেন, যা আমি বুঝতে পারিনি, রাবী বলেনঃ তখন আমি আবু জাফরকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বললেনঃ মৃত্যুর সময় আল্লাহ যাকে এ কলিমা বলার তাওফিক দিবেন, আগুন তাকে সম্পর্শ করতে পারবে না।
بَاب فَضْلِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرٍ، حَدَّثَنَا الْحُسَيْنُ بْنُ عَلِيٍّ، عَنْ حَمْزَةَ الزَّيَّاتِ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ، عَنِ الأَغَرِّ أَبِي مُسْلِمٍ، أَنَّهُ شَهِدَ عَلَى أَبِي هُرَيْرَةَ وَأَبِي سَعِيدٍ أَنَّهُمَا شَهِدَا عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ قَالَ " إِذَا قَالَ الْعَبْدُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ . قَالَ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ صَدَقَ عَبْدِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا وَأَنَا أَكْبَرُ . وَإِذَا قَالَ الْعَبْدُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ . قَالَ صَدَقَ عَبْدِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا وَحْدِي . وَإِذَا قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ . قَالَ صَدَقَ عَبْدِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا وَلاَ شَرِيكَ لِي . وَإِذَا قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ . قَالَ صَدَقَ عَبْدِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا لِيَ الْمُلْكُ وَلِيَ الْحَمْدُ . وَإِذَا قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ . قَالَ صَدَقَ عَبْدِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِي " . قَالَ أَبُو إِسْحَاقَ ثُمَّ قَالَ الأَغَرُّ شَيْئًا لَمْ أَفْهَمْهُ . قَالَ فَقُلْتُ لأَبِي جَعْفَرٍ مَا قَالَ فَقَالَ مَنْ رُزِقَهُنَّ عِنْدَ مَوْتِهِ لَمْ تَمَسَّهُ النَّارُ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে যিকিরের চারটি বাক্য উল্লেখ করা হয়েছে। বাক্যগুলো একত্র করলে এরকম হয়-
لا إِلهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ
বান্দা যখন যিকিরের এ বাক্যগুলো বলে, তখন প্রত্যেকটি বাক্যের বেলায় আল্লাহ তা'আলা বান্দার সমর্থন করেন। যে ব্যক্তি তার অন্তিমকালে এ বাক্যগুলো বলার তাওফীক লাভ করে, তার সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে বলেছেন যে, জাহান্নামের আগুন তাকে গ্রাস করবে না। অর্থাৎ সে জাহান্নামে যাবেই না। সরাসরি জান্নাতে চলে যাবে। বাক্যচারটির প্রথমটি হল-
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ (আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই এবং আল্লাহ মহান)। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই। তিনিই মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনিই সবকিছুর একচ্ছত্র মালিক। তিনিই সকলের প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন। তাঁরই হাতে সকলের জীবন ও মৃত্যু। উপকার ও অপকার সাধনের সর্বময় ক্ষমতা কেবল তিনিই রাখেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ এসবের ক্ষমতা রাখে না। তাই তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতেরও উপযুক্ত হতে পারে না। কাজেই মানুষ তাঁকে ছাড়া আর যা-কিছুকে মা'বুদ ও উপাস্য বানিয়ে রেখেছে, তা সবই মিথ্যা। সুতরাং বান্দার এ ঘোষণা এক পরম সত্য। তাই বান্দা যখন এ ঘোষণা দেয়, তখন আল্লাহ তা'আলা তার সমর্থন করেন এবং বলেন- আমি ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই এবং আমি মহান।
اللَّهُ أَكْبَرُ এর আক্ষরিক অর্থ আল্লাহ অধিকতর বড়। কার তুলনায় বেশি বড়, তার উল্লেখ করা হয়নি। তা উল্লেখ করা হয়নি এ কারণে যে, বড়ত্বের দিক থেকে আল্লাহর সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। তিনি সৃষ্টিকর্তা ও মালিক। সকলে তাঁরই সৃষ্টি ও তাঁরই মালিকানাধীন। সকলে সকল বিবেচনায় সসীম। পক্ষান্তরে তিনিই সবদিক থেকে অসীম। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সৃষ্টির, মালিকের সঙ্গে মালিকানাধীন বস্তুর এবং অসীমের সঙ্গে সসীমের কিসের তুলনা? তিনি বড় অতুলনীয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ
'কোনও জিনিস নয় তাঁর অনুরূপ’। (সূরা শূরা, আয়াত ১১)
সুতরাং اللَّهُ أَكْبَرُ হল আল্লাহর তুলনাতীত গৌরব ও বড়ত্বের ঘোষণা। ইসলামের শৌর্যবীর্যের প্রতীক। এটা ইসলামের শ্লোগান। ইসলামের শুরুতেই এ শ্লোগান মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়। শুরুর ওহীতে আল্লাহ তা'আলা হুকুম করেন- وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ (এবং নিজ প্রতিপালকের তাকবীর বলো) (সূরা মুদ্দাচ্ছির, আয়াত ৩)
তিনি বলে উঠেন اللَّهُ أَكْبَرُ। সে ধ্বনির প্রতিধ্বনিতে প্রথম মুসলিম মা খাদীজা রাযি.-ও বলে ওঠেন اللَّهُ أَكْبَرُ
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরী ৭ম সনে যখন খায়বারের যুদ্ধে যান, তখন তাঁর মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল اللهُ أَكْبَرُ خَرِبَتْ خَیبر (আল্লাহু আকবার! খায়বারের পতন হল)। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ যমানার কনস্টান্টিনোপলের জিহাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে জানান যে, সেখানে যখন মুসলিম বাহিনী পৌঁছাবে, তখন তারা কোনও অস্ত্র দিয়ে লড়াই করবে না এবং কোনও তির নিক্ষেপ করবে না। বরং তারা বলবে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ। ফলে নগরের এক দিক বিজিত হবে। তারপর তারা দ্বিতীয়বার বলবে لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ। তাতে নগরের অপর দিক বিজিত হবে। তারপর তৃতীয়বার বলবে لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ। তাতে তাদের সামনে পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে। তারা নগরে প্রবেশ করবে ও জয়লাভ করবে। (সহীহ মুসলিম: ২৯২০; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৮৪৬৯)
বস্তুত الله أكبر মহান আল্লাহর বড়ত্ব ও তাঁর সামনে নিখিল সৃষ্টের ক্ষুদ্রতার ঘোষণা। মানুষ সেই রাশি রাশি ক্ষুদ্র সৃষ্টির একটা বিন্দু। اللَّهُ أَكْبَرُ ধ্বনিটি নিজ সৃষ্টিকর্তা ও মালিকের সামনে তার আত্মনিবেদনের ভাষা। এটা মাখলুকের দাসত্ব ছিন্ন করার ঘোষণা। গায়রুল্লাহর আসক্তি থেকে মুক্তির উচ্চারণ। তাই اللَّهُ أَكْبَرُ এর মাধ্যমেই সে বন্দেগী প্রকাশের শ্রেষ্ঠতম পন্থা নামাযের ভেতর প্রবেশ করে। বন্দেগীর মহোৎসব দুই ঈদকে মুখর করে তোলে এই শ্লোগানের ধ্বনিতে।
দ্বিতীয় বাক্য হল- لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ (আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই। তিনি এক। তাঁর কোনও শরীক নেই)। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সৃজন ও প্রতিপালনে তাঁর কোনও শরীক নেই। ছোট-বড় প্রতিটি বস্তু একা তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তিনি একাই সবকিছু প্রতিপালন করে থাকেন। তাই ইবাদতও কেবল তাঁরই প্রাপ্য। তাতে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে শরীক করা যায় না। সুতরাং বান্দা যখন এ পরম সত্যের ঘোষণা দেয়, তখন আল্লাহ তা'আলা তার সমর্থন করে বলেন- আমি ছাড়া কোনও মা’বূদ নেই। আমি এক। আমার কোন শরীক নেই। এ বিষয়ে কুরআন মাজীদে অজস্র আয়াত রয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللَّهِ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ
'হে মানুষ! আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে নি'আমত বর্ষণ করেছেন তা স্মরণ করো। - আল্লাহ ছাড়া আর কোনও খালেক আছে কি, যে আসমান ও যমীন থেকে তোমাদেরকে রিযিক দান করে? তিনি ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। সুতরাং তোমরা বিপথগামী হয়ে কোন দিকে যাচ্ছ?' (সূরা ফাতির, আয়াত ৩)
আরও ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ قُلِ اللَّهُ قُلْ أَفَاتَّخَذْتُمْ مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ لَا يَمْلِكُونَ لِأَنْفُسِهِمْ نَفْعًا وَلَا ضَرًّا
'(হে নবী! কাফেরদের) বলো, কে তিনি, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালন করেন? বলো, আল্লাহ! বলো, তবুও তোমরা তাঁকে ছেড়ে এমনসব অভিভাবক গ্রহণ করলে, যাদের খোদ নিজেদেরও কোনও উপকার সাধনের ক্ষমতা নেই এবং অপকার সাধনেরও না?’ (সূরা রা'দ, আয়াত ১৬)
কুরআন মাজীদে এ বিষয়ক আয়াত প্রচুর। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলা যে এক এবং তাঁর কোনও শরীক নেই, এটাই কুরআন মাজীদের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়।
তৃতীয় বাক্য হল- لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ (আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই। সার্বভৌমত্ব তাঁরই এবং তাঁরই সমস্ত প্রশংসা)। বান্দা এ কথা বললে আল্লাহ তা'আলা তার সমর্থন করে বলেন- আমি ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই। আমারই সমস্ত প্রশংসা এবং সার্বভৌমত্ব আমারই। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সবকিছুর তিনিই একমাত্র মালিক এবং সবকিছুর উপর তাঁরই রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। সবকিছুতে কেবল তাঁরই ইচ্ছা কার্যকর হয়। তাঁরই হুকুম প্রতিফলিত হয়। মাখলুকের যা-কিছু ইচ্ছা ও আধিপত্য, প্রকৃতপক্ষে তা তাঁরই ইচ্ছা ও আধিপত্যের অধীন। তিনিই মহাবিশ্বের মহাঅধিপতি। এমনিভাবে জগতের যা-কিছু সৌন্দর্য, যা-কিছু মঙ্গল, যা-কিছু উপভোগ্য এবং জগতে যত আলো ও ভালো, যত সুধা, যত শোভা, আল্লাহ তা'আলাই তার আধার এবং আল্লাহ তা'আলাই তার দাতা। তাই মৌলিকভাবে সমস্ত প্রশংসার উপযুক্তও কেবল তিনিই। সৃষ্টির যাবতীয় সদগুণ ও সৌন্দর্য যেহেতু তাঁরই দান, তাই তাদের প্রশংসা করার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলারই প্রশংসা করা হয়। সেজন্যই বলা হয়েছে وَلَهُ الحَمْدُ (সমস্ত প্রশংসা তাঁরই)। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَهُوَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْحَمْدُ فِي الْأُولَى وَالْآخِرَةِ وَلَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
'তিনিই আল্লাহ। তিনি ছাড়া কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়। প্রশংসা তাঁরই দুনিয়ায়ও এবং আখিরাতেও। বিধান কেবল তাঁরই এবং তাঁরই দিকে তোমাদের সকলকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।' (সূরা কাসাস, আয়াত ৭০)
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
'এবং তারই সমস্ত প্রশংসা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে’। (সূরা রুম, আয়াত ১৮)
কুরআন মাজীদের সূচনাও হয়েছে এই ঘোষণা দ্বারাই যে-
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
‘সমস্ত প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর’।
চতুর্থ বাক্য হচ্ছে- لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ (আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই এবং আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (কারও) কোনও শক্তি ও ক্ষমতা নেই)। বান্দা এ ঘোষণা দিলে আল্লাহ তা'আলা তার সমর্থন করে বলেন- আমি ছাড়া কোনও মাবূদ নেই। আমার সাহায্য ছাড়া (কারও) কোনও শক্তি ও ক্ষমতা নেই।
لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ এর অর্থ আল্লাহর ইচ্ছা ও এরাদা, তাঁর তাওফীক ও সাহায্য এবং তাঁর শক্তি ও কুদরত ছাড়া কেউ কোনও গতি ও যতির সামর্থ্য রাখে না, কোনও কৌশল ও ব্যবস্থাগ্রহণ করতে পারে না, কোনও অনিষ্ট রোধ ও কোনও কল্যাণ অর্জন করতে পারে না এবং পারে না কোনও গুনাহ থেকে বাঁচতে ও কোনও সৎকর্ম সম্পাদন করতে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. বলেন, এর অর্থ আল্লাহর সুরক্ষাদান ছাড়া কেউ তাঁর অবাধ্যতা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে না এবং তাঁর সাহায্য ছাড়া কেউ তাঁর ইবাদত-আনুগত্য করার ক্ষমতা রাখে না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, এর অর্থ হল আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমাদের কোনও ইবাদত-আনুগত্যমূলক কাজ করার ক্ষমতা নেই এবং তাঁর সাহায্য ছাড়া আমাদের কোনও পাপকর্ম পরিহার করার শক্তি নেই। সুতরাং এ বাক্যটি আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ ও নিজেকে তাঁর নিকট নিবেদন করার ভাষা। এর মাধ্যমে স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, আল্লাহ ছাড়া বান্দার কোনও সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক নেই। তাঁর হুকুম ও ফয়সালা রোধ করার সাধ্য কারও নেই। আল্লাহ সবকিছুর সার্বভৌম মালিক। বান্দা নয়। সে চাইলেই কিছু করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যখন যা চান তাই করতে পারেন। সুতরাং বাক্যটি বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ ও গভীর অর্থবোধক। তাই এর ফযীলতও অনেক বেশি। যেমন এক হাদীছে এটিকে স্থায়ী সৎকর্ম বলা হয়েছে। বর্ণিত আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
«اسْتَكْثِرُوا مِنَ الْبَاقِيَاتِ الصَّالِحَاتِ» ، قِيلَ: وَمَا هُنَّ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟، قَالَ: «التَّكْبِيرُ، وَالتَّهْلِيلُ، وَالتَّسْبِيحُ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ»
'তোমরা স্থায়ী সৎকর্ম বেশি বেশি করো। জিজ্ঞেস করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা কী? তিনি বললেন, তাকবীর (আল্লাহু আকবার), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ), আলহামদুলিল্লাহ ও লা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।’
(সহীহ ইবনে হিব্বান : ৮৪০; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ১৩৮৪; হাকিম, আল মুস্তাদরাক ১৮৮৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৫৯৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১২৮২)
অপর এক হাদীছে এটিকে জান্নাতের খনি বলা হয়েছে। হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন-
يَا عَبْدَ اللهِ بْنَ قَيْسٍ, أَلاَ أَدُلُّكَ عَلَى كَنْزٍ مِنْ كُنُوزِ الْجَنَّةِ, فَقُلْتُ: بَلَى, يَا رَسُولَ اللهِ, قَالَ: قُلْ: لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ
'হে আব্দুল্লাহ ইবন কায়স! আমি কি তোমাকে জান্নাতের খনিসমূহের অন্তর্ভুক্ত একটি খনি সম্পর্কে জানাব না? তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, বলো-
لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ
(সহীহ বুখারী : ৬৪০৯; সহীহ মুসলিম: ২৭০৪; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৮২৪; সুনানে আবূ দাউদ : ১৫২৬; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৮৭৭৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৭২৫২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার : ৫৭৮৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৮০৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৩০১২)
খনিতে যেমন প্রচুর সম্পদ পুঞ্জিভূত থাকে, তেমনি এ বাক্যটির মধ্যেও প্রচুর ছাওয়াব নিহিত আছে। তাই এটিকে জান্নাতের খনি বলা হয়েছে।
এটি জান্নাতে প্রবেশের অছিলা। হযরত সা'দ ইবন উবাদা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন-
أَلاَ أَدُلُّكَ عَلَى بَابٍ مِنْ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ ؟ قُلْتُ : بَلَى ، قَالَ : لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ
‘আমি কি তোমাকে জান্নাতের দরজাসমূহের মধ্যে একটি দরজার কথা বলে দেব না? তিনি বলেন, আমি বললাম, অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন- لا حول ولا قُوَّةَ إِلَّا الله
(জামে' তিরমিযী: ৩৫৮১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১০১১৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৮৯৩: হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৭৭৮৭; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৬৫১)
দরজা দিয়ে যেমন ঘরের ভেতর প্রবেশ করা যায়, তেমনি এ বাক্যটি পাঠ করার দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে। সে হিসেবে এটিকে জান্নাতের দরজা বলা হয়েছে। এটি দু'আ কবুলেরও উপায়। যেমন এক হাদীছে আছে, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে
لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ، الْحَمْدُ لِلَّهِ، وَسُبْحَانَ اللهِ، وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ بِاللَّهِ
তারপর বলে- হে আল্লাহ। আমাকে ক্ষমা করুন, অথবা অন্য কোনও দু'আ করে, তার দু'আ কবুল করা হয়।
(সহীহ বুখারী: ১১৫৪; সুনানে আবু দাউদ: ৫০৬০; জামে তিরমিযী: ৩৪১৪: নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১০৬৩১; সুনানে দারিমী: ২৭২৯; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৫৯৬; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৪৬৬৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ ৯৫৩)
এটি গুনাহ মাফের উপায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ভূপৃষ্ঠের যে-কেউ বলে لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ তাঁর পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যদিও তা সাগরের ফেনাতুল্য হয়। (জামে' তিরমিযী: ৩৪৬০)
এটি শয়তান থেকে আত্মরক্ষারও উপায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলে بسم الله، توكَّلت على الله، لا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِالله, তাকে বলা হয়- তোমার জন্য যথেষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, তোমাকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়। (জামে' তিরমিযী: ৩৪২৬)
এটি জান্নাতের চারাগাছ। মি'রাজের রাতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সঙ্গে যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাৎ হয়, তখন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁকে বলেছিলেন, হে মুহাম্মাদ! তোমার উম্মতকে আদেশ করো যেন জান্নাতে বেশি বেশি চারা লাগায়। কেননা জান্নাতের মাটি উৎকৃষ্ট ও তার ভূমি প্রশস্ত। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, জান্নাতের চারাগাছ কী? হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন- لا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِالله
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৬৪৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৮২১; আল মুজালাসা ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম: ৩৬)
এমন ফযীলতপূর্ণ দু'আটি যত বেশি সম্ভব পড়া উচিত। লক্ষণীয় لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ কালেমাটি চারওটি বাক্যে রয়েছে। এ কালেমা ঈমানের মূল। যে-কোনও আমলের ফযীলত কেবল তখনই হাসিল হতে পারে, যখন বান্দার এ কালেমায় বিশ্বাস থাকবে। তাই এ কালেমার যিকির সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
চারওটি বাক্যের ফযীলত সম্পর্কে এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- من قالها فى مرضهِ ثُمَّ مَاتَ لَمْ تَطْعَمهُ النارُ (তিন বলতেন, যে ব্যক্তি তার অসুস্থতাকালে এগুলো বলে, তারপর মারা যায়, আগুন তাকে গ্রাস করবে না) এ কথা সকলেরই জানা যে, কে কোন রোগে মারা যাবে তা কেউ জানেনা। যে-কোনও রোগে আক্রান্ত থাকাকালে এ কথাগুলো বেশি বেশি পাঠ করা উচিত। মানুষ তো অসুস্থতা ছাড়াও নানা কারণে মারা যায়। তাই এ আমলটি অসুস্থাবস্থার জন্য নির্দিষ্ট না রেখে সুস্থাবস্থায়ও করা দরকার, যাতে যে হালেই মৃত্যু হোক তা যেন এ আমলের সঙ্গে হয়। তাহলে জাহান্নাম থেকে বাঁচার আশা থাকবে। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা আমাদেরকে এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহ এক। তাঁর কোনও শরীক নেই।
খ. আল্লাহ তা'আলাই একমাত্র মা'বূদ ও উপাস্য।
গ. আল্লাহ তা'আলা অতুলনীয়ভাবে অতি বড়। আল্লাহু আকবার বলার দ্বারা তাঁর সে বড়ত্বের ঘোষণা হয়। এ ঘোষণাকালে বান্দার উচিত সকল মাখলুকের সর্বপ্রকার দাসত্ব ও আসক্তির ঊর্ধ্বে ওঠে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে তাঁর প্রতি নিবেদিত ও নির্ভরশীল হওয়া।
ঘ. মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও সার্বভৌম মালিক কেবল আল্লাহ তা'আলাই।
ঙ. সমস্ত সদগুণের আধার কেবল আল্লাহ তা'আলাই। তাই সমস্ত প্রশংসার উপযুক্তও কেবল তিনিই। মাখলুকের প্রশংসা করলে প্রকৃতপক্ষে তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলারই প্রশংসা হয়।
চ. আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ও সাহায্য ছাড়া কেউ কোনও গুনাহ থেকে বাঁচতে পারে না ও সৎকর্ম করতে পারে না। তাই এ বিষয়ে তাঁরই সাহায্য চাওয়া উচিত।
ছ. হাদীছে বর্ণিত যিকিরের বাক্যসমূহ সুস্থ-অসুস্থ সকলেরই বেশি বেশি পড়া উচিত। কেননা এর দ্বারা জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচার আশা করা যায়।
জ. বান্দার যিকির ও প্রশংসায় আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। তাই তিনি বান্দার প্রশংসাবাক্যের সমর্থন করেন এবং অনুরূপ কথা তিনি নিজেও বলেন।
لا إِلهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ
বান্দা যখন যিকিরের এ বাক্যগুলো বলে, তখন প্রত্যেকটি বাক্যের বেলায় আল্লাহ তা'আলা বান্দার সমর্থন করেন। যে ব্যক্তি তার অন্তিমকালে এ বাক্যগুলো বলার তাওফীক লাভ করে, তার সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে বলেছেন যে, জাহান্নামের আগুন তাকে গ্রাস করবে না। অর্থাৎ সে জাহান্নামে যাবেই না। সরাসরি জান্নাতে চলে যাবে। বাক্যচারটির প্রথমটি হল-
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ (আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই এবং আল্লাহ মহান)। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই। তিনিই মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনিই সবকিছুর একচ্ছত্র মালিক। তিনিই সকলের প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন। তাঁরই হাতে সকলের জীবন ও মৃত্যু। উপকার ও অপকার সাধনের সর্বময় ক্ষমতা কেবল তিনিই রাখেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ এসবের ক্ষমতা রাখে না। তাই তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতেরও উপযুক্ত হতে পারে না। কাজেই মানুষ তাঁকে ছাড়া আর যা-কিছুকে মা'বুদ ও উপাস্য বানিয়ে রেখেছে, তা সবই মিথ্যা। সুতরাং বান্দার এ ঘোষণা এক পরম সত্য। তাই বান্দা যখন এ ঘোষণা দেয়, তখন আল্লাহ তা'আলা তার সমর্থন করেন এবং বলেন- আমি ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই এবং আমি মহান।
اللَّهُ أَكْبَرُ এর আক্ষরিক অর্থ আল্লাহ অধিকতর বড়। কার তুলনায় বেশি বড়, তার উল্লেখ করা হয়নি। তা উল্লেখ করা হয়নি এ কারণে যে, বড়ত্বের দিক থেকে আল্লাহর সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। তিনি সৃষ্টিকর্তা ও মালিক। সকলে তাঁরই সৃষ্টি ও তাঁরই মালিকানাধীন। সকলে সকল বিবেচনায় সসীম। পক্ষান্তরে তিনিই সবদিক থেকে অসীম। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সৃষ্টির, মালিকের সঙ্গে মালিকানাধীন বস্তুর এবং অসীমের সঙ্গে সসীমের কিসের তুলনা? তিনি বড় অতুলনীয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ
'কোনও জিনিস নয় তাঁর অনুরূপ’। (সূরা শূরা, আয়াত ১১)
সুতরাং اللَّهُ أَكْبَرُ হল আল্লাহর তুলনাতীত গৌরব ও বড়ত্বের ঘোষণা। ইসলামের শৌর্যবীর্যের প্রতীক। এটা ইসলামের শ্লোগান। ইসলামের শুরুতেই এ শ্লোগান মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়। শুরুর ওহীতে আল্লাহ তা'আলা হুকুম করেন- وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ (এবং নিজ প্রতিপালকের তাকবীর বলো) (সূরা মুদ্দাচ্ছির, আয়াত ৩)
তিনি বলে উঠেন اللَّهُ أَكْبَرُ। সে ধ্বনির প্রতিধ্বনিতে প্রথম মুসলিম মা খাদীজা রাযি.-ও বলে ওঠেন اللَّهُ أَكْبَرُ
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরী ৭ম সনে যখন খায়বারের যুদ্ধে যান, তখন তাঁর মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল اللهُ أَكْبَرُ خَرِبَتْ خَیبر (আল্লাহু আকবার! খায়বারের পতন হল)। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ যমানার কনস্টান্টিনোপলের জিহাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে জানান যে, সেখানে যখন মুসলিম বাহিনী পৌঁছাবে, তখন তারা কোনও অস্ত্র দিয়ে লড়াই করবে না এবং কোনও তির নিক্ষেপ করবে না। বরং তারা বলবে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ। ফলে নগরের এক দিক বিজিত হবে। তারপর তারা দ্বিতীয়বার বলবে لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ। তাতে নগরের অপর দিক বিজিত হবে। তারপর তৃতীয়বার বলবে لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ। তাতে তাদের সামনে পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে। তারা নগরে প্রবেশ করবে ও জয়লাভ করবে। (সহীহ মুসলিম: ২৯২০; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৮৪৬৯)
বস্তুত الله أكبر মহান আল্লাহর বড়ত্ব ও তাঁর সামনে নিখিল সৃষ্টের ক্ষুদ্রতার ঘোষণা। মানুষ সেই রাশি রাশি ক্ষুদ্র সৃষ্টির একটা বিন্দু। اللَّهُ أَكْبَرُ ধ্বনিটি নিজ সৃষ্টিকর্তা ও মালিকের সামনে তার আত্মনিবেদনের ভাষা। এটা মাখলুকের দাসত্ব ছিন্ন করার ঘোষণা। গায়রুল্লাহর আসক্তি থেকে মুক্তির উচ্চারণ। তাই اللَّهُ أَكْبَرُ এর মাধ্যমেই সে বন্দেগী প্রকাশের শ্রেষ্ঠতম পন্থা নামাযের ভেতর প্রবেশ করে। বন্দেগীর মহোৎসব দুই ঈদকে মুখর করে তোলে এই শ্লোগানের ধ্বনিতে।
দ্বিতীয় বাক্য হল- لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ (আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই। তিনি এক। তাঁর কোনও শরীক নেই)। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সৃজন ও প্রতিপালনে তাঁর কোনও শরীক নেই। ছোট-বড় প্রতিটি বস্তু একা তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তিনি একাই সবকিছু প্রতিপালন করে থাকেন। তাই ইবাদতও কেবল তাঁরই প্রাপ্য। তাতে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে শরীক করা যায় না। সুতরাং বান্দা যখন এ পরম সত্যের ঘোষণা দেয়, তখন আল্লাহ তা'আলা তার সমর্থন করে বলেন- আমি ছাড়া কোনও মা’বূদ নেই। আমি এক। আমার কোন শরীক নেই। এ বিষয়ে কুরআন মাজীদে অজস্র আয়াত রয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللَّهِ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ
'হে মানুষ! আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে নি'আমত বর্ষণ করেছেন তা স্মরণ করো। - আল্লাহ ছাড়া আর কোনও খালেক আছে কি, যে আসমান ও যমীন থেকে তোমাদেরকে রিযিক দান করে? তিনি ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। সুতরাং তোমরা বিপথগামী হয়ে কোন দিকে যাচ্ছ?' (সূরা ফাতির, আয়াত ৩)
আরও ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ قُلِ اللَّهُ قُلْ أَفَاتَّخَذْتُمْ مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ لَا يَمْلِكُونَ لِأَنْفُسِهِمْ نَفْعًا وَلَا ضَرًّا
'(হে নবী! কাফেরদের) বলো, কে তিনি, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালন করেন? বলো, আল্লাহ! বলো, তবুও তোমরা তাঁকে ছেড়ে এমনসব অভিভাবক গ্রহণ করলে, যাদের খোদ নিজেদেরও কোনও উপকার সাধনের ক্ষমতা নেই এবং অপকার সাধনেরও না?’ (সূরা রা'দ, আয়াত ১৬)
কুরআন মাজীদে এ বিষয়ক আয়াত প্রচুর। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলা যে এক এবং তাঁর কোনও শরীক নেই, এটাই কুরআন মাজীদের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়।
তৃতীয় বাক্য হল- لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ (আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই। সার্বভৌমত্ব তাঁরই এবং তাঁরই সমস্ত প্রশংসা)। বান্দা এ কথা বললে আল্লাহ তা'আলা তার সমর্থন করে বলেন- আমি ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই। আমারই সমস্ত প্রশংসা এবং সার্বভৌমত্ব আমারই। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সবকিছুর তিনিই একমাত্র মালিক এবং সবকিছুর উপর তাঁরই রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। সবকিছুতে কেবল তাঁরই ইচ্ছা কার্যকর হয়। তাঁরই হুকুম প্রতিফলিত হয়। মাখলুকের যা-কিছু ইচ্ছা ও আধিপত্য, প্রকৃতপক্ষে তা তাঁরই ইচ্ছা ও আধিপত্যের অধীন। তিনিই মহাবিশ্বের মহাঅধিপতি। এমনিভাবে জগতের যা-কিছু সৌন্দর্য, যা-কিছু মঙ্গল, যা-কিছু উপভোগ্য এবং জগতে যত আলো ও ভালো, যত সুধা, যত শোভা, আল্লাহ তা'আলাই তার আধার এবং আল্লাহ তা'আলাই তার দাতা। তাই মৌলিকভাবে সমস্ত প্রশংসার উপযুক্তও কেবল তিনিই। সৃষ্টির যাবতীয় সদগুণ ও সৌন্দর্য যেহেতু তাঁরই দান, তাই তাদের প্রশংসা করার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলারই প্রশংসা করা হয়। সেজন্যই বলা হয়েছে وَلَهُ الحَمْدُ (সমস্ত প্রশংসা তাঁরই)। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَهُوَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْحَمْدُ فِي الْأُولَى وَالْآخِرَةِ وَلَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
'তিনিই আল্লাহ। তিনি ছাড়া কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়। প্রশংসা তাঁরই দুনিয়ায়ও এবং আখিরাতেও। বিধান কেবল তাঁরই এবং তাঁরই দিকে তোমাদের সকলকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।' (সূরা কাসাস, আয়াত ৭০)
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
'এবং তারই সমস্ত প্রশংসা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে’। (সূরা রুম, আয়াত ১৮)
কুরআন মাজীদের সূচনাও হয়েছে এই ঘোষণা দ্বারাই যে-
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
‘সমস্ত প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর’।
চতুর্থ বাক্য হচ্ছে- لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ (আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই এবং আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (কারও) কোনও শক্তি ও ক্ষমতা নেই)। বান্দা এ ঘোষণা দিলে আল্লাহ তা'আলা তার সমর্থন করে বলেন- আমি ছাড়া কোনও মাবূদ নেই। আমার সাহায্য ছাড়া (কারও) কোনও শক্তি ও ক্ষমতা নেই।
لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ এর অর্থ আল্লাহর ইচ্ছা ও এরাদা, তাঁর তাওফীক ও সাহায্য এবং তাঁর শক্তি ও কুদরত ছাড়া কেউ কোনও গতি ও যতির সামর্থ্য রাখে না, কোনও কৌশল ও ব্যবস্থাগ্রহণ করতে পারে না, কোনও অনিষ্ট রোধ ও কোনও কল্যাণ অর্জন করতে পারে না এবং পারে না কোনও গুনাহ থেকে বাঁচতে ও কোনও সৎকর্ম সম্পাদন করতে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. বলেন, এর অর্থ আল্লাহর সুরক্ষাদান ছাড়া কেউ তাঁর অবাধ্যতা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে না এবং তাঁর সাহায্য ছাড়া কেউ তাঁর ইবাদত-আনুগত্য করার ক্ষমতা রাখে না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, এর অর্থ হল আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমাদের কোনও ইবাদত-আনুগত্যমূলক কাজ করার ক্ষমতা নেই এবং তাঁর সাহায্য ছাড়া আমাদের কোনও পাপকর্ম পরিহার করার শক্তি নেই। সুতরাং এ বাক্যটি আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ ও নিজেকে তাঁর নিকট নিবেদন করার ভাষা। এর মাধ্যমে স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, আল্লাহ ছাড়া বান্দার কোনও সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক নেই। তাঁর হুকুম ও ফয়সালা রোধ করার সাধ্য কারও নেই। আল্লাহ সবকিছুর সার্বভৌম মালিক। বান্দা নয়। সে চাইলেই কিছু করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যখন যা চান তাই করতে পারেন। সুতরাং বাক্যটি বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ ও গভীর অর্থবোধক। তাই এর ফযীলতও অনেক বেশি। যেমন এক হাদীছে এটিকে স্থায়ী সৎকর্ম বলা হয়েছে। বর্ণিত আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
«اسْتَكْثِرُوا مِنَ الْبَاقِيَاتِ الصَّالِحَاتِ» ، قِيلَ: وَمَا هُنَّ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟، قَالَ: «التَّكْبِيرُ، وَالتَّهْلِيلُ، وَالتَّسْبِيحُ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ»
'তোমরা স্থায়ী সৎকর্ম বেশি বেশি করো। জিজ্ঞেস করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা কী? তিনি বললেন, তাকবীর (আল্লাহু আকবার), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ), আলহামদুলিল্লাহ ও লা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।’
(সহীহ ইবনে হিব্বান : ৮৪০; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ১৩৮৪; হাকিম, আল মুস্তাদরাক ১৮৮৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৫৯৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১২৮২)
অপর এক হাদীছে এটিকে জান্নাতের খনি বলা হয়েছে। হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন-
يَا عَبْدَ اللهِ بْنَ قَيْسٍ, أَلاَ أَدُلُّكَ عَلَى كَنْزٍ مِنْ كُنُوزِ الْجَنَّةِ, فَقُلْتُ: بَلَى, يَا رَسُولَ اللهِ, قَالَ: قُلْ: لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ
'হে আব্দুল্লাহ ইবন কায়স! আমি কি তোমাকে জান্নাতের খনিসমূহের অন্তর্ভুক্ত একটি খনি সম্পর্কে জানাব না? তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, বলো-
لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ
(সহীহ বুখারী : ৬৪০৯; সহীহ মুসলিম: ২৭০৪; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৮২৪; সুনানে আবূ দাউদ : ১৫২৬; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৮৭৭৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৭২৫২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার : ৫৭৮৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৮০৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৩০১২)
খনিতে যেমন প্রচুর সম্পদ পুঞ্জিভূত থাকে, তেমনি এ বাক্যটির মধ্যেও প্রচুর ছাওয়াব নিহিত আছে। তাই এটিকে জান্নাতের খনি বলা হয়েছে।
এটি জান্নাতে প্রবেশের অছিলা। হযরত সা'দ ইবন উবাদা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন-
أَلاَ أَدُلُّكَ عَلَى بَابٍ مِنْ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ ؟ قُلْتُ : بَلَى ، قَالَ : لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ
‘আমি কি তোমাকে জান্নাতের দরজাসমূহের মধ্যে একটি দরজার কথা বলে দেব না? তিনি বলেন, আমি বললাম, অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন- لا حول ولا قُوَّةَ إِلَّا الله
(জামে' তিরমিযী: ৩৫৮১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১০১১৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৮৯৩: হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৭৭৮৭; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৬৫১)
দরজা দিয়ে যেমন ঘরের ভেতর প্রবেশ করা যায়, তেমনি এ বাক্যটি পাঠ করার দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে। সে হিসেবে এটিকে জান্নাতের দরজা বলা হয়েছে। এটি দু'আ কবুলেরও উপায়। যেমন এক হাদীছে আছে, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে
لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ، الْحَمْدُ لِلَّهِ، وَسُبْحَانَ اللهِ، وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ بِاللَّهِ
তারপর বলে- হে আল্লাহ। আমাকে ক্ষমা করুন, অথবা অন্য কোনও দু'আ করে, তার দু'আ কবুল করা হয়।
(সহীহ বুখারী: ১১৫৪; সুনানে আবু দাউদ: ৫০৬০; জামে তিরমিযী: ৩৪১৪: নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১০৬৩১; সুনানে দারিমী: ২৭২৯; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৫৯৬; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৪৬৬৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ ৯৫৩)
এটি গুনাহ মাফের উপায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ভূপৃষ্ঠের যে-কেউ বলে لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ তাঁর পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যদিও তা সাগরের ফেনাতুল্য হয়। (জামে' তিরমিযী: ৩৪৬০)
এটি শয়তান থেকে আত্মরক্ষারও উপায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলে بسم الله، توكَّلت على الله، لا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِالله, তাকে বলা হয়- তোমার জন্য যথেষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, তোমাকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়। (জামে' তিরমিযী: ৩৪২৬)
এটি জান্নাতের চারাগাছ। মি'রাজের রাতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সঙ্গে যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাৎ হয়, তখন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁকে বলেছিলেন, হে মুহাম্মাদ! তোমার উম্মতকে আদেশ করো যেন জান্নাতে বেশি বেশি চারা লাগায়। কেননা জান্নাতের মাটি উৎকৃষ্ট ও তার ভূমি প্রশস্ত। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, জান্নাতের চারাগাছ কী? হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন- لا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِالله
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৬৪৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৮২১; আল মুজালাসা ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম: ৩৬)
এমন ফযীলতপূর্ণ দু'আটি যত বেশি সম্ভব পড়া উচিত। লক্ষণীয় لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ কালেমাটি চারওটি বাক্যে রয়েছে। এ কালেমা ঈমানের মূল। যে-কোনও আমলের ফযীলত কেবল তখনই হাসিল হতে পারে, যখন বান্দার এ কালেমায় বিশ্বাস থাকবে। তাই এ কালেমার যিকির সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
চারওটি বাক্যের ফযীলত সম্পর্কে এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- من قالها فى مرضهِ ثُمَّ مَاتَ لَمْ تَطْعَمهُ النارُ (তিন বলতেন, যে ব্যক্তি তার অসুস্থতাকালে এগুলো বলে, তারপর মারা যায়, আগুন তাকে গ্রাস করবে না) এ কথা সকলেরই জানা যে, কে কোন রোগে মারা যাবে তা কেউ জানেনা। যে-কোনও রোগে আক্রান্ত থাকাকালে এ কথাগুলো বেশি বেশি পাঠ করা উচিত। মানুষ তো অসুস্থতা ছাড়াও নানা কারণে মারা যায়। তাই এ আমলটি অসুস্থাবস্থার জন্য নির্দিষ্ট না রেখে সুস্থাবস্থায়ও করা দরকার, যাতে যে হালেই মৃত্যু হোক তা যেন এ আমলের সঙ্গে হয়। তাহলে জাহান্নাম থেকে বাঁচার আশা থাকবে। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা আমাদেরকে এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহ এক। তাঁর কোনও শরীক নেই।
খ. আল্লাহ তা'আলাই একমাত্র মা'বূদ ও উপাস্য।
গ. আল্লাহ তা'আলা অতুলনীয়ভাবে অতি বড়। আল্লাহু আকবার বলার দ্বারা তাঁর সে বড়ত্বের ঘোষণা হয়। এ ঘোষণাকালে বান্দার উচিত সকল মাখলুকের সর্বপ্রকার দাসত্ব ও আসক্তির ঊর্ধ্বে ওঠে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে তাঁর প্রতি নিবেদিত ও নির্ভরশীল হওয়া।
ঘ. মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও সার্বভৌম মালিক কেবল আল্লাহ তা'আলাই।
ঙ. সমস্ত সদগুণের আধার কেবল আল্লাহ তা'আলাই। তাই সমস্ত প্রশংসার উপযুক্তও কেবল তিনিই। মাখলুকের প্রশংসা করলে প্রকৃতপক্ষে তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলারই প্রশংসা হয়।
চ. আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ও সাহায্য ছাড়া কেউ কোনও গুনাহ থেকে বাঁচতে পারে না ও সৎকর্ম করতে পারে না। তাই এ বিষয়ে তাঁরই সাহায্য চাওয়া উচিত।
ছ. হাদীছে বর্ণিত যিকিরের বাক্যসমূহ সুস্থ-অসুস্থ সকলেরই বেশি বেশি পড়া উচিত। কেননা এর দ্বারা জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচার আশা করা যায়।
জ. বান্দার যিকির ও প্রশংসায় আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। তাই তিনি বান্দার প্রশংসাবাক্যের সমর্থন করেন এবং অনুরূপ কথা তিনি নিজেও বলেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
