আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৬- জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়

হাদীস নং: ২৮০১
আন্তর্জতিক নং: ৩০০৯

পরিচ্ছেদঃ ১৮৮৪. যার হাতে কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে, তার ফযীলত

২৮০১। কুতাইবা ইবনে সাঈদ (রাহঃ) .... সাহল (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) খায়বার যুদ্ধের দিন বলেন, আগামীকাল আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে পতাকা দিব, যার হাতে আল্লাহ তাআলা বিজয় দান করবেন। সে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে ভালবাসে, আর আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল (ﷺ) তাকে ভালবাসেন। লোকেরা সারা রাত এ চিন্তায় কাটিয়ে দেয় যে, কাকে এ পতাকা দেওয়া হয়? আর পরদিন সকালে প্রত্যেকেই তা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আলী কোথায়? বলা হল, তাঁর চোখে অসুখ। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর চোখে আপন মুখের লালা লাগিয়ে দিলেন এবং তাঁর জন্য দু‘আ করলেন। তাতে তিনি আরোগ্য লাভ করলেন। যেন আদৌ তাঁর চোখে কোন রোগই ছিল না।
তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর হাতে পতাকা দিলেন। আলী (রাযিঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, আমি তাদের সাথে ততক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যাব যতক্ষণ না তারা আমাদের মত হয়ে যায়। তিনি (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)) বললেন, ‘তুমি স্বাভাবিকভাবে অগ্রসর হয়ে তাদের আঙ্গিনায় অবতরণ কর। তারপর তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান কর এবং ইসলাম গ্রহণ করার পর তাদের জন্য যা অপরিহার্য তা তাদেরকে জানিয়ে দাও। আল্লাহর কসম! আল্লাহ তাআলা যদি তোমার মাধ্যমে এক ব্যক্তিকে হেদায়েত দান করেন, তবে তা তোমার জন্য লালবর্ণের উটের মালিক হওয়া অপেক্ষা উত্তম।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

এ হাদীছে খায়বার যুদ্ধে হযরত আলী রাযি.-এর বীরত্ব ও কৃতিত্বের প্রতি ইঙ্গিত আছে। হাদীছটি ভালোভাবে বুঝতে হলে খায়বার যুদ্ধ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা দরকার। তাই সংক্ষেপে এ যুদ্ধের কিছুটা বিবরণ পেশ করা যাচ্ছে। খায়বার যুদ্ধ খায়বার যুদ্ধ হয়েছিল হিজরী ৭ম সালের মুহাররাম মাসে। খায়বার মদীনা মুনাওয়ারা থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রায় দুইশ' মাইল দূরে অবস্থিত। এটি বড় বড় খেজুর বাগান-বিশিষ্ট ইয়াহুদী-অধ্যুষিত এক উর্বর ভূখণ্ড। বিস্তৃত খেজুর বাগানের একপাশে অনেকগুলো বড় বড় সুরক্ষিত দুর্গে তারা বাস করত। অঞ্চলটি শামের কাছাকাছি হওয়ায় বহুদিন থেকেই এখানে ইয়াহুদীদের বসবাস। পরবর্তীকালে মদীনা থেকে নির্বাসিত বনূ কাইনুকা' ও বনূ নাযীর নামক ইয়াহুদী গোত্রদু'টিও এখানে চলে আসে। এভাবে খায়বার ইসলামের বিরুদ্ধে ইয়াহুদীদের এক শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এর আগে খন্দকের যুদ্ধ খায়বারে ইয়াহুদীদের ষড়যন্ত্রের ফলেই সংঘটিত হয়েছিল। তারা বনূ গাতফানের মত একটি শক্তিশালী গোত্রকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে এক বৃহৎ শক্তিবলয়ের সৃষ্টি করেছিল। আশঙ্কা ছিল যে-কোনও সময়ই তারা বনূ গাতফানের সঙ্গে মিলিত হয়ে মদীনা মুনাওয়ারার ওপর এক প্রচণ্ড হামলা চালাবে। তাদের পক্ষ থেকে এর জোর প্রস্তুতিও চলছিল। তা জানতে পেরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। পরিশেষে হিজরী ৭ম সালের মুহাররাম মাসে হযরত সিবা' ইব্ন 'উরফুতা গিফারী রাযি.-কে মদীনা মুনাওয়ারায় নিজ স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে তিনি খায়বার অভিমুখে যাত্রা করেন। সিদ্ধান্ত ছিল যারা হুদায়বিয়ার অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন কেবল তারাই খায়বার যুদ্ধে যোগদান করতে পারবে। সুতরাং তিনি হুদায়বিয়ায় অংশগ্রহণকারী চৌদ্দশ' সাহাবীকে নিয়েই যাত্রা শুরু করলেন। তাদের মধ্যে দুইশ' ছিল অশ্বারোহী, বাকি সকলে উষ্ট্রারোহী বা পদাতিক। উম্মুল মু'মিনীন হযরত উম্মু সালামা রাযি.-ও সঙ্গে ছিলেন। মুসলিম সৈন্যগণ আসরের নামাযকালে খায়বারের নিকটবর্তী ‘সাবা' নামক স্থানে পদার্পণ করেন। তারা সেখানে আসরের নামায আদায় করলেন। তারপর আরও খানিকটা এগিয়ে গেলেন। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও রাত্রিকালে শত্রুদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালাতেন না। কাজেই সেখানেই তারা রাতযাপন করলেন। তারপর ফজরের নামায আদায় করে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হলেন। খায়বারের ইয়াহুদীগণ ছিল কৃষিজীবি। তারা কাস্তে-কোদাল নিয়ে যখন কৃষিকাজের জন্য মাঠের দিকে বের হয়ে আসল, তখন হঠাৎ করেই মুসলিম বাহিনীকে দেখতে পেল এবং ভীত-বিহ্বল হয়ে চিৎকার করে উঠল, এই যে মুহাম্মাদ! আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ তার গোটা বাহিনীসহ এসে গেছে। এই বলে তারা নিজেদের দুর্গের দিকে ছুটে পালাল। খায়বার উপত্যকায় ইয়াহুদীদের ১২টি দুর্গ ছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের গোটা এলাকা অবরোধ করে ফেললেন। তারপর একের পর এক দুর্গে হামলা চালাতে থাকেন। সর্বপ্রথম নাঈম দুর্গটি বিজিত হয়। তারপর বিজিত হয় আল-কামূস দুর্গ। এ দুর্গটি ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও সুরক্ষিত। প্রথমদিকে এটি কিছুতেই জয় করা যাচ্ছিল না। সবশেষে হযরত 'আলী রাযি-কে দায়িত্ব প্রদান করা হয়, যা আলোচ্য হাদীছটিতে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর হাতে আল্লাহ তা'আলা বিজয় দান করেন। এ দুর্গটি বিজিত হওয়ার পর অবশিষ্ট দুর্গগুলো সহজেই বিজিত হয়ে যায় । খায়বারের সমগ্র উপত্যকা দখলে এসে যাওয়ার পর ইয়াহুদীরা কোনও উপায়ন্তর না দেখে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন করল যে, তাদেরকে যদি এখানে থাকতে দেওয়া হয় তাহলে চাষাবাদ করে যে ফসল পাওয়া যাবে তার অর্ধেক রাজস্ব হিসেবে প্রদান করবে। তিনি তাদের এ আবেদন মঞ্জুর করেন। তবে শর্তারোপ করেন যে, আমরা যে-কোনও সময় চাইলে তোমাদেরকে খায়বার উপত্যকা ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। তারা তাতে রাজি হয়ে যায়। সেমতে হযরত উমর রাযি. নিজ খেলাফতকালে যখন তাদের শান্তি-শৃঙ্খলাবিরোধী তৎপরতা লক্ষ করলেন, তখন তাদেরকে খায়বার থেকে সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করেন। এ যুদ্ধে ১৯ জন সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। শত্রুপক্ষে নিহত হয়েছিল ৯৩ জন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাইলে ইয়াহুদী ধর্মের বিধান অনুযায়ী সকল ইয়াহুদী পুরুষকে হত্যা এবং তাদের নারী ও শিশুকে দাসে পরিণত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন রহমাতুল লিল-'আলামীন। তিনি তাদের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে দয়ার আচরণ করলেন। তাদেরকে তাদের আবাসভূমিতেই বসবাসের অনুমতি দিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি হযরত আলী রাযি.-এর ভালোবাসা এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম পতাকাদান প্রসঙ্গে বলেছেন যে, তিনি সেটি এমন এক ব্যক্তিকে দেবেন, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাকে ভালোবাসেন। পতাকাটি যখন হযরত আলী রাযি.-কে দেওয়া হল তখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ কথাটি তাঁর জন্যই বলা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি মুসলিমই নিজ অন্তরে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালোবাসা লালন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কিরামের স্থান সকলের ওপর। তাদের আল্লাহপ্রেম ও ইশকে রাসূলের কোনও তুলনা মানবেতিহাসে পাওয়া যাবে না। তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসতেন নিজ পিতামাতা ও সন্তান-সন্ততির চেয়েও বেশি, এমনকি বেশি নিজ প্রাণের চে’ও। প্রশ্ন হচ্ছে, সব সাহাবীরই নবীপ্রেম যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল, তখন হযরত আলী রাযি.-এর কী বিশেষত্ব ছিল, যে কারণে তাঁর ব্যাপারে আলাদা সনদ দেওয়া হল? এর উত্তরে প্রথম কথা হচ্ছে, তাঁর সম্পর্কে ইশ্ক ও মহব্বতের এ সনদ দেওয়ার দ্বারা অন্যান্য সাহাবীগণের ইশ্ক ও মহব্বতকে খাটো করে দেখানো উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং বিষয়টাকে তুলনামূলকভাবে দেখে এরূপ অর্থ নেওয়া সমীচীন হবে না যে, অন্যান্য সাহাবীদের তুলনায় তাঁর নবীপ্রেম বেশি ছিল বা তাঁর তুলনায় অন্যদের কম ছিল। বস্তুত এ ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেকেই আপন আপন স্থানে ছিলেন অনন্য। হাঁ, কুদরতীভাবেই হযরত আলী রাযি.-এর কিছু আলাদা বিশেষত্ব অর্জিত ছিল। এক তো তিনি ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচাতো ভাই। শৈশব থেকেই তিনি তাঁর পেছনে ছায়ার মত লেগে থেকেছেন। ইসলাম গ্রহণ করেছেন শৈশবেই। তিনি ছিলেন তাঁর সর্বকনিষ্ঠা ও সবশেষে বেঁচে থাকা কন্যার জামাতা। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য কতটা অকাতরে প্রাণ দিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারেন, হিজরতের রাতে তার প্রমাণ দিয়েছেন। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগের পর তাঁর শূন্য বিছানায় তিনি শুয়ে থেকেছেন। এ তো কেবল শুয়ে থাকা নয়, জান দিয়ে দেওয়া। কেননা এ আশঙ্কা তো প্রবলভাবেই ছিল যে, কাফেরগণ একযোগে হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে ফেলবেন। তাদের তো জানা নেই যে, তিনি 'আলী রাযি। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানায় তিনি নিজেই শুয়ে থাকবেন এই তো স্বাভাবিক। কাজেই খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুয়ে আছেন মনে করে যদি তারা হযরত ‘আলী রাযি.-কে হত্যা করে ফেলত, তবে তা মোটেই অস্বাভাবিক হত না। আর এভাবে যে তাঁর জান চলে যেতে পারে সে ধারণা হযরত আলী রাযি.-এর নিজেরও না থাকার কোনও কারণ ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি সেখানে শুয়ে থেকেছেন। নিঃসন্দেহে এটা নবীপ্রেমের এক অসাধারণ নিদর্শন। তিনি নবীপ্রেমের নিদর্শন রেখেছেন আপন খেলাফতকালেও। নবীপ্রেমের দাবি হচ্ছে সর্বাবস্থায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের অনুসরণকে অন্য সবকিছুর ওপর প্রাধান্য দেওয়া এবং তাঁর রেখে যাওয়া দীনের হেফাজত ও প্রতিষ্ঠায় সর্বশক্তি ব্যয় করা। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে হযরত আলী রাযি.-এর স্থান অনেক উপরে এবং সর্বশ্রেষ্ঠদের মধ্যে। নিজ খেলাফত আমলে তিনি ছিলেন নবীপ্রেম ও সুন্নত অনুসরণের শ্রেষ্ঠতম নমুনা। দীন ও সুন্নতের হেফাজতকল্পে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। শেষপর্যন্ত তো এ কারণে খারিজী সম্প্রদায়ের হাতে তাঁকে শাহাদাতও বরণ করতে হয়েছে। এ সকল বিশেষত্বের কারণে তাঁর পক্ষে আল্লাহ ও নবীপ্রেম এবং তাঁর প্রতি আল্লাহ তা'আলা ও প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহকর্তৃক বান্দাকে ভালোবাসার অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক আমল করা ও তাঁর অভিমুখী হয়ে চলার তাওফীক দান করা। আর বান্দাকর্তৃক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসার অর্থ হচ্ছে তাঁদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। সাহাবায়ে কিরামের আল্লাহ ও রাসূলপ্রেমের নমুনা এ হাদীছে বলা হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন উপরে বর্ণিত সনদের সাথে কোনও একজনকে পতাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন, তখন প্রত্যেক সাহাবীই সে পতাকা পাওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠলেন। তারা সারারাত কাটালেন এই চিন্তা-ভাবনা ও আলাপ-আলোচনার ভেতর যে, না-জানি সে ভাগ্যবান কে! পরদিন প্রত্যেকে এই আগ্রহ নিয়েই হাজির হলেন যে, পতাকাটি যদি তার হাতে অর্পণ করা হয়। পতাকা পাওয়ার জন্য কেন তাদের এ উদ্দীপনা? নিঃসন্দেহে এটা কেবলই আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসার কারণে। তাদের অন্তরে এ ভালোবাসা ছিল পরিপূর্ণ মাত্রায়। এর সঙ্গে যদি সে ভালোবাসার সনদও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে পাওয়া যায়, তা কতই না সৌভাগ্যের ব্যাপার! আরও পরম সৌভাগ্য এই যে, এ পবিত্র মন্তব্যে এ কথাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাকে ভালোবাসেন। বান্দার পক্ষ থেকে মহব্বতের উদ্দেশ্য তো কেবল তাঁদের পক্ষ থেকে মহব্বত পেয়ে যাওয়া ও তাঁদের মাহবূব বনে যাওয়া। মানবজীবনে এরচে' বড় প্রাপ্তি আর কিছুই হতে পারে না যে, নবীর মুখ থেকে কারও সম্পর্কে এই সুসংবাদ শুনিয়ে দেওয়া হবে যে, আল্লাহ ও আল্লাহর নবী তাকে ভালোবাসেন। তাঁর পবিত্র মুখ থেকে এ সুসংবাদ পাওয়ার জন্য কার না মন ব্যাকুল হতে পারে? আর তারা তো মহান সাহাবী। তাদের মনপ্রাণ এ জন্য কতটা যে উদ্‌গ্রীব হতে পারে তা আমাদের পক্ষে অনুমান করাও কঠিন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু আমাদেরকে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফীক দান করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি মু'জিযা হযরত আলী রাযি. ‘চোখ ওঠা' রোগে ভুগছিলেন। এ কারণে তিনি মজলিসে হাজির হতে পারেননি। তাঁকে না দেখে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, সে কোথায়? বলা হল, তাঁর 'চোখ ওঠা' রোগ হয়েছে। তিনি লোক পাঠিয়ে তাঁকে ডেকে আনলেন। তারপর তাঁর চোখে নিজ থুথু লাগিয়ে দিলেন। তাঁর চোখ ভালো হয়ে গেল। এটা ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মু'জিযা বা অলৌকিক ঘটনা। তাঁর এরকম বহু অলৌকিক ঘটনা আছে। সব নবীরই ছিল। আল্লাহ তা'আলা নিজ ইচ্ছায় তাঁদের দ্বারা এরকম ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য তাঁদের নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করা। কুরআন মাজীদে বহু নবীর এ জাতীয় ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং মু'জিযার সত্যতা বিশ্বাস করা জরুরি। বিশ্বাস না করা কুফরী। রোগ-ব্যাধি মূলত আল্লাহ তাআলাই দেন। আরোগ্যও তিনিই দিয়ে থাকেন। ঔষধ পথ্য ইত্যাদি পার্থিব উপকরণ। এসব উপকরণ অবলম্বন করলে আল্লাহ তা'আলা নিজ ইচ্ছায় তার ক্রিয়া ঘটান। মু'জিযায়ও কোনও না কোনও উপকরণ থাকে। তবে তা স্বাভাবিক উপকরণ নয়, অস্বাভাবিক। থুথু লাগানোর দ্বারা চোখ ভালো হওয়া স্বাভাবিক নয়। সেজন্যই এটা মু'জিযা। জিহাদের আগে দা'ওয়াত যুদ্ধে যাত্রাকালে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী রাযি. কে উপদেশ দিলেন, তাদেরকে আগে ইসলামের দা'ওয়াত দেবে এবং তাদেরকে জানাবে ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের ওপর আল্লাহ তা'আলার এমন কী কী হক আরোপিত হয়, যা আদায় করা তাদের অবশ্যকর্তব্য। যেমন নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি। এর দ্বারা বোঝা গেল যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে, আগে তাদের কাছে ইসলামের দা'ওয়াত পৌঁছা চাই। যাদের কাছে ইসলামের দা'ওয়াত পৌঁছেনি তাদের সঙ্গে শুরুতেই যুদ্ধ করা যাবে না। যাদের কাছে আগে দা'ওয়াত পৌঁছে গেছে, যুদ্ধ শুরু করার সময় তাদেরকে প্রথমে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেওয়া জরুরি নয়, তবে দা'ওয়াত দেওয়া উত্তম। সে হিসেবেই হযরত আলী রাযি.-কে হুকুম দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে যেন আগে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়। ইয়াহুদীদের কাছে ইসলামের দা'ওয়াত আগেই পৌছে গিয়েছিল। সে হিসেবে এ ক্ষেত্রে তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া জরুরি ছিল না। তা সত্ত্বেও এ হুকুম দেওয়া হয়েছে উত্তম হিসেবে। জিহাদের উদ্দেশ্য নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী রাযি.-কে বলেছিলেন, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তোমার মাধ্যমে কোনও এক ব্যক্তিকে হিদায়াত দান করলে তা তোমার জন্য একদল লাল উট অপেক্ষাও উত্তম। তুলনাটা লাল উটের সঙ্গে করা হয়েছে এ কারণে যে, আরবদের কাছে লাল উটই ছিল সর্বাপেক্ষা দামী সম্পদ। এমনিতে তো আখিরাতের নি'আমতের বিপরীতে দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা দামী সম্পদও কোনও তুলনায় আসে না। অনন্ত আখিরাতের সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র নি'আমতও দুনিয়া এবং দুনিয়ার মধ্যে যা-কিছু আছে তারচে' শতকোটি গুণ শ্রেয়। তা সত্ত্বেও এ তুলনা করা হয়েছে কেবল আখিরাতের নি'আমতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়ার জন্য। কেননা কোনও বিষয় যদি তুলনা ও উদাহরণ দ্বারা বোঝানো হয়, তবে শ্রোতার কাছে তা বেশি স্পষ্ট হয়। যাহোক, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, তোমার মাধ্যমে যদি একজন লোকও হিদায়াত পায় তবে তোমার জন্য তা এক পাল লাল উট অপেক্ষাও শ্রেয়। এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে, ইসলামে জিহাদের উদ্দেশ্য মানবহত্যা নয়; বরং মানুষকে অনন্ত জীবন দেওয়া। মানুষ মরণশীল। মরতে তাকে হয়ই। কিন্তু সে যদি হিদায়াত কবূল করে, তবে মৃত্যুর পর জান্নাতে যে জীবন পাবে তা অনন্ত সুখ-শান্তির জীবন । সে জীবনে কোনও মৃত্যু নেই। ইসলামী জিহাদের উদ্দেশ্য মানুষকে সেই জীবনের দিকে পরিচালিত করা। অনেকে ইসলামী জিহাদকে দুনিয়ার সাধারণ যুদ্ধ-বিগ্রহের মত মনে করে। এটা নিতান্তই ভুল। সাধারণ যুদ্ধ-বিগ্রহের পেছনে কোনও মহৎ উদ্দেশ্য থাকে না। মানবেতিহাসে এ যাবৎকাল কত যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছে। কিন্তু তার অধিকাংশই হয়েছে কেবলই রাজ্য বিস্তার বা বংশীয় গৌরব প্রতিষ্ঠা কিংবা ব্যক্তির শৌর্য-বীর্য প্রদর্শনের জন্য। যে যুদ্ধের পেছনে নবুওয়াতী শিক্ষার প্রেরণা নেই, তা এরকম আদর্শবহির্ভূত রক্তক্ষয়ই হয়ে থাকে। ইসলামী জিহাদ মোটেই সেরকম নয়। তাই এতে সর্বাত্মক চেষ্টা থাকে লড়াই এড়ানোর। প্রথমে ইসলাম গ্রহণের দা'ওয়াত দেওয়া হয়। মানুষের সামনে ইসলামের সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা হয়। তা সত্ত্বেও যদি তারা ইসলাম গ্রহণে সম্মত না হয়, তবে ইসলামের সত্য ও সৌন্দর্যের সামনে নতিস্বীকারের নিদর্শনস্বরূপ জিযিয়া দিতে বলা হয় আর এভাবে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সবশেষে যুদ্ধ। তাতেও জয়লাভের পর প্রতিপক্ষের ওপর দমন-নিপীড়ন চালানো নয়; বরং তারা যাতে ইসলামের অমূল্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা ও মানবিক মূল্যবোধের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায় – সে পথ খোলা রাখা হয়েছে। সুতরাং ইসলামী জিহাদ মানবকল্যাণের শ্রেষ্ঠতম এক ব্যবস্থা। প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রের কর্তব্য এ ব্যবস্থাটি পুনর্জীবিত করে বিশ্বের বঞ্চিত মানবতাকে এর কল্যাণধারায় সিঞ্চিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. এ হাদীছ দ্বারা আল্লাহর ‘ইশ্ক ও নবীপ্রেমের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় । খ. সাহাবায়ে কিরাম আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গের জন্য কেমন ব্যাকুল ছিলেন, এ হাদীছ দ্বারা সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এর থেকে আমাদেরও প্রেরণা নেওয়া উচিত। গ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, নবীদের মু'জিযা সত্য। ঘ. এর দ্বারা এটাও জানা যায় যে, ইসলামী জিহাদের উদ্দেশ্য রাজ্যবিস্তার নয়; বরং মানুষের হিদায়াত। ঙ. এ হাদীছ দ্বারা আরও জানা যায় মানুষকে হিদায়াতের দা'ওয়াত দেওয়া কত বড় ফযীলতের কাজ।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন