কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ

১৫. দান-সাদ্‌কা সম্পর্কিত

হাদীস নং: ২৪১৭
আন্তর্জাতিক নং: ২৪১৭
অস্বচ্ছল ব্যক্তিকে (দেনা পরিশোধে) সময় দেওয়া
২৪১৭। আবু বকর ইবন আবু শায়রা (রাহঃ) .... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি গরীবের ওপর আসান করবে, আল্লাহ দুনিয়াতে ও আখিরাতে তার ওপর আসান করবেন।
بَاب إِنْظَارِ الْمُعْسِرِ
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ، عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ مَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللَّهُ عَلَيْهِ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ ‏"‏ ‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

অভাবগ্রস্তের অভাবের কষ্ট লাঘব করার ফযীলত
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সৎকর্মরূপে অভাবগ্রস্তের সাহায্য করার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ- ومن يسر على معسر (যে ব্যক্তি কোনও অভাবগ্রস্তের অর্থকষ্ট লাঘব করে দেয়)। معسر এর অর্থ অভাবগ্রস্ত। শব্দটির উৎপত্তি عسر থেকে। এর অর্থ কষ্ট। অর্থাভাব দ্বারা মানুষের নানারকম কষ্ট হয়ে থাকে। তাই অভাবগ্রস্তের নামই দেওয়া হয়েছে معسر ।
অভাবগ্রস্তের কষ্ট লাঘব করা যায় বিভিন্নভাবে। সে যদি কারও কাছে ঋণগ্রস্ত হয় আর সে তার ঋণ মওকুফ করে দেয়, তাতে তার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। ঋণশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি দ্বারাও আসানী লাভ হয়। পাওনাদারের কাছে নিজে গিয়ে বা লোক পাঠিয়ে পাওনা মওকুফ করা বা পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ দ্বারাও কষ্ট লাঘবে সহযোগিতা করা হয়। যদি সরাসরি আর্থিক সহযোগিতা করা হয়, সে তো অনেক ভালো। এর প্রত্যেকটিই অনেক বড় ফযীলতের কাজ।
এ হাদীছে এর ফযীলত জানানো হয়েছে এই যে يسر الله عليه فى الدنيا والا خرة (আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার কষ্ট লাঘব করে দেবেন)। দুনিয়ায় কষ্ট লাঘব হতে পারে অর্থসংকট দূর করার দ্বারা, বিপদাপদ থেকে রক্ষা করার দ্বারা, বিভিন্ন রকম নেককাজের তাওফীক দ্বারা ইত্যাদি। আর আখেরাতের কষ্ট লাঘব হতে পারে হিসাব নিকাশ সহজ করার দ্বারা, গুনাহের শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার দ্বারা, হাশরের ময়দানের বিভীষিকায় নিরাপত্তাদান দ্বারা ইত্যাদি।
দুনিয়ায় মানুষের যত দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, তার মধ্যে অভাব-অনটনের কষ্টই সবচে' বড়। তাই কারও এ কষ্ট লাঘবের পুরস্কারকে আল্লাহ তাআলা কেবল পরকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ইহকাল-পরকাল উভয় জগতেই ব্যাপক করে দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! এটা আল্লাহ তাআলার কত বড়ই না মেহেরবানী! একজনের অর্থকষ্ট দূর করার দ্বারা তাঁর অনুগ্রহে দুনিয়ারও ফায়দা হাসিল হয় এবং আখেরাতেরও।
দুনিয়ায় মানুষ তার বিভিন্ন রকম কষ্ট-ক্লেশ থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে নানা উপায় অবলম্বন করে থাকে। এ হাদীছ দ্বারা আমরা জানতে পারলাম অন্যের অর্থকষ্ট লাঘবে সহযোগিতা করাও কষ্ট-ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভের একটি উপায়। আবার এর দ্বারা আখেরাতের কষ্ট থেকেও আল্লাহ তাআলা মুক্তি দান করেন, যা কিনা প্রত্যেক মুমিনের পরম কাম্য।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ জাতীয় কাজ নিজেও অনেক করেছেন এবং বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা আমাদেরকেও করতে উৎসাহ দিয়েছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণনা করেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক পাওনাদার ও দেনাদারের বাদানুবাদ শুনতে পান। তারা উঁচু আওয়াজে কথা কাটাকাটি করছিল। একজন অন্যজনকে অনুরোধ করছিল যেন পাওনার অঙ্ক থেকে কিছুটা কমিয়ে দেয় এবং তার প্রতি একটু সদয় হয়। অন্যজন আল্লাহর নামে কসম করে বলছিল, কিছুতেই তা করব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন أين المتألي على الله، لا يفعل المعروف؟ فقال: أنا يا رسول الله، وله أي ذلك أحب 'কই সে, যে সদয় আচরণ করবে না বলে আল্লাহর নামে কসম করছে? এ কথা শুনে সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি। সে যা চায় তাই হবে।১৯০
এক হাদীছে ইরশাদ من سره أن ينجيه الله من كرب يوم القيامة، فلينفس عن معسر أو يضع عنه “যে ব্যক্তি কামনা করে আল্লাহ তাআলা যেন কিয়ামত দিবসের কষ্ট থেকে তাকে নাজাত দান করেন, সে যেন অভাবগ্রস্তকে সুযোগ দান করে অথবা তার দেনা মওকুফ করে দেয়।১৯১
এ হাদীছটি হযরত আবূ কাতাদা রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি এক ব্যক্তির কাছে কিছু টাকা পেতেন। সে ছিল গরীব। টাকা দিতে না পেরে তাঁকে দেখে পালাত। একবার হযরত আবূ কাতাদা রাযি. তাকে গিয়ে ধরলেন। সে তার অর্থসংকটের কথা জানাল। তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে এ হাদীছটি বর্ণনা করলেন এবং তার দেনা মওকুফ করে দিলেন।
অন্য এক হাদীছে ইরশাদ من أنظر معسرا أو وضع عنه، أظله الله في ظله 'যে ব্যক্তি কোনও অভাবগ্রস্তকে অবকাশ দেয় বা তার দেনা মওকুফ করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে (হাশরের ময়দানে) নিজ (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন।১৯২
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন كان رجل يداين الناس، فكان يقول لفتاه إذا أتيت معسرا فتجاوز عنه، لعل الله يتجاوز عنا، فلقي الله فتجاوز عنه ‘জনৈক (ব্যবসায়ী) ব্যক্তি মানুষের কাছে বাকিতে মাল বিক্রি করত। সে তার কর্মচারীকে বলত, কোনও অভাবগ্রস্তের কাছে মাল বিক্রি করলে তাকে ছাড় দিও, হয়তো এ অসিলায় আল্লাহ আমাদেরকেও ছাড় দেবেন। অতঃপর সে আল্লাহর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাকে এ কারণে মুক্তি দিয়ে দেন।১৯৩
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তাআলা তাকে সে দুনিয়ায় কী কী নেক আমল করেছে তা জিজ্ঞেস করলে কোনও উত্তর দিতে পারছিল না। বারংবার জিজ্ঞাসার পর পরিশেষে তার গরীব ভোক্তাকে ছাড় দেওয়ার কথাটি মনে পড়ল। সে এ কথাটি আল্লাহ তাআলাকে জানালে আল্লাহ তাআলা বললেন, হে বান্দা! তুমি গরীবকে ছাড় দিতে! ছাড় দেওয়ার বিষয়টা তো আমাকেই বেশি সাজে। সুতরাং তিনি তাকে আযাব না দিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে দিলেন।
গরীব-দুঃখীর কষ্ট লাঘবে সহায়তা করাটা দুআ কবুলের পক্ষেও সহায়ক। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন من أراد أن تستجاب دعوته، وأن تكشف كربته، فليفرج عن معسر “যে ব্যক্তি কামনা করে তার দুআ কবুল হোক এবং তার পেরেশানি দূর হোক, সে যেন অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনের চেষ্টা করে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দুনিয়া ও আখেরাতের সংকট থেকে উত্তরণের একটি উপায় মানুষের অর্থসংকট দূর করার চেষ্টা। সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেকেরই এ চেষ্টা করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
সুনানে ইবনে মাজা - হাদীস নং ২৪১৭ | মুসলিম বাংলা