কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ

১৫. দান-সাদ্‌কা সম্পর্কিত

হাদীস নং: ২৪১৩
আন্তর্জাতিক নং: ২৪১৩
ঋণের ব্যাপারে কঠোরতা করা প্রসঙ্গে
২৪১৩। আবু মারওয়ান 'উছমানী (রাহঃ) ….. আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বরেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ মুমিনের রুহ তার ঋণের কারণে ততক্ষণ পর্যন্ত ঝুলে থাকে, যতক্ষণ না তা পরিশোধ করা হয়।
بَاب التَّشْدِيدِ فِي الدَّيْنِ
حَدَّثَنَا أَبُو مَرْوَانَ الْعُثْمَانِيُّ، حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ سَعْدٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عُمَرَ بْنِ أَبِي سَلَمَةَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ نَفْسُ الْمُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهِ حَتَّى يُقْضَى عَنْهُ ‏"‏ ‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটি দ্বারা দেনা পরিশোধের গুরুত্ব এবং দেনা রেখে মারা যাওয়ার ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যায়। বলা হয়েছে, মুমিনের আত্মা তার দেনার সঙ্গে ঝুলন্ত থাকে। অর্থাৎ মুমিনের আত্মা দেনার দায়ে আটক থাকে। তার বিষয়টি স্থগিত থাকে। তার সম্পর্কে নাজাত বা শাস্তির কোনও ফয়সালা নেওয়া হয় না। ফলে সে তার মর্যাদাপূর্ণ ঠিকানায় পৌছতে পারে না। এটা তার কষ্টের কারণ। তার মর্যাদাপূর্ণ স্থানে পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় সে কষ্ট পায়। জান্নাতের নি'আমত পেতে দেরি হওয়ায় এবং সেখানকার আনন্দ উপভোগ থেকে সাময়িক কালের জন্য বঞ্চিত থাকায় সে ব্যথিত হয়। এভাবে সে দুঃখ ও কষ্ট পেতে থাকে, যাবৎ না তার দেনা পরিশোধ করা হয়।

হাদীছটি দ্বারা যেমন দেনাদারকে তার দেনা পরিশোধে তাগাদা দেওয়া হয়েছে এবং পরিশোধ না করে মারা গেলে বিপদে পড়ার ভয় দেখানো হয়েছে, তেমনি তার ওয়ারিছকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যেন তারা তার পক্ষ থেকে যথাশীঘ্র দেনা পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

প্রকাশ থাকে যে, দেনাদার বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এক তো হল এমন দেনাদার, যে দেনা বা ঋণ গ্রহণের সময়ই তা পরিশোধ করার পাকা নিয়ত রাখে না। এরূপ ব্যক্তি যদি পরে নিজেকে সংশোধন করে নেয় এবং দেনা পরিশোধ করে ফেলে, তবে সে দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে সে যদি দেনা রেখেই মারা যায়, তবে মৃত্যুর পর দেনার দায়ে সে আটকা পড়ে যাবে, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে। আরেক হল এমন দেনাদার, যে দেনা পরিশোধের নিয়ত রাখে বটে, কিন্তু সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিশোধে টালবাহানা করে। সময়মতো তা পরিশোধ করে না। পরে সে যদি দেনা পরিশোধ করে দেয়, তবে দায় থেকে মুক্ত হবে বটে, কিন্তু টালবাহানা করার কারণে গুনাহগার হবে। এর জন্য তার কর্তব্য পাওনাদারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। তৃতীয় হল এমন দেনাদার, যে পরিশোধের পরিপক্ক নিয়তের সঙ্গে দেনা গ্রহণ করে। কিন্তু সামর্থ্যের অভাবে সে তা সময়মতো পরিশোধ করতে পারে না। চতুর্থ হল এমন দেনাদার, যার দেনা পরিশোধের সামর্থ্য আছে এবং সময়মতো তা পরিশোধও করে।

দেনা পরিশোধের নিয়ত যার থাকে, কিন্তু সামর্থ্যের অভাবে তা পরিশোধ করতে পারে না আর এ অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়ে যায়, এরূপ ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার কাছে ক্ষমার উপযুক্ত। আল্লাহ তা'আলা নিজ দয়ায় তাকে তার দেনা থেকে মুক্তিলাভের কোনও ব্যবস্থা করে দেবেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أَخَذَ أَمْوَالَ النَّاسِ يُرِيدُ أَدَاءَهَا أَدّى اللَّهُ عَنْهُ، وَمَنْ أَخَذَ يُرِيدُ إِتلَافَهَا أَتْلَفَهُ اللَّهُ
'যে ব্যক্তি পরিশোধ করার নিয়তে মানুষের অর্থ-সম্পদ গ্রহণ করে, আল্লাহ তা'আলা তার পক্ষ থেকে তা আদায় করে দেন। আর যে ব্যক্তি তা ধ্বংস করার নিয়তে গ্রহণ করে, আল্লাহ তা'আলা তাকে ধ্বংস করেন। (সহীহ বুখারী: ২৩৮৭; মুসনাদে আহমাদ: ৮৭১৯; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৪১১; মুসনাদুল বাযযার: ৮১৫৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১০৯৫৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২১৪৭)

হযরত আবু উমামা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ تَدَايَنَ بِدَيْنٍ، وَفِي نَفْسِهِ وَفَاؤُهُ، ثُمَّ مَاتَ، تَجَاوَزَ اللَّهُ عَنْهُ، وَأَرْضَى غَرِيمَهُ بِمَا شَاءَ، وَمَنْ تَدَايَنَ بِدَيْنٍ وَلَيْسَ فِي نَفْسِهِ وَفَاؤُهُ، ثُمَّ مَاتَ، اقْتَصَّ اللَّهُ لِغَرِيمِهِ عَنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
'যে ব্যক্তি কোনও ঋণ গ্রহণ করে আর তার মনে তা পরিশোধের নিয়ত থাকে, তারপর (পরিশোধ করতে না পারা অবস্থায়) সে মারা যায়, আল্লাহ তা'আলা তাকে ক্ষমা করবেন এবং তার পাওনাদারকে খুশি করে দেবেন সে যা চায় তার বিনিময়ে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কোনও ঋণ গ্রহণ করে অথচ তার মনে তা পরিশোধের নিয়ত থাকে না আর এ অবস্থায় সে মারা যায়, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার থেকে তা উসুল করে তার পাওনাদারকে প্রদান করবেন। (তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৭৯৩৭; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ২২০৬)

উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَدَّانُ دَيْنا ، يَعْلَمُ اللهُ مِنْهُ أَنَّهُ يُرِيدُ أَدَاءَهُ، إِلَّا أَدّاهُ اللَّهُ عَنْهُ فِي الدُّنْيَا
'কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি এমন কোনও ঋণ গ্রহণ করে, যে সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলার জানা আছে যে সে তা পরিশোধ করার ইচ্ছা রাখে, তবে আল্লাহ তা'আলা তার পক্ষ থেকে তা দুনিয়ায়ই আদায় করে দেন’। (সুনানে ইবন মাজাহ: ২৪০৮; সহীহ ইবনে হিব্বান ৫০৪১; মুসনাদে আহমাদ: ২৬৮১৬: নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৬২৩১)

এসব হাদীছ দ্বারা বোঝা যায়, ঋণগ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই তা আদায় করার নিয়ত থাকতে হবে। আদায় করার নিয়ত থাকলে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে সাহায্য লাভ হয়। পক্ষান্তরে যদি নিয়ত মন্দ হয়, আদায় করার ইচ্ছা না থাকে, তবে এর পরিণাম বড় কঠিন। এর জন্য আখিরাতে আটকা পড়তে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তার ওয়ারিছগণ তা পরিশোধ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে আটক করে রাখা হবে। ওয়ারিছগণ পরিশোধ না করলে তার নেকী কেটে পাওনাদারদের দেওয়া হবে। তাতেও দেনা পুরোপুরি পরিশোধ না হলে পাওনাদারদের পাপ তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। বিভিন্ন হাদীছে এরূপ উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ঋণের বিষয়ে আমাদের খুবই সাবধান হতে হবে।

আলোচ্য হাদীছটিতে বলা হয়েছে, দেনা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত মুমিন ব্যক্তির আত্মা আটকে রাখা হয়। কাজেই কোনও ঋণগ্রস্ত মুমিনের মৃত্যু হলে প্রথম কাজ হওয়া উচিত তার ঋণ পরিশোধ করা। সে কোনও সম্পদ রেখে গেলে তা দ্বারা পরিশোধ করা হবে। তার কোনও সম্পদ না থাকলে ওয়ারিছগণ কামাই-রোজগার করে তা পরিশোধের ব্যবস্থা নেবে। তাদের পক্ষে যদি তা সম্ভব না হয় কিংবা মায়্যিতের কোনও ওয়ারিছই না থাকে, তবে সরকারের দায়িত্ব তার সে ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَمَنْ تَرَكَ دَيْنا أَوْ ضَياعًا، فَلْيَأْتِنِي فَأَنَا مَوْلَاهُ
'যে ব্যক্তি দেনা রেখে যায় কিংবা অভাবগ্রস্ত পরিবার রেখে যায়, তার বিষয়ে লোকে আমার কাছে আসুক। কেননা আমিই তার অভিভাবক’। (সহীহ বুখারী: ২৩৯৯; সহীহ মুসলিম: ৮৮৬৭; সুনানে নাসাঈ: ১৫৭৮; সুনানে আবূ দাঊদ: ২৯৫৪; সুনানে ইবন মাজাহ; ৪৪: সুনানে দারিমী ২৬৩৬; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১৫২৬২; সহীহ ইবনে খুযায়মা; ১৭৮৫; সহীহ ইবনে হিব্বান ৩০৬২; সুনানে দারা কুতনী: ৪১১৬)

অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ تَرَكَ مَالًا فَلِوَرَثَتِهِ، وَمَنْ تَرَكَ دَيْنا فَعَلَيَّ، وَعَلَى الْوُلَاةِ مِنْ بَعْدِي، مِنْ بَيْتِ مَالِ الْمُسْلِمِينَ
'যে ব্যক্তি সম্পদ রেখে যায়, তার সম্পদ তার ওয়ারিছদের। আর যে ব্যক্তি দেনা রেখে যায়, তার সে দেনা আমার দায়িত্বে এবং আমার পর শাসকদের দায়িত্বে। মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তা আদায় করা হবে’। (তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৬১০৩)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দেনার বিষয়টি খুব কঠিন। বিশেষ প্রয়োজন না হলে দেনাগ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত।

খ. ঋণ বা দেনা গ্রহণকালে অবশ্যই তা পরিশোধের নিয়ত রাখতে হবে।

গ. কেউ দেনা রেখে মারা গেলে তার ওয়ারিছদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা পরিশোধ করতে হবে।

ঘ. ওয়ারিছ না থাকলে বা ওয়ারিছদের সামর্থ্য না থাকলে তার ঋণ পরিশোধ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান