কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ

৬. জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৬৩৫
আন্তর্জাতিক নং: ১৬৩৫
নবী (ﷺ)-এর ওফাত ও তাঁর দাফন প্রসঙ্গে
১৬৩৫। হাসান ইব্‌ন 'আলী খাল্লাল (রাহঃ)....... আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতের পর আবু বকর (রাযিঃ) 'উমর (রাযিঃ) কে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেমন উন্মু আয়মনের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, চলুন তেমন আমরাও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি বলেনঃ আমরা যখন তাঁর কাছে পৌঁছলাম, তখন তিনি কেঁদে উঠলেন।

তারা দু'জন তাকে বললেনঃ আপনি কেন কাঁদছেন? আল্লাহর নিকট যা আছে, তা তাঁর রাসূলের জন্য কল্যাণকর। তিনি বললেনঃ আমি অবশ্যই জানি যে, আল্লাহর নিকট যা আছে, তা তার রাসূলের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু আমিতো এজন্য কাঁদছি যে, আসমান থেকে ওহী নাযিল হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। রাবী বলেনঃ তিনি তাঁদের উভয়কে কাঁদতে অনুপ্রাণিত করেন। ফলে তাঁরা উভয়ে তাঁর সঙ্গে কাঁদতে শুরু করেন।
بَاب ذِكْرِ وَفَاتِهِ وَدَفْنِهِ ﷺ
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ الْخَلَّالُ حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ عَاصِمٍ حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ الْمُغِيرَةِ عَنْ ثَابِتٍ عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ أَبُو بَكْرٍ بَعْدَ وَفَاةِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم لِعُمَرَ انْطَلِقْ بِنَا إِلَى أُمِّ أَيْمَنَ نَزُورُهَا كَمَا كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم يَزُورُهَا قَالَ فَلَمَّا انْتَهَيْنَا إِلَيْهَا بَكَتْ فَقَالَا لَهَا مَا يُبْكِيكِ فَمَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ لِرَسُولِهِ قَالَتْ إِنِّي لَأَعْلَمُ أَنَّ مَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ لِرَسُولِهِ وَلَكِنْ أَبْكِي أَنَّ الْوَحْيَ قَدْ انْقَطَعَ مِنْ السَّمَاءِ قَالَ فَهَيَّجَتْهُمَا عَلَى الْبُكَاءِ فَجَعَلَا يَبْكِيَانِ مَعَهَا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

দীনদার ও বুযুর্গ ব্যক্তিদের যিয়ারত-সাক্ষাতে যাওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে এটি অত্যন্ত শিক্ষণীয় এক হাদীছ। যিয়ারত ও সাক্ষাতের কতটা গুরুত্ব থাকলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর মত এ উম্মতের শ্রেষ্ঠতম দুই ব্যক্তি হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এর সঙ্গে সাক্ষাত করতে যেতে পারেন তা সহজেই বোধগম্য। তাঁদেরকে দেখেই হযরত উম্মু আয়মান রাযি. কেঁদে উঠলেন। তাঁদের ধারণা ছিল এ কান্নার কারণ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহাপ্রয়াণ ও তাঁর বিরহবেদনা। তাই তাঁরা এই বলে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে চাইলেন যে- (আপনি জানেন না, আল্লাহর কাছে যা আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তাই শ্রেয়?)। নিঃসন্দেহে যে-কোনও মুমিনের জন্যই দুনিয়ার চেয়ে আখেরাত শ্রেষ্ঠ। দুনিয়ার বিভিন্ন আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রীর উল্লেখ করার পর কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ

‘বল, আমি কি তোমাদেরকে এসব অপেক্ষা উৎকৃষ্ট জিনিসের সংবাদ দেব? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে এমন বাগ-বাগিচা, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত, যেখানে তারা সর্বদা থাকবে এবং (তাদের জন্য আছে) পবিত্র স্ত্রী ও আল্লাহর পক্ষ হতে সন্তুষ্টি। আল্লাহ সকল বান্দাকে ভালোভাবে দেখছেন ।২৩০
জান্নাতের স্থায়ী, অফুরন্ত, অতুলনীয় নিআমতরাজির সামনে দুনিয়ার বস্তুসামগ্রী নিতান্তই তুচ্ছ। কাজেই প্রত্যেক মুমিনের জন্য আল্লাহর কাছে রক্ষিত সেই নিআমতসমূহ ইহজীবনের সবকিছু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বৈকি। তাহলে নবী-রাসূলদের জন্য আখেরাতে কেমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে? তাদের মধ্যে আবার সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহামর্যাদা অনুপাতে যে মহা আয়োজনের সমারোহ থাকবে, সে হিসেবে এ দুনিয়া তাঁর পক্ষে সিন্ধুর মধ্যে বিন্দু অপেক্ষাও তুচ্ছ নয় কি? তাই তো ওফাতের আগে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে কোনও একটা বেছে নেওয়ার এখতিয়ার দেওয়া হলে তিনি সানন্দে আখেরাতকে বেছে নেন। ওফাতকালে বার বার এই বলে মহান বন্ধু মহাপ্রভুর সন্নিধানে যাত্রার ব্যকুলতা ব্যক্ত করছিলেন যে, 'হে আল্লাহ! হে মহান বন্ধু!" ।

হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এর চিন্তার গভীরতা
হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এরও ঢের জানা ছিল যে, আল্লাহ তাআলার কাছে তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যা সংরক্ষিত আছে তা ইহজীবনের সবকিছু অপেক্ষা অনেক অনেক শ্রেয়। তাই তিনি কান্নার যে কারণ তারা উল্লেখ করেছেন তা নাকচ করে দেন। তাহলে কেন তিনি কাঁদছিলেন? তিনি তার কারণ ব্যাখ্যা করেন-

ولكِنِّي أَبْكِي أَنَّ الوَحْيَ قَدِ انْقَطَعَ مِنَ السَّماءِ

(বরং আমি কাঁদছি এজন্য যে, আসমান থেকে ওহী নাযিলের ধারা ছিন্ন হয়ে গেল)। এ সংক্ষিপ্ত কথাটি দ্বারা ওহীর মর্ম ও ঐশ্বর্য, তার কল্যাণ ও বরকত, তার আলোকময়তা ও শক্তি-ক্ষমতা এবং তার প্রভাব ও মাধুর্য সম্পর্কে হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এর গভীর উপলব্ধির পরিচয় মেলে। তাঁর এ অভিব্যক্তি মহান সিদ্দীক ও ফারূকের অন্তর্দেশে ভাবাবেগের কলরোল তুলল। ভূবন উদ্ভাসী ওহীর ধারাবিচ্ছেদ-বেদনার যে শোক তাঁরা এতদিন পাথরচাপা দিয়ে রেখেছিলেন, সহসাই তা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। তাঁরাও তাঁর সঙ্গে কাঁদতে থাকলেন।

প্রকাশ থাকে যে, যদিও দীনের পরিপূর্ণতার জন্য যে পরিমাণ ওহী নাযিলের প্রয়োজন ছিল তা নাযিল করা হয়ে গেছে, দীনের পরিপূর্ণতা ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে, ফলে দীনের চাহিদা ও জরুরত পূরণের জন্য আর কোনও ওহী নাযিলের প্রয়োজন নেই, তবুও এতে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, ওহী শুধু কল্যাণই কল্যাণ, জ্ঞানই জ্ঞান ও বরকতই বরকত। এর মাধুর্য ও স্নিগ্ধতা প্রকৃত মুমিনের প্রাণের খোরাক। মুমিনদের এ খোরাকের চাহিদা অফুরন্ত। ঠিক ধনাসক্ত ব্যক্তির ধনসম্পদের চাহিদার মত। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

منهُوْمَانِ لا يَشْبعَانِ : مَنْهُومٌ فِي الْعِلْم لا يَشبَعُ مِنْهُ، وَمَنْهُومٌ فِي الدُّنْيَا لَا يَشْبَعُ مِنْهَا

‘দুই ক্ষুধার্ত কখনও পরিতৃপ্ত হয় না। এক হলো ইলমের ক্ষুধার্ত, (যতই ইলম অর্জন হোক) তাতে তার পরিতৃপ্তি আসে না। আরেক হলো দুনিয়ার অর্থ-সম্পদে আসত ব্যক্তি, তারও তাতে কখনও পরিতৃপ্তি লাভ হয় না।’২৩১

তবে সংক্ষিপ্ত ও সীমিত ইহজগতের সবকিছুই সীমিত ও পরিমিত। এ জগতে জাহিরী ও বাতিনী, প্রকাশ্য ও গুপ্ত, মূর্ত ও বিমূর্ত এবং ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক সবকিছুই সীমিত। আকারে দেওয়া হয়েছে। সবকিছু সীমিত রাখাই এ জগতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ জগতে তাতেই কল্যাণ। সে নিয়মের অধীনেই ওহী নাযিলের ধারাও সীমিতই রাখা হয়েছে। একপর্যায়ে সে ধারা তার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। আর অমনি সর্বশেষ যাঁর প্রতি ওহী নাযিল হচ্ছিল, সেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও দুনিয়া থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । আর কোনও নবীও আসবে না, নতুন কোনও ওহীও নাযিল হবে না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছে অনেক মূল্যবান শিক্ষা আছে। তার মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা গেল-

ক. দীনদার ও নেককার ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতে যাওয়া চাই।

খ. নিজ মুরুব্বী ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি জীবিতকালে যাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করত, তার মৃত্যুর পর তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত অব্যাহত রাখা বাঞ্ছনীয়।

গ. কোনও বুযুর্গ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় কোনও প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভালো।

ঘ. প্রিয় ব্যক্তি ও প্রিয় বস্তুর বিরহ-বিচ্ছেদে শোকার্ত হওয়া ও কান্না করা দোষের নয়; বরং এটা ব্যক্তির গুণগ্রাহিতা ও সংবেদনশীলতার পরিচায়ক।

ঙ. খাঁটি মানুষেরা সামাজিক অবস্থা ও অবস্থানগত দিক থেকে নিজেদের তুলনায় নিম্নস্তরের লোকের সঙ্গেও সাক্ষাত করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

২৩০, সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৫

২৩১. শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯৭৯৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৬১১৮; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ৩৪৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৩৮৮
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন