কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ
৫. নামাযের আদ্যোপান্ত বর্ণনা এবং সুন্নাতসমূহ
১৩৯৩। মুহাম্মাদ ইবন ইয়াহইয়া (রাহঃ).... কা'ব ইবন মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ যখন আল্লাহ তাঁর তাওবা কবূল করেন, তখন তিনি শোকরানা সিজদা আদায় করেন।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এটি তাওবা সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ। এতে হযরত কা'ব ইবনে মালিক রাযি.-এর নিজ জবানীতে তার তাওবা কবুলের বৃত্তান্ত বিবৃত হয়েছে। তাঁর এ ঘটনা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষাপ্রদ। তাবুকের যুদ্ধ তাবুকের যুদ্ধাভিযান সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ৯ সালের রজব মাসে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ পেলেন রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস মদিনা মুনাওয়ারায় এক জোরদার হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনকি সে শাম ও আরবের সীমান্ত এলাকায় এক বিশাল বাহিনীও মোতায়েন করেছে। যদিও সাহাবায়ে কিরান এ যাবতকাল বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, কিন্তু তার সবক'টিই হয়েছিল জাযিরাতুল আরবের ভেতরে। কোনও বহিঃশক্তির সাথে এ পর্যন্ত মোকাবেলা হয়নি। এবার তারা সেই পরীক্ষার সম্মুখীন। তাও দুনিয়ার এক বৃহৎ শক্তির সাথে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিরাক্লিয়াসের আক্রমণের অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই সামনে অগ্রসর হয়ে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। সুতরাং তিনি সকল মুসলিমকে এ যুদ্ধে শরীক হওয়ার হুকুম দিলেন। মুসলিমদের পক্ষে এটা ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা। কেননা দীর্ঘ ১০ বছর উপর্যুপরি যুদ্ধ শেষে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। এই যুদ্ধে যাওয়া মানে সেই সুযোগটিও হারানো। দ্বিতীয়ত সময়টা ছিল এমন, যখন বাগানের খেজুর পাকছিল, যেই খেজুরের উপর মদীনাবাসীদের সারা বছরের জীবিকা নির্ভরশীল ছিল। তৃতীয়ত ছিল প্রচণ্ড গরমের মৌসুম। যেন আকাশ থেকে আগুন ঝরছে। ভূমি থেকেও যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। তদুপরি ছিল তাবুকের সুদীর্ঘ সফর। মদীনা হতে তাবুক প্রায় ৮০০ মাইল দূরে অবস্থিত। দুর্গম মরুভূমির পথ। বাহনের সংখ্যাও খুব কম। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সেই বৃহত্তম শক্তির রণকৌশল সম্পর্কেও মুসলিমদের জানাশোনা ছিল না। কিন্তু এতকিছু সংকট সত্ত্বেও শাহাদাতের প্রেরণায় উজ্জীবিত সাহাবীগণ এ অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। তারা দলে দলে এসে নাম লেখালেন। যথাসাধ্য প্রস্তুতি শেষে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ত্রিশ হাজার সাহাবায়ে কিরামের এক বাহিনী নিয়ে তাবুকের উদ্দেশে বের হয়ে পড়লেন। আল্লাহ তা'আলা হিরাক্লিয়াস ও তার বাহিনীর উপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ দুঃসাহসিক অভিযানের এমন প্রভাব ফেললেন যে, তারা কালবিলম্ব না করে ফেরত চলে গেল। ফলে যুদ্ধ আর হল না। তবে যুদ্ধ না হলেও এ অভিযানে ইসলাম ও মুসলিম বাহিনীর বিজয় ঠিকই অর্জিত হল। কেননা একে তো সেকালের বৃহত্তম শক্তির উপর ইসলামী শক্তির প্রভাব পড়েছিল এবং তারা ইসলাম ও তার অনুসারীদের আমলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। দ্বিতীয়ত তাদের ফিরে যাওয়ায় আশপাশের ক্ষুদ্র রাজন্যবর্গ ক্রমবর্ধমান ইসলামী শক্তির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা কালবিলম্ব না করে তাবুকে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে সাক্ষাত করে এবং তাঁর সংগে সন্ধি স্থাপন করে। তাছাড়া এ অভিযানের মাধ্যমেই কে খাঁটি মুসলিম এবং কে মুনাফিক তা ভালোভাবে পরিষ্কার হয়ে যায়, যা কুরআন মাজীদের সূরা তাওবায় বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে। মুনাফিকদের অধিকাংশই এ যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত থাকে। তাদের কিছুসংখ্যক দুরভিসন্ধীমূলকভাবে এতে শরীক হয়েছিল। তিনজন খাঁটি মুসলিমেরও এতে যোগদান করা হয়নি। তাদের দ্বারা গড়িমসি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ গড়িমসির দরুন তারা যারপরনাই অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং এজন্য তাদেরকে এমন কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল, তাওবার ইতিহাসে যা এক শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। সেই পরীক্ষায় উত্তর এ মহান সাহাবীদেরকে মহত্তর মানবরূপে চিরস্মরণীয় করে তুলেছে। সেই তিনজনের একজন হলেন হযরত কা'ব ইবন মালিক রাযি.। এই সুদীর্ঘ হাদীছখানিতে মূলত তাঁর জবানীতে তাদের তাওবা কবুলের বৃত্তান্তই বিবৃত হয়েছে। ‘আকাবার বাই'আতের ঘটনা ‘আকাবা জামরাতুল-উখরার নিকটবর্তী একটি উপত্যকার নাম। এখানে মদীনার আনসারগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাংগে সাক্ষাত করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তারা মদীনার ইহুদীদের কাছ থেকে শেষ নবীর আগমন সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। সে নবী কেমন হবেন, তাঁর হুলিয়া ও বৈশিষ্ট্যাবলী কী, তাদের কাছ থেকে তারা তা অবহিত হয়েছিল। আগে থেকেই তাদের হজ্জ উপলক্ষে পবিত্র মক্কা মুকাররামায় আসা-যাওয়া ছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভের পরও তাদের সে যাতায়াত অব্যাহত ছিল। হজ্জের মৌসুমে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনা-মুযদালিফায় ঘুরে ঘুরে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এই দাওয়াতী ব্যস্ততার এক পর্যায়ে একদল আনসারের সংগে তাঁর সাক্ষাত হয়। আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ছিল তাঁর দীনকে বিজয়ী করবেন এবং তাঁর নবীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের বীজ এই সাক্ষাতকারেই বপন হয়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে কুরআন মাজীদ পড়ে শোনালেন এবং আল্লাহর দীন বোঝালেন। কুরআন মাজীদের আয়াত এবং নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য তাদের অন্তরে রেখাপাত করে। ফলে সেই মুহূর্তেই তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং নিজ দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দীপনা নিয়ে ফিরে যায়। তারা মদীনায় ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিষয়ে মানুষকে অবহিত করলেন এবং তাদের ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। সে আহ্বানে মদীনার লোকজন স্বতঃস্ফূর্ত সাড়াদান করে। ফলে মদীনার আনসারদের ভেতর ইসলামের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। পরের বছর হজ্জ মৌসুমে ১২জন আনসার মক্কায় আগমন করেন। তারা ‘আকাবায় নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এটাই ‘আকাবার প্রথম বাই'আত। এ বাই'আতের বিষয়বস্তু ছিল এই যে, তারা আল্লাহর সংগে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না,সন্তান হত্যা করবে না, কারও নামে অপবাদ রটাবে না এবং কোনও সৎকাজে বাধা দেবে না। যদি তারা এগুলো পূরণ করে, তবে জান্নাত লাভ করবে। আর এর অন্যথা করলে বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে। তিনি চাইলে শাস্তি দেবেন অথবা ক্ষমা করবেন। বাইআত শেষে তারা মদীনায় ফিরে গেলেন। তাদেরকে কুরআনের তালীম, ইসলাম শিক্ষা ও দীনী বিধি-বিধান সম্পর্কে অবহিত করার জন্য শিক্ষকরূপে হযরত মুসআব ইবন উমায়র রাযি.-কে পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর পবিত্র মদীনায় ইসলাম প্রচার বেগবান হয়ে উঠল। মদীনার প্রধান দুই গোত্র আওস ও খাযরাজের নেতৃবর্গসহ প্রায় অধিকাংশ লোকই ইসলাম গ্রহণ করে ফেলল। পরের বছর বিপুল উদ্দীপনায় তাদের একটি বড়সড় দল মক্কা মুকাররামায় আগমন করল। এ দলের লোকসংখ্যা ছিল পঁচাত্তরজন। তিয়াত্তরজন পুরুষ দু’জন মহিলা। এবারে তাদের আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মদীনায় গমনের প্রস্তাব দেওয়া। তাদের জানা ছিল পবিত্র মক্কায় তিনি ইসলাম প্রচারে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন এবং মক্কাবাসীগণ নতুন ধর্ম প্রচারের কারণে তাঁকে ও তাঁর মুষ্টিমেয় অনুসারীকে অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন করছে। তাদের লক্ষ্য সেই জুলুম নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষা করা এবং মদীনা মুনাওয়ারাকে ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করা। তারা রাতের বেলা ‘আকাবায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে সাক্ষাত করলেন। সেখানে জরুরি সব কথার এক পর্যায়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরতের দাওয়াত দিলেন। তাদের এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে চাচা আব্বাস রাযি. জানতে পেরেছিলেন। যদিও তিনি তখনও পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেননি, কিন্তু মহান ভাতিজার মর্যাদা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে নিজ ভাই আবূ তালিবের মতই সচেতন ছিলেন। কাজেই তিনি 'আকাবার আলোচনায় নিজের উপস্থিত থাকা জরুরি মনে করলেন। সময়মত তিনি এসেও গেলেন। তিনি আনসারদের লক্ষ্য করে একটি সারগর্ভ বক্তৃতা দিলেন। তাতে বললেন“হে খাযরাজ (ও আওস) গোত্রের লোকেরা! আমাদের কাছে মুহাম্মাদের কী মর্যাদা তা আপনাদের অজানা নয়। আমরা তাঁকে আমাদের সম্প্রদায়ের হাত থেকে এ যাবত রক্ষা করে এসেছি। তাঁর প্রতিপক্ষও আমাদেরই মত ধারণা রাখে। কাজেই তাঁর দেশ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর অবস্থান অত্যন্ত সুরক্ষিত। কিন্তু তবুও তিনি আপনাদের কাছে চলে যেতে এবং আপনাদের মাঝে থাকতে ইচ্ছুক। চিন্তা করে দেখুন, আপনারা যদি তাঁকে প্রদত্ত অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেন এবং শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার সামর্থ্য আপনাদের থাকে, তবে এ দায়িত্ব গ্রহণ করুন। পক্ষান্তরে যদি মনে করেন আপনারা তাঁকে রক্ষা করতে পারবেন না এবং তাঁকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন, তবে আপনারা এর থেকে বিরত থাকুন। তিনি নিজ দেশে ও নিজ গোত্রে নিরাপদে আছেন।” আনসারগণ বললেন, আমরা আপনার বক্তব্য শুনলাম। এবার ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কথা বলুন এবং নিজের পক্ষে ও নিজ রব্বের পক্ষে আমাদের থেকে যে অঙ্গীকার নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন তা নিয়ে নিন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বললেন। তিনি প্রথমে কুরআন তিলাওয়াত করলেন, তারপর তাদের সামনে ইসলামের ব্যাখ্যা দিলেন এবং ইসলামের প্রতি তাদের উৎসাহ দান করলেন। তারপর বললেন, আমি এ মর্মে তোমাদের থেকে বাই'আত (প্রতিশ্রুতি) গ্রহণ করছি যে, তোমরা তোমাদের নারী ও শিশুদের যেভাবে রক্ষা কর তেমনি আমাকেও রক্ষা করবে। তারা আল্লাহর নামে শপথ করে এই প্রতিশ্রুতি তাঁকে দান করলেন। তারপর বললেন, মদীনার ইহুদীদের সাথে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক আছে। এ বাই'আতের মাধ্যমে আমরা তা ছিন্ন করতে চাচ্ছি। পরে এমন তো হবে না যে ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ যখন আপনাকে বিজয় দান করবেন, তখন আপনি আমাদের ছেড়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবেন? নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কথা শুনে মৃদু হাসলেন। তারপর এই বলে তাদের আশ্বস্ত করলেন যে, তোমাদের রক্ত আমার রক্ত। তোমাদের জীবন-মরণের সাথে আমার জীবন-মরণ গাঁথা থাকবে। আমি তোমাদের, তোমরা আমার। তোমরা যাদের সাথে লড়বে, আমি তাদের সাথে লড়ব। তোমরা যাদের সাথে শান্তি স্থাপন করবে, আমিও তাদের সাথে শান্তি স্থাপন করব। এভাবে 'আকাবার দ্বিতীয় বাই'আত সম্পন্ন হল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আনসারদের পক্ষে এ বাই'আত ছিল এক চ্যালেঞ্জিং পদক্ষেপ। এটা ছিল সমগ্র আরব: বরং সমস্ত বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর। সমগ্র বিশ্ব তখন শিরক-কবলিত। তাওহীদের দাওয়াত ছিল শিরকী আকীদা-বিশ্বাসের উপর প্রত্যক্ষ আঘাত। অন্ধকারাচ্ছন্ন মুশরিকদের সে আঘাত সহ্য করার কথা নয়। বরং এ দাওয়াত আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী ইহুদী-খৃষ্টানদের জন্যও প্রীতিকর ছিল না, যেহেতু তারাও প্রকৃত তাওহীদের বিশ্বাস থেকে সরে এসেছিল। ফলে এ দাওয়াতের পক্ষাবলম্বন দ্বারা ইহুদী-খৃষ্টানসহ সারা বিশ্বের সমস্ত পৌত্তলিক ও নাস্তিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত শক্তির মুখোমুখি হওয়া ছিল অনিবার্য। খোদ মদীনার ভেতরই শক্তিশালী ইহুদী গোত্রসমূহের বসবাস। এহেন পরিস্থিতিতে মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশ্রয় দান করলে যে ভেতরের ও বাইরের সবরকম শক্তির বিরুদ্ধে জানবাজি রেখে লড়তে হবে, মুষ্টিমেয় আনসারদের সে কথা ভালোভাবেই জানা ছিল। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার তো তাঁর দীনকে বিজয় করার ছিল। তিনি আনসারদের অন্তরে হিম্মত দিলেন, ঈমানী উদ্দীপনা দিলেন এবং দিলেন কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিতে অটল-অবিচল থাকার দৃঢ় সংকল্প। ফলে সম্ভাব্য সকল ঝুঁকি মাথায় নিয়েই তারা ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার সাথে বাই'আত সম্পন্ন করলেন। ‘আকাবার এই বাই'আত ইসলামী ইতিহাসের এক মহিমময় ঘটনা। মদীনা মুনাওয়ারার ইসলামের কেন্দ্রীয় মর্যাদালাভ, বদর যুদ্ধে জয়লাভ, মক্কাবিজয়, ইসলামী খেলাফতের বিপুল বিস্তার এবং বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচারের ভিত্তি এই বাই'আতের মাধ্যমেই স্থাপিত হয়েছিল। যারা এই বাই'আতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেই সুমহান ব্যক্তিবর্গের অন্তরে এর মূল্য ও মর্যাদাবোধ সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে এটা স্বাভাবিক কথা। মূল্যবোধের সেই অবস্থান থেকেই হযরত কা'ব ইবন মালিক রাযি. বলেছিলেন, ‘আকাবার বাই'আতের বিপরীতে বদর যুদ্ধের উপস্থিতিকে আমি পসন্দ করব না, (অর্থাৎ এমন যদি হত যে, আমি বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি কিন্তু ‘আকাবার বাই'আতে শরীক থাকিনি, এটা আমার পক্ষে প্রীতিকর হত না) যদিও বদর যুদ্ধ মানুষের কাছে ‘আকাবা অপেক্ষা বেশি আলোচিত। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. কোনও নেককাজে গড়িমসি করতে নেই। গড়িমসি করলে অনেক সময়ই সেই নেককাজ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে, যেমন হযরত কা'ব রাযি. ও তাঁর দুই সঙ্গী তাবুকের যুদ্ধাভিযানে যাওয়ার সুযোগ হারিয়েছিলেন। খ. ইসলাম গ্রহণের বাই'আত ছাড়াও দীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাই'আত জায়েয। ‘আকাবার বাই'আত সে রকমেরই ছিল। এর দ্বারা খাঁটি পীরের হাতে বাই'আতের বৈধতা প্রমাণিত হয়। গ. সর্বাবস্থায় সত্য বলা উচিত। সত্য বললে প্রথমদিকে কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হলেও পরিণাম সর্বদা শুভই হয়ে থাকে। হযরত কা'ব রাযি.-এর সত্যবলা সে কথাই প্রমাণ করে। পক্ষান্তরে মিথ্যার পরিণাম সর্বদা অশুভই হয়, তাতে সাময়িক যত সুবিধাই দেখা যাক না কেন। ঘ. সর্বাবস্থায় আমীর, উসতায ও শায়খের হুকুম শিরোধার্য করা উচিত। তাদের কঠিন থেকে কঠিনতর হুকুম পালন করতে পারলে তা অভাবনীয় সুফল বয়ে আনে। ঙ. মিথ্যা অজুহাত প্রদর্শন মুনাফিকদের কাজ। তা থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। চ. নিজেদের পরিকল্পনা ও গতিবিধি সম্পর্কে শত্রুপক্ষ যাতে অবহিত হতে না পারে, সেই লক্ষ্যে সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থাগ্রহণ অধিনায়কের যোগ্যতা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক এটা বিজয় ও সাফল্য লাভের পক্ষে সহায়ক। ছ. কারও দ্বারা কোনও অপরাধ হয়ে গেলে তার সংশোধনকল্পে তার সংগে কথা বন্ধের শাস্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে। জ. সফর থেকে ফিরে আসার পর প্রথমেই ঘরে না ঢুকে মসজিদে যাওয়া এবং দু' রাক'আত নামায পড়া মুস্তাহাব। ঝ. কারও ভালো কিছু ঘটলে তাকে সে সম্পর্কে সুসংবাদ শোনানো একটি ইসলামী আদব। এর দ্বারা সুসংবাদদাতার মনের ঔদার্য প্রকাশ পায় এবং পরস্পরে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। ঞ. সুসংবাদদাতাকে পুরস্কৃত করা মুস্তাহাব। ট, কারও সুখকর কিছু ঘটলে সেজন্যে তাকে অভিনন্দন জানানো চাই। ঠ. আগুম্ভককে স্বাগত জানানোর জন্য উঠে এগিয়ে যাওয়া ও তার সাথে মুসাফাহা করা একটি প্রশংসনীয় কাজ। ড. অমুসলিম শত্রুর তোষামোদে ভুলতে নেই। অনেক সময় তা ঈমান হরণেরও কারণ হয়ে থাকে। সেজন্যই হযরত কা'ব রাযি. গাস্সানের রাজার চিঠিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং সেটি আগুনে পুড়ে ফেলেছেন। ঢ. দীনের স্বার্থ আত্মীয়তারও উপরে। কাজেই দীনের কারণে যদি আত্মীয়কে পরিত্যাগ করতে হয়, তবে তা করাই বাঞ্ছনীয়। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথাবার্তা বলতে নিষেধ করে দিলে হযরত কা'ব রাযি.-এর সাথে তাঁর চাচাত ভাই কথা বলতে রাজি হননি। ণ. আমীরের কর্তব্য তার অধীনস্থদের খোঁজখবর রাখা ও তাদের সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ত. আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে কোনও নি'আমত লাভ হলে তার শোকরস্বরূপ দান-সদাকা করা মুস্তাহাব। থ. ইসলামের সাধারণ শিক্ষা এটাই যে, যার অর্থ-সম্পদ আছে সে সমস্ত সম্পদ দান-সদাকা না করে একটা অংশ ওয়ারিশদের জন্য রেখে দেবে, যাতে তাদের অন্যদের কাছে হাত পেতে বেড়াতে না হয়। দ. বিশেষ কোনও আমলের বদৌলতে কোনও নি'আমত লাভ হলে তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সেই আমলে আরও বেশি যত্নবান হওয়া উচিত, যেমন হযরত কা'ব রাযি. সত্য বলার বদৌলতে আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমাপ্রাপ্তির নি'আমত লাভ করেছিলেন। ফলে তিনি জীবনভর সত্যবাদিতায় অবিচল থাকবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ধ. কারও সামনে অন্য কারও গীবত ও সমালোচনা করা হলে তার কর্তব্য প্রতিবাদ করা এবং তার প্রশংসনীয় দিক তুলে ধরা, যেমন হযরত কা'ব রাযি.-এর সমালোচনা করা হলে হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি. প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আমরা তো কা'বকে ভালো বলেই জানি। ন. কারও পক্ষ থেকে কোনও উপকার ও সদাচরণ পেলে তা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। হযরত কা'ব রাযি. হযরত তালহা রাযি.-এর সদাচরণ জীবনভর মনে রেখেছিলেন। এ হাদীছে এছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। সংক্ষেপ করার লক্ষ্যে এখানেই ক্ষান্ত করা হল।

তাহকীক:
তাহকীক চলমান