আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৩- সন্ধি - আপোষরফা সংক্রান্ত অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৭০৭
১৬৮৩. মানুষের মধ্যে মীমাংসা করার এবং তাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করার ফযীলত
২৫২৬। ইসহাক (রাহঃ) .... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘মানুষের হাতের প্রতিটি জোড়ার জন্য তার উপর সাদ্‌কা রয়েছে। সূর্যোদয় হয় এমন প্রতিদিন (অর্থাৎ প্রত্যহ) মানুষের মধ্যে সুবিচার করাও সাদ্‌কা।’

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে মানবদেহের জোড়াসমূহ ও প্রতিটি অঙ্গ যে আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এবং এর শোকর আদায়ের উপায় শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
মানবদেহের জোড়াসমূহ কত বড় নিআমত তা একটু চিন্তা করলেই বুঝে আসে। এ জোড়াসমূহের কারণে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার অত্যন্ত সহজ হয়েছে। এগুলো না থাকলে সারা শরীর অখণ্ড এক কাঠের গুঁড়ি বা পাথরের মূর্তির মত হত। না তা ইচ্ছামত নাড়াচাড়া করা যেত আর না সুবিধামত ব্যবহার করা সম্ভব হত। আল্লাহ জাল্লা শানুহু সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য যেমন পৃথক পৃথক অঙ্গ সৃষ্টি করেছেন, তেমনি ব্যবহারের সুবিধার্থে অঙ্গসমূহকে সুনিপুণভাবে পরস্পর জুড়ে দিয়েছেন।
প্রথমত অঙ্গসমূহের সুসমঞ্জস সৃষ্টি ও তার যথোপযুক্ত সন্ধিস্থাপন আল্লাহ তাআলার বিশাল নিআমত। তারপর এসব অঙ্গ ও অঙ্গসন্ধি সুস্থ ও সক্রিয় রাখা তাঁর অতি বড় মেহেরবানী। আমাদের প্রতি তিনি এ মেহেরবানী নিত্যদিন জারি রাখছেন। মানুষ সাধারণত দিন শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর নিয়ে বিশ্রাম যায় আবার ভোরবেলা সুস্থ ও চনমনে শরীর নিয়ে কর্মক্ষেত্রে নেমে পড়ে।
প্রতিদিন সকালবেলা আমরা আমাদের প্রতিটি অঙ্গকে সুস্থ ও সচল পাই। কখনও এমনও হয়ে যায় যে, ঘুম থেকে উঠার পর দেখা গেল হাঁটুতে খিল ধরে গেছে। আগের মত স্বাভাবিক নড়াচড়া করছে না। যার এমন হয় সে বুঝতে পারে হাঁটুর জোড়াটি কত বড় নিআমত। এতদিন সে কেমন অবলীলায় চলাফেরা করত, আজ তার চলতে কত কষ্ট। তারপরও অন্যসব অঙ্গ যেহেতু অবিকল আছে, তাই তার জীবন সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়নি। সে তার বেশিরভাগ অঙ্গ নিয়ে সচল রয়েছে। আল্লাহ তাআলা চাইলে তার সবগুলো অঙ্গ বিকল করে দিতে পারতেন। বিশেষত এ কারণেও যে, অঙ্গগুলো তো আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করা হয় না। প্রতিটি অঙ্গ আল্লাহ তাআলার কত বড় নিআমত। এর কোনওটিকেই পাপকর্মে ব্যবহার করা উচিত নয়। কিন্তু হামেশাই তা করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা এ নিআমত কেড়ে না নিয়ে বহাল তবিয়তে রেখে দিয়েছেন। তো ঘুম থেকে জাগার পর যখন এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও তাদের সন্ধিসমূহ সুস্থ-সবল দেখতে পাওয়া যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই কর্তব্য হয়ে পড়ে এসবের সৃষ্টিকর্তা ও রক্ষাকর্তার সামনে নিজেকে একজন শোকরগুযার বান্দারূপে পেশ করা। এ হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সংক্ষিপ্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ বাক্যে এ বিষয়টাই তুলে ধরেছেন।
তিনি ইরশাদ করেন- كل سلامى من الناس عليه صدقة كل يوم تطلع فيه الشمس (সূর্য উদিত হয় এমন প্রতিটি দিনে মানবদেহের প্রতিটি জোড়ার উপর সদাকা আবশ্যিক হয়)। ‘সূর্য উদিত হয়' এ কথাটি 'দিন'-এর ব্যাখ্যামূলক বিশেষণ। অর্থাৎ সূর্যোদয়ের দ্বারাই দিনের সূচনা ঘটে। যদি সূর্য না উঠত, দিন হত না। তাহলে সূর্যোদয়ও আমাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার এক বিরাট অনুগ্রহ। একটা সময় আসবে। যখন আর সূর্যোদয় হবে না। অনন্ত অন্ধকারে নিখিল বিশ্ব আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। সেটা রোজ কিয়ামত। যতদিন কিয়ামত না হচ্ছে, ততদিন সূর্যের উদয়-অস্ত ঘটতে থাকবে আর এর মাধ্যমে কুলমাখলূক আল্লাহর অপার অনুগ্রহ লাভ করতে থাকবে। ভোগ করতে থাকবে বহুবিচিত্র নিআমত।
সূর্যোদয়ের মাধ্যমে মানুষ নিত্যনতুন দিন পায়। এভাবে প্রতিদিন নতুন করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও অস্থিসমূহের নিআমত হাসিল করে। তাই প্রতিদিন নতুন করে আল্লাহর শোকর আদায় করা তার কর্তব্য হয়ে যায়। সদাকা আদায় কর্তব্য বলে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেইসঙ্গে সারাদিন যাতে সবগুলো অঙ্গ সুস্থ ও সক্রিয় থাকে এবং নিজ গুনাহের কারণে কোনও অঙ্গ কেড়ে নেওয়া না হয়, তাও প্রত্যেকেরই একান্ত কাম্য। এ কামনা যাতে পূরণ হয়, সে লক্ষ্যেও সদাকা আদায় করা কর্তব্য। কেননা সদাকা দ্বারা বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন الصدقة تطفئ غضب الرب، وتدفع ميتة السوء ‘সদাকা আল্লাহর ক্রোধ নিবারণ করে এবং অপমৃত্যু রোধ করে।২১৮
মানবদেহে ৩৬০টি জোড়া আছে। প্রতিটি জোড়ার বিনিময়ে একটি সদাকা ওয়াজিব হলে প্রতিদিন সর্বমোট ৩৬০টি সদাকা দেওয়া কর্তব্য হয়। বাহ্যত বিষয়টা কঠিন। কোনও কোনও সাহাবী প্রশ্নও করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ৩৬০টি সদাকা দেওয়া কী করে সম্ভব? তার উত্তরে তিনি এ হাদীছ পেশ করেন, যা দ্বারা জানা গেল যে, সদাকা বলতে কেবল অর্থ-সম্পদ খরচ করাই বোঝায় না; বরং যে-কোনও নফল ইবাদত-বন্দেগীকেও সদাকা বলে। এ হাদীছে সেরকম কয়েকটি আমল উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে দুই ব্যক্তির মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দেওয়া।

দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা করার দ্বারা সদাকার ছাওয়াব
হাদীছে ইরশাদ হয়েছে تعدل بين الاثنين صدقة (কেউ দুই ব্যক্তির মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দিলে তা একটি সদাকা)। অর্থাৎ দুই ব্যক্তির মধ্যে যদি ঝগড়া-ফাসাদ হয় বা এমন মনোমালিন্য হয়, যদ্দরুন একে অন্যের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করে দেয়, তবে তাদের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে মীমাংসা করে দেওয়া একটি সদাকা । গরীব-দুঃখীর প্রতি যেমন তাদের অভাবের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে দান-সদাকা করা হয়ে থাকে, মীমাংসার কাজটিও যেন তদ্রূপ বিবদমান দুই পক্ষের উপর একরকম মানবিক দান। এর দ্বারা তাদের মানসিক কষ্ট লাঘব হয়। সেইসঙ্গে কলহ-বিবাদের কারণে যেসকল অন্যায়-অনুচিত কথা ও কাজে তারা লিপ্ত হয়ে পড়ে, তা থেকেও
তাদেরকে রক্ষা করা হয়, যেমন দান-সদাকা দ্বারা অভাবগ্রস্তকে অনুচিত কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা হয়।
বিবদমান দুই পক্ষ আদালতের দ্বারস্থ হলে তখন তো মীমাংসা করাটা বিচারকের দায়িত্ব হয়ে যায় আর বিচারক ইনসাফসম্মত মীমাংসা করলে তারও এজন্য সদাকার ছাওয়াব অর্জিত হয়। পক্ষান্তরে আদালতে মামলা রুজু হওয়ার আগেই যদি কোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়, তবে সেও সদাকার ছাওয়াব লাভ করবে। যাদের এটা করার মত যোগ্যতা ও ক্ষমতা আছে তাদের এটা করাই উচিত। এটা ভ্রাতৃত্ববোধের দাবি। এক মুমিন যখন অপর মুমিনের ভাই, তখন দুই ভাইয়ের পারস্পরিক বিরোধে তৃতীয় ভাইয়ের মীমাংসামূলক ভূমিকা রাখা কর্তব্য বৈকি, যেমন উপরে বর্ণিত চতুর্থ আয়াত দ্বারা আমরা জানতে পেরেছি।
মীমাংসায় ন্যায়-ইনসাফ রক্ষা জরুরি
এ হাদীছে দু'জনের মধ্যে মীমাংসা করাকে تعدل (তুমি ইনসাফ করবে) শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। এটা ইঙ্গিত করে, সত্যিকারের মীমাংসা সেটাই, যা ন্যায় ও ইনসাফসম্মত হয় এবং সদাকার ছাওয়াব সেরকম মীমাংসা দ্বারাই অর্জিত হয়। পক্ষান্তরে যে মীমাংসা ইনসাফসম্মত হয় না, তা প্রকৃত মীমাংসাই নয়; বরং জুলুম ও অন্যায় পক্ষপাত। সেরকম মীমাংসা ছাওয়াবের কাজ নয়; বরং কঠিন গুনাহ।
অন্যায় ও পক্ষপাতদুষ্ট মীমাংসা যখন কঠিন পাপ, তখন এর থেকে বিরত থাকা এবং সর্বদা ইনসাফসম্মত ফয়সালা করা অবশ্যকর্তব্য, তাতে বিচারপ্রার্থী যে-ই হোক না কেন বা বিবদমান কোনও পক্ষের সঙ্গে মীমাংসাকারীর সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ এবং অপর পক্ষ তার যত ঘোর শত্রুই হোক না কেন। সুতরাং কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا

“হে মুমিনগণ! তোমরা ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী হয়ে যাও আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতারূপে, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে কিংবা পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। সে ব্যক্তি (যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার আদেশ করা হচ্ছে)। যদি ধনী বা গরীব হয়, তবে আল্লাহ উভয়প্রকার লোকের ব্যাপারে (তোমাদের চেয়ে) বেশি কল্যাণকামী। সুতরাং তোমরা ইনসাফ করার ব্যাপারে ইচ্ছা-অভিরুচির অনুসরণ করো না।
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ

'হে মুমিনগণ! তোমরা হয়ে যাও আল্লাহর (বিধানাবলি পালনের) জন্য সদাপ্রস্তুত (এবং) ইনসাফের সাথে সাক্ষ্যদানকারী এবং কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফ পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ অবলম্বন করো। এ পন্থাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। এবং আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত।

প্রকাশ থাকে যে, আলোচ্য হাদীছে যে বিষয় উল্লেখ করা হল, সদাকা এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর বাইরেও অনেক কিছু আছে। যেমন অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

تبسمك في وجه أخيك لك صدقة، وأمرك بالمعروف ونهيك عن المنكر صدقة، وإرشادك الرجل في أرض الضلال لك صدقة، وبصرك للرجل الرديء البصر لك صدقة، وإماطتك الحجر والشوكة والعظم عن الطريق لك صدقة، وافراغك من دلوك في دلو أخيك لك صدقة

'তোমার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তোমার হাসি দেওয়া তোমার জন্য একটি সদাকা; তোমার পক্ষ হতে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা একটি সদাকা; কোনও ভূমিতে পথহারা ব্যক্তিকে তোমার পথ দেখিয়ে দেওয়াটাও তোমার জন্য একটি সদাকা; যার দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে তার জন্য তোমার দৃষ্টিশক্তির ব্যবহারও তোমার জন্য একটি সদাকা; রাস্তা থেকে পাথর কাঁটা ও হাড় সরিয়ে দেওয়াও তোমার জন্য একটি সদাকা এবং তোমার পাত্র থেকে তোমার ভাইয়ের পাত্রে পানি ঢেলে দেওয়াও তোমার জন্য একটি সদাকা।
এর দ্বারা বোঝা যায়, অন্যের পক্ষে কল্যাণকর যে-কোনও বৈধ কাজই সদাকারূপে গণ্য। এমনকি যে আমল দ্বারা নিজ আখেরাতের কল্যাণ হয় তাও সদাকা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও তার জোড়াসমূহ আল্লাহপ্রদত্ত অনেক বড় নিআমত। আমাদের কর্তব্য এর শোকর আদায় করা।

খ. সদাকা দ্বারা বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত হয়। তাই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যাতে বিপদ আপদ থেকে মুক্ত থাকে, সে লক্ষ্যে সদাকা করা চাই।

গ. সূর্য আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার এক বিরাট দান। এর জন্যও আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত।

ঘ. বিবাদমান দুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া চাই। এতে সদাকারও ছাওয়াব পাওয়া যায়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন