আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৩- সন্ধি - আপোষরফা সংক্রান্ত অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৬৯২
১৬৭৪. সেই ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয়, যে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়
২৫১৩। আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুল্লাহ (রাহঃ) .... উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছেন, সে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয়, যে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য (নিজের থেকে) ভালো কথা পৌঁছে দেয় কিংবা ভালো কথা বলে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ইসলামে মানুষের মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি করে দেওয়া যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা এ হাদীছ দ্বারা পরিস্ফুট হয়। এর জন্য এমনকি মিথ্যা বলার পর্যন্ত অবকাশ আছে, অথচ এমনিতে মিথ্যা বলা কত কঠিন পাপ। এক হাদীছে জানানো হয়েছে, মুমিন ব্যক্তির স্বভাবে মিথ্যা বলার খাসলত থাকতে পারে না। অপর এক হাদীছে বর্ণিত আছে- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিথ্যাবাদীকে জাহান্নামে লোহার আংটা দ্বারা শাস্তিপ্রাপ্ত হতে দেখেছেন। তো যে মিথ্যা বলাটা এমন গর্হিত কাজ, বিবাদমান দুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তারও পর্যন্ত অবকাশ রাখা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে— ليس الكذاب الذي يصلح بين الناس (ওই ব্যক্তি মিথ্যুক নয়, যে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়)। অর্থাৎ, যদি দুই ব্যক্তির মধ্যে কলহ-বিবাদ দেখা দেয় এবং কোন ব্যক্তি তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার চেষ্টা করে আর তা করতে গিয়ে তাকে মিথ্যা বলার আশ্রয় নিতে হয়, তবে সে তা নিতে পারে। এতে তার কোনও গুনাহ হবে না। মিথ্যুক নয় বলে বোঝানো উদ্দেশ্য যে, মিথ্যা বলার কারণে সে গুনাহগার হবে না। না হয় মিথ্যা তো মিথ্যাই। উদ্দেশ্য সৎ হওয়ায় মিথ্যা তো সত্য হয়ে যেতে পারে না।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- فينمي خيرا او يقول خيرا (মীমাংসা করার উদ্দেশ্যে সে ভালো কথা পৌঁছায় ও ভালো কথা বলে)। যে দুই ব্যক্তির মধ্যে ঝগড়া, তাদের একজনের কথা অন্যজনের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে সে এই নীতি অবলম্বন করে যে, তাদের একজন অন্যজন সম্পর্কে ভালো কিছু বললে সেটা তো উল্লেখ করে আর মন্দ কিছু বললে তা এড়িয়ে যায়। এমনকি মন্দ বিষয়টাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এমনভাবে বলে, যাতে করে অপরপক্ষ সেটিকে আর মন্দ অর্থে নেয় না; বরং ভালোই মনে করে। মীমাংসার উদ্দেশ্যে শরীআত এ পন্থাকে কেবল জায়েযই নয়; প্রশংসনীয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে আবশ্যিক সাব্যস্ত করেছে।
যদি এতটুকুতে মীমাংসা করা সম্ভব না হয় এবং আরও আগে বেড়ে কথা হেরফের করা বা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলার প্রয়োজন পড়ে, তবে তারও সুযোগ রয়েছে। অনেক সময় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এর প্রয়োজন পড়েও বৈকি। সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরস্পরের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি না থাকলে দুনিয়াবী জীবন বিপর্যস্ত তো হয়ই, দীনদারীরও সর্বনাশ হয়ে যায়। এক পাপ আরও হাজারটা পাপ ডেকে আনে। খানিকটা মিথ্যা বলার দ্বারা যদি সেই মহাফ্যাসাদ থেকে বাঁচা যায় এবং সে মিথ্যায় কারও কোনও ক্ষতিও না হয়, তবে তা তো বলাই চাই। এ হাদীছ তা বলতেই উৎসাহ দেয়।
মুসলিম শরীফের বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার অনুমতি দিয়েছেন। তার একটি হচ্ছে যুদ্ধ। যুদ্ধে জয়-পরাজয়ে কৌশলের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিথ্যা বলার অনুমতি সেই কৌশল হিসেবেই। তবে এ ক্ষেত্রেও যতক্ষণ সম্ভব সরাসরি মিথ্যা না বলে চাতুর্যপূর্ণ কথা বলা শ্রেয়। যেমন রণক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে লক্ষ্য করে বলা যে, তোমাদের সেনাপতি নিহত হয়েছে। এর দ্বারা বক্তার উদ্দেশ্য প্রাক্তন কোনও সেনাপতি, কিন্তু শ্রোতা মনে করবে বর্তমান সেনাপতি। ফলে সে হতোদ্যম হয়ে পড়বে। এমনিভাবে নিজেদের এমন কোনও শক্তির কথা উল্লেখ করা, যা এককালে ছিল বটে, তবে বর্তমানে নেই, কিন্তু শত্রু মনে করবে বর্তমানের কথা বলা হচ্ছে। ফলে তার মনে ভয় সৃষ্টি হবে। বস্তুত সবকালেই যুদ্ধ-বিগ্রহে চাতুর্যের আশ্রয় নেয়া হত। তাই বলা হয়ে থাকে- الحرب خدعة 'যুদ্ধ হল চাতুৰ্য'।২২৮
দ্বিতীয় যে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মিথ্যা বলার অনুমতি দেয়া হয়েছে, তা হচ্ছে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করার কাজ। এ সম্পর্কে উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
আর তৃতীয় হচ্ছে স্ত্রীকে লক্ষ্য করে স্বামীর এবং স্বামীকে লক্ষ্য করে স্ত্রীর কথাবার্তা। পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি ও শান্তিস্থাপনের লক্ষ্যে স্বামী-স্ত্রী প্রয়োজনে মিথ্যা বলতে পারে। যেমন একজন আরেকজনকে লক্ষ্য করে বলল, আমি তোমার চেয়ে আর কাউকে বেশি ভালোবাসি না। প্রকৃতপক্ষে সে তাকে মোটেও ভালোবাসে না। তা সত্ত্বেও এ অসত্য কথা বলা জায়েয বৃহত্তর কল্যাণার্থে। কেননা দাম্পত্যজীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পারস্পরিক সদ্ভাবের উপর নির্ভরশীল। দু'জনের মধ্যে মধুর সম্পর্ক না থাকলে সে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সাধিত তো হয়ই না; উল্টো হাজারও অনূর্ধ ও ফ্যাসাদ ঘিরে ধরে। নানা রকম গুনাহও সংঘটিত হয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে জীবনটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তা থেকে বাঁচার লক্ষ্যে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের কর্তব্য নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব সৃষ্টির চেষ্টা করা। এর জন্য কৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশ করা এমনকি মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন হলে তাও বলা চাই।
এ হাদীছে যদিও তিনটি ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার অবকাশ রাখা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এ অবকাশ এ তিনটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং বৈধ বৃহত্তর যে-কোনও স্বার্থে প্রয়োজনে মিথ্যা বলা যায়। উদাহরণত কোনও নির্দোষ ব্যক্তিকে জালেম শাসকের পাইক-পেয়াদা অনুসন্ধান করলে তাদের কাছ থেকে তাকে গোপন কোনও জায়গায় লুকিয়ে রাখা তারপর বলে দেওয়া যে, সে কোথায় আছে আমি জানি না বা তার সম্পর্কে আমার কাছে কোনও তথ্য নেই। যদিও তার এ কথাটি মিথ্যা, তবুও একজন মুসলিম ভাইকে জালেমের জুলুম থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে এরূপ মিথ্যা বলা কেবল জায়েযই নয়, কর্তব্যও বটে।
এ প্রসঙ্গে ইমাম গাযালী রহ. এর বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, কথা বলাটা হচ্ছে উদ্দেশ্যপূরণের অছিলা। কাজেই কোন মহৎ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যদি সত্য ও মিথ্যা উভয়ই ফলপ্রসূ হয়, তবে সে ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা হারাম, যেহেতু তার প্রয়োজন নেই। যদি মিথ্যা বলারই প্রয়োজন পড়ে, সত্য দ্বারা কাজ না হয় তবে মুবাহ কাজের জন্য মিথ্যা বলা মুবাহ হবে এবং ওয়াজিব কাজের জন্য ওয়াজিব।
তবে স্মরণ রাখতে হবে যে, এটা সর্বশেষ ব্যবস্থা। অপ্রয়োজনে মিথ্যা বলা কিছুতেই জায়েয নয়, যদিও তা মীমাংসার উদ্দেশ্যে বা অন্য কোনও মহৎ লক্ষ্যে হয়। হাদীছের ভাষার মধ্যেই সেদিকে ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা বলা হয়েছে যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে মীমাংসা করতে গিয়ে প্রয়োজনে মিথ্যা বলে সে মিথ্যুক নয়। এর দ্বারাই বোঝা যায় মিথ্যুক হওয়াটা মৌলিকভাবে অত্যন্ত নিন্দনীয়। তা জায়েয রাখা হয়েছে। নিতান্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে। কাজেই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও সর্বপ্রথম চেষ্টাটা সত্য বলার দ্বারাই করা কর্তব্য। দ্বিতীয় পর্যায়ে সরাসরি মিথ্যা না বলে এমন কোনও পন্থা অবলম্বন করা চাই, যা সম্পূর্ণ সত্য না হলেও বিলকুল মিথ্যাও নয়, যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতেও কাজ না হলে শেষ পর্যায়ে মিথ্যা বলার অবকাশ।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা উপলব্ধি করা যায় মানুষের মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি করার কাজটি কত গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু এজন্য প্রয়োজনে মিথ্যা বলারও অবকাশ রাখা হয়েছে।

খ. আপস-নিষ্পত্তি করা যেহেতু একটি মহৎ কাজ, তাই আমাদের কর্তব্য আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এ কাজে অংশগ্রহণ করা।

গ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, যুদ্ধ-বিগ্রহে শক্তিশালী রণসামগ্রীই শেষ কথা নয়; কৌশল ও চাতুর্যও গুরুত্বপূর্ণ।

ঘ. এ হাদীছ দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সদ্ভাব ও মধুর সম্পর্ক রক্ষা করার গুরুত্ব বুঝে আসে, যে কারণে মিথ্যা বলার মত নিন্দনীয় কাজটিরও অবকাশ রাখা হয়েছে।

ঙ. মৌলিকভাবে মিথ্যা বলা কঠিন পাপ। শরীআতসম্মত জরুরত ছাড়া কিছুতেই এ পাপকর্মে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়।

২২৭. সূরা মুমতাহিনা (৬০), আয়াত ১০

২২৮. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩০৩০; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০৬৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ২৬৩৬; সুনানে তিরমিযী, হাদীছ নং ৮৫১০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ২৮৩৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৯৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৩৬৬১; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৯৭৪৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩৭০
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন