কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ
৪৭. ঈমান এবং ঈমানের শাখা প্রশাখার বিবরণ
৫০১৯. বিশর ইবনে খালিদ (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ যে, ব্যক্তির মধ্যে চারটি অভ্যাস থাকবে, সে মুনাফিক। আর যদি ঐ চারটি অভ্যাসের একটি অভ্যাস থাকে, তবে তার মধ্যে একটি নিফাকের অভ্যাস হলো, যতক্ষণ না তা পরিত্যাগ করেঃ সে যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে, কোন ওয়াদা করলে তা খেলাফ করে, যখন কোন অঙ্গীকার করে তা ভঙ্গ করে এবং কারো সাথে ঝগড়া করার সময় গালি দেয়।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এ হাদীছটিতে মুনাফিকের চারটি আলামত বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটি বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনাগুলোর মাঝে বাহ্যত সামান্য বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। মিথ্যা বলা এর দ্বারা মিথ্যা কথা কত গুরুতর পাপ তা অনুমান করা যায়। কেননা প্রকৃত মুনাফিক হচ্ছে একজন সুবিধাবাদী কাফের। সে অন্তরে তার কুফর ও বেঈমানী গোপন রাখে আর বিভিন্ন স্বার্থ ও সুবিধাভোগের খাতিরে নিজেকে মুসলিম বলে জাহির করে। তার সবচে' বড় মিথ্যাচার হচ্ছে কাফের হয়েও নিজেকে মু'মিন ও মুসলিম বলে প্রকাশ করা। এত বড় বিষয়েও যখন সে মিথ্যা বলতে দ্বিধাবোধ করে না, তখন অন্যান্য ক্ষেত্রে তার মিথ্যা বলাটা তো খুবই স্বাভাবিক। মোটকথা মিথ্যা বলাটা মুনাফিকের স্বভাব। কাজেই একজন মুসলিম ব্যক্তির কোনওক্রমেই মিথ্যা বলা উচিত নয়। একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জারাদ রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! মু'মিন কি ব্যাভিচার করতে পারে? তিনি বললেন, হাঁ, কখনও তার দ্বারা এটা ঘটে যেতে পারে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, মু'মিন কি চুরি করতে পারে? তিনি বললেন, হাঁ, এটাও তার দ্বারা কখনও ঘটে যেতে পারে। তাঁর শেষ প্রশ্ন ছিল- يَا نَبِيَّ اللَّهِ ، هَلْ يَكْذِبُ الْمُؤْمِنُ؟ قَالَ: " لَا " . ثُمَّ أَتْبَعَهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ هَذِهِ الْكَلِمَةَ: إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! মু'মিন কি মিথ্যা বলতে পারে? তিনি বললেন, না। এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াত পাঠ করলেন- إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ নিশ্চয়ই মিথ্যা রচনা তো (নবী নয়, বরং) তারাই করে, যারা আল্লাহর আয়াতের উপর ঈমান রাখে না। প্রকৃতপক্ষে তারাই মিথ্যাবাদী। (সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১০৫) (খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ১২৭) মিথ্যা বলাটা এক রকম বিশ্বাসঘাতকতাও বটে। কেননা মিথ্যা যাকে বলা হয়, সে তো সেই কথাটিকে সত্যই মনে করে এবং বক্তাকে সে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু মিথ্যুক ব্যক্তি তার বিশ্বাসের পরিপন্থী কাজ করে। তার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাকে দিয়ে মিথ্যা গ্রহণ করায়। এটা তো মারাত্মক বিশ্বাসঘাতকতা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন- كَبُرَتْ خِيَانَةً أَنْ تُحَدِّثَ أَخَاكَ حَدِيثًا هُوَ لَكَ بِهِ مُصَدِّقٌ، وَأَنْتَ لَهُ بِهِ كَاذِبٌ ‘এটা এক মহা বিশ্বাসঘাতকতা যে, তুমি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে কোনও কথা বলছ আর সে তোমাকে বিশ্বাস করছে, অথচ তুমি তার সঙ্গে মিথ্যা বলছ।' (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৭১; আল-আদাবুল মুফরাদ: ৩৯৩; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক : ১০৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ২০৮৪৬; শু'আবুল ঈমান: ৪৪৭৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৭৯; তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়্যীন: ৪৯৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৭৬৩৫) কোন কোন বর্ণনায় আছে, আমানতের খেয়ানত করা আমানত রক্ষা করা মু'মিন ব্যক্তির এক অপরিহার্য গুণ। আল্লাহ তা'আলা মু'মিনের পরিচয় দিতে গিয়ে যেসকল গুণের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে এটিও একটি। ইরশাদ হয়েছে- وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ ‘এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।' (সূরা মা'আরিজ (৭০), আয়াত ৩২) যেহেতু আমানত রক্ষা মু'মিনের অপরিহার্য গুণ, তাই আমানতের খেয়ানত করতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে- يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং জেনেশুনে নিজেদের আমানতের খেয়ানত করো না। (সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৭) এতে সম্বোধন করা হয়েছে 'মুমিন' বলে। অর্থাৎ খেয়ানত করা মু'মিনের কাজ হতে পারে না। আর আলোচ্য হাদীছ দ্বারা জানা গেল এটা মুনাফিকের আলামত। আমানতের খেয়ানত করা কঠিন পাপ। এক হাদীছ দ্বারা জানা যায়, আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার দ্বারা সব গুনাহ মাফ হয়, কিন্তু আমানতের খেয়ানত করার গুনাহ মাফ হয় না। কিয়ামতের দিন খেয়ানতকারীকে ডেকে বলা হবে, তোমার কাছে যে আমানত রাখা হয়েছিল তা আদায় করো। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! এটা কীভাবে সম্ভব, যখন আমরা দুনিয়া থেকে চলে এসেছি? তখন ঘোষণা করা হবে, একে জাহান্নামে নিয়ে যাও। সুতরাং এহেন কঠিন পাপ থেকে প্রত্যেক মুমিনকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। কোন কোন বর্ণনায় আছে, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা অঙ্গীকার রক্ষা করা ফরয। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে অঙ্গীকার রক্ষার হুকুম দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বিনা ওজরে কিছুতেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করা যাবে না। বিনা ওজরে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা কঠিন পাপ। কুরআন মাজীদে এ বিষয়ে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে- إِنَّ الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَئِكَ لَا خَلَاقَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (77) যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ও নিজেদের কসমের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, আখিরাতে তাদের কোনও অংশ নেই। আর আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে (সদয় দৃষ্টিতে) তাকাবেন না এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য থাকবে কেবল যন্ত্রণাময় শাস্তি। (সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ৭৭) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা এমনই এক পাপ, যা কিয়ামতের দিন চরম লাঞ্ছনারও কারণ হয়ে দাঁড়াবে। হাশরের ময়দানে এরূপ ব্যক্তিকে সমস্ত মানুষের সামনে একজন বিশ্বাসঘাতকরূপে প্রচার করে দেওয়া হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُعْرَفُ بِهِ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের একটি পতাকা থাকবে, যা দ্বারা তাকে চেনা যাবে। (সহীহ বুখারী : ৬৯৬৬; সহীহ মুসলিম: ১৭৩৭; জামে তিরমিযী: ১৫৮১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৮৬৮২; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৮৭২; মুসনাদে আহমাদ: ৫৯৬৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৩৪১০; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৩৫২০; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৭৩৪১) অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, কাফের ও মুশরিকদের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম করা জায়েয নয়। কোনও মুশরিকের সঙ্গে কোনও বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলে মুশরিক নিজে যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভঙ্গ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলিমের জন্যও তা ভঙ্গ করা জায়েয নয়। এ অবস্থায় মুমিন-মুসলিমদের মধ্যে পরস্পরে যেসব বিষয়ে অঙ্গীকার সংঘটিত হয়, তা ভঙ্গ করা কীভাবে জায়েয হতে পারে? সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের এ বিষয়ে সতর্ক থাকা একান্ত জরুরি। কলহ-বিবাদে সীমালঙ্ঘন করা কলহ-বিবাদে সীমালঙ্ঘন করাও মুনাফিকের একটি আলামত। মানুষের মধ্যে কোনও বিষয়ে কলহ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। অর্থ-সম্পদ, জমি-জায়েদাদ ইত্যাদি নিয়ে পরস্পরের মধ্যে বিবাদ দেখা দিতেই পারে। প্রত্যেকেই মনে করে তার দাবি ন্যায্য। নিজ দাবি ন্যায্য মনে করলে তা থেকে সরে দাঁড়ানো সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে করণীয় হল তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ফয়সালা করে নেওয়া কিংবা আদালতের মাধ্যমে বিচার-নিষ্পত্তি করা। তৃতীয় পক্ষ অথবা আদালতের শরণাপন্ন না হয়ে পেশিশক্তির ব্যবহার করা ও মারামারি-হানাহানিতে লিপ্ত হওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়। সেটা সীমালঙ্ঘন। আর কলহ-বিবাদে সীমালঙ্ঘন করা মুনাফিকীর লক্ষণ, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে। দুই পক্ষের প্রত্যেকেই যদি নিজের দাবি সঠিক মনে করে আর এ অবস্থায় কোনও সালিসের উপর ফয়সালার ভার অর্পণ করা হয় কিংবা আদালতে মামলা করা হয়, তখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফাসাদ না করে সালিস বা আদালতের রায়ের অপেক্ষা করা উচিত। ন্যায্য রায় যার পক্ষেই যাবে, উভয়ে তা মেনে নেবে। এর কারণে নিজেদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হতে দেবে না। উভয়পক্ষের মধ্যে আত্মীয়তা থাকলে সে সম্পর্ক যথারীতি রক্ষা করবে। আত্মীয়তা না থাকলে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা দেবে। কোনও অবস্থায়ই নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট করবে না। তা নষ্ট করলে সীমালঙ্ঘন হয়ে যাবে। আর কলহ-বিবাদে সীমালঙ্ঘন করা মুনাফিকের লক্ষণ। অনেক সময় কলহ-বিবাদে মানুষ মিথ্যা কথার আশ্রয় নেয়। যার দাবি অন্যায়, সে তো মিথ্যা বলেই। এমনকি যার দাবি ন্যায্য, সেও জেতার জন্য কখনও কখনও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে। অথচ মিথ্যা কথা বলা মুনাফিকের লক্ষণ ও কঠিন পাপ। কাজেই কলহ-বিবাদ ও মামলা-মোকদ্দমায় কিছুতেই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। তা আশ্রয় নেওয়াটা হবে কলহ-বিবাদে সীমালঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত, যা কিনা মুনাফিকের লক্ষণ। সম্পদ বা অন্য কোনওকিছু নিয়ে যদি বিবাদ দেখা দেয় আর তাতে কোনও এক পক্ষ বুঝতে পারে তার দাবি সঠিক নয়; বরং অপর পক্ষের দাবিই ন্যায্য, সে ক্ষেত্রে মামলা-মোকদ্দমায় না গিয়ে প্রথমেই অপর পক্ষের দাবি মেনে নেওয়া চাই। তা না মানাটা হবে সীমালঙ্ঘন। আর সীমালঙ্ঘন করা মুনাফিকী। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- وَمَنْ خَاصَمَ فِي بَاطِلٍ وَهُوَ يَعْلَمُهُ ، لَمْ يَزَلْ فِي سَخَطِ اللَّهِ حَتَّى يَنْزِعَ عَنْهُ যে ব্যক্তি জেনেশুনে অন্যায় দাবির উপর কলহ-বিবাদ করে, সে আল্লাহ তা'আলার ক্রোধের মধ্যে থাকে, যাবৎ না তা থেকে বিরত হয়। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৫৯৭; মুসনাদে আহমাদ: ৫৩৮৬; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ২২২২ বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১১৪১; শু'আবুল ঈমান : ৬৩০৯) অন্যায় দাবির উপর মামলা করার পর যদি বাদির পক্ষে রায়ও হয়ে যায়, তথাপি তার কর্তব্য নিজ দাবি প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং বিবাদির অধিকার স্বীকার করে নেওয়া। কেননা সে জানে রায় তার পক্ষে হলেও প্রকৃতপক্ষে তার দাবি সঠিক নয়। তাই সে রায়ের ভিত্তিতে সে যে অর্থ-সম্পদ, জমি-জায়েদাদ ইত্যাদি গ্রহণ করবে, তা সম্পূর্ণ হারাম হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- إنَّما أنا بَشَرٌ وإنَّكُمْ تَخْتَصِمُونَ إلَيَّ، ولَعَلَّ بَعْضَكُمْ أنْ يَكونَ ألْحَنَ بحُجَّتِهِ مِن بَعْضٍ، فأقْضِي علَى نَحْوِ ما أسْمَعُ، فمَن قَضَيْتُ له مِن حَقِّ أخِيهِ شيئًا، فلا يَأْخُذْهُ فإنَّما أقْطَعُ له قِطْعَةً مِنَ النَّارِ ‘আমি তো মানুষই। তোমরা আমার কাছে মামলা নিয়ে আস। তোমাদের একজন হয়তো অপরজন অপেক্ষা দলীল-প্রমাণ পেশ করায় বেশি দক্ষ। ফলে আমি যা শুনি সে অনুযায়ী তার পক্ষে রায় দিয়ে দিই। কাজেই আমি তার ভাইয়ের অধিকারের কোনওকিছুতে যদি তার পক্ষে রায় দিই, তবে সে যেন তা গ্রহণ না করে। কেননা আমি সে ক্ষেত্রে তার জন্য জাহান্নামের একটা টুকরা স্থির করে দিই।' (সহীহ বুখারী: ৬৯৬৭; সহীহ মুসলিম: ১৭১৩; জামে তিরমিযী: ১৩৩৯; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৫৯১০; সুনানে আবু দাউদ: ৩৫৮৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৩১৭; মুসনাদে আহমাদ: ১৮২১; মুসনাদুল হুমায়দী : ২৯৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৫৯২০; সুনানে দারা কুতনী: ৪৫৮৪) উল্লেখ্য, কারও দাবি যদি অন্যায় হয়, তবে তার সহযোগিতা করাও জায়েয নয়। কাজেই যে উকিল অন্যায় দাবিদারের পক্ষে মামলা লড়বে, সে নিঃসন্দেহে গুনাহগার হবে। এক হাদীছে ইরশাদ- وَمَنْ أَعَانَ عَلَى خُصُوْمَةٍ بِظُلْمٍ فَقَدْ بَاءَ بِغَضَبٍ مِنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘যে ব্যক্তি অন্যায় মোকদ্দমায় সাহায্য করবে, সে আল্লাহর ক্রোধের পাত্র হবে।' (সুনানে আবু দাউদ: ৩৫৯৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৩১৯; মুসনাদে আহমাদ : ৫৫৪৫; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ২৯২১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক : ৭০৫১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১১৪৪৩; শু'আবুল ঈমান : ৬৩১০) বস্তুত পার্থিব কোনও বিষয় নিয়ে কলহে লিপ্ত হওয়া পসন্দনীয় নয়। নিজ দাবি ন্যায্য না হলে সে ক্ষেত্রে কলহ-বিবাদ তো নয়ই, এমনকি দাবি ন্যায্য হলেও কলহ-বিবাদ থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব রক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে হলেও শান্তি রক্ষা করাই শ্রেয়। এটা অনেক বড় পুণ্যের কাজ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- مَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَهُوَ بَاطِلٌ بُنِيَ لَهُ فِي رَبَضِ الْجَنَّةِ وَمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ وَهُوَ مُحِقٌّ بُنِيَ لَهُ فِي وَسَطِهَا وَمَنْ حَسَّنَ خُلُقَهُ بُنِيَ لَهُ فِي أَعْلَاهَا যে ব্যক্তি মিথ্যা, যা কিনা অন্যায়, পরিহার করে, তার জন্য জান্নাতের কিনারার দিকে প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। যে ব্যক্তি ন্যায়ের উপর থাকা সত্ত্বেও কলহ পরিত্যাগ করে, তার জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। আর যে ব্যক্তি নিজ চরিত্র সুন্দর করে, তার জন্য জান্নাতের উচ্চস্থলে প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। (জামে' তিরমিযী: ১৯৯৩; সুনানে ইবন মাজাহ ৫১; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৪৭: বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫০২) হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. আমরা অবশ্যই আমানত রক্ষায় যত্নবান থাকব। খ. কথাবার্তায় কখনও মিথ্যাচার করব না। গ. অঙ্গীকার রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তা রক্ষায় সচেষ্ট থাকব। ঘ. কারও সঙ্গে বিবাদ করব না। কখনও বিবাদ দেখা দিলে তাতে কিছুতেই সীমালঙ্গন করব না।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন