কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ
৪৭. ঈমান এবং ঈমানের শাখা প্রশাখার বিবরণ
৫০১২. হুমায়দ ইবনে মাসআদা (রাহঃ) ......... আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে কেউই পূর্ণ মু’মিন হবে না, যতক্ষণ না আমি তার সন্তান-সন্ততি, মাতাপিতা এবং সকল লোক হতে তার নিকট অধিক প্রিয় হই।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
একজন মুসলমান পূর্ণ মু'মিন তখনই হতে পারে, যখন দুনিয়ার সকল মানুষ থেকে এমনকি নিজের পিতা-মাতা ও সন্তানাদি থেকেও বেশী ভালবাসা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি থাকবে। এর আগের হাদীসটিতে অন্য সকলের চাইতে আল্লাহর ভালবাসা, রাসূলের ভালবাসা ইসলামের ভালবাসা অধিক হওয়াকে ঈমানের স্বাদ লাভের পূর্বশর্ত বলা হয়েছে। আর এ হাদীসে কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আসল ব্যাপার এই যে, আল্লাহ এবং রাসূলের ভালবাসা এবং ইসলামের ভালবাসার মধ্যে এমন সম্পর্ক রয়েছে যে, এর একটি অন্যটি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। আল্লাহ তা'আলার প্রতি এবং ইসলামের প্রতি খাঁটি ভালবাসা আল্লাহর রাসূলের ভালবাসা ছাড়া সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে আল্লাহর এবং ইসলামের ভালবাসা ব্যতীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসার কল্পনাও করা যায় না। কেননা, রাসূলের প্রতি যে ভালবাসা রাসূল হিসাবে হবে, সেটা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কের কারণেই হবে। আর এর অপরিহার্য ফল এ হবে যে, ইসলামের প্রতিও তার পূর্ণ ভালবাসা থাকবে। এ জন্য এ হাদীসে ঈমানের পূর্ণতার জন্য কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মর্ম উহাই যে, ঈমানের আলো ও এর বরকত কেবল ঐ ভাগ্যবানরাই লাভ করতে পারবে, যাদের অন্তরে আল্লাহ্ এবং রাসূলের ভালবাসা এবং ইসলামের প্রতি ভালবাসা এমন প্রবল যে, এর সামনে অন্য সকল ভালবাসা পরাভূত হয়ে যায়। এ হাদীসসমূহে আল্লাহ্ এবং রাসূলের প্রতি ভালবাসার যে দাবী উল্লেখ করা হয়েছে, এর মর্ম নির্ধারণে হাদীস ব্যাখ্যাতাদের বক্তব্য অভিন্ন নয়। যে কারণে অনেকের পক্ষে এর মর্ম ও উদ্দেশ্য বুঝে উঠা কঠিন হয়ে পড়েছে, অথচ যে বাস্তবতাটি এ হাদীসসমূহে বর্ণনা করা হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার ও সহজ। ভালবাসা একটি পরিচিত শব্দ, আর এর অর্থও সুবিদিত, আর সে অর্থই এখানে উদ্দেশ্য। তবে আল্লাহ এবং রাসূলের সাথে মু'মিনদের যে ভালবাসা হয়ে থাকে, সেটা পিতা-মাতা ও স্ত্রী-পুত্রদের ভালবাসার ন্যায় রক্তের সম্পর্ক অথবা অন্য কোন সহজাত প্রবৃত্তির কারণে হয় না; বরং আত্মিক ও জ্ঞান বিবেচনায় হয়ে থাকে। আর এই ভালবাসা যখন পূর্ণতা লাভ করে, তখন এর বাইরে অন্যান্য ভালবাসা যা মানুষের স্বভাবগত চাহিদা অথবা প্রবৃত্তির কারণে হয়ে থাকে, সেটা এর সামনে পরাজিত ও পরাভূত হয়ে যায়। এ কথাটি প্রত্যেক ঐ ব্যক্তিই বুঝতে পারে, যাকে আল্লাহ্ তা'আলা এর কিছুটা অংশ দিয়ে থাকেন। সারকথা, এসব হাদীসে ভালবাসা দ্বারা অন্তরের ঐ অবস্থাকেই বুঝানো হয়েছে, যা ভালবাসা শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়ে থাকে, আর আমাদের কাছে এ জিনিসটিরই দাবী করা হয়েছে। আসলে এ জিনিসটিই আমাদের ঈমানের প্রাণতুল্য। কুরআন মজীদেও এরশাদ হয়েছে। “ঈমানদাররা সবচেয়ে বেশী ভালবাসা আল্লাহর প্রতিই রাখে।” (সূরা বাকারা) অন্যত্র এরশাদ হয়েছে। “হে নবী। আপনি বলে দিন, যদি তোমাদের পিতা-মাতা, তোমাদের সন্তানাদি, তোমাদের ভাই-বেরাদর, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের গোত্র, তোমাদের কষ্টার্জিত সম্পদ, তোমাদের ঐ চালু ব্যবসা, যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যাকে তোমরা পছন্দ কর, (দুনিয়ার এসব পছন্দনীয় ও আকর্ষণীয় জিনিসসমূহ) আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জেহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তাহলে তোমরা আল্লাহর হুকুম আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর আল্লাহ্ ফাসেক সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।" (সূরা তওবা) অতএব, পবিত্র কুরআনের এ মহত্বপূর্ণ আয়াতের দাবী ও আবেদনও এটাই যে, ঈমানদারদের অন্তরে তাদের সকল প্রিয় জিনিসের চেয়ে আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং তাঁর দ্বীনের ভালবাসা বেশী থাকতে হবে। অন্যথায় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর বিশেষ হেদায়াত লাভ করা সম্ভব হবে না এবং ঈমানের পূর্ণতাও লাভ করা যাবে না। এটা প্রকাশ্য বিষয় যে, যে ব্যক্তি এ সম্পদ ও সৌভাগ্য অর্জন করে নিতে পারবে, তার জন্য ঈমানের সকল দাবী পূরণ করা এবং আল্লাহ ও রাসূলের বিধানের উপর চলা কেবল সহজই হবে না; বরং এ পথে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও সে অন্তরে স্বাদ অনুভব করবে। পক্ষান্তরে যার অন্তরে আল্লাহ ও রাসূলের ভালবাসার এই প্রাবল্য থাকবে না, তার জন্য প্রাত্যহিক ইসলামী বিধান পালন ও ঈমানের সাধারণ দাবী পুরণও কঠিন মনে হবে। সে এ পথে যতটুকু করবে, সেটা কেবল আইন পালন হিসাবেই করবে। এর বেশী কিছু তার কাছে আশা করা যায় না। এ জন্যই বলা হয়েছে যে, যে পর্যন্ত আল্লাহ এবং রাসূলের ভালবাসা অন্য সকল ভালবাসার উপর জয়ী না হবে, সে পর্যন্ত ঈমানের প্রকৃত মর্তবা লাভ করা সম্ভব হবে না এবং ঈমানের স্বাদ এবং মজাও পাওয়া যাবে না। আর হাদীসে স্বীয় সত্তার কথা উল্লেখ করা হয়নি এজন্য যে, তা وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ এর মধ্যে নিহিত রয়েছে। অথবা পিতা ও সন্তান উল্লেখ করার পর স্বীয় সত্তার উল্লেখ করা প্রয়োজন হয়নি এজন্য যে, পিতা ও সন্তান নিজ সত্তার চেয়েও ব্যক্তির নিকট মর্যাদাবান। ইমাম খাত্ত্বাবী বলেনঃ হাদীসে মুহাব্বাত বা ভালোবাসা দ্বারা অভ্যাসগত ভালোবাসা বুঝানো হয়নি। বরং তা দ্বারা ইখতিয়ারী (ইচ্ছাকৃত) ভালোবাসা বুঝানো হয়েছে। কেননা মানুষের পরিবার ও সম্পদের প্রতি ভালোবাসা প্রকৃতিগত ভালোবাসা যা থেকে পরিত্রাণ মানুষের সাধ্যাতীত। তা পরিবর্তন করার কোন পথ নেই। অতএব হাদীসের মর্ম হলো, কোন ব্যক্তি তার ঈমানের দাবীতে সঠিক বলে প্রমাণিত হবে না যতক্ষণ না সে স্বীয় সত্তাকে আমার আনুগত্যের উদ্দেশে উৎসর্গ করবে এবং আমার সন্তুষ্টিকে স্বীয় প্রবৃত্তির উপর প্রাধান্য দিবে। হে আল্লাহ্! তুমি আমাদেরকে তোমার ভালবাসা, তোমার রাসূলের ভালবাসা এবং ঐ কাজের ভালবাসা দান কর, যা আমাদেরকে তোমার ভালবাসা লাভে ধন্য করবে। হাদীসের শিক্ষাঃ ১। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ভালোবাসা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। ২। এ ভালোবাসা অর্জনে মানুষের মধ্যে শ্রেণী বিন্যাস রয়েছে। অর্থাৎ- রসূলের প্রতি ভালোবাসা অর্জনে সকলে একই স্তরের নয়। ৩। রসূলের প্রতি ভালোবাসার কারণে ঈমান বৃদ্ধি পায়। আর তাঁর প্রতি ভালোবাসা কমে গেলে ঈমানও কমে যায় যা দুর্বল ঈমানের আলামত।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন