আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৩৬- যুলুম - নির্যাতন ও কিসাসের অধ্যায়

হাদীস নং: ২২৯২
আন্তর্জাতিক নং: ২৪৫৪
১৫৩৭. যে ব্যক্তি কারো জমির কিছু অংশ যুলম করে নিয়ে নেয় তার গুনাহ
২২৯২। মুসলিম ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) .... সালিম (রাযিঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে সামাণ্য পরিমাণ জমিও নিয়ে নিবে, কিয়ামতের দিন তাকে সাত তবক যমীনের নীচ পর্যন্ত ধসিয়ে দেওয়া হবে।
আবু আব্দুল্লাহ (ইমাম বুখারী) (রাহঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মুরারক (রাহঃ) কর্তৃক খুরাসানে রচিত হাদীসগ্রন্থে এ হাদীসটি নেই। এ হাদীসটি বসরায় লোকজনকে শোনানো হয়েছে।
باب إِثْمِ مَنْ ظَلَمَ شَيْئًا مِنَ الأَرْضِ
2454 - حَدَّثَنَا مُسْلِمُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ المُبَارَكِ، حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ عُقْبَةَ، عَنْ سَالِمٍ، عَنْ أَبِيهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ أَخَذَ مِنَ الْأَرْضِ شَيْئًا بِغَيْرِ حَقِّهِ خُسِفَ بِهِ يَوْمَ القِيَامَةِ إِلَى سَبْعِ أَرَضِينَ» قَالَ أَبُو عَبْدِ اللَّهِ هَذَا الْحَدِيثُ لَيْسَ بِخُرَاسَانَ فِي كِتَابِ ابْنِ الْمُبَارَكِ، أَمْلاَهُ عَلَيْهِمْ بِالْبَصْرَةِ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে অন্যের জমি জবরদখল করা যে কী কঠিন পাপ এবং তার শাস্তি কী কঠোর, সে সম্পর্কে সতর্ক করছেন। তিনি জানাচ্ছেন, যতটুকু জমি জবরদখল করা হয় তাকে সেই জমিতে সাত তবক নিচ পর্যন্ত ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। ফলে প্রত্যেক তবক তার গলার বেড়ির মত হবে। অন্য এক বর্ণনা দ্বারা এ ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছেঃ- সে পরিমাণ জমি তার সাত স্তরসহ জবরদখলকারীর গলায় বেড়ির মত ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।

এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় যমীনের সাতটি স্তর আছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ ‘আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সাত আকাশ এবং তার অনুরূপ পৃথিবীও। এক বিঘত জমি জবরদখল করলে যে তার নিচ থেকে সাত স্তর পর্যন্ত জমি দ্বারা বেড়ি বানিয়ে গলায় পরানো হবে, এর দ্বারা বোঝা যায় আসল মালিকের মালিকানা জমির সাত স্তর নিচ পর্যন্তই প্রতিষ্ঠিত থাকে। অর্থাৎ‍ বৈধ সূত্রে যখন কারও কোনও জমির মালিকানা লাভ হয়, তখন তার ওপর-নিচ সবটাই তার অধিকারভুক্ত হয়ে যায়। ফলে তার অনুমতি ছাড়া ওই জমির উপরে বা নিচে কারও কোনওরূপ হস্তক্ষেপ জায়েয হয় না।

একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা

এ হাদীছ দ্বারা অন্যের জমি জবরদখল করা কী কঠিন গুনাহ তা অনুমান করা যায়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহাবী হযরত সাঈদ ইবন যায়দ রাযি.-এর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার আরওয়া বিনত উওয়াইস নামক এক মহিলা তাঁর বিরুদ্ধে মদীনার গভর্নর মারওয়ান ইবনুল হাকামের নিকট মামলা দায়ের করল যে, সাঈদ তার কিছু জমি দখল করে নিয়েছেন।

মারওয়ান তদন্তের জন্য দুই ব্যক্তিকে সেখানে পাঠিয়ে দেন। তারা এ ব্যাপারে সা'ঈদ রাযি.-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আপনারা কি মনে করেন আমি তার ওপর জুলুম করেছি, অথচ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- যে ব্যক্তি এক বিঘত জমিতে জুলুম করল (অর্থাৎ তা জবরদখল করে নিল), কিয়ামতের দিন তাকে (অর্থাৎ তার গলায়) সাত তবকসহ তার বেড়ি পরানো হবে?

বস্তুত অভিযোগটা একটু কঠিনই ছিল। তাও এক মহান সাহাবীর বিরুদ্ধে, যিনি কিনা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ওই দশ সাহাবীর একজন, যাঁরা 'আশারায়ে মুবাশশারা' নামে সুবিখ্যাত। এরকম এক মহান সাহাবীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সত্য হলে তারপর আর কার ওপর মানুষের আস্থা থাকবে? মহান সাহাবীগণের মাধ্যমে আমরা দীন পেয়েছি। তাদের প্রতি আস্থা নড়বড়ে হয়ে গেলে তো গোটা দীনের ইমারতই নড়বড়ে হয়ে যায়। কী ভয়ংকর দুঃসংবাদ। এর সত্যাসত্য প্রমাণ হয়ে যাওয়ার দরকার ছিল। হযরত সা'ঈদ ইব্ন যায়দ রাযি.-এর দু'আর মাধ্যমে তা প্রমাণ হয়ে গেল।

সুতরাং সাঈদ রাযি, দু'আ করলেন, হে আল্লাহ! সে যদি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে থাকে, তবে তাকে অন্ধ না করে মৃত্যু দিও না, তার বাড়ির কুয়ার মধ্যেই তার কবরের ব্যবস্থা কর। তাঁর এ দু'আ আল্লাহ তা'আলা কবূল করেন। ফলে শীঘ্রই আরওয়ার দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় একদিন সে নিজ বাড়ির আঙিনায় হাঁটাচলা করছিল। আঙিনায় ছিল একটি গভীর কুয়া। হাঁটতে হাঁটতে সে ওই কুয়ার মধ্যে পড়ে গেল। সেখান থেকে তার আর উঠে আসা সম্ভব হয়নি। ওই কুয়াই তার কবরে পরিণত হল।

পরবর্তীকালে এ ঘটনাটি একটি প্রবাদে পরিণত হয়ে যায়। দুই ব্যক্তির মধ্যে কোনও বিষয়ে কলহ ঘটলে তাদের একজন অন্যজনকে লক্ষ্য করে বলত- আল্লাহ তোমাকে আরওয়ার মত অন্ধ করে দিন।
বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ এভাবেই তাঁর শিক্ষা মেনে চলতেন এবং তাঁর শিক্ষা মেনে চলাকে জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য মনে করতেন। আমাদেরও কর্তব্য তাঁদের অনুসরণে দীনের যাবতীয় বিধানাবলী পালনে সচেষ্ট থাকা। তাতেই দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের সফলতা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় জুলুম করা একটি কঠিন পাপ।

খ. অন্যের জমি কোনও অবস্থায়ই অন্যায়ভাবে দখল করা উচিত নয়, তাতে তার পরিমাণ যত কমই হোক, যেহেতু তার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন।

গ. জমির মালিকের অধিকার উপরের শূন্যমণ্ডল এবং নিচের গভীরতম স্তর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত থাকে। কাজেই তার অনুমতি ছাড়া অন্য কারও জন্য সে জমি বরাবর উপরের শূন্যস্থান ও তার নিচের স্তর ব্যবহার করা জায়েয নয়।

ঘ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় আল্লাহ তা'আলা ভূমিকে সাত স্তরবিশিষ্ট করে সৃষ্টি করেছেন।

ঙ. আরও জানা যায়, দুনিয়ায় মানুষের অপরাধের ধরন যেমন হয়, তার সাথে আখিরাতের শাস্তিরও মিল থাকবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)