আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৩৬- যুলুম - নির্যাতন ও কিসাসের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৪৫৩
১৫৩৭. যে ব্যক্তি কারো জমির কিছু অংশ যুলম করে নিয়ে নেয় তার গুনাহ
২২৯১। আবু মা‘মার (রাহঃ) .... আবু সালামা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেন যে, তাঁর এবং কয়েকজন লোকের মধ্যে একটি বিবাদ ছিল। আয়িশা (রাযিঃ) এর কাছে উল্লেখ করা হলে তিনি বললেন, হে আবু সালামা! জমির ব্যাপারে সতর্ক থাক। কেননা নবী (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি এক বিঘত জমি অন্যায়ভাবে নিয়ে নেয়, (কিয়ামতের দিন) এর সাত তবক জমি তার গলায় লটকিয়ে দেওয়া হবে।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে অন্যের জমি জবরদখল করা যে কী কঠিন পাপ এবং তার শাস্তি কী কঠোর, সে সম্পর্কে সতর্ক করছেন। তিনি জানাচ্ছেন, যতটুকু জমি জবরদখল করা হয় সে পরিমাণ জমি তার সাত স্তরসহ জবরদখলকারীর গলায় বেড়ির মত ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।
উলামায়ে কিরাম এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ বলেন, এর দ্বারা বাহ্যত যে অর্থ বোঝা যাচ্ছে, বাস্তবিকভাবে সেটাই করা হবে। ওই পরিমাণ জমির বেড়ি বানিয়ে তার গলায় পরিয়ে দেওয়া হবে আর সে তা বয়ে বেড়াতে থাকবে। এটা হবে তার জমি জবরদখল করার শাস্তি। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে যাকাত না দেওয়ার শাস্তি। কেউ যদি যাকাত দিতে কার্পণ্য করে, তবে সে যে মালের যাকাত দেবে না তা দ্বারা বেড়ি বানিয়ে তার গলায় পরিয়ে দেওয়া হবে। যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ-
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
আল্লাহপ্রদত্ত অনুগ্রহে (সম্পদে) যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে, এটা তাদের জন্য ভালো কিছু। বরং এটা তাদের পক্ষে অতি মন্দ। যে সম্পদের ভেতর তারা কৃপণতা করে, কিয়ামতের দিন তাকে তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে। (সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৮০)
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, মানুষের এ ছোট গলায় এত বড় বেড়ি কিভাবে পরানো হবে? তার উত্তর হচ্ছে, সেদিন জাহান্নামীদের গলাও এমন বড় করে দেওয়া হবে, যাতে সেরকম বড় বড় বেড়ি পরানো যায়। যেমন এক হাদীছে জাহান্নামীদের চামড়া ও দাঁত সম্পর্কে জানানো হয়েছে-
إن غلظ جلد الكافر اثنان وأربعون ذراعا، وإن ضرسه مثل أحد، وإن مجلسه من جهنم كما بين مكة والمدينة
(জাহান্নামে) কাফের ব্যক্তির চামড়া বিয়াল্লিশ হাত পরিমাণ মোটা হবে, তার দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের মত এবং জাহান্নামে তার বসার স্থান হবে মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী দূরত্ব পরিমাণ। (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫৭৭: মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৮৭৬০; বায়হাকী, আল-আসমা ওয়াস-সিফাত, হাদীছ নং ৭৪৩)
কেউ বলেন এর অর্থ হচ্ছে- কিয়ামতের দিন তাকে ওই পরিমাণ জমি টেনে নিয়ে হাশরের ময়দানে নিয়ে যেতে হুকুম করা হবে। ফলে এ জমি তার গলার বেড়ির মত হবে। বাস্তবিকই বেড়ি হবে তা নয়। একটি হাদীছ দ্বারাও এ ব্যাখ্যা সমর্থন মেলে।
ইরশাদ হয়েছেঃ-
من أخذ من طريق المسلمين شبرا، جاء يوم القيامة يحمله من سبع أرضين.
যে ব্যক্তি মুসলমানদের রাস্তা থেকে এক বিঘত পরিমাণ জমি দখল করে নেয়, কিয়ামতের দিন সে সাত তবক জমিসহ সেই জমির ভার বহন করা অবস্থায় উপস্থিত হবে। (তাবারানী, আল-মু'জামুস সাগীর, হাদীছ নং ১১৯৭; ফাতহুল বারী, খ. ৫, পৃ. ১৩০)
কারও মতে এর অর্থ- তাকে সেই জমিতে সাত তবক নিচ পর্যন্ত ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। ফলে প্রত্যেক তবক তার গলার বেড়ির মত হবে। অন্য এক বর্ণনা দ্বারা এ ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছেঃ-
من أخذ من الأرض شيئا بغير حقه خسف به يوم القيامة إلى سبع أرضين
যে ব্যক্তি জমির কোনও অংশ অন্যায়ভাবে দখল করে, কিয়ামতের দিন তাকে সাত স্তর জমি পর্যন্ত ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৪৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৭৪০: বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২১৬৬)
কেউ বলেন, এর অর্থ হচ্ছে তাকে সাত স্তর ভূমি দ্বারা বেড়ি বানানোর হুকুম দেওয়া হবে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে তা বানাতে সক্ষম হবে না। এভাবে সে চেষ্টা করতেই থাকবে, যা দ্বারা সে অবর্ণনীয় কষ্ট পাবে। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে মিথ্যা স্বপ্ন বলার শাস্তি। যেমন হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ-
من تحلم بحلم لم يره كلف أن يعقد بين شعيرتين ولن يفعل
যে ব্যক্তি কোনও স্বপ্ন না দেখেও তা দেখেছে বলে বর্ণনা করে, তাকে দুটি জবের মধ্যে গিঠ দিতে হুকুম করা হবে। (সে অশেষ কষ্টের সাথে চেষ্টা করতে থাকবে,) কিন্তু সে তা দিতে সক্ষম হবে না। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭০৪২: জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২২৮৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৫০২৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৬৬; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৬৮৫; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৮১৮৫)
এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় যমীনের সাতটি স্তর আছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ
আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সাত আকাশ এবং তার অনুরূপ পৃথিবীও। (সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ১২)
এক বিঘত জমি জবরদখল করলে যে তার নিচ থেকে সাত স্তর পর্যন্ত জমি দ্বারা বেড়ি বানিয়ে গলায় পরানো হবে, এর দ্বারা বোঝা যায় আসল মালিকের মালিকানা জমির সাত স্তর নিচ পর্যন্তই প্রতিষ্ঠিত থাকে। অর্থাৎ বৈধ সূত্রে যখন কারও কোনও জমির মালিকানা লাভ হয়, তখন তার ওপর-নিচ সবটাই তার অধিকারভুক্ত হয়ে যায়। ফলে তার অনুমতি ছাড়া ওই জমির উপরে বা নিচে কারও কোনওরূপ হস্তক্ষেপ জায়েয হয় না।
একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা
এ হাদীছ দ্বারা অন্যের জমি জবরদখল করা কী কঠিন গুনাহ তা অনুমান করা যায়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহাবী হযরত সাঈদ ইবন যায়দ রাযি.-এর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার আরওয়া বিনত উওয়াইস নামক এক মহিলা তাঁর বিরুদ্ধে মদীনার গভর্নর মারওয়ান ইবনুল হাকামের নিকট মামলা দায়ের করল যে, সাঈদ তার কিছু জমি দখল করে নিয়েছেন।
মারওয়ান তদন্তের জন্য দুই ব্যক্তিকে সেখানে পাঠিয়ে দেন। তারা এ ব্যাপারে সা'ঈদ রাযি.-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আপনারা কি মনে করেন আমি তার ওপর জুলুম করেছি, অথচ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- যে ব্যক্তি এক বিঘত জমিতে জুলুম করল (অর্থাৎ তা জবরদখল করে নিল), কিয়ামতের দিন তাকে (অর্থাৎ তার গলায়) সাত তবকসহ তার বেড়ি পরানো হবে?
বস্তুত অভিযোগটা একটু কঠিনই ছিল। তাও এক মহান সাহাবীর বিরুদ্ধে, যিনি কিনা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ওই দশ সাহাবীর একজন, যাঁরা 'আশারায়ে মুবাশশারা' নামে সুবিখ্যাত। এরকম এক মহান সাহাবীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সত্য হলে তারপর আর কার ওপর মানুষের আস্থা থাকবে? মহান সাহাবীগণের মাধ্যমে আমরা দীন পেয়েছি। তাদের প্রতি আস্থা নড়বড়ে হয়ে গেলে তো গোটা দীনের ইমারতই নড়বড়ে হয়ে যায়। কী ভয়ংকর দুঃসংবাদ। এর সত্যাসত্য প্রমাণ হয়ে যাওয়ার দরকার ছিল। হযরত সা'ঈদ ইব্ন যায়দ রাযি.-এর দু'আর মাধ্যমে তা প্রমাণ হয়ে গেল।
সুতরাং সাঈদ রাযি, দু'আ করলেন, হে আল্লাহ! সে যদি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে থাকে, তবে তাকে অন্ধ না করে মৃত্যু দিও না, তার বাড়ির কুয়ার মধ্যেই তার কবরের ব্যবস্থা কর। তাঁর এ দু'আ আল্লাহ তা'আলা কবূল করেন। ফলে শীঘ্রই আরওয়ার দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় একদিন সে নিজ বাড়ির আঙিনায় হাঁটাচলা করছিল। আঙিনায় ছিল একটি গভীর কুয়া। হাঁটতে হাঁটতে সে ওই কুয়ার মধ্যে পড়ে গেল। সেখান থেকে তার আর উঠে আসা সম্ভব হয়নি। ওই কুয়াই তার কবরে পরিণত হল।
পরবর্তীকালে এ ঘটনাটি একটি প্রবাদে পরিণত হয়ে যায়। দুই ব্যক্তির মধ্যে কোনও বিষয়ে কলহ ঘটলে তাদের একজন অন্যজনকে লক্ষ্য করে বলত- আল্লাহ তোমাকে আরওয়ার মত অন্ধ করে দিন।
বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ এভাবেই তাঁর শিক্ষা মেনে চলতেন এবং তাঁর শিক্ষা মেনে চলাকে জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য মনে করতেন। আমাদেরও কর্তব্য তাঁদের অনুসরণে দীনের যাবতীয় বিধানাবলী পালনে সচেষ্ট থাকা। তাতেই দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের সফলতা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় জুলুম করা একটি কঠিন পাপ।
খ. অন্যের জমি কোনও অবস্থায়ই অন্যায়ভাবে দখল করা উচিত নয়, তাতে তার পরিমাণ যত কমই হোক, যেহেতু তার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন।
গ. জমির মালিকের অধিকার উপরের শূন্যমণ্ডল এবং নিচের গভীরতম স্তর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত থাকে। কাজেই তার অনুমতি ছাড়া অন্য কারও জন্য সে জমি বরাবর উপরের শূন্যস্থান ও তার নিচের স্তর ব্যবহার করা জায়েয নয়।
ঘ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় আল্লাহ তা'আলা ভূমিকে সাত স্তরবিশিষ্ট করে সৃষ্টি করেছেন।
ঙ. আরও জানা যায়, দুনিয়ায় মানুষের অপরাধের ধরন যেমন হয়, তার সাথে আখিরাতের শাস্তিরও মিল থাকবে।
উলামায়ে কিরাম এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ বলেন, এর দ্বারা বাহ্যত যে অর্থ বোঝা যাচ্ছে, বাস্তবিকভাবে সেটাই করা হবে। ওই পরিমাণ জমির বেড়ি বানিয়ে তার গলায় পরিয়ে দেওয়া হবে আর সে তা বয়ে বেড়াতে থাকবে। এটা হবে তার জমি জবরদখল করার শাস্তি। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে যাকাত না দেওয়ার শাস্তি। কেউ যদি যাকাত দিতে কার্পণ্য করে, তবে সে যে মালের যাকাত দেবে না তা দ্বারা বেড়ি বানিয়ে তার গলায় পরিয়ে দেওয়া হবে। যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ-
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
আল্লাহপ্রদত্ত অনুগ্রহে (সম্পদে) যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে, এটা তাদের জন্য ভালো কিছু। বরং এটা তাদের পক্ষে অতি মন্দ। যে সম্পদের ভেতর তারা কৃপণতা করে, কিয়ামতের দিন তাকে তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে। (সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৮০)
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, মানুষের এ ছোট গলায় এত বড় বেড়ি কিভাবে পরানো হবে? তার উত্তর হচ্ছে, সেদিন জাহান্নামীদের গলাও এমন বড় করে দেওয়া হবে, যাতে সেরকম বড় বড় বেড়ি পরানো যায়। যেমন এক হাদীছে জাহান্নামীদের চামড়া ও দাঁত সম্পর্কে জানানো হয়েছে-
إن غلظ جلد الكافر اثنان وأربعون ذراعا، وإن ضرسه مثل أحد، وإن مجلسه من جهنم كما بين مكة والمدينة
(জাহান্নামে) কাফের ব্যক্তির চামড়া বিয়াল্লিশ হাত পরিমাণ মোটা হবে, তার দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের মত এবং জাহান্নামে তার বসার স্থান হবে মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী দূরত্ব পরিমাণ। (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫৭৭: মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৮৭৬০; বায়হাকী, আল-আসমা ওয়াস-সিফাত, হাদীছ নং ৭৪৩)
কেউ বলেন এর অর্থ হচ্ছে- কিয়ামতের দিন তাকে ওই পরিমাণ জমি টেনে নিয়ে হাশরের ময়দানে নিয়ে যেতে হুকুম করা হবে। ফলে এ জমি তার গলার বেড়ির মত হবে। বাস্তবিকই বেড়ি হবে তা নয়। একটি হাদীছ দ্বারাও এ ব্যাখ্যা সমর্থন মেলে।
ইরশাদ হয়েছেঃ-
من أخذ من طريق المسلمين شبرا، جاء يوم القيامة يحمله من سبع أرضين.
যে ব্যক্তি মুসলমানদের রাস্তা থেকে এক বিঘত পরিমাণ জমি দখল করে নেয়, কিয়ামতের দিন সে সাত তবক জমিসহ সেই জমির ভার বহন করা অবস্থায় উপস্থিত হবে। (তাবারানী, আল-মু'জামুস সাগীর, হাদীছ নং ১১৯৭; ফাতহুল বারী, খ. ৫, পৃ. ১৩০)
কারও মতে এর অর্থ- তাকে সেই জমিতে সাত তবক নিচ পর্যন্ত ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। ফলে প্রত্যেক তবক তার গলার বেড়ির মত হবে। অন্য এক বর্ণনা দ্বারা এ ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছেঃ-
من أخذ من الأرض شيئا بغير حقه خسف به يوم القيامة إلى سبع أرضين
যে ব্যক্তি জমির কোনও অংশ অন্যায়ভাবে দখল করে, কিয়ামতের দিন তাকে সাত স্তর জমি পর্যন্ত ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৪৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৭৪০: বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২১৬৬)
কেউ বলেন, এর অর্থ হচ্ছে তাকে সাত স্তর ভূমি দ্বারা বেড়ি বানানোর হুকুম দেওয়া হবে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে তা বানাতে সক্ষম হবে না। এভাবে সে চেষ্টা করতেই থাকবে, যা দ্বারা সে অবর্ণনীয় কষ্ট পাবে। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে মিথ্যা স্বপ্ন বলার শাস্তি। যেমন হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ-
من تحلم بحلم لم يره كلف أن يعقد بين شعيرتين ولن يفعل
যে ব্যক্তি কোনও স্বপ্ন না দেখেও তা দেখেছে বলে বর্ণনা করে, তাকে দুটি জবের মধ্যে গিঠ দিতে হুকুম করা হবে। (সে অশেষ কষ্টের সাথে চেষ্টা করতে থাকবে,) কিন্তু সে তা দিতে সক্ষম হবে না। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭০৪২: জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২২৮৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৫০২৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৬৬; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৬৮৫; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৮১৮৫)
এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় যমীনের সাতটি স্তর আছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ
আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সাত আকাশ এবং তার অনুরূপ পৃথিবীও। (সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ১২)
এক বিঘত জমি জবরদখল করলে যে তার নিচ থেকে সাত স্তর পর্যন্ত জমি দ্বারা বেড়ি বানিয়ে গলায় পরানো হবে, এর দ্বারা বোঝা যায় আসল মালিকের মালিকানা জমির সাত স্তর নিচ পর্যন্তই প্রতিষ্ঠিত থাকে। অর্থাৎ বৈধ সূত্রে যখন কারও কোনও জমির মালিকানা লাভ হয়, তখন তার ওপর-নিচ সবটাই তার অধিকারভুক্ত হয়ে যায়। ফলে তার অনুমতি ছাড়া ওই জমির উপরে বা নিচে কারও কোনওরূপ হস্তক্ষেপ জায়েয হয় না।
একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা
এ হাদীছ দ্বারা অন্যের জমি জবরদখল করা কী কঠিন গুনাহ তা অনুমান করা যায়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহাবী হযরত সাঈদ ইবন যায়দ রাযি.-এর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার আরওয়া বিনত উওয়াইস নামক এক মহিলা তাঁর বিরুদ্ধে মদীনার গভর্নর মারওয়ান ইবনুল হাকামের নিকট মামলা দায়ের করল যে, সাঈদ তার কিছু জমি দখল করে নিয়েছেন।
মারওয়ান তদন্তের জন্য দুই ব্যক্তিকে সেখানে পাঠিয়ে দেন। তারা এ ব্যাপারে সা'ঈদ রাযি.-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আপনারা কি মনে করেন আমি তার ওপর জুলুম করেছি, অথচ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- যে ব্যক্তি এক বিঘত জমিতে জুলুম করল (অর্থাৎ তা জবরদখল করে নিল), কিয়ামতের দিন তাকে (অর্থাৎ তার গলায়) সাত তবকসহ তার বেড়ি পরানো হবে?
বস্তুত অভিযোগটা একটু কঠিনই ছিল। তাও এক মহান সাহাবীর বিরুদ্ধে, যিনি কিনা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ওই দশ সাহাবীর একজন, যাঁরা 'আশারায়ে মুবাশশারা' নামে সুবিখ্যাত। এরকম এক মহান সাহাবীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সত্য হলে তারপর আর কার ওপর মানুষের আস্থা থাকবে? মহান সাহাবীগণের মাধ্যমে আমরা দীন পেয়েছি। তাদের প্রতি আস্থা নড়বড়ে হয়ে গেলে তো গোটা দীনের ইমারতই নড়বড়ে হয়ে যায়। কী ভয়ংকর দুঃসংবাদ। এর সত্যাসত্য প্রমাণ হয়ে যাওয়ার দরকার ছিল। হযরত সা'ঈদ ইব্ন যায়দ রাযি.-এর দু'আর মাধ্যমে তা প্রমাণ হয়ে গেল।
সুতরাং সাঈদ রাযি, দু'আ করলেন, হে আল্লাহ! সে যদি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে থাকে, তবে তাকে অন্ধ না করে মৃত্যু দিও না, তার বাড়ির কুয়ার মধ্যেই তার কবরের ব্যবস্থা কর। তাঁর এ দু'আ আল্লাহ তা'আলা কবূল করেন। ফলে শীঘ্রই আরওয়ার দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় একদিন সে নিজ বাড়ির আঙিনায় হাঁটাচলা করছিল। আঙিনায় ছিল একটি গভীর কুয়া। হাঁটতে হাঁটতে সে ওই কুয়ার মধ্যে পড়ে গেল। সেখান থেকে তার আর উঠে আসা সম্ভব হয়নি। ওই কুয়াই তার কবরে পরিণত হল।
পরবর্তীকালে এ ঘটনাটি একটি প্রবাদে পরিণত হয়ে যায়। দুই ব্যক্তির মধ্যে কোনও বিষয়ে কলহ ঘটলে তাদের একজন অন্যজনকে লক্ষ্য করে বলত- আল্লাহ তোমাকে আরওয়ার মত অন্ধ করে দিন।
বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ এভাবেই তাঁর শিক্ষা মেনে চলতেন এবং তাঁর শিক্ষা মেনে চলাকে জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য মনে করতেন। আমাদেরও কর্তব্য তাঁদের অনুসরণে দীনের যাবতীয় বিধানাবলী পালনে সচেষ্ট থাকা। তাতেই দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের সফলতা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় জুলুম করা একটি কঠিন পাপ।
খ. অন্যের জমি কোনও অবস্থায়ই অন্যায়ভাবে দখল করা উচিত নয়, তাতে তার পরিমাণ যত কমই হোক, যেহেতু তার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন।
গ. জমির মালিকের অধিকার উপরের শূন্যমণ্ডল এবং নিচের গভীরতম স্তর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত থাকে। কাজেই তার অনুমতি ছাড়া অন্য কারও জন্য সে জমি বরাবর উপরের শূন্যস্থান ও তার নিচের স্তর ব্যবহার করা জায়েয নয়।
ঘ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় আল্লাহ তা'আলা ভূমিকে সাত স্তরবিশিষ্ট করে সৃষ্টি করেছেন।
ঙ. আরও জানা যায়, দুনিয়ায় মানুষের অপরাধের ধরন যেমন হয়, তার সাথে আখিরাতের শাস্তিরও মিল থাকবে।
