কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ

১৯. দু' ঈদের নামাযের বর্ণনা

হাদীস নং: ১৫৫৬
আন্তর্জাতিক নং: ১৫৫৬
উভয় ঈদের নামায
১৫৫৯। আলী ইবনে হুজর (রাহঃ) ......... আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জাহিলীয়াত যুগের অধিবাসীদের জন্য প্রত্যেক বৎসরে দু’টি দিন ছিল, যাতে তারা খেল-তামশা করতো। যিখন নবী (ﷺ) মদীনায় আগমন করলেন তখন তিনি বললেন, তোমাদের জন্য দু’টি দিন ছিল, যাতে তোমরা খেল-তামাশা করতে। এখন আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য উক্ত দু’দিনের পরিবর্তে তার চেয়েও অধিকতর উত্তম দু’টি দিন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, ঈদুল ফিতরের দিন এবং কুরবানীর দিন।
باب
أَخْبَرَنَا عَلِيُّ بْنُ حُجْرٍ، قَالَ أَنْبَأَنَا إِسْمَاعِيلُ، قَالَ حَدَّثَنَا حُمَيْدٌ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ كَانَ لأَهْلِ الْجَاهِلِيَّةِ يَوْمَانِ فِي كُلِّ سَنَةٍ يَلْعَبُونَ فِيهِمَا فَلَمَّا قَدِمَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم الْمَدِينَةَ قَالَ " كَانَ لَكُمْ يَوْمَانِ تَلْعَبُونَ فِيهِمَا وَقَدْ أَبْدَلَكُمُ اللَّهُ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا يَوْمَ الْفِطْرِ وَيَوْمَ الأَضْحَى " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, জাহেলী যুগের দুটি আনন্দের দিনের পরিবর্তে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকেও দুটি আনন্দের দিন তথা ঈদের দিন দান করেছেন। সুতরাং বাৎসরিক ঈদ দু’টির পরিবর্তে তিনটি হলে অতিরিক্তটি ইসলাম বহির্ভূত ঈদ হবে। অনেকে ঈদে মিলাদুন্নবী নামে আরো একটি ঈদ পালন করে থাকে। কুরআন ও হাদীসে এ নামে কোন ঈদের অস্তিত্ব নেই।

সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ও ঈদ পালনের বিধানঃ

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ তিনি উম্মিদের মধ্যে তাদেরই থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন। (ছূরা জুমআহ-২)। এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, রসূলে কারীম স. নিজেও উম্মি তথা নিরক্ষর ছিলেন এবং আল্লাহ তাআলা তাঁকে যাদের নিকট পাঠিয়েছিলেন তারাও নিরক্ষর ছিলো। আবার রসূলুল্লাহ স. নিজে বলেন, إِنَّا أُمَّةٌ أُمِّيَّةٌ، لاَ نَكْتُبُ وَلاَ نَحْسُبُ، আমরা উম্মি উম্মাত, হিসাব-কিতাব জানি না। (বুখারী-১৭৯২)। অথাৎ ইবাদতের ক্ষেত্রে আমরা এষ্ট্রোনোমি অর্থাৎ জ্যোতির্বিদ্যা-এর সূক্ষ ম্যারপ্যাচে না পড়ে চাড়্গুশ দর্শনের ভিত্তিতে চাঁদ দেখে রোজা রাখি। বর্তমান যুগের আধুনিক প্রযুক্তির কোন কিছুই সে যুগে বিদ্যমান ছিলো না। আর প্রযুক্তি শিখানো বা এ শিক্ষার প্রতি উৎসাহ দেয়ার জন্যও তিনি প্রেরিত হননি। বরং তিনি নিজে অকপটে স্বীকার করেছেন যে, أَنْتُمْ أَعْلَمُ بِأَمْرِ دُنْيَاكُمْ “তোমাদের দুনিয়ার (উন্নতি/অবনতির) বিষয় তোমরা ভালো বুঝো”। (মুসলিম-৫৯১৬)। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا আমি আপনাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি। (ছূরা সাবা-২৮)। এ আয়াতের ভাষ্য মতে মুহাম্মাদ স.কে আল্লাহ তাআলা কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। মানুষের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, প্রযুক্তি ব্যবহারকারী-বর্জনকারী সব শ্রেণীর মানুষই ছিলো, আছে এবং থাকবে। তাই শরীআতের কোন বিধি-বিধানের ভিত্তি প্রযুক্তির উপরে নয়। বরং সকল বিধি-বিধানের ভিত্তিই হলো ইন্দ্রিয়ানুভূতির উপর। নামাযের সময় নির্ধারণ, সাহরীর শেষ সময় এবং ইফতারের সময় নির্ধারণসহ সকল বিধি-বিধানের ভিত্তিই হলো ইন্দ্রিয়ানুভূতির উপর। এ ধারাবাহিকতার ব্যতিক্রম ঘটেনি রোজা বা ঈদের চাঁদ দেখার ক্ষেত্রেও। তাই রসূলু্ল্লাহ স. বলেন, لاَ تَصُومُوا حَتَّى تَرَوُا الْهِلَالَ، وَلاَ تُفْطِرُوا حَتَّى تَرَوْهُ، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَاقْدُرُوا لَهُ তোমরা চাঁদ না দেখে রোজা রেখো না এবং চাঁদ না দেখে রোজা ছেড়ো না। আর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় তাহলে মাসের গণনা (৩০ দিন) পূর্ণ করো। (বুখারী-১৭৮৫)। রসূলু্ল্লাহ স.-এর এ হাদীস দ্বারা এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, মেঘের কারণে চাঁদ দেখতে না পারলে ধরে নাও যে, মাস ৩০ দিনে হচ্ছে। চাঁদের জন্ম হিসাব করা, মেঘ অতিক্রম করতে উঁচু পাহাড়ে আরোহণ করা বা সম্ভব হলে কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করাসহ কোন কিছু না বলে তিনি সরাসরি বলে দিলেন যে, মাসের গণনা ৩০ দিন পূর্ণ করে নাও। তিনি অন্য কোন সম্ভাবনাকে আমলে নেননি। অথচ হতে পারে যে, আকাশে চাঁদ ঠিকই উঠেছিলো কিন্তু মেঘের কারণে তা দৃষ্টিগোচর হয়নি।
রসূলু্ল্লাহ স. এ হাদীসে ঘোষণা করেছেন যে, চাঁদ না দেখে রোজা রাখা যাবে না। বরং চাঁদ দেখেই রোজা রাখতে হবে। এখন চাঁদ দেখা হতে পারে সরাসরি অথবা বিধানগতভাবে। সরাসরি চাঁদ দেখার অর্থ স্পষ্ট। আর বিধানগতভাবে চাঁদ দেখার ব্যাখ্যা হলো কোন ব্যক্তির অবস্থান এমন যায়গায় হওয়া যেখান থেকে আকাশ পরিস্কার থাকলে চাঁদ দেখা যেতো। কিন্তু হয়তো আকাশ মেঘলা ছিলো অথবা সে ইচ্ছা করে দেখেনি কিংবা লোকটি অন্ধ তাই দেখতে পারেনি। এ সকল ড়্গেত্রে বিধানগতভাবে সে চাঁদ দেখেছে বলে ধরে নেয়া হবে।
উপরিউক্ত দুটি পদ্ধতির কোন পদ্ধতিতেই যদি চাঁদ দেখা প্রমাণিত না হয় তাহলে বুখারী-১৭৮৫ নং হাদীসে বর্ণিত রসূলু্ল্লাহ স.-এর ঘোষণা মোতাবেক তার রোজা রাখা বা ছাড়ার কোন সুযোগ নেই। কোন ব্যক্তির অবস্থান যদি এমন স্থানে থাকে যে স্থানের আকাশ মেঘমুক্ত ছিলো এতদ্‌সত্ত্বেও মানুষ চেষ্টা করে চাঁদ দেখতে পারেনি তাহলে সে স্থানের মানুষের চাঁদ দেখা সরাসরিও প্রমাণিত হয় না। আর বিধানগতভাবেও প্রমাণিত হয় না। এমন স্থানে যদি কেউ রমাযানের রোজা রাখে বা ছাড়ে তাহলে সে ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে বুখারী-১৭৮৫ নং হাদীসে বর্ণিত রসূলু্ল্লাহ স.-এর নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলো।
হ্যাঁ, কোন রাষ্ট্রের পরিধি যদি পূর্ব-পশ্চিমে এত দীর্ঘ হয় যে, তার পশ্চিম প্রান্তে চাঁদ দেখা গেলেও পূর্ব প্রান্তে দেখা যায় না। তাহলে সাধারণ মুসলমানদের প্রতিনিধি মুসলিম শাসকবর্গের নিকট নির্ভরযোগ্য সূত্রে চাঁদ উঠা প্রমাণিত হওয়ায় তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করলে ঐ সরকারের অধীনে বসবাসকারী সকলের জন্য বিধানগতভাবে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হবে বলে কোন কোন আলেম মত দিয়েছেন। তাদের মতে অমুসলিম রাষ্ট্রে উলামায়ে কিরামের পক্ষ থেকে চাঁদ দেখার ঘোষণা রাষ্ট্রীয় ঘোষণার মান রাখে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এটা মানা যেতে পারে। কেননা রোজা ও ঈদ পালন একটি সম্মিলিত ইবাদাত। তাই এটা পালনে একই রাষ্ট্রের মানুষ দুই বা ততাধিক ভাগে বিভক্ত হওয়া শরীআতের চাহিদার পরিপন্থী। (তিরমিযী-৬৯৫ ও ৮০০, আবু দাউদ-২৩১৮)
শরঈ ভিত্তিতে সংবাদ পৌঁছা এবং রাষ্ট্রীয় ঘোষণা হওয়ার শর্ত না মেনে শুধু টেলিফোন, মুঠোফোন বা টেলিভিশনের ঘোষণা শুনে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রোজা বা ঈদ পালনের সিদ্ধানত্ম কুরআন-হাদীসেও বর্ণিত হয়নি। আর উম্মাতের কোন নির্ভরযোগ্য আলেমও দেননি। এ বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করতে রসূল স.-এর ইরশাদ, সাহাবায়ে কিরামের অবস্থান, তাবিঈগণের মতামত এবং মুসলিম উম্মাহ’র মহামনীষীদের মনত্মব্য ধারাবাহিকভাবে পেশ করা হচ্ছে:

চাঁদের তারিখ ভিন্ন হওয়ার দলীল :

عَنْ كُرَيْبٍ، أَنَّ أُمَّ الْفَضْلِ بِنْتَ الْحَارِثِ، بَعَثَتْهُ إِلَى مُعَاوِيَةَ بِالشَّامِ، قَالَ: فَقَدِمْتُ الشَّامَ، فَقَضَيْتُ حَاجَتَهَا، وَاسْتُهِلَّ عَلَيَّ رَمَضَانُ وَأَنَا بِالشَّامِ، فَرَأَيْتُ الْهِلَالَ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ، ثُمَّ قَدِمْتُ الْمَدِينَةَ فِي آخِرِ الشَّهْرِ، فَسَأَلَنِي عَبْدُ اللهِ بْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، ثُمَّ ذَكَرَ الْهِلَالَ فَقَالَ: مَتَى رَأَيْتُمُ الْهِلَالَ؟ فَقُلْتُ: رَأَيْنَاهُ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ، فَقَالَ: أَنْتَ رَأَيْتَهُ؟ فَقُلْتُ: نَعَمْ، وَرَآهُ النَّاسُ، وَصَامُوا وَصَامَ مُعَاوِيَةُ، فَقَالَ: " لَكِنَّا رَأَيْنَاهُ لَيْلَةَ السَّبْتِ، فَلَا نَزَالُ نَصُومُ حَتَّى نُكْمِلَ ثَلَاثِينَ، أَوْ نَرَاهُ، فَقُلْتُ: أَوَ لَا تَكْتَفِي بِرُؤْيَةِ مُعَاوِيَةَ وَصِيَامِهِ؟ فَقَالَ: لَا، هَكَذَا أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ (رواه مسلم فى بَابِ بَيَانِ أَنَّ لِكُلِّ بَلَدٍ رُؤْيَتَهُمْ وَأَنَّهُمْ إِذَا رَأَوُا الْهِلَالَ بِبَلَدٍ لَا يَثْبُتُ حُكْمُهُ لِمَا بَعُدَ عَنْهُمْ-١/٣٤٨)
অনুবাদ : হযরত কুরাইব রহ. থেকে বর্ণিত, উম্মুল ফজল বিনতে হারেস (হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর আম্মা) তাঁকে হযরত মুআবিয়া রা.-এর দরবারে শামে পাঠালেন। তিনি বলেন, আমি শামে গিয়ে আমার প্রয়োজন মিটালাম। আমি শামে থাকতেই জুমআর রাতে রমজানের চাঁদ দেখলাম। অতঃপর মাসের শেষ দিকে মদীনায় আসলে হযরত ইবনে আব্বাস রা. আমাকে বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করে অবশেষে চাঁদ দেখার ব্যাপারে বললেন যে, কবে চাঁদ দেখেছো? আমি বললাম, জুমআর রাতে দেখেছি। তিনি আবার বললেন, তুমি নিজে দেখেছো? আমি বললাম, হ্যাঁ আমি নিজে দেখেছি এবং অন্য মানুষেও দেখেছে। হযরত মুআবিয়া নিজেও রোজা রেখেছেন এবং অন্যরাও রোজা রেখেছে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বললেন, আমরাতো দেখেছি শনিবার রাতে। তাই আমরা ঈদের চাঁদ দেখা বা ৩০ রোজা পূর্ণ করা পর্যনত্ম রোজা রাখতে থাকবো। কুরাইব রহ. বলেন, আমি হযরত ইবনে আব্বাস রা.কে বললাম, হযরত মুআবিয়া রা.-এর চাঁদ দেখা এবং রোজা রাখা কি যথেষ্ট হবে না? তিনি বললেন, না যথেষ্ট হবে না। রসূলুলস্নাহ স. আমাদেরকে এভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন। (মুসলিম, হাদীস নং-২৩৯৯, মুসনাদে আহমদ- ২৭৮৯; জামে তিরমিযী-৬৯১; সুনানে আবী দাউদ-২৩২৬, সুনানে নাসাঈ: ২১১৫, সহীহ ইবনে খুযাইমা-১৯১৬)
হাদীসটির স্তর : সহীহ। ইমাম তিরমিযী রহ. এ হাদীসের বর্ণনা শেষে বলেন, حَدِيثُ ابْنِ عَبَّاسٍ حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ ইবনে আব্বাস রা.-এর হাদীসটি হাসান, সহীহ, গরীব। মুসনাদে আহমাদের তাহকীকে শায়খ শুআইব আরনাউত রহ. বলেন, إسناده صحيح হাদীসটির সনদ সহীহ। (মুসনাদে আহমদ, ২৭৮৯ নং হাদীসের আলোচনায়)
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শাম এবং মদীনার মধ্যে যে পরিমাণ দুরত্ব রয়েছে এই পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশী দুরত্ব হলে এক শহরের চাঁদ দেখা অন্য শহরের জন্য কার্যকর হবে না। বরং দুরবর্তী প্রত্যেক শহরবাসীদের জন্য আপন আপন চাঁদ দেখা কার্যকর হবে। এ হাদীসের ভিত্তিতে মুহাদ্দিসীনে কিরাম নিজ নিজ কিতাবে যে শিরোনাম দাঁড় করিয়েছেন তা থেকে কিঞ্চিত আপনাদের খেদমতে পেশ করছি।
ইমাম ইবনে খুযাইমা রহ. তাঁর কিতাব সহীহ ইবনে খুযাইমায় এ শিরোনাম দাঁড় করিয়েছেন যে, بَابُ الدَّلِيلِ عَلَى أَنَّ الْوَاجِبَ عَلَى أَهْلِ كُلِّ بَلْدَةٍ صِيَامُ رَمَضَانَ لِرِؤْيَتِهِمْ لَا رُؤْيَةِ غَيْرِهِمْ অধ্যায়: প্রত্যেক শহরের জন্য তাদের চাঁদ দেখা অনুযায়ী রমাযানের রোজা রাখা আবশ্যক হওয়ার দলীল, অন্য শহরবাসীদের দেখা অনুযায়ী নয়।
আর মুসলিম শরীফের টিকায় ইমাম নববী রহ. এই শিরোনাম দাঁড় করিয়েছেন যে, بَابُ بَيَانِ أَنَّ لِكُلِّ بَلَدٍ رُؤْيَتَهُمْ وَأَنَّهُمْ إِذَا رَأَوُا الْهِلَالَ بِبَلَدٍ لَا يَثْبُتُ حُكْمُهُ لِمَا بَعُدَ عَنْهُمْ অধ্যায়: প্রত্যেক শহরের জন্য তাদের চাঁদ দেখা গ্রহণযোগ্য। কোন এক শহরের চাঁদ দেখা তার থেকে দুরবর্তী শহরের জন্য কার্যকর হবে না। ইমাম তিরমিযী রহ. তাঁর কিতাবে উক্ত হাদীসের জন্য এ শিরোনাম দাঁড় করিয়েছেন যে ,بَابُ مَا جَاءَ لِكُلِّ أَهْلِ بَلَدٍ رُؤْيَتُهُم ْ অধ্যায়: প্রত্যেক শহরের জন্য তাদের চাঁদ দেখা গ্রহণযোগ্য। ইমাম তিরমিযী রহ. এ শিরোনামের অধীনে পূর্বে বর্ণিত ইবনে আব্বাস রা.-এর হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। অতঃপর এ হাদীসের চাহিদা আর উম্মাতের আমল বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, وَالعَمَلُ عَلَى هَذَا الحَدِيثِ عِنْدَ أَهْلِ العِلْمِ أَنَّ لِكُلِّ أَهْلِ بَلَدٍ رُؤْيَتَهُمْ উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে এ হাদীস অনুযায়ী আমল করতে হবে যে, প্রত্যেক শহরের জন্য তাদের চাঁদ দেখা গ্রহণযোগ্য। ইমাম নাসাঈ রহ. এ হাদীসের শিরোনাম এভাবে দাঁড় করিয়েছেন যে, اخْتِلَافُ أَهْلِ الْآفَاقِ فِي الرُّؤْيَةِ অধ্যায়: ‘চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে উদয়স্থলের ভিন্নতা’।
রসূলুল্লাহ স.-এর ইন্তেকালের পরে ইসলামী খিলাফাতের অনেক বিসত্মৃতি ঘটেছিলো। মদীনা এবং শামের মধ্যে চাঁদের উদয়স্থলের যে ভিন্নতা হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে এটা স্বাবাভীক নিয়মে হয়তো এর পূর্বেও অনেকবার ঘটেছিলো। চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা মেনে নেয়া হলে প্রত্যেকে যার যার অঞ্চলে চাঁদ দেখে রোজা রাখবে, ঈদ করবে। এ ক্ষেত্রে সারা মুসলিম বিশ্ব থেকে চাঁদের সংবাদ সংগ্রহ করা এবং চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে তা প্রচার করার কোন দায়িত্ব মুসলিম জনসাধারণ বা তাদের খলিফার উপর বর্তায় না। আর যদি চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা স্বীকার না করা হয় তাহলে মুসলিম জনসাধারণ এবং তাদের খলিফার উপর অবশ্যই এ দায়িত্ব বর্তাবে। বিশেষ করে শেষ তিন খলিফা তথা হযরত উমার, উসমান এবং হযরত আলী রা.-এর খিলাফত আমলে ইসলামী খিলাফতের যে বিসত্মার ঘটেছিলো সে ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব পালনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য ছিলো। কিন্তু আমাদের অনুসন্ধানে এমন কোন প্রমাণ মেলেনি যে, চাঁদের সংবাদ সংগ্রহ করা বা বিতরণ করা মুসলিম উম্মাহ’র উপর আরো একটি ফরযে কিফায়াহ দায়িত্ব বলে কুরআন-হাদীসের কোথাও ঘোষিত হয়েছে। এমনও কোন প্রমাণ মেলেনি যে, খুলাফায়ে রাশেদার যুগে তাঁরা চাঁদের সংবাদ সংগ্রহ করে তা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। বিশেষতঃ উমরে ছানী খ্যাত খলিফায়ে রাশেদ হযরত উমার বিন আব্দুল আজীজ রহ.-এর খিলাফত আমলে ইসলামী খিলাফাত স্পেন থেকে চীন পর্যনত্ম বিসত্মার লাভ করেছিলো। এ ক্ষেত্রে স্পেনের বাসিন্দাদের চাঁদ দেখা আর সমরকন্দের বাসিন্দাদের ঐ চাঁদ না দেখার বিষয়টি অতি বাসত্মব। একজন মুসলিম খলিফার একই রাষ্ট্রে পশ্চিম দিকে রমাযানের রোজা চলছে, আর পূর্ব প্রানেত্ম দিনের বেলায় পানাহার চলছে। আবার এক দিকে ঈদের আনন্দ চলছে, অপর দিকে রোজা চলছে। সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ও ঈদ পালনের প্রবক্তাগণের দৃষ্টিতে এ অন্যায়ের বিরম্নদ্ধে খলিফায়ে রাশেদগণ কি করেছেন? নাকি কিছুই করেননি? করে থাকলে প্রমাণ কোথায়? আর না করে থাকলে কেন করেননি? হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, হযরত মুআবিয়া রা. রাষ্ট্রীয়ভাবে এর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। খুলাফায়ে রাশেদা বা তাঁদের কেউ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইলেও তাঁরা কী করতে পারতেন? যে যুগে খবর পোঁছানোর সবচেয়ে দ্রম্নত ব্যবস্থা ঘোড় সাওয়ারের মাধ্যমে পৌঁছানো, সে যুগে স্পেন থেকে চীনে রাতারাতি সংবাদ পৌঁছানোর কল্পনা করা যেতো কি? কোন কারণে যদি টেলিফোন-মোবাইলের নেটওয়ার্কে বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় দেখা দেয় তাহলে প্রযুক্তিভক্তরা রোজা ও ঈদের কী ব্যবস্থা নিবেন? খোলা আকাশে চাঁদ দেখার ম্যানুয়াল ব্যবস্থা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন ব্যবস্থা থাকবে কি? সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ও ঈদ পালন করার যুক্তিগুলোর পরিস্থিতি তখন যা হবে ইসলামকে ডিজিটালায়নের স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে এখন ঐ ব্যবস্থা মেনে নেয়া উত্তম নয় কি? যাতে ইসলামের নিয়ম কানুনগুলো সর্ব যুগে সর্ব শ্রেণীর মানুষের বোধগম্য থাকে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত উক্ত হাদীস ও অন্যান্য দলীলের ভিত্তিতে যে সকল মহামনীষীগণ চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতার বিষয়ে মতামত দিয়েছেন তাঁদের মধ্য থেকে যুগশ্রেষ্ট কয়েক জন ইমামের অভিমত পেশ করা হচ্ছে :

আল্লামা ইবনে আব্দিল বার রহ. বলেন,

قَالَ أَبُو عُمَرَ إِلَى الْقَوْلِ الْأَوَّلِ أَذْهَبُ لِأَنَّ فِيهِ أَثَرًا مَرْفُوعًا وَهُوَ حَدِيثٌ حَسَنٌ تَلزَمُ بِهِ الْحُجَّةُ وَهُوَ قَوْلُ صَاحِبٍ كَبِيرٍ لا مخالف له (من الصحابة) وَقَوْلُ طَائِفَةٍ مِنْ فُقَهَاءِ التَّابِعِينَ وَمَعَ هَذَا إِنَّ النَّظَرَ يَدُلُّ عَلَيْهِ عِنْدِي لِأَنَّ النَّاسَ لَا يُكَلَّفُونَ عِلْمَ مَا غَابَ عَنْهُمْ فِي غَيْرِ بَلَدِهِمْ وَلَوْ كُلِّفُوا ذَلِكَ لَضَاقَ عَلَيْهِمْ
অনুবাদ : মালেকী মাযহাবের বিশিষ্ট আলেম এবং যুগশ্রেষ্ট ফকীহ ও মুহাদ্দিস হযরত আবু উমার ইবনু আব্দিল বার রহ. বলেন, আমি প্রথম মত অবলম্বন করি। অর্থাৎ প্রত্যেক শহরের জন্য তাদের চাঁদ দেখা কার্যকর হবে। যেহেতু এ ব্যাপারে রসূলুল্লাহ স.-এর আছার বর্ণিত রয়েছে। আর সেটা হাসান হাদীস যা দ্বারা দলীল গ্রহণ আবশ্যক হয়। সাথে সাথে এটা একজন মহা ব্যক্তিত্ব তথা ইবনে আব্বাসের কথা এবং সাহাবাদের মধ্যে কেউ তার বিরোধী নেই। আর এটা ফকীহ তাবিঈগণের একটি দলেরও মত। উপরন্তু আমার দৃষ্টিতে যুক্তির চাহিদাও এটাই। যেহেতু ভিন্ন শহরে দৃষ্টির আড়ালে যা ঘটেছে সে ব্যাপারে তাদেরকে বাধ্য করা যায় না। আর করলেও তা তাদের জন্য সংকীর্ণতার কারণ হবে। (আত্ তামহীদ, নাফে’ সূত্রে বর্ণিত চলিস্নশতম হাদীসের আলোচনায়) তিনি আরো বলেন,
وروي عن بن عَبَّاسٍ أَنَّهُ قَالَ لِكُلِّ قَوْمٍ رُؤْيَتُهُمْ وَبِهِ قَالَ عِكْرِمَةُ وَالْقَاسِمُ بْنُ مُحَمَّدٍ وَسَالِمُ بْنُ عَبْدِ الله وإليه ذهب إبن المبارك وإسحاق بن رَاهْوَيْهِ وَطَائِفَةٌ.
অনুবাদ : হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘প্রত্যেক কওমের জন্য তাদের চাঁদ দেখা গ্রহণযোগ্য’। আর এটিই ইকরিমা, কাসিম বিন মুহাম্মাদ ও সালিম বিন আব্দুল্লাহর বক্তব্য। ইবনুল মুবারক ও ইসহাক বিন রাহওয়াইহ রহ.সহ একটি জামাতের মাযহাবও এটিই। (আল্ ইসতিযকার ১০/২৯)
হযরত ইবনে আব্দুল বার রহ.-এর বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসের ভাষ্যমতে রসূলে কারীম স.-এর নির্দেশ, হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর নিজের মতামত, তাঁর বিশিষ্ট ছাত্র এবং উঁচু মানের মুহাদ্দিস ও ফকীহ হযরত ইকরিমা রহ., আবু বকর সিদ্দীক রা-এর পৌত্র ও সাহাবায়ে কিরামের ইলমের ধারক মদীনার বিখ্যাত সাতজন ফকীহ যারা ‘ফুকাহায়ে সাবআহ’ নামে পরিচিত তাঁদের অন্যতম সদস্য কাসেম বিন মুহাম্মাদ এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার রা.-এর ছেলে ও মদীনায় অবস্থিত ‘ফুকাহায়ে সাবআহ’র আরেক সদস্য হযরত সালেম বিন আব্দুল্লাহ রহ.-এর মতামত এ কথারই সমর্থন করে যে, পৃথিবীর যে কোন স্থানে চাঁদ দেখা গেলে তা সমগ্র বিশ্বের জন্য কার্যকর হবে না। বরং দুর-দুরানেত্ম অবস্থিত প্রত্যেক শহরের জন্য স্বতন্ত্র চাঁদ দেখা কার্যকর হবে।

ইমাম নববী রহ.

(بَابُ بَيَانِ أَنَّ لِكُلِّ بَلَدٍ رُؤْيَتَهُمْ وَأَنَّهُمْ إِذَا رَأَوُا الْهِلَالَ بِبَلَدٍ لَا يَثْبُتُ حُكْمُهُ لِمَا بَعُدَ عَنْهُمْ) فِيهِ حَدِيثُ كُرَيْبٍ عَنِ بن عَبَّاسٍ وَهُوَ ظَاهِرُ الدَّلَالَةِ لِلتَّرْجَمَةِ وَالصَّحِيحُ عِنْدَ أَصْحَابِنَا أَنَّ الرُّؤْيَةَ لَا تَعُمُّ النَّاسَ بَلْ تَخْتَصُّ بِمَنْ قَرُبَ عَلَى مَسَافَةٍ لَا تُقْصَرُ فِيهَا الصَّلَاةُ (شرح النبوى على مسلم)
অনুবাদ : শাফেঈ মাযহাবের বিশিষ্ট আলেম এবং যুগশ্রেষ্ট ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম নববী রহ. হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসের উপর প্রথমে এ শিরোনাম দাঁড় করান যে, প্রত্যেক শহরের জন্য তাদের চাঁদ দেখা গ্রহণযোগ্য। কোন এক শহরের চাঁদ দেখা তার থেকে দূরবর্তী শহরের জন্য কার্যকর হবে না। এরপরে তিনি বলেন, এ মাসআলার ব্যাপারে কুরাইব রহ. সূত্রে বর্ণিত হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর হাদীসটি স্পষ্ট দলীল। আমাদের ইমামগণের নিকট কোন অঞ্চলে চাঁদ দেখা গেলে তা সারা দুনিয়ার জন্য ব্যাপকহারে ধর্তব্য নয়। বরং চাঁদ দেখার স্থান থেকে কসরের দুরত্বের চেয়ে নিকটে যারা বসবাস করে তাদের ড়্গেত্রে এ চাঁদ দেখার বিধান প্রযোজ্য হবে। (ইমাম নববীর লিখিত মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আল মিনহাজে হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায়)
ইমাম নববী রহ.-এর কথা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পৃথিবীর যে কোন স্থানে চাঁদ দেখা গেলে তা সমগ্র বিশ্বের জন্য কার্যকর হবে না। বরং দুর-দুরানেত্ম অবস্থিত প্রত্যেক শহরের জন্য স্বতন্ত্র চাঁদ দেখা কার্যকর হবে।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ.

وَقَدِ اخْتَلَفَ الْعُلَمَاءُ فِي ذَلِكَ عَلَى مَذَاهِبَ أَحَدُهَا لِأَهْلِ كُلِّ بَلَدٍ رُؤْيَتُهُمْ وَفِي صَحِيح مُسلم من حَدِيث بن عَبَّاس مَا يشْهد لَهُ وَحَكَاهُ بن الْمُنْذِرِ عَنْ عِكْرِمَةَ وَالْقَاسِمِ وَسَالِمٍ وَإِسْحَاقَ وَحَكَاهُ التِّرْمِذِيُّ عَنْ أَهْلِ الْعِلْمِ وَلَمْ يَحْكِ سِوَاهُ وَحَكَاهُ الْمَاوَرْدِيُّ وَجْهًا لِلشَّافِعِيَّة.
অনুবাদ : শাফেঈ মাযহাবের আরো একজন বিশিষ্ট আলেম এবং যুগশ্রেষ্ঠ ফকীহ ও মুহাদ্দিস হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, চাঁদ দেখার মাসআলা নিয়ে উলামায়ে কিরাম কয়েক মাযহাবে বিভক্ত হয়েছেন। তম্মধ্যে একটি এই যে, প্রত্যেক শহরের জন্য তাদের চাঁদ দেখা কার্যকর হবে। মুসলিম শরীফে বর্ণিত হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর হাদীস এরই সাক্ষ বহন করে। হযরত ইবনুল মুনযির রহ. ইকরিমা, কাসেম, সালেম এবং ইসহাক রহ. থেকে এ মতই বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম তিরমিযী রহ. এটাকেই উলামায়ে কিরামের মতামত বলে উল্লেখ করেছেন; এর বিপরীতে কিছুই বলেননি। আল্লামা মা-ওরদী রহ. এটাকে শাফেঈ মাযহাবের একটি মত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর পরে হাফেজ ইবনে হাজার রহ. এ ব্যাপারে দ্বিতীয় মতটি পেশ করেন-
ثَانِيهَا مُقَابِلُهُ إِذَا رُؤِيَ بِبَلْدَةٍ لَزِمَ أَهْلَ الْبِلَادِ كُلِّهَا وَهُوَ الْمَشْهُور عِنْد الْمَالِكِيَّة لَكِن حكى بن عَبْدِ الْبَرِّ الْإِجْمَاعَ عَلَى خِلَافِهِ وَقَالَ أَجْمَعُوا عَلَى أَنَّهُ لَا تُرَاعَى الرُّؤْيَةُ فِيمَا بَعُدَ مِنَ الْبِلَادِ كَخُرَاسَانَ وَالْأَنْدَلُسِ (فَتْحُ الْبَارِىْ)
অনুবাদ : আর অপর মতটি হলো, কোন এক শহরে চাঁদ দেখা গেলে তা সমগ্র বিশ্বের জন্য কার্যকর বলে ধরা হবে। মালেকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ মত এটা। তবে মালেকী মাযহাবের বিশিষ্ট ইমাম হযরত ইবনু আব্দিল বার রহ. এ মতের বিপরীতে ইজমা তথা সকলের ঐকমত্য বর্ণনা করে বলেন, খুরাসান এবং স্পেনের মতো দুরবর্তী শহরের ড়্গেত্রে এক শহরের চাঁদ দেখা অন্য শহরের জন্য কার্যকর না হওয়ার উপর সকলে একমত হয়েছে। (ফাতহুল বারী, চাঁদ দেখা অধ্যায়)

আল্লামা কুরতুবী রহ.

قَالَ عُلَمَاؤُنَا: قَوْلُ ابْنِ عَبَّاسٍ (هَكَذَا أَمَرَنَا رَسُولُ الله صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) كَلِمَةُ تَصْرِيحٍ بِرَفْعِ ذَلِكَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَبِأَمْرِهِ. فَهُوَ حُجَّةٌ عَلَى أَنَّ الْبِلَادَ إِذَا تَبَاعَدَتْ كَتَبَاعُدِ الشَّامِ مِنْ الْحِجَازِ فَالْوَاجِبُ عَلَى أَهْلِ كُلِّ بَلَدٍ أَنْ تَعْمَلَ عَلَى رُؤْيَتِهِ دُونَ رُؤْيَةِ غَيْرِهِ، وَإِنْ ثَبَتَ ذلك عِنْدَ الْإِمَامِ الْأَعْظَمِ، مَا لَمْ يَحْمِلِ النَّاسَ عَلَى ذَلِكَ، فَإِنْ حُمِلَ فَلَا تَجُوزُ مُخَالَفَتُهُ. (تفسير القرطبى: فى قوله ولتكملوا العدة الخ.)
অনুবাদ : মালেকী মাযহাবের আরো একজন বিশিষ্ট আলেম এবং যুগশ্রেষ্ট ফকীহ ও মুফাসসির, তাফসীরে কুরতুবীর লেখক আল্লামা আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ শামসুদ্দীন কুরতুবী রহ. (মৃত্যু-৬৭১ হিঃ) ছূরা বাকারার আয়াত ولتكملوا العدة الخ. এর ব্যাখ্যায় বলেন, আমাদের উলামাগণ বলেছেন যে, হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর উক্তি هَكَذَا أَمَرَنَا رَسُولُ الله صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘অর্থাৎ রসূলুল্লাহ স. আমাদেরকে এভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন’ স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, হযরত ইবনে আব্বাস যা করেছেন বা বলেছেন তা রসূলুল্লাহ স.-এর নির্দেশেই করেছেন। সুতরাং এটা দলীল যে, দুটি শহর যদি শাম ও হিজাজের মত দুরত্বে অবস্থিত হয় তাহলে প্রত্যেক শহরবাসী যার যার চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করবে। অন্য শহরের চাঁদ দেখা তাদের জন্য কার্যকর হবে না। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রধানের নিকট প্রমাণিত হলেও না। যতক্ষন তিনি জনগণের উপর সিদ্ধানত্ম চাপিয়ে না দেন। হ্যাঁ তিনি সিদ্ধানত্ম ঘোষণা করলে তাঁর বিরোধিতা করা জনসাধারণের জন্য বৈধ হবে না। (তাফসীরে কুরতুবী, ছূরা বাকারার আয়াত ولتكملوا العدة الخ. এর ব্যাখ্যায়)
আল্লামা কুরতুবী রহ.-এর কথা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পৃথিবীর যে কোন স্থানে চাঁদ দেখা গেলে তা সমগ্র বিশ্বের জন্য কার্যকর হবে না। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রধানের নিকট প্রমাণিত হলেও না। যতড়্গণ তিনি জনসাধারণকে রোজা রাখা এবং ঈদ পালনের নির্দেশ না দেন। বরং দুর-দুরানেত্ম অবস্থিত প্রত্যেক শহরের জন্য স্বতন্ত্র চাঁদ দেখা কার্যকর হবে।

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী রহ.

وقال حجة الإسلام الغزالي: وإذا رؤي الهلال ببلدة ولم ير بأخرى وكان بينهما أقل من مرحلتين وجب الصوم على الكل وإن كان أكثر كان لكل بلدة حكمها ولا يتعدى الوجوب
অনুবাদ : ইমাম গাযালী আবু হামেদ মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ রহ. (মৃত্যু-৫০৫ হিঃ) বলেন, যদি কোন এক শহরে চাঁদ দেখা যায় আর অন্য শহরে না দেখা যায় এবং এ দুই শহরের মাঝের দুরত্ব দুই মারহালা (দু’দিনের রাসত্মা অর্থাৎ ৩২ মাইল) এর চেয়ে কম হয় তাহলে যে শহরে চাঁদ দেখা যায়নি তাদেরও রোজা রাখতে হবে। আর যদি ঐ দুই শহরের মাঝে দুরত্ব এর চেয়ে বেশী হয় তাহলে প্রত্যেক শহরের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিধান কার্যকর হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক শহরে স্বতন্ত্রভাবে চাঁদ দেখতে হবে। (এহইয়াউ উলূমিদ্বীন : ১/২৩২, সওম অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদ)

ইবনে তাইমিয়া রহ.

قال شيخ الإسلام ـ رحمه الله: تختلف مطالع الهلال باتفاق أهل المعرفة بالفلك، فإن اتفقت لزم الصوم، وإلا فلا،
অনুবাদ : শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ বিন মুহাম্মাদ আল উছাইমীন বলেন, আলস্নামা ইবনে তাইমিয়া রহ. (মৃত্যু-৭২৮ হিঃ) বলেন, আকাশের অবস্থা সম্পর্কে যাদের জ্ঞান আছে তাদের ঐকমত্য যে, চাঁদের উদয়স্থলের পার্থক্য ঘটে। যদি দুই শহরের উদয়স্থল অভিন্ন হয় তাহলে এক শহরে চাঁদ দেখা গেলে অন্য শহরে রোজা রাখা জরম্নরী হবে। আর উদয়স্থল ভিন্ন হলে এক শহরে চাঁদ দেখা গেলে অন্য শহরে রোজা রাখা জরম্নরী হবে না। (আশ্ শারহুল মুমতি’ আলা ঝাদিল মুসতাকনী’)
القول الثالث: أن رؤية أهل المشرق رؤية لأهل المغرب ولا عكس والسبب أنه إذا رؤي في المشرق لزم أن يُرى في المغرب ولابد؛ وذلك لأنه لا يغيب عن أهل المشرق قبل أن يغيب عن أهل المغرب وهذا ما ذهب إليه شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله وغيره
অনুবাদ : শায়খ আব্দুলস্নাহ বিন আব্দুর রহমান বিন জাবরীন বলেন, পূর্ব দিগনেত্মর মানুষরা চাঁদ দেখলে পশ্চিম দিগনেত্মর মানুষের জন্য তা কার্যকর হবে। তবে এর বিপরীতে পশ্চিম দিগনেত্মর মানুষ চাঁদ দেখলে পূর্ব দিগনেত্মর মানুষের জন্য কার্যকর হবে না। আর তার কারণ এই যে, পূর্ব দিগনেত্ম চাঁদ দেখা গেলে পশ্চিম দিগনেত্ম দেখা দেয়া জরম্নরী। যেহেতু পূর্ব দিগনেত্ম চাঁদ ডোবার পূর্বে পশ্চিম দিগনেত্ম ডুবতে পারে না। এ মতই গ্রহণ করেছেন শায়খ ইবনে তাইমিয়া এবং অন্যান্যরা। (আবুত তুরাব সায়্যিদ বিন হুসাইন কর্তৃক লিখিত নিদাউর রয়্যান কিতাবে: ৩৩৪/৩)


শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল্ উছাইমীন রহ.

সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের অন্যতম সদস্য, হাম্বলী মাযহাবের বিশিষ্ট আলেম ও মুফতি শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ বিন মুহাম্মাদ আল্ উছাইমীন এ মাসআলার ব্যাপারে চারটি মত উল্লেখ করেন। তম্মধ্যে দ্বিতীয় মতটি হলো চাঁদের উদয়স্থলের পার্থক্য ধর্তব্য হবে। এ কারণে এক শহর থেকে আরেক শহরের দুরত্ব যদি এই পরিমাণ হয় যাতে চাঁদের উদয়স্থলের ব্যবধান হয়ে থাকে তাহলে এক শহরের চাঁদ দেখা অন্য শহরের জন্য কার্যকর হবে না। এ মতের পক্ষে তিনি শায়খুল ইসলাম আলস্নামা ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর উক্তি তুলে ধরে বলেন,
قال شيخ الإسلام ـ رحمه الله: تختلف مطالع الهلال باتفاق أهل المعرفة بالفلك، فإن اتفقت لزم الصوم، وإلا فلا، واستدلوا بالنص والقياس.
অনুবাদ : শায়খুল ইসলাম আলস্নামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, আকাশের অবস্থা সম্পর্কে যাদের জ্ঞান আছে তাদের ঐকমত্য যে, চাঁদের উদয়স্থলের পার্থক্য ঘটে থাকে। যদি দুই শহরের উদয়স্থল অভিন্ন হয় তাহলে এক শহরে চাঁদ দেখা গেলে অন্য শহরে রোজা রাখা জরম্নরী হবে। আর উদয়স্থল ভিন্ন হলে এক শহরে চাঁদ দেখা গেলে অন্য শহরে রোজা রাখা জরম্নরী হবে না। অতঃপর শায়খ উছাইমীন বলেন,
أما النص فهو: قوله تعالى: {فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ}، والذين لا يوافقون من شاهده في المطالع لا يقال إنهم شاهدوه لا حقيقة؛ ولا حكماً، والله تعالى أوجب الصوم على من شاهده. قوله صلّى الله عليه وسلّم: صوموا لرؤيته، وأفطروا لرؤيته فعلل الأمر في الصوم بالرؤية، ومن يخالف من رآه في المطالع لا يقال إنه رآه لا حقيقة، ولا حكماً. حديث ابن عباس ـ رضي الله عنهما ـ وفيه أن أم الفضل بنت الحارث بعثت كريباً إلى معاوية بالشام فقدم المدينة من الشام في آخر الشهر فسأله ابن عباس عن الهلال فقال: رأيناه ليلة الجمعة فقال ابن عباس: لكننا رأيناه ليلة السبت فلا نزال نصوم حتى نكمل ثلاثين أو نراه، فقال: أو لا تكتفي برؤية معاوية وصيامه؟ فقال: لا هكذا أمرنا رسول الله صلّى الله عليه وسلّم.
অনুবাদ : এ মতের অনুসারীগণ কুরআন-হাদীসের বাণী এবং যুক্তি দ্বারা দলীল পেশ করে থাকেন। কুরআনের বাণী হিসেবে ছূরা বাকারার আয়াত فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রমাযান মাস দেখে অর্থাৎ চাঁদ দেখে সে রোজা রাখবে। সুতরাং চাঁদ প্রত্যড়্গকারীদের সাথে যাদের উদয়স্থলের মিল নেই তারা চাঁদ দেখেছে এটা কোনভাবেই বলা যায় না। বাসত্মবতার দিক দিয়েও না। বিধি-বিধানের দিক দিয়েও না। অথচ আলস্নাহ তাআলা রোজা ফরয করেছেন তাদের উপর যারা চাঁদ দেখেছে। অনুরূপভাবে রসূলুল্লাহ স.-এর বাণী- صوموا لرؤيته، وأفطروا لرؤيته চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে রোজা ছাড়ো। এখানে চাঁদ দেখাকে রোজা ফরয হওয়ার কারণ বানানো হয়েছে । সুতরাং চাঁদ প্রত্যক্ষকারীদের সাথে যাদের উদয়স্থলের মিল নেই তারা চাঁদ দেখেছে এটা কোনভাবেই বলা যায় না। বাসত্মবতার দিক দিয়েও না। বিধি-বিধানের দিক দিয়েও না। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসও এর আরেকটি দলীল। উক্ত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, উম্মুল ফজল বিনতে হারেস (হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর আম্মা) কুরাইব রহ.কে হযরত মুআবিয়াহ রা.-এর দরবারে শামে পাঠালেন। তিনি মাসের শেষ দিকে মদীনায় আসলে হযরত ইবনে আব্বাস রা. তাঁকে চাঁদ দেখার বিষয় জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি জুমআর রাতে দেখেছি। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বললেন, আমরা শনিবারে দেখেছি। আমরা চাঁদ দেখা বা ৩০ রোজা পূর্ণ করা পর্যনত্ম রোজা রাখতে থাকবো। কুরাইব রহ. বলেন, হযরত মুআবিয়া রা.-এর চাঁদ দেখা এবং রোজা রাখা কি যথেষ্ট হবে না? তিনি বললেন, না যথেষ্ট হবে না। রসূলুল্লাহ স. আমাদেরকে এভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন। শায়খ উছাইমীন রহ. আরো বলেন,
وأما القياس فلأن التوقيت اليومي يختلف فيه المسلمون بالنص والإجماع، فإذا طلع الفجر في المشرق فلا يلزم أهل المغرب أن يمسكوا لقوله تعالى: {وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ} ، ولو غابت الشمس في المشرق، فليس لأهل المغرب الفطر.فكما أنه يختلف المسلمون في الإفطار والإمساك اليومي، فيجب أن يختلفوا كذلك في الإمساك والإفطار الشهري، وهذا قياس جلي وهذا القول هو القول الراجح، وهو الذي تدل عليه الأدلة.
অনুবাদ : এ মতের পক্ষে যৌক্তিক দিক এই যে, দিনের সময় ব্যবধানের ড়্গেত্রে মুসলমানদের ভিন্নতা কুরআন- হাদীসের বাণী এবং মুসলমানদের ঐকমত্য সবকিছু দ্বারাই প্রমাণিত। সুতরাং পূর্ব দিগনেত্ম বসবাসরতদের জন্য সুবহে সাদেক হলে যেমনিভাবে আল্লাহ তাআলার বাণী وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ “রাতের আধার থেকে দিনের আলো পার্থক্য হওয়া পর্যনত্ম পানাহার করো” দ্বারা পশ্চিম দিগনেত্ম বসবাসকারীদের জন্য পানাহার বর্জনের আবশ্যকীয়তা আসে না। আবার পূর্ব দিগনেত্ম বসবাসরতদের সূর্য ডুবে গেলে পশ্চিম দিগনেত্ম বসবাসকারীদের জন্য ইফতার করা বৈধ হয় না। দৈনন্দিন হিসেবের ব্যাপারে মুসলমানদের এই পার্থক্যের মতো মাসিক হিসেবেও রোজা রাখা বা না রাখার পার্থক্য ঘটবে। এটা স্পষ্ট যুক্তির কথা এবং দলীলের দৃষ্টিকোণ থেকে এটাই অগ্রগণ্য মত। সব শেষে তিনি বলেন,
قال أهل العلم: إذا رآه أهل المشرق وجب على أهل المغرب المساوين لهم في الخط أن يصوموا؛ لأن المطالع متفقة، ولأن الهلال إذا كان متأخراً عن الشمس في المشرق فهو في المغرب من باب أولى؛ لأن سير القمر بطيء. وإذا رآه أهل المغرب هل يجب الصيام على أهل المشرق؟ الجواب: لا؛ لأنه ربما في سير هذه المسافة تأخر القمر.
অনুবাদ : উলামায়ে কিরাম বলেন, পূর্ব দিগনেত্ম বসবাসরত মানুষেরা চাঁদ দেখলে ঐ বরাবর পশ্চিম দিগনেত্ম বসবাসকারীদের জন্য রোজা রাখা জরম্নরী হবে। কেননা তাদের উদয়স্থল একই। আবার সূর্যের চেয়ে চাঁদের গতি কম হওয়ায় পূর্ব দিগনেত্ম সূর্য ডোবার পরে চাঁদ দেখা গেলে পশ্চিম দিকে তা অবশ্যই দেখা দিবে। তবে পশ্চিম দিকে বসবাসকারীগণ চাঁদ দেখলে পূর্ব দিকে বসবাসরত মানুষের জন্য রোজা রাখা জরম্নরী কী না? এর জবাব হলো-জরম্নরী না। যেহেতু দুরত্ব বেশী হওয়ার কারণে অনেক সময় চাঁদ বিলম্বে দেখা দেয়। (আশ্ শারহুল মুমতি’ আলা ঝাদিল মুসতান্‌কি’)
শায়খ উছাইমীনের বক্তব্য থেকে পরিস্কার হয়ে গেলো যে, তিনি চাঁদের উদয়স্থলের পার্থক্য স্বীকার করেন এবং বিশ্বের যে কোন স্থানে চাঁদ দেখা গেলে সারা দুনিয়ার মানুষ সে অনুযায়ী রোজা রাখবে এ মতকে প্রাধান্য দেন না। বরং প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য তাদের চাঁদ দেখা গ্রহণযোগ্য হওয়াকে তিনি কুরআন-হাদীসের বাণী এবং যুক্তির দিক দিয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন। এর পরে তিনি তৃতীয় আরেকটি মত প্রকাশ করে বলেন,
القول الثالث: أن الناس تبع للإمام فإذا صام صاموا، وإذا أفطر أفطروا، ولو كانت الخلافة عامة لجميع المسلمين فرآه الناس في بلد الخليفة، ثم حكم الخليفة بالثبوت لزم من تحت ولايته في مشارق الأرض أو مغاربها، أن يصوموا أو يفطروا لئلا تختلف الأمة وهي تحت ولاية واحدة، فيحصل التنازع والتفرق.
অনুবাদ : তৃতীয় মত এই যে, মানুষ রাষ্ট্রপ্রধানের অনুসারী। সুতরাং তিনি রোজা রাখলে মানুষ রোজা রাখবে আর তিনি রোজা ছেড়ে দিলে মানুষ রোজা ছেড়ে দিবে। যদি বিশ্বের সমগ্র মুসলমান এক খিলাফাতের অধীনে থাকে আর ঐ খলিফার অধীনসত্ম কোন শহরে মানুষ চাঁদ দেখে এবং সে ভিত্তিতে খলিফা ফায়সালা ঘোষণা করেন তাহলে পূর্ব-পশ্চিমে যারাই তাঁর রাষ্ট্রে বসবাস করে তাদের সকলের জন্য রোজা রাখা বা ছাড়ার বিধান প্রযোজ্য হবে। যেন একই রাষ্ট্রের মানুষ মতবিরোধে জড়িয়ে না পড়ে এবং সে মতবিরোধ ঝগড়া-বিবাদের কারণ না হয়। সর্বশেষে তিনি এই বলে পরিসমাপ্তি টানেন যে,
وعمل الناس اليوم على هذا أنه إذا ثبت عند ولي الأمر لزم جميع من تحت ولايته أن يلتزموا بصوم أو فطر، وهذا من الناحية الاجتماعية قول قوي. (الشرح الممتع على زاد المستقنع لمحمد بن صالح بن محمد العثيمين)
অনুবাদ : মানুষের এখনকার আমল এই যে, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তির নিকট চাঁদ প্রমাণিত হলে তাঁর অধীনে বসবাসকারী সকলের জন্য রোজা রাখা বা না রাখার বিধান প্রযোজ্য হবে। (এক রাষ্ট্রের ভেতর) ঐক্য রক্ষার স্বার্থে এটা শক্তিশালী মত। (আশ্ শারহুল মুমতি’ আলা ঝাদিল মুসতান্‌কি’)

শায়খ আব্দুল আজীজ বিন বায রহ.
وقال العلامة عبد العزيز بن باز: وقد صدر قرار من مجلس هيئة كبار العلماء في المملكة العربية السعودية بأن لكل أهل بلد رؤيتهم؛ لحديث ابن عباس المذكور وما جاء في معناه. (مجموع فتاوى للعلامة عبد العزيز بن باز رحمه الله المتوفى: ۱٤۲۰هـ)
অনুবাদ : হাম্বলী মাযহাবের বিশিষ্ট আলেম, সৌদি আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতি এবং স্থায়ী ফতওয়া বোর্ড “আল লাযনাতুত দায়েমাহ...”-এর গুরম্নত্বপূর্ণ সদস্য, শায়খ আব্দুল আজীজ বিন বায রহ. প্রথমে নিজের মতামত পেশ করেন, অতঃপর বলেন, সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের একটি সিদ্ধানত্ম এ মর্মে প্রকাশিত হয়েছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীস এবং ঐ অর্থে বর্ণিত আরো যা আছে তার প্রেড়্গিতে প্রত্যেক শহরের জন্য তাদের চাঁদ দেখাই গ্রহণযোগ্য।

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান বিন জাবরীন রহ.

سئل فضيلة الشيخ عبد الله بن عبد الرحمن بن جبرين حفظه الله: (عضو في اللجنة الدائمة للإفتاء بالمملكة العربية السعودية.) إذا رؤي الهلال في المملكة مثلاً، هل يجب على أهل البلاد الأخرى الصيام أم أنه يعتبر لكل أهل بلدة رؤيتهم؟ فأجاب: هذه مسألة خلافية. القول الأول: أنه إذا رؤي الهلال في بلد لزم أهل البلاد الأخرى أن يصوموا....
অনুবাদ : সৌদি আরবের স্থায়ী ফতওয়া বোর্ড “আল লাযনাতুত দায়েমাহ..”-এর গুরম্নত্বপূর্ণ সদস্য শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান বিন জাবরীন রহ. (মৃত্যু-১৪৩০) এর নিকট জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, কোন এক শহরে চাঁদ দেখা গেলে অন্য শহরবাসীদের জন্য রোজা রাখা জরম্নরী হবে নাকি প্রত্যেক শহরের জন্য ভিন্নভাবে চাঁদ দেখতে হবে? জবাবে তিনি বলেন, এ মাসআলাটি বিরোধপূর্ণ। প্রথম মত হলো-কোন এক শহরে চাঁদ দেখা গেলে অন্য শহরবাসীদের জন্য রোজা রাখা জরম্নরী হবে।
القول الثاني: أن لكل أهل بلدة رؤيتهم. وقد ذهب إلى هذا القول بعض العلماء منهم الشيخ عبد الله بن حميد رحمه الله، وألّف في ذلك رسالة أيدها كذلك بالأحاديث. ومن الأحاديث التي استدل بها أصحاب هذا القول قصة كريب ....ففي هذا الحديث: أن ابن عباس جعل لأهل الشام رؤيتهم ولأهل المدينة رؤيتهم وأن كلاَّ منهم يصوم إذا أهلّ عليه الهلال.
অনুবাদ : আর দ্বিতীয় মতটি হলো-প্রত্যেক শহরবাসীদের জন্য ভিন্নভাবে চাঁদ দেখতে হবে। কিছু উলামায়ে কিরাম এ মত গ্রহণ করেছেন। তম্মধ্যে শায়খ আব্দুল্লাহ বিন হুমায়েদ রহ. অন্যতম। তিনি এ ব্যাপারে একটি পুসিত্মকাও প্রণয়ন করেছেন। উক্ত পুসিত্মকায় তিনি বিভিন্ন হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন। তম্মধ্যে একটি হলো হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীস। ঐ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, শাম দেশের জন্য তাদের চাঁদ দেখা কার্যকর। আর মদীনাবাসীদের জন্য তাদের চাঁদ দেখা কার্যকর। আর প্রত্যেকেই রোজা রাখবে যখন তারা চাঁদ দেখবে। তিনি আরো বলেন,
القول الثالث: أن رؤية أهل المشرق رؤية لأهل المغرب ولا عكس؛ والسبب أنه إذا رؤي في المشرق لزم أن يُرى في المغرب ولابد؛ وذلك لأنه لا يغيب عن أهل المشرق قبل أن يغيب عن أهل المغرب. وهذا ما ذهب إليه شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله وغيره.
অনুবাদ : আর তৃতীয় মতটি হলো-পূর্ব দিগনেত্মর মানুষরা চাঁদ দেখলে পশ্চিম দিগনেত্মর মানুষের জন্য তা কার্যকর হবে। তবে এর বিপরীতে পশ্চিম দিগনেত্মর মানুষ চাঁদ দেখলে পূর্ব দিগনেত্মর মানুষের জন্য কার্যকর হবে না। আর তার কারণ এই যে, পূর্ব দিগনেত্ম চাঁদ দেখা গেলে পশ্চিম দিগনেত্ম দেখা দেয়া জরম্নরী। যেহেতু পূর্ব দিগনেত্ম চাঁদ ডোবার পূর্বে পশ্চিম দিগনেত্ম ডুবতে পারে না। এ মতই গ্রহণ করেছেন শায়খ ইবনে তাইমিয়া এবং অন্যান্যরা। তিনি সবশেষে বলেন,
والراجح: القول الثاني: وهو أن لكل أهل بلدة رؤيتهم إذا كان هناك مسافة بين البلدتين يمكن أن يُرى في البلدة الأخرى. وهذا ما عليه العمل.
অনুবাদ : এ ব্যাপারে প্রাধান্য পাবে দ্বিতীয় মতটি। অর্থাৎ যদি দুই শহরের মধ্যে এতটা দুরত্ব থাকে যে, এক শহরে চাঁদ না দেখা গেলেও অন্য শহরে দেখা যেতে পারে তাহলে প্রত্যেক শহরবাসীদের জন্য তাদের চাঁদ দেখা কার্যকর হবে। আর এর উপরই মানুষের আমল রয়েছে। (আবুত তুরাব সায়্যিদ বিন হুসাইন কর্তৃক লিখিত নিদাউর রয়্যান কিতাবে:৩৩৪/৩)

এ মাসআলায় হানাফী মাযহাবের অবস্থান :

এ মাসআলার ব্যাপারে হানাফী মাযহাবের সিদ্ধানত্মও পূর্বোক্ত মহামনীষীগণের অনুরূপ। অর্থাৎ উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য। সুতরাং নিকটবর্তী শহরের ক্ষেত্রে এক শহরের চাঁদ দেখা অন্য শহরের জন্য কার্যকর। তবে চাঁদের উদয়স্থল ভিন্ন হয়ে থাকে এমন দুরত্বে অবস্থিত শহরগুলোর ক্ষেত্রে এক শহরের চাঁদ দেখা অন্য শহরের জন্য কার্যকর হবে না। বরং প্রত্যেক শহরে স্বতন্ত্রভাবে চাঁদ দেখতে হবে।
‘চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় সুতরাং পশ্চিমের চাঁদ দেখা পূর্বের অধিবাসীদের জন্য অবশ্য অনুসরণীয়’ এ কথাগুলো হানাফী মাযহাবের মূল তিন ইমাম তথা আবু হানিফা, আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. কারো থেকেই বর্ণিত নয়। জাহিরুর রিওয়ায়েত তথা ইমাম মুহাম্মাদের লিখিত ছয়টি কিতাব যা হানাফী মাযহাবের মূল হিসেবে খ্যাত এর কোন কিতাবে এ মতটি উল্লেখ নেই। তবে ঐ ছয় কিতাব ব্যতীত হানাফী মাযহাবের নাদির তথা দুর্লভ বর্ণনায় ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, কোনো শহরের অধিবাসীরা যদি চাঁদ দেখে ত্রিশ রোযা রাখে তাহলে যে শহরের অধিবাসীরা উনত্রিশ রোযা রেখেছেন তারা একটি রোযা কাযা করবেন। এ মাসআলার ভিত্তিতে পরবর্তী কিছু ইমাম বলতে আরম্ভ করেছেন যে, হানাফী মাযহাবে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়। অথচ হানাফী মাযহাবের পূর্ববর্তী নির্ভরযোগ্য ফকীহগণ এ মাসআলার এমন অর্থ করেননি। বরং তাঁরা বুঝেছেন যে, এ বিধান কাছাকাছি অঞ্চলসমূহের ক্ষেত্রে কার্যকর; দূরের শহর-নগরের ক্ষেত্রে নয়। দূর-দূরানেত্মর শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক শহরের চাঁদ দেখা অন্য শহরের জন্য অনুসরণীয় নয়। ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণ ব্যতীত হানাফী মাযহাবের মূল মাসআলা বর্ণনার ক্ষেত্রে যে সকল প্রাচীন গ্রন্থ ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিলো সে সকল গ্রন্থেও এ মাসআলা বর্ণিত হয়নি। হানাফী মাযহাবের পরবর্তী কোন কোন কিতাবে যদিও খুলাসা ও খানিয়ার বরাতে এ মাসআলা লিখিত আছে, তবে এগুলোর লেখকগণ সকলেই দূর-দূরানেত্মর শহর-নগরে এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য কার্যকর না হওয়ার মতটি প্রাধান্য দিয়েছেন।
অতএব, উদয়স্থলের ব্যবধান ঘটতে পারে এমন দুরত্বে অবস্থিত প্রত্যেকটি অঞ্চলের জন্য তাদের নিজেস্ব চাঁদ দেখা কার্যকর হবে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান