আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
২৪- রোযার অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১৯৭৩
১২৩৫. নবী (ﷺ) এর রোযা পালন করা ও না করার বর্ণনা।
১৮৪৯। মুহাম্মাদ (রাহঃ) ......... হুমাইদ (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আনাস (রাযিঃ) কে নবী (ﷺ) এর নফল রোযার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, যেকোন মাসে আমি তাঁকে রোযা পালনরত অবস্থায় দেখতে চেয়েছি, তাঁকে সে অবস্থায় দেখেছি, আবার তাঁকে রোযা পালন না করা অবস্থায় দেখতে চাইলে তাও দেখতে পেয়েছি। রাতে যদি তাঁকে নামায আদায়রত অবস্থায় দেখতে চেয়েছি, তা প্রত্যক্ষ করেছি। আবার ঘুমন্ত দেখতে চাইলে তাও দেখতে পেয়েছি। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর হাত মুবারক হতে নরম কোন পশমী বা রেশমী কাপড় স্পর্শ করি নাই। আর আমি তাঁর (শরীরের) ঘ্রাণ হতে অধিক সুগন্ধযুক্ত কোন মিশক বা আম্বর পাইনি।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।
হযরত আনাস রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতের চেয়ে বেশি নরম কোনও দীবাজ ও হারীর স্পর্শ করিনি এবং রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুরভীর চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনও সুরভীর ঘ্রাণ কখনও নিইনি। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেবা করেছি দশ বছর। তিনি কখনও আমাকে লক্ষ্য করে বিরক্তি প্রকাশ করেননি এবং কখনও আমি কোনও কাজ করলে সেজন্য বলেননি তুমি এটা কেন করেছ। আর যে কাজ করিনি, সেজন্যও বলেননি তুমি এটা করলে না কেন।
دِيبَاج (দীবাজ) অর্থ রেশমি কাপড়। حَرِيرٌ (হারীর) অর্থ রেশম। রেশমি কাপড়কেও কখনও কখনও হারীর বলা হয়। তুলনামূলকভাবে দীবাজ অপেক্ষা হারীর বেশি মোলায়েম হয়ে থাকে। হাদীছটিতে হযরত আনাস রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতের চেয়ে বেশি মোলায়েম কোনও দীবাজ বা হারীর কখনও স্পর্শ করিনি। বোঝাতে চাচ্ছেন, তাঁর হাত খুব বেশি মোলায়েম ছিল।
তাঁর শরীর ছিল সুগন্ধিময়। হযরত আনাস রাযি.-এর সাক্ষ্য হচ্ছে যে, তিনি তাঁর শরীরকেই সবচে' বেশি সুগন্ধিময় পেয়েছেন। তাঁর শরীরের চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনও সুরভী তিনি কখনও শোঁকেননি। এটা ছিল তাঁর ঘামের সুরভী। হযরত আনাস রাযি. তাঁর মা উম্মু সুলায়ম রাযি. সম্পর্কে বলেন-
دَخَلَ عَلَيْنَا النَّبِيُّ ﷺ فَقَالَ عِنْدَنَا ، فَعَرِقَ ، وَجَاءَتْ أُمِّي بِقَارُورَة، فَجَعَلَتْ تَسْلِتُ الْعَرَقَ فِيْهَا، فَاسْتَيْقَظَ النَّبِيُّ ﷺ فَقَالَ: «يَا أَمَّ سُلَيْمٍ مَا هذَا الَّذِي تَصْنَعِيْنَ؟ قَالَتْ : هذَا عَرَقُكَ نَجْعَلُهُ فِي طِيبِنَا، وَهُوَ مِنْ أَطْيَبِ الطَّيبِ
একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে আসলেন। তিনি আমাদের এখানে দুপুরবেলা ঘুমালেন। এ অবস্থায় তাঁর শরীর থেকে ঘাম ঝরছিল। আমার মা উম্মু সুলায়ম রাযি. একটি শিশি এনে তার ভেতর সেই ঘাম ভরছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘুম ভেঙ্গে গেল। জিজ্ঞেস করলেন, হে উম্মু সুলায়ম! তুমি এটা কী করছ? তিনি বললেন, আপনার এ ঘাম আমরা আমাদের আতরে মেশাব। এর সুবাস আতরের চেয়ে বেশি।(সহীহ মুসলিম: ২৩৩১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ২৮৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ১৩৬১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৬৬১)
হযরত আনাস রাযি.-এর অপর এক বর্ণনায় আছে-
مَا شَمَمْتُ عَنْبَرًا قَطُّ، وَلَا مِسْكًا ، وَلَا شَيْئًا أَطْيَبَ مِنْ رِيْحِ رَسُوْلِ اللَّهِ ﷺ
আমি কখনও এমন কোনও আম্বর, কোনও মিশক বা অন্য কিছু শুঁকিনি, যার ঘ্রাণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘ্রাণের চেয়ে বেশি মধুর ছিল।(সহীহ মুসলিম: ২৩৩০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ৩১৭১৮; ইবন শাব্বাহ, ২ খণ্ড, ৬০৯ পৃ.: মুসনাদুল বাযযার: ৬৬৮৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ১৩৬১)
প্রকাশ থাকে যে, এ সুরভী ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মগত। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে সৃষ্টিই করেছিলেন এভাবে। সুতরাং এটা তাঁর এক মু'জিযা ও অলৌকিকত্ব।
তারপর হযরত আনাস রাযি. বলেন- وَلَقَدْ خَدَمْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ عَشْرَ سِنِينَ (আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেবা করেছি দশ বছর)। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাদানী জীবনের দশ বছর। তিনি মক্কা মুকাররামা থেকে হিজরত করে যখন মদীনা মুনাউওয়ারায় আসেন, তখন হযরত আনাস রাযি.-কে নিয়ে তাঁর মা তাঁর নিকট উপস্থিত হন এবং বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার জন্য এই ছোট্ট এক খাদেম নিয়ে এসেছি। তখন তাঁর বয়স দশ বছর। তখন থেকেই তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে থেকে তাঁর খেদমত করতে থাকেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত তিনি একটানা তাঁর খেদমত করেছেন। তখন আনাস রাযি.-এর বয়স হয়েছিল ২০ বছর। এই ১০ বছরের খেদমতকাল সম্পর্কে তিনি বর্ণনা করেন-
فَمَا قَالَ لِيْ قَط : اف (তিনি কখনও আমাকে লক্ষ্য করে বিরক্তি প্রকাশ করেননি)। اف একটি বিরক্তিব্যঞ্জক শব্দ। আরবী ভাষাভাষীগণ কোনও কারণে কারও প্রতি বিরক্ত হলে اف শব্দ দ্বারা তা প্রকাশ করে। বাংলায় আমরা বলে থাকি, উহ্। আমরা এটা যেমন ব্যথা পেলেও বলি, তেমনি বিরক্ত হলেও বলে থাকি। তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ প্রিয় বালক খাদেমের প্রতি কখনও বিরক্ত হয়ে এ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। একজন বালকবয়সী খাদেমের ভুলচুক হওয়ারই কথা। নিশ্চয়ই হযরত আনাস রাযি.-এর দ্বারাও কখনও কখনও ভুল হয়েছিলও। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা তা জানাও যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কখনও তার প্রতি বিরক্ত হননি। এটা তাঁর মহান ও উন্নত চরিত্রেরই পরিচায়ক।
হযরত আনাস রাযি. আরও বলেন- وَلَا قَالَ لِشَيءٍ فَعَلْتُهُ: لِمَ فَعَلْتَهُ؟ (এবং কখনও আমি কোনও কাজ করলে সেজন্য বলেননি তুমি এটা কেন করেছ)। অর্থাৎ ছোট বা বড় এমন কোনও কাজ যদি আমি কখনও করেছি, যা করা উচিত ছিল না বা না করাই ভালো ছিল, তবুও তিনি আমাকে তা করার কারণ জিজ্ঞেস করেননি।
শিশু ও বালকেরা অনেক সময়ই এমন এমন কাজ করে থাকে, যা বড়দের মনমতো হয় না বা তাদের পক্ষ থেকে সেরকম কাজ করার অনুমতিও থাকে না। সব বয়সেরই এক রকম চাহিদা ও মানসিকতা থাকে। সে অনুপাতে একেক বয়সীরা একেক রকম কাজ করে বসে, যা অনেক সময়ই সঙ্গত ও সঠিক হয় না। শিশু ও বালকদের এরূপ কাজকর্মকে যদি তাদের বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়, তবে তা স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কিন্তু বড়রা অনেক সময় কাজটিই লক্ষ করে, কর্তার বয়স চিন্তা করে না। ফলে কাজটিকে অপরাধরূপে বিবেচনা করে। অনেক সময় সে কারণে ধমক তো বটেই, শাস্তিও দিয়ে বসে। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ কাজকে হয়তো তাদের বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক মনে করতেন কিংবা সেরকম কাজকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন। সর্বাবস্থায়ই এটা তাঁর মহানুভব চরিত্রের নিদর্শন।
হযরত আনাস রাযি. আরও বলেন- وَلَا لِشَيْءٍ لَمْ أَفْعَلْهُ: أَلا فَعَلْتَ كَذَا (আর যে কাজ করিনি, সেজন্যও বলেননি তুমি এটা করলে না কেন)। অর্থাৎ যে কাজটি করা দরকার ছিল, তা না করলেও তিনি সেজন্য কৈফিয়ত নিতেন না। তিনি আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি আত্মনিবেদিত ছিলেন। যে কাজ করা হয়নি, ভাবতেন আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ছিল না বলে হয়নি। এ অবস্থায় কৈফিয়ত নেওয়ার কোনও ফায়দা নেই। বরং আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশই বাঞ্ছনীয়। এটাও তাঁর মহৎ চরিত্র। আমরা সাধারণত এরূপ ক্ষেত্রে কৈফিয়ত চেয়ে থাকি। মেযাজ খারাপ করি। তিনি তাঁর এ চরিত্র দ্বারা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যেন আমরা খাদেম ও সেবকদের ভুলত্রুটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখি এবং তাদেরকে বেশি বেশি ক্ষমা করতে অভ্যস্ত হই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শারীরিকভাবেও সুন্দরতম ছিলেন।
খ. তাঁর শরীর ছিল সৌরভময়। সাধ্যমতো ভালো আতর দ্বারা নিজেকে সুরভিত রাখলে তাঁর সঙ্গে এক পর্যায়ের সাদৃশ্য স্থাপিত হবে। এটা কাম্য।
গ. কেউ তার ব্যক্তিগত কাজকর্মের জন্য খাদেম রাখলে তাতে দোষের কিছু নেই।
ঘ. খাদেমের দোষত্রুটিকে অবশ্যই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে।
ঙ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক বেশি ক্ষমাশীল ও মহানুভব ছিলেন।
হযরত আনাস রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতের চেয়ে বেশি নরম কোনও দীবাজ ও হারীর স্পর্শ করিনি এবং রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুরভীর চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনও সুরভীর ঘ্রাণ কখনও নিইনি। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেবা করেছি দশ বছর। তিনি কখনও আমাকে লক্ষ্য করে বিরক্তি প্রকাশ করেননি এবং কখনও আমি কোনও কাজ করলে সেজন্য বলেননি তুমি এটা কেন করেছ। আর যে কাজ করিনি, সেজন্যও বলেননি তুমি এটা করলে না কেন।
دِيبَاج (দীবাজ) অর্থ রেশমি কাপড়। حَرِيرٌ (হারীর) অর্থ রেশম। রেশমি কাপড়কেও কখনও কখনও হারীর বলা হয়। তুলনামূলকভাবে দীবাজ অপেক্ষা হারীর বেশি মোলায়েম হয়ে থাকে। হাদীছটিতে হযরত আনাস রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতের চেয়ে বেশি মোলায়েম কোনও দীবাজ বা হারীর কখনও স্পর্শ করিনি। বোঝাতে চাচ্ছেন, তাঁর হাত খুব বেশি মোলায়েম ছিল।
তাঁর শরীর ছিল সুগন্ধিময়। হযরত আনাস রাযি.-এর সাক্ষ্য হচ্ছে যে, তিনি তাঁর শরীরকেই সবচে' বেশি সুগন্ধিময় পেয়েছেন। তাঁর শরীরের চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনও সুরভী তিনি কখনও শোঁকেননি। এটা ছিল তাঁর ঘামের সুরভী। হযরত আনাস রাযি. তাঁর মা উম্মু সুলায়ম রাযি. সম্পর্কে বলেন-
دَخَلَ عَلَيْنَا النَّبِيُّ ﷺ فَقَالَ عِنْدَنَا ، فَعَرِقَ ، وَجَاءَتْ أُمِّي بِقَارُورَة، فَجَعَلَتْ تَسْلِتُ الْعَرَقَ فِيْهَا، فَاسْتَيْقَظَ النَّبِيُّ ﷺ فَقَالَ: «يَا أَمَّ سُلَيْمٍ مَا هذَا الَّذِي تَصْنَعِيْنَ؟ قَالَتْ : هذَا عَرَقُكَ نَجْعَلُهُ فِي طِيبِنَا، وَهُوَ مِنْ أَطْيَبِ الطَّيبِ
একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে আসলেন। তিনি আমাদের এখানে দুপুরবেলা ঘুমালেন। এ অবস্থায় তাঁর শরীর থেকে ঘাম ঝরছিল। আমার মা উম্মু সুলায়ম রাযি. একটি শিশি এনে তার ভেতর সেই ঘাম ভরছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘুম ভেঙ্গে গেল। জিজ্ঞেস করলেন, হে উম্মু সুলায়ম! তুমি এটা কী করছ? তিনি বললেন, আপনার এ ঘাম আমরা আমাদের আতরে মেশাব। এর সুবাস আতরের চেয়ে বেশি।(সহীহ মুসলিম: ২৩৩১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ২৮৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ১৩৬১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৬৬১)
হযরত আনাস রাযি.-এর অপর এক বর্ণনায় আছে-
مَا شَمَمْتُ عَنْبَرًا قَطُّ، وَلَا مِسْكًا ، وَلَا شَيْئًا أَطْيَبَ مِنْ رِيْحِ رَسُوْلِ اللَّهِ ﷺ
আমি কখনও এমন কোনও আম্বর, কোনও মিশক বা অন্য কিছু শুঁকিনি, যার ঘ্রাণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘ্রাণের চেয়ে বেশি মধুর ছিল।(সহীহ মুসলিম: ২৩৩০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ৩১৭১৮; ইবন শাব্বাহ, ২ খণ্ড, ৬০৯ পৃ.: মুসনাদুল বাযযার: ৬৬৮৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ১৩৬১)
প্রকাশ থাকে যে, এ সুরভী ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মগত। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে সৃষ্টিই করেছিলেন এভাবে। সুতরাং এটা তাঁর এক মু'জিযা ও অলৌকিকত্ব।
তারপর হযরত আনাস রাযি. বলেন- وَلَقَدْ خَدَمْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ عَشْرَ سِنِينَ (আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেবা করেছি দশ বছর)। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাদানী জীবনের দশ বছর। তিনি মক্কা মুকাররামা থেকে হিজরত করে যখন মদীনা মুনাউওয়ারায় আসেন, তখন হযরত আনাস রাযি.-কে নিয়ে তাঁর মা তাঁর নিকট উপস্থিত হন এবং বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার জন্য এই ছোট্ট এক খাদেম নিয়ে এসেছি। তখন তাঁর বয়স দশ বছর। তখন থেকেই তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে থেকে তাঁর খেদমত করতে থাকেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত তিনি একটানা তাঁর খেদমত করেছেন। তখন আনাস রাযি.-এর বয়স হয়েছিল ২০ বছর। এই ১০ বছরের খেদমতকাল সম্পর্কে তিনি বর্ণনা করেন-
فَمَا قَالَ لِيْ قَط : اف (তিনি কখনও আমাকে লক্ষ্য করে বিরক্তি প্রকাশ করেননি)। اف একটি বিরক্তিব্যঞ্জক শব্দ। আরবী ভাষাভাষীগণ কোনও কারণে কারও প্রতি বিরক্ত হলে اف শব্দ দ্বারা তা প্রকাশ করে। বাংলায় আমরা বলে থাকি, উহ্। আমরা এটা যেমন ব্যথা পেলেও বলি, তেমনি বিরক্ত হলেও বলে থাকি। তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ প্রিয় বালক খাদেমের প্রতি কখনও বিরক্ত হয়ে এ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। একজন বালকবয়সী খাদেমের ভুলচুক হওয়ারই কথা। নিশ্চয়ই হযরত আনাস রাযি.-এর দ্বারাও কখনও কখনও ভুল হয়েছিলও। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা তা জানাও যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কখনও তার প্রতি বিরক্ত হননি। এটা তাঁর মহান ও উন্নত চরিত্রেরই পরিচায়ক।
হযরত আনাস রাযি. আরও বলেন- وَلَا قَالَ لِشَيءٍ فَعَلْتُهُ: لِمَ فَعَلْتَهُ؟ (এবং কখনও আমি কোনও কাজ করলে সেজন্য বলেননি তুমি এটা কেন করেছ)। অর্থাৎ ছোট বা বড় এমন কোনও কাজ যদি আমি কখনও করেছি, যা করা উচিত ছিল না বা না করাই ভালো ছিল, তবুও তিনি আমাকে তা করার কারণ জিজ্ঞেস করেননি।
শিশু ও বালকেরা অনেক সময়ই এমন এমন কাজ করে থাকে, যা বড়দের মনমতো হয় না বা তাদের পক্ষ থেকে সেরকম কাজ করার অনুমতিও থাকে না। সব বয়সেরই এক রকম চাহিদা ও মানসিকতা থাকে। সে অনুপাতে একেক বয়সীরা একেক রকম কাজ করে বসে, যা অনেক সময়ই সঙ্গত ও সঠিক হয় না। শিশু ও বালকদের এরূপ কাজকর্মকে যদি তাদের বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়, তবে তা স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কিন্তু বড়রা অনেক সময় কাজটিই লক্ষ করে, কর্তার বয়স চিন্তা করে না। ফলে কাজটিকে অপরাধরূপে বিবেচনা করে। অনেক সময় সে কারণে ধমক তো বটেই, শাস্তিও দিয়ে বসে। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ কাজকে হয়তো তাদের বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক মনে করতেন কিংবা সেরকম কাজকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন। সর্বাবস্থায়ই এটা তাঁর মহানুভব চরিত্রের নিদর্শন।
হযরত আনাস রাযি. আরও বলেন- وَلَا لِشَيْءٍ لَمْ أَفْعَلْهُ: أَلا فَعَلْتَ كَذَا (আর যে কাজ করিনি, সেজন্যও বলেননি তুমি এটা করলে না কেন)। অর্থাৎ যে কাজটি করা দরকার ছিল, তা না করলেও তিনি সেজন্য কৈফিয়ত নিতেন না। তিনি আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি আত্মনিবেদিত ছিলেন। যে কাজ করা হয়নি, ভাবতেন আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ছিল না বলে হয়নি। এ অবস্থায় কৈফিয়ত নেওয়ার কোনও ফায়দা নেই। বরং আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশই বাঞ্ছনীয়। এটাও তাঁর মহৎ চরিত্র। আমরা সাধারণত এরূপ ক্ষেত্রে কৈফিয়ত চেয়ে থাকি। মেযাজ খারাপ করি। তিনি তাঁর এ চরিত্র দ্বারা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যেন আমরা খাদেম ও সেবকদের ভুলত্রুটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখি এবং তাদেরকে বেশি বেশি ক্ষমা করতে অভ্যস্ত হই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শারীরিকভাবেও সুন্দরতম ছিলেন।
খ. তাঁর শরীর ছিল সৌরভময়। সাধ্যমতো ভালো আতর দ্বারা নিজেকে সুরভিত রাখলে তাঁর সঙ্গে এক পর্যায়ের সাদৃশ্য স্থাপিত হবে। এটা কাম্য।
গ. কেউ তার ব্যক্তিগত কাজকর্মের জন্য খাদেম রাখলে তাতে দোষের কিছু নেই।
ঘ. খাদেমের দোষত্রুটিকে অবশ্যই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে।
ঙ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক বেশি ক্ষমাশীল ও মহানুভব ছিলেন।
