মা'আরিফুল হাদীস
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
হাদীস নং: ১
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
يٰأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اذْكُرُو اللّٰهَ ذِكْرًا كَثِيْرًا وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وأصِيْلاً.
"হে ঈমানদারগণ! (অন্তর ও রসনার মাধ্যমে) আল্লাহকে বহুলভাবে স্মরণ কর এবং (বিশেষত) সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা কর।"
وَادْعُوْهُ خَوْفًا وَطَمَعًا إِنَّ رَحْمَتَ اللّٰهِ قَرِيْبٌ مِّنَ الْمُحْسِنِيْنَ.
"(নিজেদের ভুল-ত্রুটির জন্যে আল্লাহর ধরপাকড় ও শাস্তি থেকে) ভীতির সাথে এবং (তাঁর রহম ও করমের) আশায় আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাও! আল্লাহর রহমত নিঃসন্দেহে সৎকর্মশীল বান্দাদের নিকটেই রয়েছে।" (আল-আ'রাফ: ৫৬)
'মা'আরিফুল হাদীছ' 'কিতাবুৎ-তাহারাত'-এর একেবারে শুরুতেই 'হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা'-এর বরাতে এ বক্তব্যটি উদ্ধৃত করা হয়েছে:
আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে এই তত্ত্ব জানিয়ে দিয়েছেন যে, কল্যাণ ও সৌভাগ্যের যে রাজপথের দিকে আহ্বানের জন্যে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম প্রেরিত হয়েছিলেন, (যার নাম হচ্ছে শরীয়ত) যদিও তার অনেক তোরণদ্বার রয়েছে এবং প্রত্যেক তোরণদ্বারের অধীন শত শত হাজার হাজার আহকাম রয়েছে, কিন্তু এগুলোর এ প্রাচুর্য সত্ত্বেও এসব নীতিগতভাব মোটামুটি চারটি শিরোনামের অধীনে এসে যায়: ১. তাহারাত ২. ইখবাত ৩. সামাহাত ৪. আদালত।
এতটুকু লেখার পর শাহ সাহেব (র) এ চারটির প্রত্যেকটির গূঢ়তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন। তা পাঠ করলে একথা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নিঃসন্দেহে শরীয়ত ঐ চারটি শাখায়ই বিভক্ত।
মা'আরিফুল হাদীছ তৃতীয় জিলদে 'কিতাবুৎ তাহারাত' এর শুরুতে হযরত শাহ্ সাহেব (র)-এর সেই বক্তব্যের শুধু ততটুকু অংশই সংক্ষিপ্তভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছিল-যাতে তিনি তাহারাত বা পবিত্রতার মূলতত্ত্ব বর্ণনা করেছিলেন।
ইখবাত-এর মৌলতত্ত্ব সম্পর্কে তিনি যা কিছু লিখেছেন, তা সংক্ষিপ্তাকারে এভাবে বলা যায়:
"বিস্ময়, ভীতি ও মহব্বত এবং সন্তুষ্টি কামনা ও অনুগ্রহ প্রার্থনার স্পীরিটের সাথে আল্লাহ যুল-জালাল ও জাবারুতের হুযুরে যাহির ও বাতিনের দ্বারা নিজের বন্দেগী, দীনতা, মুখাপেক্ষিতা ও ভিখারীপনার অভিব্যক্তি ঘটানোই হচ্ছে ইখবাত।”
এরই অপর বিখ্যাত শিরোনাম বা পরিচিতি হচ্ছে ইবাদত। আর এটাই হচ্ছে
মানব সৃষ্টির বিশেষ উদ্দিষ্ট:
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنَ
"জিন ও ইনসানকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যেই সৃষ্টি করেছি।"
হযরত শাহ্ সাহেব (র) সৌভাগ্যের উক্ত চারটি শাখা সম্পর্কে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা-এর মকসদ ২-এ 'আবওয়াবুল ইহসান' অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। এ আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেন:
"ঐগুলির প্রথমটি অর্থাৎ তাহারাত অর্জনের জন্যে ওযু-গোসল প্রভৃতির হুকুম দেওয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয়টা অর্থাৎ 'ইখবাত' হাসিলের ওসীলা হচ্ছে নামায, আযকার ও কুরআন মজীদ তিলাওয়াত।" (আবওয়াবুল ইহসান, হুজ্জাতুল্লাহি বালিগা, জিলদ ২, পৃ. ৬৭)
বরং বলা যায়, যিকরুল্লাহ তথা আল্লাহর স্মরণই ইখবাতের বিশেষ ওসীলা স্বরূপ আর নামায, তিলাওয়াত এবং অনুরূপভাবে দু'আও এর বিশেষ বিশেষ রূপ।
মোদ্দা কথা, নামায, যিকরুল্লাহ, কুরআন মজীদ তিলাওয়াত এ সবের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই মুবারক গুণ অর্জন ও তার পূর্ণতা বিধান, যাকে হযরত শাহ ওলীউল্লাহ (র) 'ইখবাত' বলে অভিহিত করেছেন। এজন্যে এ সবই একই পর্যায়ভুক্ত।
নামায সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাদীসসমূহ এবং তাঁর বাণী ও অভ্যাস বা আচরিত পন্থা সম্পর্কে আল্লাহর তওফীক অনুযায়ী এ সিরিজের তৃতীয় জিলদে উপস্থাপিত হয়েছে। যিকির, দু'আ ও তিলাওয়াত সংক্রান্ত হাদীসসমূহ এখন এই পঞ্চম জিলদে পেশ করা হচ্ছে।
আল্লাহ তা'আলা এ গুনাহগার লিখককে, সহৃদয় পাঠকবর্গকে তার উপর আমল করার এবং এগুলো থেকে পুরোপুরি উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন।
আল্লাহর যিকিরের মাহাত্ম্য এবং এর বরকতসমূহ
যেমনটি উপরে বলা হয়েছে, যিকরুল্লাহ বা আল্লাহর যিকির শব্দটি ব্যাপক অর্থে সালাত (নামায), কুরআন তিলাওয়াত, দু'আ ও ইস্তিগফার সবকিছুর ব্যাপারেই প্রযোজ্য এবং এসব হচ্ছে যিকরুল্লাহরই বিশেষ বিশেষ রূপ। কিন্তু বিশেষ অর্থে যিকরুল্লাহ হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার তাসবীহ-তাকদীস তথা মাহাত্ম্য বর্ণনা তাওহীদ-তামজীদ, তাঁর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা এবং তাঁর পূর্ণতার গুণ বর্ণনা ও ধ্যান করা। পারিভাষিক অর্থে একেই যিকরুল্লাহ বা আল্লাহর যিকির বলা হয়ে থাকে। সম্মুখে বর্ণিতব্য কোন কোন হাদীছের দ্বারা স্পষ্টভারে জানা যাবে যে, এই যিকরুল্লাহ হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি এবং মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং ঊর্ধ্বজগতের সাথে তার সম্পর্কের খাস ওসীলা স্বরূপ।
শায়খ ইবনুল কাইয়েম (র) তাঁর 'মাদারিজুস সালিকীন' (مدارج السالكين) নামক গ্রন্থে যিকরুল্লাহর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব এবং তার বরকতসমূহ সম্পর্কে অত্যন্ত শিক্ষণীয় এবং আত্মার উৎকর্ষ বিধায়ক বর্ণনা দিয়েছেন। তার একাংশের সংক্ষিপ্ত সার আমরা এখানে উদ্ধৃত করছি। বর্ণিতব্য হাদীসসমূহে যিকরুল্লাহর যে মাহাত্ম্য বর্ণিত হবে, শায়খ ইব্ন কাইয়েম (র) লিখিত উক্ত বক্তব্যটি পাঠের পর তা অনুধাবন করা ইনশাআল্লাহ অনেকটা সহজ হবে। তিনি লিখেন:
"কুরআন মজীদে যিকরুল্লাহর তাকিদ ও উৎসাহদানের যে দশটি শিরোনাম পাওয়া যায়, তা নিম্নরূপ:
১. কোন কোন আয়াতে ঈমানদারগণকে তাকিদসহকারে তার আদেশ দান করা
হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে:
يٰأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اذْكُرُو اللّٰهَ ذِكْرًا كَثِيرًا وَسَبِّحُوْهُ بُكْرَةً وأَصِيْلاً
“হে ঈমানদারগণ, বহুল পরিমাণে আল্লাহর যিকির করবে এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করবে।" (সূরা আহযাব, ষষ্ঠ রুকূ')
অন্য আয়াতে আছে:
وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيْفَةً (الأعراف (٢٤)
মনে মনে এবং কান্নাকাটি করে ও ভয়ের সাথে তোমার প্রভুর যিকির করবে।"
(আ'রাফ রুকু' ২৪)
২. কোন কোন আয়াতে আল্লাহকে বিস্মৃত হতে এবং তাঁর স্মরণ থেকে গাফেল হতে কঠোরভাবে মানা করা হয়েছে। এটাও যিকরুল্লাহর তাকিদেরই একটা ধরন।
বলা হয়েছে:
وَلَا تَكُنْ مِّنَ الْغَافِلِيْنَ
"এবং তোমরা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।" (আল আ'রাফ: ২৪তম রুকূ')
অন্যত্র বলা হয়েছে:
وَلَا تَكُونُوْا كَالَّذِيْنَ نَسُوا اللّٰهَ فَانْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ (الحشر (٢٤)
"এবং তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়োনা, যারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে (ফলশ্রুতিতে) আল্লাহরও বিস্তৃত করিয়ে দিয়েছেন তাদের নিজেদেরকে" অর্থাৎ আল্লাহ বিস্মৃতির পরিণতিতে তারা হয়েছে আত্মবিস্মৃত। (আল-হাশর ৩য় রুকু)
৩. কোন কোন আয়াতে বলা হয়েছে যে, সাফল্য নিহিত রয়েছে আল্লাহর প্রচুর যিকিরের সাথে। বলা হয়েছে:
وَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ.
"বহুল পরিমাণে আল্লাহর যিকির করবে, যাতে করে তোমরা সাফল্যমণ্ডিত হতে পারো।"
(সূরা জুমুআ ২য় রুকু)
৪. কোন কোন আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে যিকির ওয়ালা বান্দাদের প্রশংসা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, যিকিরের বিনিময়ে তাদের সাথে রহমত ও মাগফিরাতের খাস মুআমেলা করা হবে এবং তাদেরকে বিপুল বিনিময় প্রদানে ধন্য করা হবে। তাই সূরা আহযাবে ঈমান ওয়ালা নারী-পুরুষ বান্দাহদের অন্যান্য গুণাবলীর সাথে সাথে বলা হয়েছে:
والذّٰكِرِينَ اللّٰهَ كَثِيْرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللّٰهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عظِيمًا.
"আর আল্লাহর প্রচুর পরিমাণে যিকিরকারী নারী-পুরুষ বান্দাগণ-আল্লাহর তা'আলা তাদের জন্যে তৈরি করে রেখেছেন মাগফিরাত ও বিরাট ছওয়াব।"
৫. অনুরূপভাবে কোন কোন আয়াতে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, যারা দুনিয়ার বাহার ও স্বাদে-ভোগে নিমগ্ন হয়ে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে যাবে, তারা ব্যর্থকাম হবে। যেমন সূরা মুনাফিকুনে ইরশাদ হয়েছে:
يٰأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَالِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ (المنافقون ع (۲)
"হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ধন-সম্পদ এবং তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল করে না দেয়। যারা এরূপ গাফলতে নিমগ্ন হবে, তারাই হলো ক্ষতিগ্রস্ত।"
(আল-মুনাফিকূন রুকূ'-২)
এই তিনটি শিরোনামও যিকরুল্লাহর তাগিদ ও উৎসাহ প্রদানের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কার্যকরী।
৬. কোন কোন আয়াতে বলা হয়েছে যে, যে বান্দারা আমাকে স্মরণ করবে, আমিও তাদেরকে স্মরণ করবো:
فَاذْكُرُوْنِيْ أَذْكُرُكُمْ وَاشْكُرُوْا لِيْ وَلَا تَكْفُرُوْنِ (بقرة ع (۱۸)
"হে আমার বান্দারা, তোমরা আমাকে স্মরণ কর, তা হলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ রাখবো, তোমরা আমার শুকরিয়া আদায় করবে এবং না-শুকরী করবে না।"
(বাকারা ১৮তম রুকূ')
সুবহানাল্লাহি ও বিহামদিহী! বান্দার জন্য এর চাইতে বড় সাফল্য ও সৌভাগ্য আর কী হতে পারে যে, স্বয়ং বিশ্বজাহানের স্রষ্টা ও প্রতিপালক তাকে স্মরণ করবেন ও স্মরণ রাখবেন।
৭. কোন কোন আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর যিকির প্রত্যেক বস্তুর মুকাবিলায় গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রাখে এবং তা এ বিশ্বজগতের সবকিছু থেকে উচ্চতর ও মর্যাদা সম্পন্ন।
وَلَذِكْرُ اللّٰهِ أَكْبَرُ ( عنكبوت ع (٥)
"নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর যিকির প্রত্যেক বস্তু থেকেই উচ্চতর।"
(আনকাবূত রুকূ'-৫)
নিঃসন্দেহে বান্দাহর ভাগ্যে যদি প্রতীতি জুটে তাহলে তার জন্য আল্লাহর যিকির বিশ্বের সবকিছু থেকে উচ্চতর।
৮. কোন কোন আয়াতে অনেক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন আমল প্রসঙ্গে আল্লাহর যিকির করার হিদায়াত করা হয়েছে, যেন যিকরুল্লাহই সে সব আমলের উপসংহার স্বরূপ হয়। যেমন নামায সম্পর্কে বলা হয়েছে:
فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلٰوةَ فَاذْكُرُوْا اللّٰهَ قِيَامًا وَقُعُوْدًا وَعَلٰى جُنُوبِكُمْ (النساء ع (١٥)
"ফলে তোমরা যখন সালাত সম্পন্ন করবে, তখন আল্লাহর যিকির করবে দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় এবং পার্শ্বদেশের উপর শায়িত অবস্থায়।"
(আন্ নিসা: রুকূ-১৫)
এবং বিশেষত জুমার নামায সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে:
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلٰوةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ وَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ. (الجمعة ٤-٢)
যখন জুমার নামায সম্পন্ন করবে, তখন (অনুমতি রয়েছে যে,) তোমরা (মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজেদের কাজকর্ম উপলক্ষে) পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অনুসন্ধানে লিপ্ত হবে এবং সে অবস্থায়ও আল্লাহর যিকির বহুল পরিমাণে করবে- যাতে করে তোমরা সাফল্যমণ্ডিত হতে পারো।" (জুমুআ রুকু-২)
এবং হজ্জ সম্পর্কে বলা হয়েছে:
فَإِذَا قَضَيْتُمْ مَنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَذِكْرِكُمْ آبَائَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا . (بقرة ع ٢٥)
"তারপর যখন হজ্জের মানাসিক বা রীতিসমূহ পালন করে ফারেগ হয়ে যাবে তখন আল্লাহর যিকির বা স্মরণ করবে যেমনটি তোমরা (পারস্পরিক বড়াই করতে গিয়ে) তোমাদের পিতৃপুরুষের কথা স্মরণ ও উল্লেখ করে থাকো অথবা তার চাইতে ও বেশি আল্লাহর যিকির করবে।" (বাকারা ২৫তম রুকূ)
উক্ত আয়াতগুলো দ্বারা জানা গেল যে, নামায ও হজ্জের মত উচ্চ দর্জার ইবাদতসমূহ থেকে ফারেগ হওয়ার পরও তার অন্তরে ও রসনায় আল্লাহর যিকির থাকা চাই এবং যিকিরই হবে তার আমলের ইতি স্বরূপ।
৯. কোন কোন আয়াতে যিকরুল্লাহর তাকিদ দেয়া হয়েছে এভাবে যে, বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ব্যক্তি তারাই, যারা আল্লাহর যিকির থেকে গাফিল হয় না। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো, যারা আল্লাহর যিকির থেকে গাফিল হয়, তারা দূরদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত। যেমন সূরা আলে ইমরানের শেষ রুকুতে ইরশাদ করা হয়েছে:
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لأُولِي الْأَلْبَابِ الَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللّٰهَ قِيَامًا وَقُعُوْدًا وَعَلٰى جُنُوبِهِمْ. ال عمران ع (۲۰)
নিঃসন্দেহে আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং দিন-রাত্রির আবর্তনে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্যে যারা স্মরণ (যিকির) করে আল্লাহকে দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় এবং তাদের পার্শ্ব দেশে শায়িত অবস্থায়।
(সূরা আলে ইমরান রুকু-২০)
১০. কোন কোন আয়াত থেকে জানা যায় আমল যতই উচ্চ হোক না কেন, তার প্রাণ হচ্ছে যিকরুল্লাহ। যেমন নামায সম্পর্কে বলা হয়েছে:
أقِمِ الصَّلٰوةَ لِذِكْرِى (طه ع (۱)
"আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর।" (সূরা তাহা রুকু-১)
মানাসিকে হজ্জ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন:
إنما جعل الطواف بالبيت والسعي بين الصفا والمروة ورمي الجمار لإقامة ذكر اللّٰه
বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ এবং কঙ্কর নিক্ষেপ- এ সব যিকরুল্লাহর উদ্দেশ্যেই নির্ধারণ করা হয়েছে।
জিহাদ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা'আলার ঘোষণা:
يَأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا لَقِيْتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوْا وَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِيْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ . (انفال ع (٦)
“হে ঈমানদারগণ! যখন দুশমনদের সাথে তোমাদের মুকাবিলা হয় তখন তোমরা ধৈর্য-স্থৈর্য অবলম্বন করবে এবং আল্লাহর অধিক যিকির করবে (আল্লাহকে স্মরণ করবে) যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পার।
(আনফাল রুকূ-৬)
একটি হাদীছে কুদসীতে আছে:
إن عبدي كل عبدي الذي يذكرني وهو ملاق قرنه
"আমার বান্দা এবং পূর্ণ বান্দা সে-ই, যে তার শত্রুর সাথে যুদ্ধরত অবস্থায়ও আমাকে স্মরণ করে।"
কুরআন ও হাদীছের এ সুস্পষ্ট বাণীগুলো দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হলো যে, সালাত থেকে নিয়ে জিহাদ পর্যন্ত সমস্ত সৎ কর্ম বা আমালে সালেহের প্রাণ হচ্ছে যিকরুল্লাহ বা আল্লাহর যিকির। আর এই যিকির তথা অন্তর ও রসনার দ্বারা আল্লাহর স্মরণই হচ্ছে বেলায়েতের পরওয়ানা স্বরূপ। যে এ পরওয়ানা লাভ করলো, সে সব পেয়েছি-এর পাওয়াটিই পেয়ে গেল আর যে এথেকে বঞ্চিত হলো, সে চিরবঞ্চিত ও পরিত্যক্তই রয়ে গেল। এই যিকরুল্লাহই হচ্ছে আল্লাহওয়ালাদের কালবের খোরাক এবং জীবন ধারণের অবলম্বন। যদি তাই তাদের না জুটে তা হলে তাদের দেহ তাদের কালবের জন্যে কবর স্বরূপ হয়ে যায়। যিকির-এর দ্বারাই হৃদয়ের জগত আবাদ হয়েছে। যিকির বিহনে হৃদয়ের সে জগত বিলকুল বিরান হয়ে যায়। যিকরের অস্ত্র দিয়েই তারা আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রের দস্যু-তস্করদের সাথে যুদ্ধ করে থাকেন। এই যিকিরই তাদের জন্যে শীতল পানি স্বরূপ, যদ্বারা তারা বাতেনের আগুন নির্বাপিত করে থাকেন। এই যিকিরই তাদের ব্যাধির ওষুধ স্বরূপ। এ ওষুধ বিহনে তাদের অন্তর নির্জীব হয়ে যায়। এই যিকিরই তাদের এবং তাদের প্রভু পরোয়ারদিগারের মধ্যকার সেতুবন্ধন স্বরূপ। কী চমৎকারই না বলেছেন কবি:
إِذَا مَرِضْنَا تَدَاوَيْنَا بِذِكْرِكُمْ
فَنْتَرُكُ الذِّكْرَ أَحْيَانًا فَنَتَكَّسُ
যখন আমি হই পীড়িত ওষুধ হলো যিকির তোমার
যখন যিকির দেই কো ছেড়ে নামান্তর তা মরতে বসার।
আল্লাহ তা'আলা যেমন দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন চোখের সৌন্দর্য ও সৌষ্ঠব নিহিত রেখেছেন দৃষ্টি শক্তির মধ্যে, ঠিক তেমনি যিকিরকারী রসনা সমূহের সৌষ্ঠব ও সৌন্দর্যও নিহিত রেখেছেন যিকিরের মধ্যে। সুতরাং আল্লাহ তা'আলার যিকির থেকে গাফেল রসনা দৃষ্টিশক্তি হারা চোখ, শ্রবণশক্তি বঞ্চিত কান এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাতের মতই নিষ্ক্রিয় ও বেকার।
যিকরুল্লাহই সেই একমাত্র খোলা দরজা পথ, যে দরজা দিয়ে বান্দা হক তা'আলা জাল্লা শানুহুর দরবার পর্যন্ত অবলীলাক্রমে পৌঁছে যেতে পারে। আর যখন বান্দা আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল হয়ে যায়, তখন এ দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়। কী চমৎকারই না বলেছেন আরবী কবি:
فَنِسْيَانُ ذِكْرِ اللّٰهِ مَوْتُ قُلُوبِهِمْ
وَأَجْسَامُهُمْ قَبْلَ الْقَبُورِ قُبُوْرٌ
وَأَرْوَاحُهُمْ فِيْ وَحْشَةٍ مِّنْ جُسُوْمِهِمْ
وَلَيْسَ لَهُمْ حَتّٰى النُّشُوْرِ نُشُوْرٌ
আল্লাহর যিকির থেকে গাফলতি মৃত্যু তাদের
কবরের আগেই দেহ সাজে যে কবর গহ্বর
দেহ মাঝে হৃদি তখন উসুখস্ করে নিরন্তর
পুনরুত্থান পূর্বে যেন জীবন আর নাই কেহ তাদের।
[মাদারিজুস সালিকীনে লিখিত শায়খ ইবনুল কাইয়েমের বক্তব্যের সার সংক্ষেপ]
এ দীন লেখকের আরয হচ্ছে উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে যিকরুল্লাহর তাকিদ ও উৎসাহ ব্যঞ্জক যে দশটি শিরোনাম বা ধারার বর্ণনা রয়েছে, কুরআন মজীদে এগুলো ছাড়াও অন্যভাবেও যিকরুল্লাহর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে:
অন্তরসমূহ (অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা রক্ষাকারী দেল ও রূহসমূহ)
আল্লাহর যিকিরেই প্রশান্তি লাভ করে থাকে:
اَلَا بِذِكْرِ اللّٰهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوْبُ
যিকরুল্লাহর তাছীর ও বরকত সম্পর্কে অপর একজন রব্বানী মুহাক্কিক ও সূফী ترصيع الجواهر المكية এর লেখক-এর কয়েকটি বাক্যের তরজমাও এর সাথে পড়ে নিন, তাহলে এ অধ্যায়ে আলোচিতব্য হাদীছগুলো অনুধাবনে তা বেশ সহায়ক প্রতিপন্ন হবে। তিনি বলেন:
"কালবসমূহকে নূরানী বানানোর ব্যাপারে এবং মন্দ স্বভাবসমূহকে উত্তম স্বভাবে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে সমস্ত ইবাদত-বন্দেগীর চাইতে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী হচ্ছে আল্লাহর তা'আলার যিকির।"
স্বয়ং আল্লাহ তা'আলার ইরশাদ:
إِنَّ الصَّلٰوةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللّٰهِ أَكْبَرُ. عنكبوت (٥)
"সালাত নিঃসন্দেহে অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বারণ করে থাকে এবং আল্লাহর যিকির নিশ্চিতভাবেই সর্বশ্রেষ্ঠ।" (আনকাবূত: রুকু-৫)
এবং অন্যান্য বুযুর্গগণ বলেন:
"যিকির অন্তর পরিষ্কার করার ব্যাপারে ঠিক সেরূপ কার্যকর, যেরূপ তামা পরিষ্কার ও ঘষা-মাজার ব্যাপারে বালু অত্যন্ত কার্যকর। আর অন্যান্য আমল এ ব্যাপারে তামা পরিষ্কারে সাবানের মত।" (তারসীউল জাওয়াহিরিল মক্কীয়া)
"হে ঈমানদারগণ! (অন্তর ও রসনার মাধ্যমে) আল্লাহকে বহুলভাবে স্মরণ কর এবং (বিশেষত) সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা কর।"
وَادْعُوْهُ خَوْفًا وَطَمَعًا إِنَّ رَحْمَتَ اللّٰهِ قَرِيْبٌ مِّنَ الْمُحْسِنِيْنَ.
"(নিজেদের ভুল-ত্রুটির জন্যে আল্লাহর ধরপাকড় ও শাস্তি থেকে) ভীতির সাথে এবং (তাঁর রহম ও করমের) আশায় আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাও! আল্লাহর রহমত নিঃসন্দেহে সৎকর্মশীল বান্দাদের নিকটেই রয়েছে।" (আল-আ'রাফ: ৫৬)
'মা'আরিফুল হাদীছ' 'কিতাবুৎ-তাহারাত'-এর একেবারে শুরুতেই 'হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা'-এর বরাতে এ বক্তব্যটি উদ্ধৃত করা হয়েছে:
আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে এই তত্ত্ব জানিয়ে দিয়েছেন যে, কল্যাণ ও সৌভাগ্যের যে রাজপথের দিকে আহ্বানের জন্যে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম প্রেরিত হয়েছিলেন, (যার নাম হচ্ছে শরীয়ত) যদিও তার অনেক তোরণদ্বার রয়েছে এবং প্রত্যেক তোরণদ্বারের অধীন শত শত হাজার হাজার আহকাম রয়েছে, কিন্তু এগুলোর এ প্রাচুর্য সত্ত্বেও এসব নীতিগতভাব মোটামুটি চারটি শিরোনামের অধীনে এসে যায়: ১. তাহারাত ২. ইখবাত ৩. সামাহাত ৪. আদালত।
এতটুকু লেখার পর শাহ সাহেব (র) এ চারটির প্রত্যেকটির গূঢ়তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন। তা পাঠ করলে একথা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নিঃসন্দেহে শরীয়ত ঐ চারটি শাখায়ই বিভক্ত।
মা'আরিফুল হাদীছ তৃতীয় জিলদে 'কিতাবুৎ তাহারাত' এর শুরুতে হযরত শাহ্ সাহেব (র)-এর সেই বক্তব্যের শুধু ততটুকু অংশই সংক্ষিপ্তভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছিল-যাতে তিনি তাহারাত বা পবিত্রতার মূলতত্ত্ব বর্ণনা করেছিলেন।
ইখবাত-এর মৌলতত্ত্ব সম্পর্কে তিনি যা কিছু লিখেছেন, তা সংক্ষিপ্তাকারে এভাবে বলা যায়:
"বিস্ময়, ভীতি ও মহব্বত এবং সন্তুষ্টি কামনা ও অনুগ্রহ প্রার্থনার স্পীরিটের সাথে আল্লাহ যুল-জালাল ও জাবারুতের হুযুরে যাহির ও বাতিনের দ্বারা নিজের বন্দেগী, দীনতা, মুখাপেক্ষিতা ও ভিখারীপনার অভিব্যক্তি ঘটানোই হচ্ছে ইখবাত।”
এরই অপর বিখ্যাত শিরোনাম বা পরিচিতি হচ্ছে ইবাদত। আর এটাই হচ্ছে
মানব সৃষ্টির বিশেষ উদ্দিষ্ট:
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنَ
"জিন ও ইনসানকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যেই সৃষ্টি করেছি।"
হযরত শাহ্ সাহেব (র) সৌভাগ্যের উক্ত চারটি শাখা সম্পর্কে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা-এর মকসদ ২-এ 'আবওয়াবুল ইহসান' অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। এ আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেন:
"ঐগুলির প্রথমটি অর্থাৎ তাহারাত অর্জনের জন্যে ওযু-গোসল প্রভৃতির হুকুম দেওয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয়টা অর্থাৎ 'ইখবাত' হাসিলের ওসীলা হচ্ছে নামায, আযকার ও কুরআন মজীদ তিলাওয়াত।" (আবওয়াবুল ইহসান, হুজ্জাতুল্লাহি বালিগা, জিলদ ২, পৃ. ৬৭)
বরং বলা যায়, যিকরুল্লাহ তথা আল্লাহর স্মরণই ইখবাতের বিশেষ ওসীলা স্বরূপ আর নামায, তিলাওয়াত এবং অনুরূপভাবে দু'আও এর বিশেষ বিশেষ রূপ।
মোদ্দা কথা, নামায, যিকরুল্লাহ, কুরআন মজীদ তিলাওয়াত এ সবের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই মুবারক গুণ অর্জন ও তার পূর্ণতা বিধান, যাকে হযরত শাহ ওলীউল্লাহ (র) 'ইখবাত' বলে অভিহিত করেছেন। এজন্যে এ সবই একই পর্যায়ভুক্ত।
নামায সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাদীসসমূহ এবং তাঁর বাণী ও অভ্যাস বা আচরিত পন্থা সম্পর্কে আল্লাহর তওফীক অনুযায়ী এ সিরিজের তৃতীয় জিলদে উপস্থাপিত হয়েছে। যিকির, দু'আ ও তিলাওয়াত সংক্রান্ত হাদীসসমূহ এখন এই পঞ্চম জিলদে পেশ করা হচ্ছে।
আল্লাহ তা'আলা এ গুনাহগার লিখককে, সহৃদয় পাঠকবর্গকে তার উপর আমল করার এবং এগুলো থেকে পুরোপুরি উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন।
আল্লাহর যিকিরের মাহাত্ম্য এবং এর বরকতসমূহ
যেমনটি উপরে বলা হয়েছে, যিকরুল্লাহ বা আল্লাহর যিকির শব্দটি ব্যাপক অর্থে সালাত (নামায), কুরআন তিলাওয়াত, দু'আ ও ইস্তিগফার সবকিছুর ব্যাপারেই প্রযোজ্য এবং এসব হচ্ছে যিকরুল্লাহরই বিশেষ বিশেষ রূপ। কিন্তু বিশেষ অর্থে যিকরুল্লাহ হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার তাসবীহ-তাকদীস তথা মাহাত্ম্য বর্ণনা তাওহীদ-তামজীদ, তাঁর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা এবং তাঁর পূর্ণতার গুণ বর্ণনা ও ধ্যান করা। পারিভাষিক অর্থে একেই যিকরুল্লাহ বা আল্লাহর যিকির বলা হয়ে থাকে। সম্মুখে বর্ণিতব্য কোন কোন হাদীছের দ্বারা স্পষ্টভারে জানা যাবে যে, এই যিকরুল্লাহ হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি এবং মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং ঊর্ধ্বজগতের সাথে তার সম্পর্কের খাস ওসীলা স্বরূপ।
শায়খ ইবনুল কাইয়েম (র) তাঁর 'মাদারিজুস সালিকীন' (مدارج السالكين) নামক গ্রন্থে যিকরুল্লাহর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব এবং তার বরকতসমূহ সম্পর্কে অত্যন্ত শিক্ষণীয় এবং আত্মার উৎকর্ষ বিধায়ক বর্ণনা দিয়েছেন। তার একাংশের সংক্ষিপ্ত সার আমরা এখানে উদ্ধৃত করছি। বর্ণিতব্য হাদীসসমূহে যিকরুল্লাহর যে মাহাত্ম্য বর্ণিত হবে, শায়খ ইব্ন কাইয়েম (র) লিখিত উক্ত বক্তব্যটি পাঠের পর তা অনুধাবন করা ইনশাআল্লাহ অনেকটা সহজ হবে। তিনি লিখেন:
"কুরআন মজীদে যিকরুল্লাহর তাকিদ ও উৎসাহদানের যে দশটি শিরোনাম পাওয়া যায়, তা নিম্নরূপ:
১. কোন কোন আয়াতে ঈমানদারগণকে তাকিদসহকারে তার আদেশ দান করা
হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে:
يٰأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اذْكُرُو اللّٰهَ ذِكْرًا كَثِيرًا وَسَبِّحُوْهُ بُكْرَةً وأَصِيْلاً
“হে ঈমানদারগণ, বহুল পরিমাণে আল্লাহর যিকির করবে এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করবে।" (সূরা আহযাব, ষষ্ঠ রুকূ')
অন্য আয়াতে আছে:
وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيْفَةً (الأعراف (٢٤)
মনে মনে এবং কান্নাকাটি করে ও ভয়ের সাথে তোমার প্রভুর যিকির করবে।"
(আ'রাফ রুকু' ২৪)
২. কোন কোন আয়াতে আল্লাহকে বিস্মৃত হতে এবং তাঁর স্মরণ থেকে গাফেল হতে কঠোরভাবে মানা করা হয়েছে। এটাও যিকরুল্লাহর তাকিদেরই একটা ধরন।
বলা হয়েছে:
وَلَا تَكُنْ مِّنَ الْغَافِلِيْنَ
"এবং তোমরা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।" (আল আ'রাফ: ২৪তম রুকূ')
অন্যত্র বলা হয়েছে:
وَلَا تَكُونُوْا كَالَّذِيْنَ نَسُوا اللّٰهَ فَانْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ (الحشر (٢٤)
"এবং তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়োনা, যারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে (ফলশ্রুতিতে) আল্লাহরও বিস্তৃত করিয়ে দিয়েছেন তাদের নিজেদেরকে" অর্থাৎ আল্লাহ বিস্মৃতির পরিণতিতে তারা হয়েছে আত্মবিস্মৃত। (আল-হাশর ৩য় রুকু)
৩. কোন কোন আয়াতে বলা হয়েছে যে, সাফল্য নিহিত রয়েছে আল্লাহর প্রচুর যিকিরের সাথে। বলা হয়েছে:
وَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ.
"বহুল পরিমাণে আল্লাহর যিকির করবে, যাতে করে তোমরা সাফল্যমণ্ডিত হতে পারো।"
(সূরা জুমুআ ২য় রুকু)
৪. কোন কোন আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে যিকির ওয়ালা বান্দাদের প্রশংসা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, যিকিরের বিনিময়ে তাদের সাথে রহমত ও মাগফিরাতের খাস মুআমেলা করা হবে এবং তাদেরকে বিপুল বিনিময় প্রদানে ধন্য করা হবে। তাই সূরা আহযাবে ঈমান ওয়ালা নারী-পুরুষ বান্দাহদের অন্যান্য গুণাবলীর সাথে সাথে বলা হয়েছে:
والذّٰكِرِينَ اللّٰهَ كَثِيْرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللّٰهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عظِيمًا.
"আর আল্লাহর প্রচুর পরিমাণে যিকিরকারী নারী-পুরুষ বান্দাগণ-আল্লাহর তা'আলা তাদের জন্যে তৈরি করে রেখেছেন মাগফিরাত ও বিরাট ছওয়াব।"
৫. অনুরূপভাবে কোন কোন আয়াতে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, যারা দুনিয়ার বাহার ও স্বাদে-ভোগে নিমগ্ন হয়ে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে যাবে, তারা ব্যর্থকাম হবে। যেমন সূরা মুনাফিকুনে ইরশাদ হয়েছে:
يٰأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَالِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ (المنافقون ع (۲)
"হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ধন-সম্পদ এবং তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল করে না দেয়। যারা এরূপ গাফলতে নিমগ্ন হবে, তারাই হলো ক্ষতিগ্রস্ত।"
(আল-মুনাফিকূন রুকূ'-২)
এই তিনটি শিরোনামও যিকরুল্লাহর তাগিদ ও উৎসাহ প্রদানের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কার্যকরী।
৬. কোন কোন আয়াতে বলা হয়েছে যে, যে বান্দারা আমাকে স্মরণ করবে, আমিও তাদেরকে স্মরণ করবো:
فَاذْكُرُوْنِيْ أَذْكُرُكُمْ وَاشْكُرُوْا لِيْ وَلَا تَكْفُرُوْنِ (بقرة ع (۱۸)
"হে আমার বান্দারা, তোমরা আমাকে স্মরণ কর, তা হলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ রাখবো, তোমরা আমার শুকরিয়া আদায় করবে এবং না-শুকরী করবে না।"
(বাকারা ১৮তম রুকূ')
সুবহানাল্লাহি ও বিহামদিহী! বান্দার জন্য এর চাইতে বড় সাফল্য ও সৌভাগ্য আর কী হতে পারে যে, স্বয়ং বিশ্বজাহানের স্রষ্টা ও প্রতিপালক তাকে স্মরণ করবেন ও স্মরণ রাখবেন।
৭. কোন কোন আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর যিকির প্রত্যেক বস্তুর মুকাবিলায় গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রাখে এবং তা এ বিশ্বজগতের সবকিছু থেকে উচ্চতর ও মর্যাদা সম্পন্ন।
وَلَذِكْرُ اللّٰهِ أَكْبَرُ ( عنكبوت ع (٥)
"নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর যিকির প্রত্যেক বস্তু থেকেই উচ্চতর।"
(আনকাবূত রুকূ'-৫)
নিঃসন্দেহে বান্দাহর ভাগ্যে যদি প্রতীতি জুটে তাহলে তার জন্য আল্লাহর যিকির বিশ্বের সবকিছু থেকে উচ্চতর।
৮. কোন কোন আয়াতে অনেক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন আমল প্রসঙ্গে আল্লাহর যিকির করার হিদায়াত করা হয়েছে, যেন যিকরুল্লাহই সে সব আমলের উপসংহার স্বরূপ হয়। যেমন নামায সম্পর্কে বলা হয়েছে:
فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلٰوةَ فَاذْكُرُوْا اللّٰهَ قِيَامًا وَقُعُوْدًا وَعَلٰى جُنُوبِكُمْ (النساء ع (١٥)
"ফলে তোমরা যখন সালাত সম্পন্ন করবে, তখন আল্লাহর যিকির করবে দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় এবং পার্শ্বদেশের উপর শায়িত অবস্থায়।"
(আন্ নিসা: রুকূ-১৫)
এবং বিশেষত জুমার নামায সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে:
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلٰوةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ وَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ. (الجمعة ٤-٢)
যখন জুমার নামায সম্পন্ন করবে, তখন (অনুমতি রয়েছে যে,) তোমরা (মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজেদের কাজকর্ম উপলক্ষে) পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অনুসন্ধানে লিপ্ত হবে এবং সে অবস্থায়ও আল্লাহর যিকির বহুল পরিমাণে করবে- যাতে করে তোমরা সাফল্যমণ্ডিত হতে পারো।" (জুমুআ রুকু-২)
এবং হজ্জ সম্পর্কে বলা হয়েছে:
فَإِذَا قَضَيْتُمْ مَنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَذِكْرِكُمْ آبَائَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا . (بقرة ع ٢٥)
"তারপর যখন হজ্জের মানাসিক বা রীতিসমূহ পালন করে ফারেগ হয়ে যাবে তখন আল্লাহর যিকির বা স্মরণ করবে যেমনটি তোমরা (পারস্পরিক বড়াই করতে গিয়ে) তোমাদের পিতৃপুরুষের কথা স্মরণ ও উল্লেখ করে থাকো অথবা তার চাইতে ও বেশি আল্লাহর যিকির করবে।" (বাকারা ২৫তম রুকূ)
উক্ত আয়াতগুলো দ্বারা জানা গেল যে, নামায ও হজ্জের মত উচ্চ দর্জার ইবাদতসমূহ থেকে ফারেগ হওয়ার পরও তার অন্তরে ও রসনায় আল্লাহর যিকির থাকা চাই এবং যিকিরই হবে তার আমলের ইতি স্বরূপ।
৯. কোন কোন আয়াতে যিকরুল্লাহর তাকিদ দেয়া হয়েছে এভাবে যে, বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ব্যক্তি তারাই, যারা আল্লাহর যিকির থেকে গাফিল হয় না। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো, যারা আল্লাহর যিকির থেকে গাফিল হয়, তারা দূরদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত। যেমন সূরা আলে ইমরানের শেষ রুকুতে ইরশাদ করা হয়েছে:
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لأُولِي الْأَلْبَابِ الَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللّٰهَ قِيَامًا وَقُعُوْدًا وَعَلٰى جُنُوبِهِمْ. ال عمران ع (۲۰)
নিঃসন্দেহে আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং দিন-রাত্রির আবর্তনে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্যে যারা স্মরণ (যিকির) করে আল্লাহকে দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় এবং তাদের পার্শ্ব দেশে শায়িত অবস্থায়।
(সূরা আলে ইমরান রুকু-২০)
১০. কোন কোন আয়াত থেকে জানা যায় আমল যতই উচ্চ হোক না কেন, তার প্রাণ হচ্ছে যিকরুল্লাহ। যেমন নামায সম্পর্কে বলা হয়েছে:
أقِمِ الصَّلٰوةَ لِذِكْرِى (طه ع (۱)
"আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর।" (সূরা তাহা রুকু-১)
মানাসিকে হজ্জ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন:
إنما جعل الطواف بالبيت والسعي بين الصفا والمروة ورمي الجمار لإقامة ذكر اللّٰه
বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ এবং কঙ্কর নিক্ষেপ- এ সব যিকরুল্লাহর উদ্দেশ্যেই নির্ধারণ করা হয়েছে।
জিহাদ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা'আলার ঘোষণা:
يَأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا لَقِيْتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوْا وَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِيْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ . (انفال ع (٦)
“হে ঈমানদারগণ! যখন দুশমনদের সাথে তোমাদের মুকাবিলা হয় তখন তোমরা ধৈর্য-স্থৈর্য অবলম্বন করবে এবং আল্লাহর অধিক যিকির করবে (আল্লাহকে স্মরণ করবে) যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পার।
(আনফাল রুকূ-৬)
একটি হাদীছে কুদসীতে আছে:
إن عبدي كل عبدي الذي يذكرني وهو ملاق قرنه
"আমার বান্দা এবং পূর্ণ বান্দা সে-ই, যে তার শত্রুর সাথে যুদ্ধরত অবস্থায়ও আমাকে স্মরণ করে।"
কুরআন ও হাদীছের এ সুস্পষ্ট বাণীগুলো দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হলো যে, সালাত থেকে নিয়ে জিহাদ পর্যন্ত সমস্ত সৎ কর্ম বা আমালে সালেহের প্রাণ হচ্ছে যিকরুল্লাহ বা আল্লাহর যিকির। আর এই যিকির তথা অন্তর ও রসনার দ্বারা আল্লাহর স্মরণই হচ্ছে বেলায়েতের পরওয়ানা স্বরূপ। যে এ পরওয়ানা লাভ করলো, সে সব পেয়েছি-এর পাওয়াটিই পেয়ে গেল আর যে এথেকে বঞ্চিত হলো, সে চিরবঞ্চিত ও পরিত্যক্তই রয়ে গেল। এই যিকরুল্লাহই হচ্ছে আল্লাহওয়ালাদের কালবের খোরাক এবং জীবন ধারণের অবলম্বন। যদি তাই তাদের না জুটে তা হলে তাদের দেহ তাদের কালবের জন্যে কবর স্বরূপ হয়ে যায়। যিকির-এর দ্বারাই হৃদয়ের জগত আবাদ হয়েছে। যিকির বিহনে হৃদয়ের সে জগত বিলকুল বিরান হয়ে যায়। যিকরের অস্ত্র দিয়েই তারা আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রের দস্যু-তস্করদের সাথে যুদ্ধ করে থাকেন। এই যিকিরই তাদের জন্যে শীতল পানি স্বরূপ, যদ্বারা তারা বাতেনের আগুন নির্বাপিত করে থাকেন। এই যিকিরই তাদের ব্যাধির ওষুধ স্বরূপ। এ ওষুধ বিহনে তাদের অন্তর নির্জীব হয়ে যায়। এই যিকিরই তাদের এবং তাদের প্রভু পরোয়ারদিগারের মধ্যকার সেতুবন্ধন স্বরূপ। কী চমৎকারই না বলেছেন কবি:
إِذَا مَرِضْنَا تَدَاوَيْنَا بِذِكْرِكُمْ
فَنْتَرُكُ الذِّكْرَ أَحْيَانًا فَنَتَكَّسُ
যখন আমি হই পীড়িত ওষুধ হলো যিকির তোমার
যখন যিকির দেই কো ছেড়ে নামান্তর তা মরতে বসার।
আল্লাহ তা'আলা যেমন দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন চোখের সৌন্দর্য ও সৌষ্ঠব নিহিত রেখেছেন দৃষ্টি শক্তির মধ্যে, ঠিক তেমনি যিকিরকারী রসনা সমূহের সৌষ্ঠব ও সৌন্দর্যও নিহিত রেখেছেন যিকিরের মধ্যে। সুতরাং আল্লাহ তা'আলার যিকির থেকে গাফেল রসনা দৃষ্টিশক্তি হারা চোখ, শ্রবণশক্তি বঞ্চিত কান এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাতের মতই নিষ্ক্রিয় ও বেকার।
যিকরুল্লাহই সেই একমাত্র খোলা দরজা পথ, যে দরজা দিয়ে বান্দা হক তা'আলা জাল্লা শানুহুর দরবার পর্যন্ত অবলীলাক্রমে পৌঁছে যেতে পারে। আর যখন বান্দা আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল হয়ে যায়, তখন এ দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়। কী চমৎকারই না বলেছেন আরবী কবি:
فَنِسْيَانُ ذِكْرِ اللّٰهِ مَوْتُ قُلُوبِهِمْ
وَأَجْسَامُهُمْ قَبْلَ الْقَبُورِ قُبُوْرٌ
وَأَرْوَاحُهُمْ فِيْ وَحْشَةٍ مِّنْ جُسُوْمِهِمْ
وَلَيْسَ لَهُمْ حَتّٰى النُّشُوْرِ نُشُوْرٌ
আল্লাহর যিকির থেকে গাফলতি মৃত্যু তাদের
কবরের আগেই দেহ সাজে যে কবর গহ্বর
দেহ মাঝে হৃদি তখন উসুখস্ করে নিরন্তর
পুনরুত্থান পূর্বে যেন জীবন আর নাই কেহ তাদের।
[মাদারিজুস সালিকীনে লিখিত শায়খ ইবনুল কাইয়েমের বক্তব্যের সার সংক্ষেপ]
এ দীন লেখকের আরয হচ্ছে উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে যিকরুল্লাহর তাকিদ ও উৎসাহ ব্যঞ্জক যে দশটি শিরোনাম বা ধারার বর্ণনা রয়েছে, কুরআন মজীদে এগুলো ছাড়াও অন্যভাবেও যিকরুল্লাহর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে:
অন্তরসমূহ (অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা রক্ষাকারী দেল ও রূহসমূহ)
আল্লাহর যিকিরেই প্রশান্তি লাভ করে থাকে:
اَلَا بِذِكْرِ اللّٰهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوْبُ
যিকরুল্লাহর তাছীর ও বরকত সম্পর্কে অপর একজন রব্বানী মুহাক্কিক ও সূফী ترصيع الجواهر المكية এর লেখক-এর কয়েকটি বাক্যের তরজমাও এর সাথে পড়ে নিন, তাহলে এ অধ্যায়ে আলোচিতব্য হাদীছগুলো অনুধাবনে তা বেশ সহায়ক প্রতিপন্ন হবে। তিনি বলেন:
"কালবসমূহকে নূরানী বানানোর ব্যাপারে এবং মন্দ স্বভাবসমূহকে উত্তম স্বভাবে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে সমস্ত ইবাদত-বন্দেগীর চাইতে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী হচ্ছে আল্লাহর তা'আলার যিকির।"
স্বয়ং আল্লাহ তা'আলার ইরশাদ:
إِنَّ الصَّلٰوةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللّٰهِ أَكْبَرُ. عنكبوت (٥)
"সালাত নিঃসন্দেহে অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বারণ করে থাকে এবং আল্লাহর যিকির নিশ্চিতভাবেই সর্বশ্রেষ্ঠ।" (আনকাবূত: রুকু-৫)
এবং অন্যান্য বুযুর্গগণ বলেন:
"যিকির অন্তর পরিষ্কার করার ব্যাপারে ঠিক সেরূপ কার্যকর, যেরূপ তামা পরিষ্কার ও ঘষা-মাজার ব্যাপারে বালু অত্যন্ত কার্যকর। আর অন্যান্য আমল এ ব্যাপারে তামা পরিষ্কারে সাবানের মত।" (তারসীউল জাওয়াহিরিল মক্কীয়া)
১. হযরত আবূ হুরায়রা ও আবূ সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: আল্লাহর বান্দারা যখন এবং যেখানে বসেই আল্লাহর যিকির করুক না কেন, তখন সেখানেই ফেরেশতাগণ সর্বদিক থেকে এসে তাদেরকে ঘিরে ফেলেন, রহমত তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে আর তাদের উপর শান্তিধারা নেমে আসে এবং আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাগণের কাছে তাদের কথা উল্লেখ করেন। (সহীহ্ মুসলিম)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ وَأَبِي سَعِيدٍ قَالَا: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَقْعُدُ قَوْمٌ يَذْكُرُونَ اللهَ إِلَّا حَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَنَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ. (رواه ومسلم)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টরূপে জানা গেল যে, আল্লাহর কিছু বান্দা কোথাও একত্রিত হয়ে যিকির করার খাস বরকত রয়েছে। হযরত শাহ্ ওলীউল্লাহ্ (র) এ হাদীছেরই ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন:
"এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, মুসলমানদের দলবদ্ধভাবে যিকির ইত্যাদি করা রহমত, শান্তি ও ফেরেশতাদের নৈকট্যের খাস ওসীলা বিশেষ।" (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ২য় জিলদ, পৃ. ৭০)
এ হাদীসে আল্লাহর যিকিরকারী বান্দাদের জন্যে চারটি খাস নিয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে:
১. চতুর্দিক থেকে আল্লাহর ফেরেশতাগণ এসে তাদেরকে ঘিরে ফেলেন,
২. আল্লাহর রহমত তাদেরকে আপন ছায়াতলে নিয়ে নেয়। এবং এ দু'টির ফলশ্রুতিতে তৃতীয় যে নিয়ামত তারা প্রাপ্ত হন তা হলো:
৩. তাদের হৃদয়-মনে শান্তিধারা নেমে আসে আর এটা আল্লাহর এক মহান রূহানী নিয়ামত। এখানে শান্তিধারা বলতে এক বিশেষ ধরনের ও বিশেষ পর্যায়ের আত্মীক ও রূহানী শান্তি বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহর খাস বান্দাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ দান হিসাবে প্রদত্ত হয়ে থাকে। আহলে সুলুক বা আধ্যাত্মবাদী মহলে যা 'জমইয়তে কল্বী' নামে অভিহিত হয়ে থাকে। শান্তিধারা প্রাপ্ত ব্যক্তি এ বিশেষ নিয়ামতটির অস্তিত্ব অনুভব করে থাকেন।
৪. যিকিরকারীকে প্রদত্ত চতুর্থ বস্তু হচ্ছে, যা সর্বশেষে এ হাদীসটিতে উল্লেখিত হয়েছে- আল্লাহ তা'আলা তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণের নিকট যিকিরকারী বান্দাদের কথা উল্লেখ করেন। যেমন তিনি তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বলেন: দেখ, আদমেরই সন্তানদের মধ্যে আমার এ বান্দারাও রয়েছে, যারা আমাকে কোনদিন চোখে দেখেনি, অদৃশ্যভাবে আমার উপর ঈমান এনেছে। এতদসত্ত্বেও তাদের মহব্বত ও খাশিয়ত তথা অনুরাগ ও ভীতির কী অবস্থা! কত আগ্রহে উৎসাহে কত আকুতি নিয়ে হৃদয়-মন উজাড় করে আমার যিকির করছে! নিঃসন্দেহে মালিকুল মুলক আহকামুল হাকিমীনের তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাদের কাছে আপন বান্দাদের সম্পর্কে এরূপ আলোচনা বা উল্লেখ করা এমনি একটি বড় ব্যাপার, যার চাইতে বড় কোন নিয়ামতের কথা কল্পনাও করা যায় না। আল্লাহ তা'আলা যেন এ নিয়ামত থেকে বঞ্চিত না রাখেন।
ফায়দা: এ হাদীস থেকে এ ইঙ্গিতও পাওয়া গেল যে, আল্লাহর যিকিরকারী বান্দা যদি আপন কলবে সকীনত বা শান্তিপ্রবাহের অস্তিত্ব অনুভব না করে (যা একটি অনুভব করার মত ব্যাপার) তা হলে বুঝতে হবে যে, এখনো সে যিকিরের ঐ স্তরে উপনীত হতে পারেনি, যে স্তরে পৌঁছলে এসব নিয়ামতের অঙ্গীকার রয়েছে; অথবা তার জীবনে এমন কিছু প্রতিবন্ধক রয়েছে, যা যিকিরের শুভ প্রভাব লাভে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। তার নিজের অবস্থা সংশোধনের চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। দয়ালু প্রভুর ওয়াদা সর্বাবস্থায় বরহক।
"এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, মুসলমানদের দলবদ্ধভাবে যিকির ইত্যাদি করা রহমত, শান্তি ও ফেরেশতাদের নৈকট্যের খাস ওসীলা বিশেষ।" (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ২য় জিলদ, পৃ. ৭০)
এ হাদীসে আল্লাহর যিকিরকারী বান্দাদের জন্যে চারটি খাস নিয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে:
১. চতুর্দিক থেকে আল্লাহর ফেরেশতাগণ এসে তাদেরকে ঘিরে ফেলেন,
২. আল্লাহর রহমত তাদেরকে আপন ছায়াতলে নিয়ে নেয়। এবং এ দু'টির ফলশ্রুতিতে তৃতীয় যে নিয়ামত তারা প্রাপ্ত হন তা হলো:
৩. তাদের হৃদয়-মনে শান্তিধারা নেমে আসে আর এটা আল্লাহর এক মহান রূহানী নিয়ামত। এখানে শান্তিধারা বলতে এক বিশেষ ধরনের ও বিশেষ পর্যায়ের আত্মীক ও রূহানী শান্তি বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহর খাস বান্দাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ দান হিসাবে প্রদত্ত হয়ে থাকে। আহলে সুলুক বা আধ্যাত্মবাদী মহলে যা 'জমইয়তে কল্বী' নামে অভিহিত হয়ে থাকে। শান্তিধারা প্রাপ্ত ব্যক্তি এ বিশেষ নিয়ামতটির অস্তিত্ব অনুভব করে থাকেন।
৪. যিকিরকারীকে প্রদত্ত চতুর্থ বস্তু হচ্ছে, যা সর্বশেষে এ হাদীসটিতে উল্লেখিত হয়েছে- আল্লাহ তা'আলা তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণের নিকট যিকিরকারী বান্দাদের কথা উল্লেখ করেন। যেমন তিনি তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বলেন: দেখ, আদমেরই সন্তানদের মধ্যে আমার এ বান্দারাও রয়েছে, যারা আমাকে কোনদিন চোখে দেখেনি, অদৃশ্যভাবে আমার উপর ঈমান এনেছে। এতদসত্ত্বেও তাদের মহব্বত ও খাশিয়ত তথা অনুরাগ ও ভীতির কী অবস্থা! কত আগ্রহে উৎসাহে কত আকুতি নিয়ে হৃদয়-মন উজাড় করে আমার যিকির করছে! নিঃসন্দেহে মালিকুল মুলক আহকামুল হাকিমীনের তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাদের কাছে আপন বান্দাদের সম্পর্কে এরূপ আলোচনা বা উল্লেখ করা এমনি একটি বড় ব্যাপার, যার চাইতে বড় কোন নিয়ামতের কথা কল্পনাও করা যায় না। আল্লাহ তা'আলা যেন এ নিয়ামত থেকে বঞ্চিত না রাখেন।
ফায়দা: এ হাদীস থেকে এ ইঙ্গিতও পাওয়া গেল যে, আল্লাহর যিকিরকারী বান্দা যদি আপন কলবে সকীনত বা শান্তিপ্রবাহের অস্তিত্ব অনুভব না করে (যা একটি অনুভব করার মত ব্যাপার) তা হলে বুঝতে হবে যে, এখনো সে যিকিরের ঐ স্তরে উপনীত হতে পারেনি, যে স্তরে পৌঁছলে এসব নিয়ামতের অঙ্গীকার রয়েছে; অথবা তার জীবনে এমন কিছু প্রতিবন্ধক রয়েছে, যা যিকিরের শুভ প্রভাব লাভে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। তার নিজের অবস্থা সংশোধনের চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। দয়ালু প্রভুর ওয়াদা সর্বাবস্থায় বরহক।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)