মা'আরিফুল হাদীস

সলাত অধ্যায়

হাদীস নং: ৩১৬
সলাত অধ্যায়
কারো মৃত্যুজনিত কারণে তার নিকট আত্মীয় স্বজনের দুঃখিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া এবং তার ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ বেয়ে পানি ঝরা কিংবা অন্য কোন-ভাবে দুঃখ-কষ্ট প্রকাশ পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। এমন অবস্থার বহিঃপ্রকাশ মৃতের জন্য তার আপন জনদের আন্তরিক ভালবাসা ও সমবেদনারই প্রতিফলন যা মানবতার এক মূল্যবান ও পসন্দনীয় উপাদান। একারণে শরী'আতে এটা নিষিদ্ধ নাই বরং কিছুটা প্রশংসনীয়ও বটে। তবে কান্নাকাঠি ও মাতম করাকে শরী'আত কখনো অনুমোদন করে না। যদিও একদিক থেকে এর মূল্যায়ন করা হয়েছে কিন্তু অপর দিকে উচ্চস্বরে কান্না ও মাতম এবং স্বেচ্ছায় বিলাপ করাকে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। প্রথমত, এ কাজ দাসত্বের অবস্থান এবং আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ্ তা'আলা মানুষকে জ্ঞান বুদ্ধি রূপ যে নি'আমত দান করেছেন এবং বিপদাপদ উত্তরণের যে বিশেষ যোগ্যতা দান করেছেন উচ্চস্বরে চিৎকার, মাতম, বিলাপ ইত্যাদি করা মূলতঃ আল্লাহ্ প্রদত্ত সে নি'আমতের অস্বীকৃতি বৈকি! কারণ এর ফলে অন্যের দুঃখ বেদনা আরো বেড়ে যায় এবং চিন্তাও কার্যশক্তি দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া উচ্চস্বরে কাঁদা ও মাতম করা মৃতের জন্য (কবরে) শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৩১৬. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সা'দ ইবনে উবাদা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। নবী কারীম ﷺ তাঁকে দেখতে যান আর তখন আবদুর রহমান ইবনে আওফ, সা'দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) তাঁর সাথে ছিলেন। যখন তিনি তাঁর কাছে গেলেন তখন তিনি বেহুঁশ ছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন তাঁর কি ইন্তিকাল হয়েছে? উপস্থিত লোকজন বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি ইন্তিকাল করেন নি। তখন তিনি কেঁদে উঠলেন, নবী কারীম ﷺ কে কাঁদতে দেখে সাহাবা কিরামও কাঁদতে লাগলেন। তিনি বললেন: তোমরা মনে রাখ যে, আল্লাহ্ অন্তরের ব্যথা ও চোখের পানির জন্য কাউকে শাস্তি দেন না। তিনি তাঁর জিহবার দিকে লক্ষ্য করে বললেন: আল্লাহ্ শাস্তি দেন (মাতমের কারণে) কিংবা দয়া করেন (দু'আ ইস্তিগফারের কারণে) তবে মৃত ব্যক্তিকে তার পরিবারের লোকদের (উচুস্বরে বিলাপ ও) কান্নার কারণে শাস্তি দেওয়া হয়। (বুখারী ও মুসলিম)
کتاب الصلوٰۃ
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا ، قَالَ : اشْتَكَى سَعْدُ بْنُ عُبَادَةَ شَكْوَى لَهُ ، فَأَتَاهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعُودُهُ مَعَ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَوْفٍ ، وَسَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ ، وَعَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ ، فَلَمَّا دَخَلَ عَلَيْهِ فَوَجَدَهُ فِي غَاشِيَةِ ، فَقَالَ : « قَدْ قَضَى » قَالُوا : لاَ يَا رَسُولَ اللَّهِ ، فَبَكَى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَلَمَّا رَأَى القَوْمُ بُكَاءَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَكَوْا ، فَقَالَ : « أَلاَ تَسْمَعُونَ إِنَّ اللَّهَ لاَ يُعَذِّبُ بِدَمْعِ العَيْنِ ، وَلاَ بِحُزْنِ القَلْبِ ، وَلَكِنْ يُعَذِّبُ بِهَذَا وَأَشَارَ إِلَى لِسَانِهِ أَوْ يَرْحَمُ ، وَإِنَّ المَيِّتَ لَيُعَذَّبُ بِبُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ » (رواه البخارى ومسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এই হাদীসের মূল বক্তব্য হল, মৃতের জন্য উচ্চস্বরে না কাঁদা এবং মাতম না করা। কারণ এগুলো কাজ আল্লাহর ক্রোধ ও শাস্তির কারণ। বরং ইন্না লিল্লাহ্ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন এবং ইস্তিগফার পাঠ করা উচিত এবং এমন কথা বলা উচিত যাতে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ লাভ হয়। এই হাদীসে পরিবারের লোকদের কান্নার কারণে মৃতের শাস্তি হওয়ার বিষয় উল্লিখিত হয়েছে। এই বিষয়ের হাদীস ইবনে উমর (রা.) ছাড়াও তাঁর সম্মানিত পিতা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এবং অন্যান্য সাহাবা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হযরত আয়েশা ও আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) এই বিষয় অস্বীকার করেন।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত যে, তাঁর কাছে যখন হয়রত উমর এবং উমর তনয় ইবনে উমর (রা.)-এর রিওয়ায়াত সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় তখন তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে এ দু'জন সত্যবাদী, কিন্তু এই রিওয়ায়াতের বিষয়ে তাঁরা ভুলে গিয়েছেন অথবা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বাণী শুনা কিংবা বুঝার ক্ষেত্রে ভুলের শিকার হয়েছেন। মূলতঃ রাসূলুল্লাহ ﷺ এ কথা বলেন নি। হযরত আয়েশা (রা.) কুরআনের এই আয়াত وَلَا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی কেউ অন্য কারো ভার বহন করবে না। (৬ সূরা আন'আম : ১৬৪) দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করেন। তিনি আরো বলেন, এই আয়াতে এ মর্মে একটি মূলনীতি বাতলে দেওয়া হয়েছে যে, কারো পাপের শাস্তি কেউ বহন করবে না। কাজেই পরিবারের লোকদের কান্নার কারণে কীভাবে মৃতের শাস্তি হতে পারে। কিন্তু হযরত উমর (রা.) এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) সূত্রে যে রিওয়ায়াত পাওয়া যায় তা থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, না তাঁরা ভুলের শিকার হয়েছেন আর না তাঁরা হাদীসের মর্ম অনুধাবনে ভুল করেছেন। অপরপক্ষে হযরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক পেশকৃত দলীলও বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। তাই হাদীস বিশারদগণ উভয় হাদীসের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। তাঁদের ব্যাখ্যাসমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও সহজবোধ্য ব্যাখ্যা হল, এই পরিবারের সদস্যদের কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার ব্যাপারে যদি মৃতের কোন সম্পৃক্ততা ও অসাবধানতা থাকে, যেমন সে মৃত্যুর পূর্বে যদি উচ্চস্বরে চিৎকার ও মাতম করার ওসীয়াত করে, যেরূপ আরব সমাজে প্রচলন ছিল এবং নিদেনপক্ষে সে যদি পরিবারের লোকদের কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে নিষেধ না করে থাকে (তবে মৃতের কবরে শাস্তি হবে)। এক্ষেত্রে হযরত উমর ও ইবনে উমর (রা)-এর রিওয়ায়াতের যথার্থতা দেখা যায়। স্বয়ং ইমাম বুখারী (র) সহীহ্ বুখারীতে এরূপ সামঞ্জস্য বিধান করেছেন।

অন্য এক ব্যাখ্যা হলো, যখন মৃতের পরিবারের লোকেরা তার মৃত্যুতে উচুস্বরে কাঁদে কিংবা মাতম করে এবং জাহিলিয়্যা যুগের প্রথা অনুযায়ী মৃতের কৃতকর্ম বর্ণনা করার জন্য সমাবেশের আয়োজন করে তখন প্রশংসায় তাকে আকাশে তোলা হয় এবং ফিরিশতারা মৃতকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করেন, ওহে! তুমি কি এরূপ এরূপ ছিলে? একথা কোন কোন হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে। এ বিষয় এখানেই শেষ করা সমীচীন মনে করছি। যিনি এ বিষয়ে সবিস্তার জানতে চান তিনি 'ফাতহুল মুলহিম' (কৃত মাওলানা শাববীর আহমাদ ওসমানী (র) পাঠ করে নিতে পারেন। এ হাদীসে হযরত সা'দ ইবনে উবাদা (রা)-এর কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার যে বিবরণ এসেছে তা থেকে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। এক বর্ণনা মতে, তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তিকালের পর হযরত আবূ বাকর (রা)-এর খিলাফতকালে ইন্তিকাল করেন। অন্য বর্ণনা অনুযায়ী হযরত সা'দ ইবনে উবাদা (রা) হযরত উমর (রা)-এর খিলাফাতকালে ইন্তিকাল করেন বলে উল্লিখিত হয়েছে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান