মা'আরিফুল হাদীস
সলাত অধ্যায়
হাদীস নং: ২১৪
সলাত অধ্যায়
রাসূলুল্লাহ ﷺ তাহাজ্জুদ সালাতের বিস্তারিত বিশ্লেষণ
২১৪. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি এক রাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট শুইলেন। তারপর (তাহাজ্জুদের সময় হলে) জাগ্রত হয়ে মিসওয়াক ও উযূ করেন। তিনি তখন পাঠ করছিলেন- إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ "আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে দিন ও রাতের পরিবর্তনে নিদর্শনাবলী রয়েছে বোধশক্তিসম্পন্ন লোকদের জন্য।" (৩, সূরা আলে ইমরান: ১৯০) এই আয়াত থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করেন। তারপর দাঁড়িয়ে দুই রাক'আত সালাত আদায় করেন এবং তাতে কিয়াম, রুকূ ও সিজদা দীর্ঘায়িত করে তিনি কিছু সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন। এমনকি তাঁর নাক ডাকার শব্দ হতে লাগল। এভাবে তিন বার করেন (অর্থাৎ তিনবার কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে উঠে মিসওয়াক ও উযূ করে দীর্ঘ কিয়াম, রুকু ও সিজদাসহ দু'রাক'আত পড়লেন)। এমনিভাবে তিনি (প্রথম দু' রাক'আত ব্যতীত) মোট ছয় রাক'আত পড়লেন। এবং প্রত্যেক বার উঠে তিনি মিস্ওয়াক করেন ও উযূ করেন এবং সূরা আলে ইমরানের ঐ আয়াতসমূহ পাঠ করেন। এরপর তিন রাক'আত বিতর নামায আদায় করেন। তারপর মু'আযযিন আযান দিলে তিনি সালাতের উদ্দেশ্যে বের হন। তখন তিনি বলছিলেন" হে আল্লাহ্! দান কর আমার হৃদয়ে নূর, আমার জিহবায় নূর, আমার কানে নূর, আমার চোখে নূর, আমার পেছনে নূর, আমার সম্মুখে নূর, আমার উপরে নূর আমার নিছে নূর। হে আল্লাহ্! আমাকে নূর দান কর।" (মুসলিম)
کتاب الصلوٰۃ
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ ، أَنَّهُ رَقَدَ عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَاسْتَيْقَظَ فَتَسَوَّكَ وَتَوَضَّأَ وَهُوَ يَقُولُ : {إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ} فَقَرَأَ هَؤُلَاءِ الْآيَاتِ حَتَّى خَتَمَ السُّورَةَ ، ثُمَّ قَامَ فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ ، فَأَطَالَ فِيهِمَا الْقِيَامَ وَالرُّكُوعَ وَالسُّجُودَ ، ثُمَّ انْصَرَفَ فَنَامَ حَتَّى نَفَخَ ، ثُمَّ فَعَلَ ذَلِكَ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ سِتَّ رَكَعَاتٍ ، كُلَّ ذَلِكَ يَسْتَاكُ وَيَتَوَضَّأُ وَيَقْرَأُ هَؤُلَاءِ الْآيَاتِ ، ثُمَّ أَوْتَرَ بِثَلَاثٍ ، فَأَذَّنَ الْمُؤَذِّنُ فَخَرَجَ إِلَى الصَّلَاةِ ، وَهُوَ يَقُولُ : « اللهُمَّ اجْعَلْ فِي قَلْبِي نُورًا ، وَفِي لِسَانِي نُورًا ، وَاجْعَلْ فِي سَمْعِي نُورًا ، وَاجْعَلْ فِي بَصَرِي نُورًا ، وَاجْعَلْ مِنْ خَلْفِي نُورًا ، وَمِنْ أَمَامِي نُورًا ، وَاجْعَلْ مِنْ فَوْقِي نُورًا ، وَمِنْ تَحْتِي نُورًا ، اللهُمَّ أَعْطِنِي نُورًا » (رواه مسلم)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত এই হাদীস বুখারী ও মুসলিম এবং অপরাপর হাদীস গ্রন্থসমূহে ভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় আরো সবিস্তার বিবরণ রয়েছে। এ বর্ণনায় কিছুটা পার্থক্য ও লক্ষণীয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, সূরা আলে ইমরানের শেষের আয়াতসমূহ তিনি ঘুম থেকে উঠার পর উযূ করার পূর্বেই পাঠ করতেন। অনুরূপভাবে অপরাপর রিওয়ায়াত সূত্রে জানা যায় যে, দু'আ নূরী اللَّهُمَّ اجْعَلْ فِي قَلْبِي نُوراً الخ তিনি ফজরের সালাতে পাঠ করতেন। এ ছাড়াও আরো কিছু পার্থক্য রয়েছে যেমন দুই দুই রাক'আতের মাঝখানে কিছুক্ষণ বিলম্ব করার পর নিদ্রায় যাওয়ার উল্লেখ এই রিওয়ায়াতে রয়েছে। কিন্তু অন্য বর্ণনায় তা নেই। এ থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, দুই দুই রাক'আতের পরে নিদ্রা যাওয়া নবী কারীম ﷺ সাধারণ আমল ছিল না। বরং ঘটনাচক্রে কোন রাতে এরূপ আমল করেন। এই রিওয়ায়েতে হালকাভাবে দুই রাক'আত সালাত শুরু করার কথাও উল্লিখিত হয়নি। স্পষ্টত বর্ণনাকারীর বর্ণনা থেকে তা বাদ পড়েছে এর প্রমাণ এই যে, এই হাদীসের অপর বর্ণনাকারীর বর্ণনায় পরিষ্কার তের রাক'আতের কথা উল্লিখিত হয়েছে, অথচ এই বর্ণনানুসারে মাত্র এগার রাক'আত হয়। উভয় বর্ণনার মধ্যে এভাবে সামঞ্জস্য বিধান করা যেতে পারে যে, দ্বিতীয় রাবী প্রথম হালকাভাবে দুই রাক'আত আদায়ের কথা উল্লেখ করেনি এবং সম্ভবত এই দুই রাক'আতকে তিনি তাহাজ্জুদ বহির্ভূত 'তাহিয়্যাতুল উযূ' মনে করেছেন। আলোচ্য হাদীসে উল্লিখিত দু'আ নূরীতে নয়টি দু'আর বাক্য সন্নিবেশিত হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনায় বাক্য সংখ্যা এর চেয়ে বেশিও পরিলক্ষিত হয়। এ অত্যন্ত বরকতময় নূরানী দু'আ। এই দু'আর মূল কথা হল এই যে, হে আল্লাহ্! আমার অন্তর, আত্মা, আমার শরীর, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিরা উপশিরায় নূর সৃষ্টি কর এবং আমাকে জ্যোতির্ময় করে দাও। আমার চারিপাশ ও উপর নিচ নূর দ্বারা পর্ণ কর। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে: اَللهُ نُوْرُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ এই আয়াতকে সামনে রেখে এই দু'আর মূল উদ্দেশ্য দাঁড়ায় এই যে, আমার অস্তিত্ব, আশপাশ তোমার জ্যোতি দ্বারা জ্যোতির্ময় করে দাও। আমার অন্তর-বাহির ও পরিবেশ তোমার রঙ্গে রঙ্গীন করে দাও। কেননা আল্লাহর বাণী- صِبْغَةَ اللَّهِ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً "আমরা আল্লাহর রঙ গ্রহণ করলাম রঙ্গে আল্লাহ্ অপেক্ষা কে অধিকতর সুন্দর"? (১, সূরা বাকারা: ১৩৮)
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)