মা'আরিফুল হাদীস

সলাত অধ্যায়

হাদীস নং: ২০৩
সলাত অধ্যায়
কিয়ামুল লায়ল বা তাহাজ্জুদ সালাতের ফযীলত ও গুরুত্ব

এশা ও ফজর সালাতের মধ্যবর্তী সময়ে কোন ফরয সালাত নেই। কাজেই এশার সালাত যদি প্রথম ওয়াক্তে কিংবা অল্প দেরীতে আদায় করা হয়, তবে ফজর পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পাওয়া যায়। গভীর রাতের নীরবতায় পরিবেশ যেরূপ প্রশান্তিময় হয় অন্য সময় তা হয় না। যদি কেউ এশার পরে কিছু সময়ের জন্য নিদ্রা যায় এবং অর্ধেক রাত অতিবাহিত হওয়ার পর (যা তাহাজ্জুদের প্রকৃত সময় উঠে যায় তবে যে একাগ্রতা ও মনোযোগের সাথে সালাত আদায় নসীব হয় তা অন্য সময়) তা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, এ সময় শয্যা ত্যাগ করে সালাত আদায় করা প্রবৃত্তির শাসন ও প্রশিক্ষণেরও একটি মাধ্যম। কুরআন মাজীদে আছে। إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا অবশ্যই রাত্রিকালের জাগরণ এমন যা কঠিনভাবে প্রবৃত্তি দলন করে এবং যা কথা বলার পক্ষে উত্তম। (৭৩, সূরা মুযযাম্মিল: ৬)
অন্যত্র বলা হয়েছে- تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ (রাতের বেলা) তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং তারা নিজ প্রতিপালককে ভয় ও আশার (মিশ্রিত অনুভূতির) সাথে ডাকে। আর আমি তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে। (৩২, সূরা সাজদা: ১৬) পরের আয়াতে বলা হয়েছে যে, 'এসব আমলকারীদের জন্য রয়েছে জান্নাতে সম্মানজনক পুরস্কার যাতে রয়েছে তাদের জন্য নয়নাভিয়াম বস্তু সামগ্রী। আর এবিষয়ে আল্লাহ্ ব্যতীত কেউ জ্ঞাত নয়।'

কুরআন মাজীদের একস্থানে রাসূলূল্লাহ কে তাহাজ্জুদের নির্দেশ দানের সাথে সাথে 'মাকামে মাহমুদ' দানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়বে, যা তোমার জন্য এক অতিরিক্ত ইবাদত। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে ‘মাকামে মাহমুদ’-এ পৌঁছাবেন। (১৭, সূরা বনী ইসরাঈল: ৭৯)
'মাকামে মাহমূদ' আখিরাতে এবং জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদার অবস্থান হবে। এই আয়াত থেকে জানা গেল যে, 'মাকামে মাহমূদ' এবং তাহাজ্জাদ সালাতের মধ্যে কোন বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই কোন মুসল্লী যদি গভীরভাবে তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হয়, তবে আল্লাহ্ চাহেত 'মাকামে মাহমূদে' নবী কারীম ﷺ এর কোন না কোন পর্যায়ের সাহচর্য তাঁর নসীব হতে পাবে।

সহীহ্ হাদীস সমূহ থেকে জানা যায় যে, রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি এক বিশেষ দয়া ও রহমত নিয়ে একান্তভাবে মনোনিবেশ করেন। কাজেই আল্লাহর যে সকল বান্দার মনে এ অনুভূতি জাগ্রত থাকে তারা ঐ বরকত পূর্ণ সময় তা বিশেষভাবে অনুভব করে থাকে। এই ভূমিকার পর কিয়ামুল লায়ল তাহাজ্জুদের সাথে সম্পৃক্ত কিছু সংখ্যক হাদীস পাঠ করা যাক।
২০৩. হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: মহামহিম আল্লাহ্ তা'আলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন-কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে এমন, যে আমার কাছে প্রার্থনা করবে? আমি তার প্রার্থিত বস্তু তাকে দান করব। কে আছে এমন, যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব (বুখারী ও মুসলিম)
کتاب الصلوٰۃ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ : أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : " يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ : مَنْ يَدْعُونِي ، فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ " (رواه البخارى ومسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আলোচ্য হাদীসে দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে আল্লাহর অবতরণ সম্পর্কে যে বক্তব্য গুণাবলী ও কর্মের বহিঃপ্রকাশ, যার হাকীকত সম্পর্কে আমরা অবহিত নই। যেমনিভাবে আমরা ইয়াদুল্লাহ, ওয়াজহুল্লাহ্, ইস্তাওয়া আলাল আরশ্ ইত্যাদি গুণাবলী ও কর্মের হাকীকত সম্পর্কে অবহিত নই। আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী ও কর্মকাণ্ডের হাকীকত ও অবস্থার জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতার স্বীকৃতিই জ্ঞানের পরিচায়ক। পূর্ববর্তী আলিমগণের অভিমত এই যে, তাঁর সম্পর্কে নিজ অজ্ঞতা প্রকাশই যথার্থ কাজ এবং এ গুলোর হাকীকতের বিষয় অপরাপর দুর্বোধ্য বিষয়ের ন্যায় আল্লাহর দিকে সোপর্দ করা চাই। একথা মেনে নেয়া ও কর্তব্য যে, এগুলোর হাকীকত যা রয়েছে তা-ই সত্য। কিন্তু আলোচ্য হাদীসের এই ভাষ্য পরিষ্কার যে, রাতের এক তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকার সময় আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি নিজ দয়ায় বিশেষ অবস্থাসহ মনোনিবেশ করেন এবং তিনি স্বয়ং তাদেরকে দু'আ প্রার্থনা ও ক্ষমা চেয়ে নেয়ার জন্য আহবান জানাতে থাকেন। যে ব্যক্তি এই হাকীকতে দৃঢ় বিশ্বাসী তার জন্য ঐ সময় বিছানায় নিদ্রা বিভোর থাকা মূলত কষ্টকর যেমনিভাবে এ সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তির শয্যাত্যাগ করে সালাতে দাঁড়িয়ে যাওয়া কষ্টকর। আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিজ দয়ায় এই হাকীকতের এমন বিশ্বাস আমাদের নসীব করুন যাতে আমরা ঐ সময়ে ব্যাকুল হয়ে তাঁর মহান দরবারে হাযিরী, দু'আ, প্রার্থনা ও ক্ষমা চেয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সালাতে দাঁড়িয়ে যেতে পারি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান