মা'আরিফুল হাদীস

সালাত অধ্যায়

হাদীস নং: ৯৫
সালাত অধ্যায়
ইমামত
একথা সর্বজনবিদিত যে, দীনে ইসলামে সালাত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শ্রেষ্ঠ আমল এবং এর মর্যাদা ঐরূপ যেমন মানবদেহে হৃৎপিণ্ডের স্থান। এজন্য সালাতের ইমামতি বিরাট মর্যাদা ও দায়িত্বশীলতার ব্যবহার এবং এটি রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর এক প্রকার প্রতিনিধিত্বও বটে। কাজেই ইমামতির জন্য এমন লোক মনোনীত করা প্রয়োজন, যিনি অন্যান্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত মর্যাদাবান ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বলে বিবেচিত এবং যিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে সর্বাধিক নিকট সম্পর্ক রাখেন। কারণ তিনি দীনের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে অধিক খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উত্তরাধিকারের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল কুরআনুল করীম, তাই যে ব্যক্তি ঈমান আনার পর কুরআন মাজীদের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করে, তা মুখস্থ করে অন্তরে রেখে দেয় এবং এর দাওয়াতও সমীহত বুঝে এবং নিজে তা কার্যে পরিণত করে সে-ই প্রকৃত অর্থে রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর উত্তরাধিকারের বিরাট অংশ লাভ করেছে। সব গুণাবলীতে পিছিয়ে থাকা লোকের তুলনায় ঐ ব্যক্তি ইমামতির জন্য অধিকতর যোগ্য বিবেচিত হবেন। যদি এক্ষেত্রে সকল মুসল্লী একই মানের হন, তবে যিনি সুন্নাতের ক্ষেত্রে অধিক পারদর্শী তিনি ইমামতির জন্য অগ্রাধিকার পাবেন। যদি এক্ষেত্রেও সবাই সমান হন, তবে যিনি অধিক আল্লাহ্ ভীরু এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী তিনি ইমামতির জন্য অগ্রাধিকার পাবেন। যদি এ ক্ষেত্রেও সবাই সমান হন, তবে যিনি অধিক আল্লাহ্ ভীরু এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী তিনি ইমামতির ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবেন। এ বিষয়ে যদি সবাই একই মানের হন, হবে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ তিনি অগ্রাধিকার পাবেন। কারণ বয়োজ্যেষ্ঠতাও মর্যাদা নির্ণয়ের অন্যতম স্বীকৃত মাপকাঠি।
মোটকথা, ইমামতির জন্য উল্লিখিত পদ্ধতিসমূহ সুস্থ বিবেকের ও প্রজ্ঞার দাবি এবং এ-ই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর শিক্ষার দিক নির্দেশ।

ইমামতির ক্ষেত্রে উপযুক্ততার বিন্যাস
৯৫. হযরত আবূ মাসউদ আনসারী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন। সেই ব্যক্তিই লোকদের ইমামতি করবে যে আল্লাহর কিতাব পাঠে সর্বাধিক জ্ঞাত। যদি কিরা'আত পাঠে সবাই সমান হয়, তবে যে আগে হিজরত করেছে সে ইমামতি করবে। যদি হিজরতের ক্ষেত্রেও সবাই সমান হয়, তবে যে বয়োজ্যেষ্ঠ সে ইমামতি করবে। তোমাদের কেউ অন্য কারো কর্তৃত্বের স্থলে ইমামতি করবে না এবং অনুমতি ছাড়া কারো ঘরে তার আসনে বসবে না। (মুসলিম)
کتاب الصلوٰۃ
عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ الْأَنْصَارِيِّ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : « يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللهِ ، فَإِنْ كَانُوا فِي الْقِرَاءَةِ سَوَاءً ، فَأَعْلَمُهُمْ بِالسُّنَّةِ ، فَإِنْ كَانُوا فِي السُّنَّةِ سَوَاءً ، فَأَقْدَمُهُمْ هِجْرَةً ، فَإِنْ كَانُوا فِي الْهِجْرَةِ سَوَاءً ، فَأَقْدَمُهُمْ سِلْمًا ، وَلَا يَؤُمَّنَّ الرَّجُلُ الرَّجُلَ فِي سُلْطَانِهِ ، وَلَا يَقْعُدْ فِي بَيْتِهِ عَلَى تَكْرِمَتِهِ إِلَّا بِإِذْنِهِ » (رواه مسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীসে উদ্ধৃত اقرأهم لكتاب الله এর অর্থ হল, "যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব পাঠে সর্বাধিক জ্ঞাত।" কিন্তু কেবল কুরআন হিফয করা অধিক পাঠ করা এর উদ্দেশ্যে নয়। বরং এর উদ্দেশ্যে, কুরআন হিফযের সাথে সাথে কুরআনের গভীর জ্ঞান অর্জন এবং কুরআনের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর যুগে 'কুররা' উপাধিধারী ব্যক্তিবর্গ এসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। তাই হাদীসের মর্ম হল- যে ব্যক্তি কুরআনের যত অধিক জ্ঞানের অধিকারী হবে সেই ইমামতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর যুগে যারা এ সব গুণে গুণান্বিত ছিলেন তাঁরাই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উত্তরাধিকারী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিরূপে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সুন্নাহ্ এবং শরী'আতের জ্ঞান ছিল মর্যাদার অন্যতম মাপকাঠি। (সেকালে কুরআন-সুন্নাহয় যার দক্ষতা ছিল তিনি তার আমালকারীও ছিলেন, তার পক্ষে আমালশূণ্য হওয়ার বিষয়টি চিন্তাও করা যেত না।)

নবী যুগে মর্যাদার তৃতীয় মাপকাঠি ছিল হিজরাতের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য হওয়ার বিষয়টি। তাই হাদীসে সেটিকে তৃতীয় স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এমন সময় এসে গেল যখন তাঁদের অস্তিত্ব বাকি থাকল না। তাই ফিক্‌হবিদগণ তাকওয়া পরহিযগারীকেও মর্যাদার মানদণ্ড স্থির করেছেন এবং প্রাধান্য দিয়েছেন যা সত্যিকারভাবে তৃতীয় মাপকাঠি হওয়ার দাবি রাখে।

আলোচ্য হাদীসে প্রাধান্য প্রাপ্তির চতুর্থ মানদণ্ড হচ্ছে, বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়া। তাই বলা হয়েছে, উপরে বর্ণিত তিনটি গুণের ব্যাপারে যদি সবাই সমান হয়, তবে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ, তিনি হবেন ইমামতির সর্বাধিক যোগ্য।
হাদীসের শেষাংশে দু'টি দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ১. যদি কেউ কারো কর্তৃত্বের এলাকায় গমন করে, তবে সে যেন ইমামতি না করে বরং তার মুক্তাদী হিসেবে সালাত আদায় করে। তবে ঐ ব্যক্তি নিজে যদি তাকে বাধ্য করেন, তবে ভিন্ন কথা, ২. যদি কেউ কারো ঘরে যায়, তবে সে যেন তার বসার নির্দিষ্ট আসনে না বসে। অবশ্য সে যদি বসায়, তবে তাতে কোন দোষ নেই। এ দু'টি নির্দেশনার রহস্য ও কার্যকারিতা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান