মা'আরিফুল হাদীস

সলাত অধ্যায়

হাদীস নং: ১২
সলাত অধ্যায়
সালাতের সময়সমূহ
সালাতের যে মহান উদ্দেশ্য ও উপকারিতা রয়েছে এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ তাতে যে স্বাদ অনুভব করেন তার অনিবার্য দাবি হচ্ছে, দিন রাতে সারাক্ষণ না হলেও কমপক্ষে দিন রাতের বেশিরভাগ সময় সালাতে অতিবাহিত করা একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর বান্দাদের উপর এতদ্ব্যতীত আরো অনেক দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আর তাই তিনি মানুষের উপর দিন রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করে দিয়েছেন। তবে তিনি সালাতের সময় নির্ধারণের ব্যাপারে এমন ব্যবস্থা করেছেন যাতে সালাতের উদ্দেশ্য সফল হয় এবং বান্দার অপরাপর দায়িত্ব পালনেও ব্যাঘাত না ঘটে।
আল্লাহ্ তা'আলা ফজরের সালাত সুবহে সাদিকের পর নিদ্রাভঙ্গ শেষে এজন্য ফরয করেছেন যাতে ইবাদতের মধ্যে দিয়ে বান্দার কাজের সূচনা হয়। তারপর দুপুরের পর সূর্য ঢলে পড়া পর্যন্ত ফরয কোন সালাত নেই, যাতে মানুষ তার নিজ নিজ দায়িত্ব এ দীর্ঘ সময়ে আঞ্জাম দিতে পারে। এই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর যুহরের সালাত ফরয করা হয়েছে। এ সালাত আদায়ের জন্য এমন দীর্ঘ সময় দেওয়া হয়েছে যাতে প্রথম সময়ে কিংবা শেষ সময়ে সালাত আদায় করা যায় এবং এ দীর্ঘ সময়েও যেন কারো অসচেতনা দেখা না যায়। বিকেলের লক্ষণ শুরু হওয়ার সময় আসরের সালাত ফরয করা হয়েছে যাতে এই নির্দিষ্ট সময়ে অধিকাংশ লোক নিজ নিজ কর্তব্য কর্ম সম্পাদনের পর আনন্দ স্ফূর্তি করে কাটায় তখন আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ সালাতে মশগুল হয়ে যায়। এরপর দিনের অবসানের পর মাগরিবের সালাত ফরয করা হয়েছে যাতে আল্লাহর তাসবীহ্-তাহলীলের মধ্য দিয়ে রাতের সূচনা হয়। তারপর নিদ্রা যাবার পূর্বে ইশার সালাত ফরয করা হয়েছে যাতে দিনের সূচনা যেমন সালাত দ্বারা হয়েছে ঠিক সেরূপ নিদ্রার পূর্বে মুহূর্তেও যেন সালাতের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে। আর এর দ্বারা আল্লাহ্ ও তাঁর বান্দার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আমাদের সুবিধার্থে এসব সালাতের মধ্যে ব্যাপক সময় দান করা হয়েছে যাতে আমাদের সামর্থ্যানুযায়ী আমরা প্রথম, মধ্য কিংবা শেষ ওয়াক্তে সালাত আদায় করতে পারি।
এই বিশ্লেষণের উপর যদি কোন লোক গভীরভাবে চিন্তা করে তাহলে তার সামনে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে যে, যুহর থেকে ইশা পর্যন্ত সালাতসমূহের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তা অল্প সময়ের হলেও একজন সত্যনিষ্ঠ মু'মিনের কাছে সালাত যে অমূল্য সম্পদ এবং যে স্বাদের বস্তু তার পক্ষে যুহর, আসর, মাগরিব ও ইশার সালাতের ব্যাপারে যত্নবান হওয়াই সাধারণ অবস্থার দাবি এবং এর দ্বারা যেন আল্লাহ্ এবং তাঁরই বান্দার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে যায়। ফজর থেকে যুহরের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান এজন্য রাখা হয়েছে। যাতে মানুষ এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তার অপরাপর কর্তব্য কর্ম আঞ্জাম দিতে পারে। তবে যারা ভাগ্যবান তারা এই দীর্ঘ সময়ের ফাঁকে চাশতের সালাত আদায় করে থাকে। একইভাবে আল্লাহ্ তা'আলা ইশার সালাত থেকে শুরু করে ফজর পর্যন্ত কোন সালাত ফরয করেন নি যাতে মানুষের সহজাত দাবি অনুযায়ী আরাম করতে পারে। এ সময়ের মধ্যে সুদীর্ঘ ব্যবধান রাখা হয়েছে। তবে এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে যেন আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ গভীর রাতে উঠে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করে। রাসূলুল্লাহ ﷺ এ সালাতের অনেক ফযীলত বর্ণনা করেছেন। মুকীম-মুসাফির সর্বাবস্থায় নিজেও তা পালন করতেন। চাশত ও তাহাজ্জুদের সালাত সম্পর্কিত ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ অনুপ্রেরণামূলক যে বাণী প্রদান করেছেন সে বিষয় যথাস্থানে আলোচনা করা হবে। নিম্নোক্ত আলোচনা কেবল পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট। এ পর্যায়ের রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিম্নোক্ত বাণীসমূহ পাঠ করা যেতে পারে।
১২. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনুল আ'স (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি সালাতের সময় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে বলেন, সূর্যের উপরের অংশ উদিত না হওয়া পর্যন্ত ফজরের সালাতের সময় রয়েছে। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার পর থেকে আসরের সালাতের সময় না হওয়া পর্যন্ত যুহরে সালাতের সময় রয়েছে। সূর্যের আলোকরশ্মি হলুদ বর্ণ ধারণ না করা পর্যন্ত এবং তার নিম্নাংশ অস্তমিত না হওয়া পর্যন্ত আসরের সালাতের সময় অবশিষ্ট থাকে। মাগরিবের সালাতের সময় সূর্যাস্ত থেকে শাফাক অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত এবং ইশার সালাতের সময় অর্ধরাত পর্যন্ত অবশিষ্ট (বুখারী ও শব্দমালা মুসলিমের).
کتاب الصلوٰۃ
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ ، أَنَّهُ قَالَ : سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ وَقْتِ الصَّلَوَاتِ ، فَقَالَ « وَقْتُ صَلَاةِ الْفَجْرِ مَا لَمْ يَطْلُعْ قَرْنُ الشَّمْسِ الْأَوَّلُ ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الظُّهْرِ إِذَا زَالَتِ الشَّمْسِ عَنْ بَطْنِ السَّمَاءِ ، مَا لَمْ تَحْضُرِ الْعَصْرُ ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الْعَصْرِ مَا لَمْ تَصْفَرَّ الشَّمْسُ ، وَيَسْقُطْ قَرْنُهَا الْأَوَّلُ ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ إِذَا غَابَتِ الشَّمْسُ ، مَا لَمْ يَسْقُطِ الشَّفَقُ ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الْعِشَاءِ إِلَى نِصْفِ اللَّيْلِ » (رواه البخارى ومسلم واللفظ لمسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

রাসূলুল্লাহ ﷺ এ হাদীসে জনৈক প্রশ্নকারীর জবাবে সালাতের প্রথম ও শেষ সময় বর্ণনা করেছেন। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রশ্নকারী সম্ভবতঃ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত কোন্ সময় পর্যন্ত আদায় করা যায় সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন এবং সালাতের শেষ সময় কি? সালাতের প্রথম সময় সম্পর্কে সম্ভবতঃ তিনি অবহিত ছিলেন।

মাগরিবের সালাত সম্পর্কে এই হাদীসে বলা হয়েছে 'শাফাক' অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত মাগরিবের সালাতের সময় থাকে। 'শাফাক' কি এ বিষয় প্রাজ্ঞ আলিমগণ একাধিক মতামত দিয়েছেন। একথা সর্বজনবিদিত যে সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর পশ্চিমাকাশে লাল আভা ভেসে উঠে১। তারপর উক্ত আভা দূর হয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর ঐগুলি সাদা হয়ে যায়২।

এরপর আবার উক্ত সাদা আভা অদৃশ্য হয়ে যায়, তারপর কালো আভা নেমে আসে। সুতরাং অধিকাংশ আলিমের অভিমত হচ্ছে, সূর্যাস্তের পর পশ্চিমাকাশে যে লাল আভা ফুটে ওঠে তাই 'শাফাক। এই অভিমত দানকারীদের মতে, পশ্চিমাকাশের লাল আভা দূরীভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে মাগরিবের সালাতের সময় শেষ হয়ে যায় এবং ইশার সালাতের সূচনা ঘটে। ইমাম আযম আবু হানীফা (র)-এর প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে এই যে, সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর পশ্চিমাকাশে যে লাল আভা দেখা যায় এবং তারপর যে সাদা আভা দেখা যায় এতদুভয়কে 'শাফাক' বলা হয়। এ অভিমত অনুসারে ইমাম আযম আবূ হানীফা (র) এর পশ্চিমাকাশে 'শাফাক' এর পর অর্থাৎ সাদা রেখা যখন অবশিষ্ট না থাকে এবং পশ্চিামকাশ কালো হয়ে যায়, তখন থেকে ইশার সালাতের সময় শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ইমাম আযম আবু হানীফা (র) সূত্রে আরেকটি অভিমত রয়েছে যা অপরাপর ইমামগণের অনুরূপ। এই মাস'আলার ব্যাপারে তাঁর দুই প্রসিদ্ধ ছাত্র ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র) এই অভিমত দিয়েছেন। আর এজন্যই বহু প্রবীন হানাফী ফিকহবিদ এই মতের পক্ষে ফাতওয়া দিয়েছেন।

এ হাদীস ও আরো কিছু সংখ্যক হাদীসে ইশার সালাতের শেষ সময় অর্ধরাত বলা হয়েছে। কিন্তু কিছু সংখ্যক হাদীস সূত্রে জানা যায় যে, ইশার সালাতের সময় সুবহে সাদিক পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে। সুতরাং বলা যায় যে, যে সকল হাদীসে ইশার সালাতের শেষ সময় অর্ধরাত বলা হয়েছে। তার মর্ম হচ্ছে, অর্ধরাত পর্যন্ত ইশার সালাতের জায়েয সময় অবশিষ্ট থাকে এবং এর পরে আদায় করা মাকরূহ্ হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা'আলা সর্বজ্ঞ।
১. টিকা: বেশির ভাগ সময় এই লাল রং প্রায় এক ঘন্টা স্থায়ী হয়।
২. টিকা: এই সাদা আভা প্রায় আধা ঘন্টা স্থায়ী হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান