মা'আরিফুল হাদীস

পবিত্রতা অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৭
পবিত্রতা অধ্যায়
তায়াম্মুম
মানুষ কখনো এমন অবস্থার শিকার হয় যে, তার পক্ষে গোসল কিংবা উযূ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে, তা রোগজনিত কারণে হোক বা অন্য কোন কারণে হোক। অনুরূপভাবে মানুষ কখনো এমন স্থানে গিয়ে পৌঁছে যেখানে পানি পাওয়া কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ে। এ সকল অবস্থায় যদি বিনা গোসল কিংবা বিনা উযূতে সালাত আদায়ের অনুমতি দেওয়া হয় তবে তাতে স্বাভাবিক পবিত্রতা অর্জনের বিষয়টি বর্জিত ও উপেক্ষিত হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর দরবারে পবিত্রতার সাথে হাযিরী পেশ করার যে অনুভূতি তা মানুষ হারিয়ে ফেলে। এতে মানুষের মনে এ উপস্থিতির গুরুত্ব ও মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য আল্লাহ্ তা'আলা এহেন পরিস্থিতি মুকাবিলার জন্য গোসল ও উযূর পরিবর্তে তায়াম্মুমকে স্থালাভিষিক্ত করেছেন। সুতরাং গোসল ও উযূ করত অপারগ ব্যক্তির ক্ষেত্রে সালাত ও অন্যান্য ইবাদতের জন্য তায়াম্মুম গ্রহণযোগ্য হওয়ার দাবি রাখে। ফলে নিরূপায় অবস্থায় তায়াম্মুম করতে বাধ্য হওয়ায় তার মন মানসিকতায় পবিত্রতার অনুভূতি বিলুপ্ত হবে না।

তায়াম্মুম করার নিয়ম হল, এই যে, ভূপৃষ্টে তথা, মাটি, পাথর বা বালির উপর হাত মেরে পবিত্রতার নিয়্যাতে মুখমণ্ডল এবং হাত মাসেহ করা। এভাবে মুখমণ্ডল ও কনুই পর্যন্ত হাত মাসেহ করলে তায়াম্মুম আদায় হয়ে যায়। তবে মুখমমণ্ডল ও হাতে মাটি লাগানো জরুরী নয় এবং মাটি দ্বারা মুখমণ্ডল ও হাত যাতে অপরিচ্ছন্ন হয়ে না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখা চাই।

তায়াম্মুমের গুরুত্ব
গোসল ও উযূতে পানি ব্যবহৃত হয়। আল্লাহ্ তা'আলা অপারগ অবস্থায় তায়াম্মুমের বিধান দিয়েছেন। আর এতে মাটি ও পাথর ব্যবহৃত হয়। এর গূঢ় রহস্য উন্মোচন করতে যেয়ে কিছু সংখ্যক প্রাজ্ঞ আলিম বলেন, পুরো ভূখণ্ড দু'অংশে বিভক্ত। এর বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পানি এবং অপর অংশ জুড়ে রয়েছে মাটি। আর পানি ও মাটির মধ্যে রয়েছে নিবিড় সর্ম্পক। মানব সৃষ্টির সূচনা প্রধানত মাটি এবং পানি থেকেই হয়েছে। বলাবাহুল্য, সমুদ্র ব্যতীত সর্বত্র মানুষ হাতের নাগালে মাটি পাচ্ছে। এ কথাও সত্য যে, হাতে মাটি লাগিয়ে হাত এবং মুখমণ্ডল মাসেহ করার মধ্য দিয়ে আরো অধিক দীনতা-হীনতা প্রকাশ পায়। তাছাড়া মানুষের শেষ ঠিকানা মাটিতেই হবে। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, তায়াম্মুম করার ফলে মৃত্যু ও কবরের কথা স্মরণ হয়। তবে এর প্রকৃত রহস্য আল্লাহ্ তা'আলা অধিক জ্ঞাত।
এ পর্যায়ে তায়াম্মুম সম্পর্কীয় কতিপয় হাদীস পাঠ করা যাক। প্রথমতঃ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত ঐ ঘটনার উল্লেখ করা, যার প্রেক্ষিতে তায়াম্মুমের বিধান নাযিল হয়।
৬৭. হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা এক সফরে (গ্রহণযোগ্য মতে যাতুর রিকা' অভিযান কালে) রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে বের হলাম। আমরা যখন বায়দা অথবা যাতুল জায়শ (মদীনা ও খায়বারের মধ্যবর্তী দু'টি স্থান) নামক স্থানে পৌঁছলাম। তখন আমার (আমার বড় বোন আসমা থেকে ধারকৃত) গলার হার (ছিড়ে পড়ে) হারিয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ ﷺ কে তা জানালে (তিনি) তা তালাশ করতে করতে সেখানে থেমে গেলেন এবং লোকেরাও তাঁর সাথে সাথে থেমে গেল। তাঁদের কাছাকাছি কোথাও পানি ছিলনা। তারপর লোকজন (আমার পিতা) আবূ বকর (রা) এর কাছে এসে বলতে লাগল, আপনি কি লক্ষ্য করেন নি যে, আয়েশা কি করেছেন? তিনি তো (হার হারিয়ে ফেলে) রাসূলুল্লাহ ﷺ কে আটকে দিয়েছেন এবং সেই সাথে সমস্ত লোককে আটকা থাকতে বাধ্য করেছেন। অথচ কাছাকাছি কোথাও পানি নেই আর সেনাদলের সাথেও পানি নেই। তারপর আবূ বকর (রা) আমার কাছে আসলেন। আর রাসূলুল্লাহ ﷺ তখন আমার উরুর উপর মাথা রেখে আরাম করছিলেন। তিনি এসে বললেন: তুমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং লোকদেরকে আটকে রেখেছ অথচ তাঁরা না পানির কাছাকাছি, আর না তাঁদের কাছে পানি আছে। আয়েশা (রা) বলেন, আবূ বকর (রা) আমাকে ভর্ৎসনা করলেন এবং যা বলার তা বললেন। তিনি তাঁর হাত দিয়ে আমার পাঁজরে আঘাত করেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ ঘুমিয়ে ছিলেন বলে আমি মোটেই নড়াচড়া করি নি পাছে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ঘুম ভেঙ্গে যায়। এমনি করে পানি বিহীনভাবে সকাল হলো। তারপর আল্লাহ্ তা'আলা তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল করেন। তখন সকলে তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করলেন। বায়'আতে আকাবার অন্যতম দলপতি উসায়দ ইবনে হুযাইর (রা) বলেন, হে আবূ বকর তনয়া। এটাই আপনার প্রথম বকরত নয় (এর পূর্বেও আপনার মাধ্যমে উম্মত বহু বরকত লাভ করেছে)। আয়েশা (রা) বলেন, এরপর আমি যে উটের উপর ছিলাম সেটিকে চলার জন্য উঠালে উক্ত হারটি তার নিচে পাওয়া গেল। (বুখারী ও মুসলিম, তবে শব্দমালা মুসলিমের।)
کتاب الطہارت
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ : خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي بَعْضِ أَسْفَارِهِ ، حَتَّى إِذَا كُنَّا بِالْبَيْدَاءِ - أَوْ بِذَاتِ الْجَيْشِ انْقَطَعَ عِقْدٌ لِي ، « فَأَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى الْتِمَاسِهِ ، وَأَقَامَ النَّاسُ مَعَهُ ، وَلَيْسُوا عَلَى مَاءٍ ، » ، فَأَتَى النَّاسُ إِلَى أَبِي بَكْرٍ فَقَالُوا : أَلَا تَرَى إِلَى مَا صَنَعَتْ عَائِشَةُ؟ « أَقَامَتْ بِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَبِالنَّاسِ مَعَهُ ، وَلَيْسُوا عَلَى مَاءٍ ، وَلَيْسَ مَعَهُمْ مَاءٌ » ، فَجَاءَ أَبُو بَكْرٍ " وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاضِعٌ رَأْسَهُ عَلَى فَخِذِي قَدْ نَامَ ، فَقَالَ : حَبَسْتِ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالنَّاسَ وَلَيْسُوا عَلَى مَاءٍ ، وَلَيْسَ مَعَهُمْ مَاءٌ « ، قَالَتْ فَعَاتَبَنِي أَبُو بَكْرٍ ، وَقَالَ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ يَقُولَ ، وَجَعَلَ يَطْعُنُ بِيَدِهِ فِي خَاصِرَتِي ، » فَلَا يَمْنَعُنِي مِنَ التَّحَرُّكِ إِلَّا مَكَانُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى فَخِذِي ، فَنَامَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى أَصْبَحَ عَلَى غَيْرِ مَاءٍ ، فَأَنْزَلَ اللهُ آيَةَ التَّيَمُّمِ فَتَيَمَّمُوا " فَقَالَ أُسَيْدُ بْنُ الْحُضَيْرِ : وَهُوَ أَحَدُ النُّقَبَاءِ « مَا هِيَ بِأَوَّلِ بَرَكَتِكُمْ يَا آلَ أَبِي بَكْرٍ » فَقَالَتْ عَائِشَةُ : « فَبَعَثْنَا الْبَعِيرَ الَّذِي كُنْتُ عَلَيْهِ فَوَجَدْنَا الْعِقْدَ تَحْتَهُ » (رواه البخارى ومسلم واللفظ لمسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে যে তায়াম্মুমের আয়াত সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা সম্ভবত সূরা নিসার নিম্নোক্ত আয়াত:
وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَفُوًّا غَفُورًا
"তোমরা যদি পীড়িত হও অথবা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেউ শৌচস্থান থেকে আসে অথবা তোমরা নারী-সম্ভোগ কর এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটির দ্বারা তায়াম্মুম করবে এবং তা মুখ ও হাতে মাসেহ করবে। আল্লাহ্ পাপ মোচনকারী, ক্ষমাশীল।" (৪, সূরা নিসাঃ ৪৩)
সামান্য শাব্দিক পার্থক্যসহ সূরা মায়িদার দ্বিতীয় রুকুতেও অনুরূপ আয়াত রয়েছে। কিছু সংখ্যক বর্ণনাকারীদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, পূর্বোক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা মায়িদার আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ তাফসীরকারদের মতে সূরা নিসায় বর্ণিত আয়াতই প্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। তারপর সূরা মায়িদার আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ্ তা'আলা সর্বজ্ঞ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান