মা'আরিফুল হাদীস

পবিত্রতা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩০
পবিত্রতা অধ্যায়
মিস্ওয়াক করা আম্বিয়ায়ে কিরামের সুন্নাত ও প্রকৃতির দাবি
৩০. হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: দশটি কাজ ফিতরাতের অন্তর্ভুক্ত। তা হল গোফ ছাঁটা, দাড়ি লম্বা করা, মিস্ওয়াক করা, নাকে পানি দিয়ে পরিষ্কার করা, নখ কাটা, নাক-কানের ছিদ্র এবং আঙ্গুলের গিরাসমূহ ধোয়া, বগলের পশম উপড়ে ফেলা, নাভির নিচের পশমকাটা এবং পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা। হাদীস বর্ণনাকারী বলেছেন: দশমটি আমি ভুলে গেছি। তবে সম্ভবত সেটি হবে কুলি করা। (মুসলিম)
کتاب الطہارت
عَنْ عَائِشَةَ ، قَالَتْ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ : قَصُّ الشَّارِبِ ، وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ ، وَالسِّوَاكُ ، وَاسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ ، وَقَصُّ الْأَظْفَارِ ، وَغَسْلُ الْبَرَاجِمِ ، وَنَتْفُ الْإِبِطِ ، وَحَلْقُ الْعَانَةِ ، وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ " قَالَ زَكَرِيَّا : قَالَ مُصْعَبٌ : وَنَسِيتُ الْعَاشِرَةَ إِلَّا أَنْ تَكُونَ الْمَضْمَضَةَ. (رواه مسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীসে বর্ণিত দশটি বস্তুকে 'ফিতরাতের' অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। কোন কোন ভাষ্যকারের মতে ফিতরাত الفطرة দ্বারা নবী-রাসূলের তরীকা-পদ্ধতি বুঝানো হয়েছে। একথার সমর্থন ইবনে আওয়ানা (রা) বর্ণিত হাদীসে فطرة এর স্থলে سنة শব্দের প্রয়োগের মাধ্যমে পাওয়া যায়। অর্থাৎ তার বর্ণনায় "عشر من الفطرة" এর স্থলে "عشر من السنة রয়েছে। এ হাদীসে ঐ সকল ভাষ্যকারদের মতে, 'ফিতরাত' অর্থ হচ্ছে, নবী-রাসূলদের অনুমোদিত কাজ। এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে হাদীসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে এই-নবী-রাসূলগণ তাঁদের পুণ্যময় জীবন যার উপর অতিবাহিত করেন এবং উম্মাতকে চলার নির্দেশ দেন এদশটি বস্তু তারই অন্তর্ভুক্ত। এ দশটি বিষয়ই সকল নবী-রাসূলের সার্বজনীন শিক্ষা ও সম্মিলিত আমল।
কোন কোন ভাষ্যকার 'ফিতরাত' দ্বারা ইসলাম ধর্মকে বুঝিয়েছেন। কারণ কুরআন মাজীদে দীনকে 'ফিতরাত' বলা হয়েছে।

ইরশাদ হয়েছে: فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ "তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজকে দীনে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন: আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল দীন" (৩০, সূরা রূম: ৩০)
উক্ত আয়াতের অর্থের ভিত্তিতে হাদীসের মূলকথা হবে-এ দশটি বস্তু ইসলাম ধর্মের অঙ্গীভূত।

কোন কোন ব্যাখ্যাকার 'ফিতরাত' দ্বারা মানুষের মৌলিক প্রকৃতি বুঝিয়েছেন। এ ব্যাখ্যার আলোকে হাদীসের মূল প্রতিপাদ্য হবে এরূপ- এ দশটি বস্তু মানব স্বভাবের দাবি যা দিয়ে আল্লাহ্ তা'আলা তাদের সৃষ্টি করেছেন। মানুষের সহজাত প্রকৃতির দাবি হচ্ছে, ঈমান আনা, পবিত্র জীবন পসন্দ করা, এবং কুফর অশ্লীলতা ও মন্দকাজ, অপবিত্রতা অশুচিতা অপসন্দ করা। তাই উল্লিখিত দশটি বস্তু হচ্ছে মানুষের সহজাত পসন্দের বিষয়। আর একথা সর্বজনমান্য যে, নবী-রাসূলগণ যে দীন ও জীবন ব্যবস্থা নিয়ে এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন তাই হবে মানুষের প্রকৃতির দাবি, এটাই তো স্বাভাবিক।

এ ব্যাখ্যা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, 'ফিতরাত' এর দ্বারা নবী-রাসূলগণের সুন্নাত এবং ইসলাম ধর্ম অথবা মানব প্রকৃতির মৌল দাবি বুঝানো হয়েছে। তবে হাদীসের তিনটি ব্যাখ্যায় অর্থ একই থাকে। যে দশটি বস্তু নিয়ে নবী-রাসূলগণ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন তা যেমন শরী'আতের অপরিহার্য অঙ্গ, তদ্রুপ মানব প্রকৃতিরও অনিবার্য দাবি। হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ (র) আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যায় তাঁর 'হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা' গ্রন্থে যে বিবরণ দিয়েছেন তার সারমর্ম নিম্নে পেশ করা হলঃ
আলোচ্য হাদীসে বর্ণিত দশটি বস্তু মূলতঃ তাহারাত অনুচ্ছেদের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং মিল্লাতে হানীফের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইব্রাহীম (আ) থেকে বর্ণিত। ইব্রাহীমী তরীকার উপর অবিচল থাকতে প্রস্তুত উম্মাতের মধ্যে এসবের সাধারণ প্রচলন রয়েছে এবং এর উপর রয়েছে তাদের সুদৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা। শতাব্দীর পর শতাব্দী উপরোক্ত আমলসমূহ কার্যকারী রয়েছে এবং এরই উপর মানুষ জীবিত থাকছে এবং ইন্তিকাল করছে। আর এজন্যেই এগুলোকে 'ফিতরাত' এবং মিল্লাতে হানীফের অন্যতম লক্ষণও বলা হয়েছে। প্রত্যেক ধর্মেরই কিছু লক্ষণ ও প্রতীক থাকা প্রয়োজন, যাতে তার অনুসারীদের সহজেই চেনা যায় এবং এবিষয়ে সংকোচ প্রদর্শনকারীদের পাকড়াও করে শাস্তি বিধান করা যায় এবং ধর্মের অনুসারী ও ধর্মবিমুখ উভয়বিধ লোকদের চিহ্নিত করা যায়। লক্ষণ এমন হওয়া চাই যা কদাচিত নয় বরং অহরহ ঘটে এবং যাতে বহুবিধ উপকারিতা নিহিত থাকে। মানুষের মননশীলতা তা মেনে নেয়। এদশটি বস্তুতেই এ গুণগুলো পাওয়া যায়। এগুলো অনুধাবন করার জন্য নিম্নের কথাগুলো গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিৎ।
মানবদেহের কোন স্থানের চুল বেড়ে গেলে রুচিসম্পন্ন মানুষের মনে তা মালিন্যের ভাব সৃষ্টি হয়, যেমন শরীর থেকে কোন দুর্গন্ধময় বস্তু বের হয়ে মালিন্যের ভাব হয়ে থাকে। বগলের এবং গাভীর নিচের চুল এ সবের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই এগুলো পরিষ্কার করার মধ্য দিয়ে রুচীবান মানুষ মাত্র প্রফুল্লতা ও সজীবতা উপলব্দি করে আর এরূপ অনুভব করাই হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অনিবার্য দাবি এবং নখের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। দাড়ি কখনো ছোট বড় হয়ে থাকে এবং তা পুরুষের সৌন্দর্যবর্ধন করে এবং এভাবেই তা পুরুষত্বের প্রতীক রূপে বিবেচিত হয়। দাড়ি নবী-রাসূলগণের সুন্নাত। কাজেই দাড়ি রাখা পুরুষের কর্তব্য১, এবং তা মুণ্ডন করা অগ্নিপূজক, হিন্দু অপরাপর অমুসলিম জাতির প্রতীক। সাধারণত নিম্নবর্ণের লোকেরাই দাড়ি মুণ্ডন করে থাকে। সুতরাং দাড়ি না রাখা মূলতঃ নিজকে নিচ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করে দেয়ারই নামান্তর।

গোঁপ বড় রাখার ক্ষতিকর দিক হচ্ছে এই যে, গোঁপ বেড়ে গেলে পানাহারের বস্তু গোঁফে লেগে যেতে পারে এবং নাকের ময়লা যেহেতু গোঁফের সোজাসুজি পথে বের হয় তাই তা পরিষ্কার রাখার অনিবার্য দাবি হিসেবে গোঁফ বড় না করা উচিত। আর এজন্যই গোঁপ ছোট রাখার বিধান দেয়া হয়েছে। কুলি এবং পানি দ্বারা নাক পরিষ্কার করা হয় মিস্ওয়াক দ্বারা মুখ পরিষ্কার রাখা হয়, পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা হয় এবং উযূতে পানি দ্বারা আঙ্গুলের ময়লা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। সুতরাং উপরিউক্ত দশটি কাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিধানের ক্ষেত্রে যে বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কোন কোন প্রাজ্ঞ আলিম এ হাদীসের আলোকে এ মূলনীতি পেশ করেছেন যে, শরীর পরিষ্কারকরণ, চেহারার শোভা বর্ধন এবং বিরক্তিকর যাবতীয় বস্তু দূরীকরণ এবং যে সব কারণে মানুষের রুচি বিগড়ে যায় তা বর্জন মূলতঃ নবী-রাসূলগণেরই সুন্নাত। চেহারার সৌন্দর্য বধর্নকে আল্লাহ্ তা'আলা অন্যতম নি'আমত ও দান বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে: وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُورَكُمْ "তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দিয়েছেন-তোমাদের আকৃতি করেছেন সুশোভন।" (৬৪ সূরা তাগাবুন: ৩)

এ হাদীসটি হযরত আয়েশা (রা) থেকে তাঁর ভাগ্নে আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবায়র (রা) বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর থেকে তালক ইবনে হাবীব এবং তাঁর থেকে মুস'আব ইবনে শায়বা এবং তাঁর থেকে তাঁর ছাত্র যাকারিয়া ইবনে আবু যায়িদা বর্ণনা করেছেন। এই যাকারিয়া স্বীয় উস্তাদ মুস'আব থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন যার মধ্যে দশটি বস্তুর মধ্যে দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন এবং দশ নম্বরটি সম্পর্কে তিনি বলেছেন: আমার সঠিক স্মরণ নেই। তবে আমার মনে হয় সেটি হল 'কুলি করা'।

১. টিকা: অপরাপর হাদীসে দাড়ি রাখার নির্দেশ মূলতঃ নির্দেশসূচক শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে। যার ফলে আলিমগণ দাড়ি রাখা ওয়াজিব মনে করেন। হাদীসে দাড়ির পরিমাণ সম্পর্কীয় পরিষ্কার বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে ফিকহবিদগণ বিভিন্ন নিদর্শনের বরাত দিয়ে এক মুষ্টি দাড়ি রাখা ওয়াজিব বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান