মা'আরিফুল হাদীস

আখলাক অধ্যায়

হাদীস নং: ২৩৮
আখলাক অধ্যায়
ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা

এ দুনিয়ায় দুঃখ-কষ্টও আছে, আরাম এবং সুখও আছে। আনন্দও আছে, দুশ্চিন্তাও আছে। মিষ্টতাও আছে, তিক্ততাও আছে। ঠাণ্ডাও আছে, গরমও আছে। অনুকূল অবস্থাও আছে, প্রতিকূলতাও আছে। আর এসব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকেই এবং তাঁরই হুকুমে হয়ে থাকে। এ জন্য আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী বান্দাদের অবস্থা এই হওয়া চাই যে, যখন কোন দুঃখ-মুসীবত এসে যায়, তখন তারা যেন নৈরাশ্যের শিকার হয়ে ভেঙ্গে না পড়ে; বরং ঈমানী ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে তা যেন বরণ করে নেয় এবং অন্তরে এ বিশ্বাস তাজা করে নেয় যে, এসব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে, যিনি আমাদের প্রজ্ঞাময় ও দয়াময় প্রভু এবং তিনিই আমাদেরকে এ দুঃখ ও বিপদ থেকে মুক্তি দানকারী।

অনুরূপভাবে যখন মানুষের অবস্থা অনুকূল ও যুৎসই থাকে, তাদের কামনা-বাসনা পূর্ণ হতে থাকে এবং সুখ ও আনন্দের সামগ্রী হাতে আসতে থাকে, তখনও যেন তারা এটাকে নিজেদের কৃতিত্ব এবং নিজেদের বাহুবলে অর্জিত ফসল মনে না করে; বরং এ সময় তারা যেন নিজেদের অন্তরে এ বিশ্বাস তাজা করে নেয় যে, এসব কিছুই কেবল আল্লাহ্ তা'আলার একান্ত অনুগ্রহ ও তাঁর দান। তিনি যখন ইচ্ছা করেন, তখন তাঁর দেওয়া সব নেয়ামত ছিনিয়েও নিতে পারেন। এ জন্য প্রতিটি নেয়ামতের উপর তাঁর কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া আদায় করা উচিত।

এটা ইসলামের এক বিশেষ শিক্ষা এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ বিভিন্নভাবে এর প্রতি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এ শিক্ষার উপর আমল করার একটি ফল তো এই হয় যে, একজন বান্দা সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে। দ্বিতীয় উপকারিতা এই যে, সে বিপদে ও ব্যর্থতায় কখনো ভেঙ্গে পড়ে না, অব্যাহত দুঃখ ও শোকে সে মুষড়ে যায় না এবং নৈরাশ্য ও ভঙ্গুরতা তার কর্মক্ষমতাকে নিঃশেষ করতে পারে না। এ প্রসঙ্গের কয়েকটি হাদীস নিম্নে পাঠ করে নিন:

মু'মিনের ব্যাপার খুব আজিব
২৩৮. হযরত সুহায়ব (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: মু'মিনের ব্যাপার খুব আজিব। প্রত্যেক ব্যাপারে তার জন্য কল্যাণ। মু'মিন ছাড়া অন্য কারো জন্য এরূপ নয়। যদি তাকে সুখ-শান্তি স্পর্শ করে, তাহলে সে আল্লাহর শোকর আদায় করে এবং এটা তার জন্য কল্যাণকর। যদি দুঃখ-কষ্ট তাকে স্পর্শ করে, তাহলে সে সবর করে এবং এটা তার জন্য কল্যাণকর। (মুসলিম)
کتاب الاخلاق
عَنْ صُهَيْبٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : « عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ ، إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ ، وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ ، إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ ، صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ » (رواه مسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

শোকর ও সবর মু'মিন বান্দার বিশেষ গুণ। আল্লাহ তাকে কল্যাণ ও প্রাচুর্য দান করলে সে কখনো অহঙ্কার করে না এবং বে-পরওয়া যিন্দেগী যাপন করে না। বরং সে আল্লাহকে আরো বেশি ভয় করে, তাঁকে মহব্বত করে এবং এ নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে। যে শুকরিয়া আদায় করে, আল্লাহ তাকে মহব্বত করেন, তাকে বর্ণিত নিয়ামাত দান করেন, তার আমলনামায় সওয়াব লিখেন। তাকে শাকির বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী বান্দাদের মধ্যে শামিল করেন। এভাবে সুখ-শান্তি ও প্রাচুর্যের অবস্থায়ও মু'মিন বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তাই বিজ্ঞ লোকমান হাকীম তাঁর ছেলেকে আল্লাহর শাকির বান্দা হওয়ার জন্য উপদেশ দানকালে বলেছিলেনঃ
وَمَنْ يَشْكُرْ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, শুকরিয়া তিনভাবে আদায় করার প্রয়োজন রয়েছে। বান্দা যেন সর্বদা এ কথা মনে করে, যে নিয়ামত সে লাভ করেছে তা কোন মানুষ তাকে দান করেনি, বরং তা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ দান করেছেন। প্রয়োজনবোধে এ চিন্তার মৌখিক প্রকাশ করা কর্তব্য। শুধু তাই নয়, বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন হওয়া উচিত। আল্লাহর দেয়া নিয়ামতকে আল্লাহর পসন্দনীয় রাস্তায় ব্যবহার করা, গোটা জীবনকে তাঁর ইবাদতের অধীন করা, আল্লাহর পয়গামকে মানুষের কাছে পৌছান, আল্লাহর শাকির বান্দাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, আল্লাহর না-শোকরকারী ও বিদ্রোহী বান্দাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্তরিক, মৌখিক ও দৈহিক সংগ্রাম করা শুকরিয়া আদায় করার বাস্তব পন্থা। বিপদ উপস্থিত হলে কখনো মু'মিন বান্দা নিরাশ হন না। বিপদকালে তিনি ধৈর্য ধারণ করেন, আল্লাহর উপর ভরসা করেন এবং বিপদ মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। বস্তুত সৎকর্মশীল ঈমানদার বান্দার গোটা জীবনকে সবরের জীবন আখ্যায়িত করা যায়। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিজের না-জায়েয খাহেশকে সংযত রাখা, আল্লাহর দেয়া সীমার পাবন্দী করা, আল্লাহর হুকুম-আহকাম পালন করা, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের সময়, নিজের দৌলত নিজের শ্রম-মেহনত ও যোগ্যতা ব্যয় করা, প্রয়োজনবোধে নিজের জান কুরবান করা, আল্লাহর রাস্তা থেকে বিচ্যুতকারী প্রত্যেক লোভ-লালসা ও হাতছানিকে পদদলিত করা, সৎপথে পা রাখার কারণে যে বালা-মুসীবত তার উপর পতিত হয়, তা বরদাশত করা, হারাম ও নাজায়েয পন্থায় যে ফায়দা ও স্বাদ পাওয়া যায়, তার খাহেশ ত্যাগ করা, আল্লাহর দীনকে জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করার কারণে শয়তান ও তার অনুচরবর্গ যে দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা ও ক্ষয়ক্ষতি করে, তা হাসিমুখে সহ্য করা এবং এসব নেক কর্মের ফল এ দুনিয়ায় নয়, বরং আখিরাতের যিন্দেগীতে দান করার জন্য আল্লাহ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার উপর পূর্ণ বিশ্বাস করা এমন এক মহান ও উজ্জ্বল কর্মধারা যা মু'মিন বান্দার গোটা জীবনকে সবরের যিন্দেগীতে রূপান্তরিত করে। মু'মিন বান্দার সবরের কামিল নমুনা হলো, প্রত্যেক দিন ও প্রতি মুহূর্তে সবর, হর মওকা ও হর হালতে সবর, সারা জীবনব্যাপী সবর। এ ধরনের সবরের প্রতিদানও নগণ্য নয়। নিয়ামতভরা জান্নাত তার উপযুক্ত প্রতিদান। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে।
وَجَزَاهُمْ بِمَا صَبَرُوا جَنَّةً
- "তাদের সবরের প্রতিদান জান্নাত।" (সূরা আদ-দাহর)

ইবনে মাজাহ আবু উমামা (রা)-এর হাওয়ালা দিয়ে যে হাদীসে কুদসী বর্ণনা করেছেন তাতে আল্লাহর সাবির বা সবরকারী বান্দাদের প্রতিদানের সুসংবাদ রয়েছে:
قَالَ: يَقُولُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: ابْنَ آدَمَ إِنْ صَبَرْتَ وَاحْتَسَبْتَ عِنْدَ الصَّدْمَةِ الْأُولَى لَمْ أَرْضَ لَكَ ثَوَابًا دُونَ الْجَنَّةِ.
-"রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ হে আদম সন্তান, যদি বিপদের সূচনাতে তুমি সবর কর এবং আমার সন্তুষ্টির চিন্তা কর, তাহলে আমি তোমাকে জান্নাত ছাড়া অন্য কোন সওয়াব দিতে রাযী হব না।" (ইবনে মাজাহ)

আল্লাহর রহমত, নিয়ামত ও মাগফিরাত লাভ করার জন্য তাবারানীর এক হাদীসে সবরের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা)-এর হাওয়ালা দিয়ে বর্ণিত উক্ত হাদীসে মুসীবত গোপন রাখা এবং মুসীবতের অভিযোগ কারো কাছে না করার উপদেশ দেয়া হয়েছে:
مَنْ أُصِيبَ بِمُصِيبَةٍ فِىْ مَالِهِ اَوْ فِىْ نَفْسِهِ فَكَتَمَهَا وَلَمْ يَشْكُهَا اِلَى النَّاسِ كَانَ حَقًّا عَلَى اَنْ يَغْفِرَ لَهُ .
"রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: যদি কোন বান্দার মাল বা নফসের উপর মুসীবত পতিত হয় এবং সে তা গোপন করে, আর মানুষের কাছে তার শেকায়েত না করে, তাহলে তাকে মাফ করে দেয়া আল্লাহর যিম্মাদারী হয়ে যায়।" (তাবারানী)

শুধু আখিরাতের যিন্দেগীতে নয়, দুনিয়ার যিন্দেগীতেও সাবির বান্দাগণ আল্লাহর অফুরন্ত মেহেরবানী লাভ করে থাকেন। অপর এক হাদীসে ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। যে ব্যক্তি ভূখা বা কোন সমস্যা জর্জরিত এবং সে তার অভাব ও সমস্যা মানুষের কাছে গোপন রাখে, আল্লাহ সে ব্যক্তিকে এক বছরের উপযোগী হালাল রিযক দান করেন।

হাদীসে বলা হয়েছে, শোকর ও সবরের প্রতিদান শুধু মু'মিন বান্দার জন্য; আল্লাহদ্রোহী ও অবিশ্বাসিগণ শোকর ও সবরের দৌলত ও তার মহা প্রতিদান থেকে বঞ্চিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান