মা'আরিফুল হাদীস

আখলাক অধ্যায়

হাদীস নং: ১০৭
আখলাক অধ্যায়
উত্তম আখলাক পরিপূর্ণ করার জন্য আমি প্রেরিত
১০৭. ইমাম মালিক (রহ.) থেকে বর্ণিত, তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বাণী পৌঁছেছে যে, তিনি বলেছেন: আখলাকের সৌন্দর্যকে নিখুঁত ও পরিপূর্ণ করার জন্য আমাকে পাঠান হয়েছে। (মুয়াত্তা)
کتاب الاخلاق
عَنْ مَالِكٍ بَلَغَهُ اَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : " بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ حُسْنَ الْأَخْلَاقِ " (رواه فى المؤطا ورواه احمد عن ابى هريرة)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

মানুষের আহরণের উৎকর্ষ সাধন ও পরিপূর্ণতা দান করার জন্য আল্লাহর রাসুল ﷺ-কে দুনিয়ায় পাঠান হয়েছে। আরবী শব্দ 'মূলক'-এর বহুবচন হচ্ছে 'আখলাক'। এই শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। তার মধ্যে রয়েছে, প্রকৃতি, স্বভাব, মেযাজ, চরিত্র, মন-মানসিকতা, নৈতিকতা, আচরণ, ব্যবহার প্রভৃতি। অপর দিকে ধৈর্যহীন বদমেজাযী ব্যক্তিকে আরবীতে বলা হয় 'যীকুল খুলক' এবং মন্দ আচার-আচরণকে বলা হয় 'সুউল খুলক' আর বেআদব ও অশিষ্টাচারীকে বলা হয় 'সাইয়িউল খুলক'।

আখলাকের উৎকর্ষ সাধন করার উপর এজন্য খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, বদমেজায, মন্দ স্বভাব, গর্হিত আচার-আচরণ, অভদ্র ব্যবহার মানুষের মন ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়, নিকটের মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং মানুষের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি করে, সামাজিক বন্ধন নষ্ট করে দেয়। চিকিৎসা দ্বারা অস্ত্রের আঘাত নিরাময় করা যায়: কিন্তু বদমেজায ও অভদ্র আচরণে মানুষের মনে যে ক্ষত সৃষ্ট হয় তা কোন কিছুর দ্বারা দূর করা যায় না। আল্লাহর নবী ﷺ মানুষকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ও সমাজবদ্ধ করে আল্লাহর দীনকে তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তাই তিনি ঈমান ও আমলের সঙ্গে আখলাকের উৎকর্ষ সাধনের উপর জোর দিয়েছেন। আল্লাহর নবী ﷺ তাঁর শত্রুদের সাথেও মন্দ আচরণ করেননি। একদিন মন্দ স্বভাবের এক ব্যক্তি তাঁর গৃহে আসল। তিনি তাঁর পরিবার-পরিজনকে আগন্তুকের মন্দ স্বভাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিলেন। কিন্তু তিনি ঘরের বাইরে গিয়ে হাসিমুখে লোকটির সাথে অনেকক্ষণ, মতান্তরে সে না যাওয়া পর্যন্ত আলাপ করলেন।

আল্লাহর পথে নবী করীম ﷺ-কে বে-ইনতেহা তকলীফ ও মুসীবত দেয়া হয়েছে। তাঁর সাথে হাসি-ঠাট্টা করা হয়েছে, তাঁকে পাগল, যাদুকর এবং জিনগ্রস্ত বলা হয়েছে। তাঁর সাথে চূড়ান্ত পর্যায়ের বেআদবী করা হয়েছে। তাঁর গায়ে থুথু ফেলা হয়েছে। তাঁর রাস্তায় কাঁটা বিছানো হয়েছে। তাঁর মাথায় ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ করা হয়েছে। তাঁর প্রতি পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছে। তিনি শত্রুদের যাবতীয় উস্কানি ও বেআদবী ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করেছেন। তিনি কখনো সংকীর্ণ মনের পরিচয় দেননি। তিনি ধৈর্যহীন হলে দীনের লোকসান হতো। তিনি সংকীর্ণ অন্তঃকরণের লোক হলে আরব মরুবাসী তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যেত। তাঁকে ক্ষিপ্ত ও উত্তেজিত করার জন্য বারবার চেষ্টা করা হয়েছে, তিনি উত্তেজিত হননি। তিনি উত্তেজিত হলে দীনের প্রচারের পথ সংকীর্ণ হতো। শত্রুদের হীন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতো। তারা খুশি হতো। তাই আল্লাহ সূরা আল-কলমে বলেছেনঃ
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ
"অবশ্যই আপনি মহান আখলাকের মরতবায় অধিষ্ঠিত।"

বলা বাহুল্য, পবিত্র কুরআন মোতাবিক তিনি তাঁর আখলাক গঠন করেছিলেন এবং তিনি কুরআনের এক বাস্তব নমুনা ছিলেন। তাই হযরত আয়েশা (রা) বলেছেনঃ
كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ
"কুরআন ছিল তাঁর আখলাক।"
মুসলিম, মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ প্রভৃতি কিভাবে তাঁর এই উক্তির উল্লেখ রয়েছে। উম্মুল মু'মিনীন তাঁর এ উক্তির ব্যাখ্যা অন্য বর্ণনাতে করেছেন।

ইমাম আহমদ হযরত আয়েশা (রা)-এর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন: আল্লাহর রাসূল ﷺ কখনো কোন খাদিমকে প্রহার করেননি, কোন স্ত্রীলোকের উপর হাত উঠাননি, জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ ছাড়া তিনি নিজের হাত দিয়ে কাউকে মারেননি, আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন করা হলে আল্লাহর খাতিরে তার শাস্তি প্রদান করা ছাড়া তিনি কখনো কোন নির্যাতনের প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। দুটো কাজের মধ্যে একটা বাছাই করার অধিকার দেয়া হলে তিনি সহজটি বেছে নিতেন। গুনাহর কাজ তার ব্যতিক্রম ছিল। তিনি তা থেকে অনেক দূরে থাকতেন।

আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য আল্লাহর বান্দাদের সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে। মানুষকে খুশি করার পেছনে আল্লাহকে খুশি করার উদ্দেশ্য থাকবে। পাপী অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে হাকিম, শাসক বা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের কঠোরতা অবলম্বন করা উত্তম আখলাকের পরিপন্থি নয়; বরং এ ব্যাপারে নরম ব্যবহার করা কর্তব্যকর্মে গাফিলতির শামিল হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান