মা'আরিফুল হাদীস

রিকাক অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৯
রিকাক অধ্যায়
মুসলিম উম্মতের পহেলা কল্যাণ এবং পহেলা ফাসাদ
৫৯. হযরত আমর ইবন শু'আয়ব তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর দাদা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী ﷺ বলেছেন: এ উম্মতের পহেলা সওয়াব ও কল্যাণ হল, ইয়াকীন ও যুহদ এবং এ উম্মতের পহেলা ফাসাদ হল, কৃপণতা ও আকাঙ্ক্ষা। (বায়হাকী: শুয়াবুল ঈমান)
کتاب الرقاق
عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ ، عَنْ أَبِيهِ ، عَنْ جَدِّهِ : أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : " أَوَّلُ صَلَاحِ هَذِهِ الْأُمَّةِ بِالْيَقِينِ وَالزُّهْدِ ، وَأَوَّلُ فَسَادِهَا بِالْبُخْلِ وَالْأَمَلِ " (رواه البيهقى فى شعب الايمان)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

মুসলিম উম্মতের সর্বোত্তম কল্যাণ হল ইয়াকীন ও যুহদ। মুহাদ্দিসগণ হাদীসে বর্ণিত ইয়াকীন১ শব্দকে বিশ্বাস অর্থে গ্রহণ করেছেন। ভাল-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গল যা কিছু মানুষকে স্পর্শ করে, তা আল্লাহর ফয়সালা মোতাবিক ও ইশারা-ইঙ্গিতে যে হয়ে থাকে, তা বিশ্বাস করাকে ইয়াকীন বলা হয়। নবী ﷺ বিভিন্ন সময়ে দু'আর মধ্যে 'ইয়াকীন' শব্দ এ অর্থে ব্যবহার করেছেন। নবী ﷺ তাঁর দু'আতে বলেন:
اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْئَلُكَ إِيمَانًا دَائِمًا يُباشِرُ قَلْبِيْ وَيَقِيْنًا صَادِقًا حَتّٰى أَعْلَمُ إِنَّهُ لَا يُصِيبُنِي إِلَّا مَا كُتِبَتْ لِيْ.

অর্থাৎ, "হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি এমন ঈমান যা সর্বদা আমার অন্তরকে প্রফুল্লতা দান করে এবং এক সত্য ইয়াকীন যাতে আমি বুঝতে পারি, তুমি আমার ভাগ্যলিপিতে যা লিখেছ, তাছাড়া কোন কিছু আমার উপর পতিত হবে না।"

বান্দা যখন কিসমতের ফয়সালার উপর সম্পূর্ণ ইয়াকীন স্থাপন করে বা মনে, প্রাণে বিশ্বাস করে যে, রিযকের স্বল্পতা ও প্রাচুর্য সম্পূর্ণ আল্লাহর এখতিয়ারের মধ্যে, তখন সে কিসমতের ফয়সালা পরিবর্তন করার জন্য কোন মানুষের শরণাপন্ন হবে না। বান্দা যখন দৃঢ়প্রত্যয় রাখে যে, দুনিয়ার কোন শক্তি আল্লাহর ফয়সালা কার্যকরী করতে বাধা দিতে সক্ষম নয়, আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানুষের কোন তদবীর কার্যকরী নয় বা আল্লাহ যে মুসীবত দিয়েছেন তা কোন শক্তি দূর করতে পারবে না, তখন সে নির্ভীকচিত্তে আল্লাহর রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। রাজার রক্তচক্ষু, আমীর-ওমারার গরম কথা, ভাই-বন্ধুর মায়া-মমতা, সম্পদের লোকসান কোন কিছুই তাকে হক পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।

যাহিদ সাধক মানুষ দুনিয়ার আরাম-আয়েশের প্রতি বিমুখ। তাঁরা দুনিয়ার জীবন ও তার প্রাচুর্যকে অস্থায়ী মনে করেন। তাঁরা আখিরাতের যিন্দেগীকে মহব্বত করেন, আখিরাতের চিত্র সুস্পষ্ট থাকায় তারা আখিরাতের জীবনের কল্যাণ হাসিল করতে দুনিয়ার সর্বোচ্চ কুরবানীকেও কুরবানী মনে করেন না। আল্লাহর সুন্নাত মোতাবিক দুনিয়া তাঁদের কাছে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে ধরা দেয়, তাই আল্লাহর যাহিদ বান্দারা আখিরাতের জীবনের সাথে সাথে দুনিয়ার জীবনের ফায়দাও হাসিল করেন। এ জন্য নবী ﷺ তাঁর উম্মতের জন্য যুহুদ (দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি) ও ইয়াকীনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেছেন। যতদিন ইয়াকীন ও যুহদের রজ্জু মুসলিম উম্মাহ দৃঢ়হস্তে ধারণ করে রাখবে, ততদিন তারা দুনিয়ার জীবনে কামিয়াব থাকবে এবং মৃত্যুর পর আখিরাতের কামিয়াবী তাদের নসীব হবে।

কৃপণতা ও আকাঙ্ক্ষাকে মুসলিম উম্মতের ফাসাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কৃপণ ব্যক্তি আত্মকেন্দ্রিক থাকার কারণে ধন-দৌলত কুক্ষিগত করা ছাড়া তার জীবনের অন্য কোন লক্ষ্য নেই। দেশ, জাতি বা সমাজের জন্য তার কোন চিন্তা-ভাবনা নেই। সে সমাজের কল্যাণে কোন কাজ করতে প্রস্তুত নয়। যে কাজে তার ধন-দৌলত উপার্জনে বিঘ্ন ঘটে, তা তার কাছে অপসন্দনীয়। এ ধরনের কৃপণ ব্যক্তি সমাজ তথা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শত্রু।

অনুরূপভাবে আকাঙ্ক্ষা পোষণকারী ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত আকাঙ্ক্ষা সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়। মৃত্যুকে অপসন্দ করে দুনিয়াতে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে চায়। এ ধরনের লোকের দ্বারা কোন মহৎ কাজ হয় না। কোন কাজে হাত দেয়ার পূর্বে তারা বারবার চিন্তা করে দেখে, তাতে বিপদের ঝুঁকি কতটুকু। কোন কঠিন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত মন-মানসিকতা এবং হিম্মত তাদের নেই। তাই নবী ﷺ তাঁর উম্মতের জন্য এ দুটো জিনিসকে ক্ষতিকারক বলেছেন। প্রথমে যে দুটি গুণের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো যতদিন মুসলিম উম্মত আঁকড়ে ধরেছিল, ততদিন তাদের দুনিয়াতে জয়জয়কার ছিল, দুনিয়া তাদের কাছে নত ছিল। শেষে যে দুটি বদ অভ্যাসের উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর অভিশাপে মুসলিম উম্মত আজ মাগলুব বা পরাজিত। দুনিয়ার অন্যান্য জাতি তাদের উপর গালিব বা বিজয়ী। দুনিয়া তাদের জন্য সংকীর্ণ, এমনকি নিজের গৃহ ও দিলও তাদের জন্য সংকীর্ণ এবং অন্যের প্রভাব ও কর্তৃত্বাধীন। আখিরাতের ব্যর্থতা ও গ্লানি। পরবর্তী পর্যায়ে আখিরাতের আদালতে অবশ্যই তাদেরকে তামাম ব্যর্থতার জবাব দিতে হবে।

১. কোন কোন ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসে 'ইয়াকীন' মৃত্যু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন:
وَاعْبُدُ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ
-"এবং তোমার রব্বের ইবাদত কর, ইয়াকীন বা মৃত্যু আসা পর্যন্ত।"
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান