মা'আরিফুল হাদীস

রিকাক অধ্যায়

হাদীস নং: ১৬
রিকাক অধ্যায়
তাকওয়া ছাড়া এক মানুষের উপর অপর মানুষের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই
১৬. আবু যর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে বলেছেন, একমাত্র তাকওয়া ছাড়া কোন লাল ও কোন কালো ব্যক্তির উপর তোমার কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। (আহমদ)
کتاب الرقاق
عَنْ أَبِي ذَرٍّ ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَهُ : « إِنَّكَ لَسْتَ بِخَيْرٍ مِنْ أَحْمَرَ وَلَا أَسْوَدَ إِلَّا أَنْ تَفْضُلَهُ بِتَقْوَى » (رواه احمد)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ইসলাম ধন-সম্পদ, চেহারা-সুরত, রং-রূপ, কাল-সাদা, আরব-অনারব এবং ভাষার ভিত্তিতে মানব জাতির মধ্যে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করে না। আমাদের পৃথিবী ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতার কারণে বহুধা বিভক্ত। বর্তমান দুনিয়ার অশান্তির মূলেও ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতা অনেকাংশে দায়ী। এক ভাষায় কথা না বলার কারণে পাশের মানুষকেও দূরের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। অনুরূপ শরীরের বর্ণের কারণেও মানুষে মানুষে বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়। মানবতাকে বহুধা বিভক্তকারী এ বিষাক্ত মতবাদকে আকর্ষণীয় করে পেশ করার জন্য মানুষ যুগে যুগে নতুন নতুন দর্শন উচ্চারণ করেছে। নতুন নতুন ধর্মের সৃষ্টি করেছে, সামাজিক বিধি-বিধান রচনা করেছে। রাজা-বাদশাহ ও শাসকগণ যুগে যুগে এই ভেদ-বৈষম্যকে ইন্ধন যুগিয়েছে। মানব জাতিকে চরম গুমরাহীর অতল গহ্বরে ফেলে দিয়েছে। মানুষে মানুষে এবং জাতিতে জাতিতে পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঘৃণা-বিদ্বেয়, হানাহানি, লুটতরাজ, যুদ্ধ-বিগ্রহ মানব জাতির শান্তি বিনষ্ট করেছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে মানব সমাজকে শতধা বিভক্তকারী এসব প্রাচীর কৃত্রিম ও অবৈধ। ইসলাম গোটা মানব জাতিকে সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে সমাজকে যাবতীয় পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখতে চায়। এ মহান লক্ষ্য তখনই অর্জিত হতে পারে যখন মানুষ তার স্রষ্টার গোলামী ইখতিয়ার করে এবং আল্লাহ-ভীতির ভিত্তিতে নিজের জীবন পরিচালিত করে। সবচেয়ে আল্লাহ-ভীরু ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি সম্মানের অধিকারী। তাই আল্লাহ সূরা আল-হুজুরাতে ঘোষণা করেছেন:

يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

"হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে পয়দা করেছি এবং যাতে একে অন্যকে জানতে পার তজ্জন্য তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে পরিণত করেছি। বস্তুত তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশি সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহ-ভীরু।"

উপরে বর্ণিত আয়াতের দ্বারা আল্লাহ পাক বিশ্বের সকল মানুষকে এক শ্রেণীভুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন। বস্তুত মানুষ এক পিতামাতা থেকে সৃষ্টি, তাই বর্ণ-ভাষা ও আঞ্চলিক পার্থক্যের কারণে তাদের মধ্যে কোনরূপ মর্যাদার পার্থক্য হতে পারে না। বর্ণ, ভাষা ও গোত্রের স্রষ্টা এক এবং অভিন্ন। কোন বিশেষ ভাষাভাষী অঞ্চলে বা কোন ভৌগলিক এলাকায় জন্মগ্রহণ করার কারণে কোন ব্যক্তি বা জাতিকে কোন বিশেষ মর্যাদা দান করা যেতে পারে না। কারণ কোন বিশেষ এলাকায় জন্মগ্রহণ করায় ব্যক্তির কোন নিজস্ব কৃতিত্ব নেই। নিজে ইচ্ছা করেও কোন এলাকায় জন্মগ্রহণ করা যায় না। আল্লাহ যাকে যে জনপদে সৃষ্টি করতে চান, তিনি তাকে সে জনপদে সৃষ্টি করেন। তাই মর্যাদার ভিত্তি বিশেষ এলাকায় জন্মগ্রহণে হতে পারে না। মর্যাদার একমাত্র ভিত্তি হলো চারিত্রিক সৌন্দর্য এবং সৎকর্ম। যে আল্লাহকে যত বেশি ভয় করে, তার চারিত্রিক সৌন্দর্যও তত বেশি এবং এজন্য সে অন্যের তুলনায় অধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। মক্কা বিজয়ের পর নবী ﷺ ঐ একই কথা ঘোষণা করেছেন:

"আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা, যিনি তোমাদের থেকে জাহিলিয়াতের দোষ এবং অহংকার দূর করে দিয়েছেন। হে মানব জাতি! তামাম মানুষ দু'অংশে বিভক্ত। এক নেক, যে আল্লাহর নিকট মর্যাদার অধিকারী। দ্বিতীয় কাফির ও দুর্ভাগা, যে আল্লাহর নিকট খুবই ঘৃণিত ও হেয়।"
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান