মা'আরিফুল হাদীস

রিকাক অধ্যায়

হাদীস নং:
রিকাক অধ্যায়
আসমানের প্রতি ইঞ্চিতে ফেরেশতারা সিজদারত
২. হযরত আবু যর গিফারী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ আমি যা দেখি তা তোমরা দেখ না এবং যা শুনি তোমরা তা শোন না। আসমান তীব্র আওয়ায করছে এবং এরূপ আওয়ায করার অধিকার তার রয়েছে। তাঁর কসম যাঁর হাতে আমার জীবন। আসমানে চার অঙ্গুলি পরিমাণ স্থানও নেই যেখানে কোন ফেরেশতা কপাল পেতে আল্লাহর নিকট সিজদারত না আছেন। আল্লাহর কসম! আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে তাহলে তোমরা খুব অল্প হাসতে এবং খুব বেশি কাঁদতে। বিছানায় তোমরা স্ত্রীদের উপভোগ করতে পারতে না, বরং তোমরা আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে কিংবা (আল্লাহর নৈকট লাভের উদ্দেশ্যে) জনশূন্য প্রান্তরে চলে যেতে। রাবী আবু যর (রা) বলেন, আফসোস, আমি যদি গাছ হতাম! যা কাটা হয়ে থাকে। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)
کتاب الرقاق
عَنْ أَبِي ذَرٍّ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : « إِنِّي أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ ، وَأَسْمَعُ مَا لَا تَسْمَعُونَ ، إِنَّ السَّمَاءَ أَطَّتْ ، وَحَقَّ لَهَا أَنْ تَئِطَّ ، مَا فِيهَا مَوْضِعُ أَرْبَعِ أَصَابِعَ إِلَّا وَمَلَكٌ وَاضِعٌ جَبْهَتَهُ سَاجِدًا لِلَّهِ ، وَاللَّهِ لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيلًا ، وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيرًا ، وَمَا تَلَذَّذْتُمْ بِالنِّسَاءِ عَلَى الْفُرُشَاتِ ، وَلَخَرَجْتُمْ إِلَى الصُّعُدَاتِ ، تَجْأَرُونَ إِلَى اللَّهِ ، وَاللَّهِ لَوَدِدْتُ أَنِّي كُنْتُ شَجَرَةً تُعْضَدُ » (رواه احمد والترمذى وابن ماجه)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

মানুষের জ্ঞান সীমিত, মানুষ তার বুদ্ধি-বিবেচনা বা জ্ঞানের দ্বারা অদৃশ্য জগতের রহস্য অনাবৃত করতে পারে না। একমাত্র আম্বিয়ায়ে কিরামের মাধ্যমে মানুষ অদৃশ্য জগতের জ্ঞান হাসিল করতে পারে। আল্লাহ তা'আলা আম্বিয়ায়ে কিরামের উপর যে হুকুম-আহকাম নাযিল করেছেন এবং অদৃশ্য জগতের যেসব বিষয় ও দৃশ্য অনাবৃত করেছেন, তা তাঁরা কোন প্রকার সংযোজন বিয়োজন ছাড়া প্রয়োজনমত মানব জাতির নিকট পেশ করেছেন। নবীগণ যা দেখেন, যা শোনেন এবং যে অভিজ্ঞতা হাসিল করেন তার বিবরণ তাঁরা মানুষকে প্রদান করেন। আর তার উপর পূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপন করার নাম হল ঈমান। যেভাবে পয়গম্বরদের হুকুম-আহকামে বিশ্বাস না করলে ঈমানদার হওয়া যায় না, তেমনি অদৃশ্য জগত বা বিষয়বস্তু সম্পর্কিত তাঁদের বিবরণের উপর বিশ্বাস স্থাপন না করলেও ঈমানদার হওয়া যায় না।

প্রশ্ন হল আম্বিয়ায়ে কিরাম যেভাবে অদৃশ্য জগত অবলোকন করতে পারেন সেভাবে সাধারণ মানুষ কেন অবলোকন করতে পারে না? আখিরাতের জীবনে মানুষের দুনিয়ার জীবনের হিসেব নেয়ার এবং ভাল-মন্দের প্রতিদানের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তার দাবি হল অদৃশ্য জগতকে সাধারণের চোখের কাছে আবৃত রাখা। শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর মহব্বতের জন্য যারা অদেখা জিনিসের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে খুব সতর্কতার সাথে দুনিয়ার জীবন যাপন করে, তারা আখিরাতের জীবনে বুলন্দ মাকামের অধিকারী হবেন। আখিরাতের জীবন যদি আবৃত না থাকত, তাহলে কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কতটুকু মহব্বত করেন তা নির্ণয় করার জন্য কোনরূপ বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যবস্থা পাওয়া যেত না। শুধু আল্লাহর কথা শুনে আল্লাহকে বিশ্বাস করা বা তাঁর বর্ণিত জান্নাত-জাহান্নাম, মীযান-সীরাত প্রভৃতির উপর ঈমান আনা সবল মানসিকতার লক্ষণ। দুর্বল মনের অধিকারিগণ অদেখা জিনিসের উপর দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না। আখিরাতের জীবনকে সাধারণ মানুষের কাছে অদৃশ্য রাখার কারণে বিশ্বাসের মধ্যে তারতম্যের সৃষ্টি হয়েছে এবং বিশ্বাসের তারতম্যের কারণে আমলের পার্থক্য; আর আমলের পার্থক্যের কারণে আখিরাতের জীবনের মর্যাদারও তারতম্য হবে।

মাওলানা মুহাম্মদ মনযূর নুমানীর মতে মানুষের কাছে অদৃশ্য জগতের রহস্য অনাবৃত করে দিলে মানুষের মনের শান্তি বিপন্ন হতো এবং তারা খিলাফতের যিম্মাদারী পালন করতে সক্ষম হতো না। কবর বা দোযখের আযাবের আসল হাকীকত মানুষের চোখের সামনে অনাবৃত করে দিলে মানুষ কোনরূপ কাজকর্ম করতে পারত না এবং বেশি দিন জীবিতও থাকতে পারত না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

নবী করীম ﷺ আখিরাতের জীবনের ভয়াবহ অবস্থার বিবরণ দেননি। শুধুমাত্র তার প্রতি ইশারা করছেন। তাঁর ইশারা এত অর্থবহ যে, সাহাবী আবূ যর গিফারী (রা) তার ভয়াবহতা থেকে কিভাবে আত্মরক্ষা করতে পারবেন তার জন্য উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেছেন মানুষ হিসাবে যদি তিনি জন্মগ্রহণ না করতেন এবং মানুষের পরিবর্তে কোন গাছ হিসেবে জন্ম নিতেন, তাহলে আখিরাতের যিন্দেগীতে কোনরূপ হিসাবের ঝামেলা তাঁকে পোহাতে হতো না। বস্তুত আখিরাতের দৃশ্য খুব ভয়াবহ এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা তা থেকে বাঁচার জন্য সব সময় সতর্ক থাকেন। নিজে সৎকর্ম করা, অন্যকে সৎকর্ম করতে উদ্বুদ্ধ করা বা হুকুম করা এবং মন্দকাজ থেকে নিজে দূরে থাকা এবং অন্যকেও তা করতে নিষেধ করার মধ্যে আখিরাতের যিন্দেগীর কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান