মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

নেক আমল অর্জনে উৎসাহিত করা অধ্যায়

হাদীস নং: ২৫
নেক আমল অর্জনে উৎসাহিত করা অধ্যায়
পরিচ্ছেদ: উত্তম নেক আমলের অভ্যাস করা এবং এর বিপরীত অভ্যাস ত্যাগ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান
২৫. জাবির (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন একদা জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)। কোন নামায সবচেয়ে উত্তম? তখন (ﷺ) রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানো। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কোন জিহাদ সবচেয়ে উত্তম? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যার তেজী ঘোড়া যুদ্ধে আহত হয় এবং যে রক্ত প্রবাহিত করে। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল (সা)। কোন হিজরত সবচেয়ে উত্তম? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যে আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিস ত্যাগ করে। এরপর সে প্রশ্ন করলো, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)। কোন মুসলমান সবচেয়ে উত্তম? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যার মুখের ও হাতের অনিষ্ট থেকে অন্যান্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)। কি কারণে কোন ব্যক্তি জান্নাতে অথবা জাহান্নামে প্রবেশ করতে বাধ্য হবে? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন শরীক না করে মৃত্যুবরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করে মৃত্যুবরণ করবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
كتاب الترغيب في صالح الأعمال
باب في الترغيب في خصال مجتمعه من أفضل أعمال البر والنهي عن ضدها
عن جابر قال أتى النبي صلى الله عليه وسلم رجل فقال يا رسول الله أي الصلاة أفضل؟ قال طول القنوت قال يا رسول الله وأي الجهاد أفضل؟ قال من عقر جواده وأريق دمه قال يا رسول الله أي الهجرة أفضل؟ قال من هجر ما كره الله عز وجل قال يا رسول الله فأي المسلمين أفضل؟ قال من سلم المسلمون من لسانه ويده قال يا رسول الله فما الموجبتان! (5) قال من مات لا يشرك بالله شيئا دخل الجنة ومن مات يشرك بالله شيئا دخل النار

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম ব্যক্তির অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন, আর তা হচ্ছে নিজের জিহ্বা ও হাত দ্বারা অন্য কোনও মুসলিমকে কষ্ট না দেওয়া। এটি পরিপূর্ণ ও উৎকৃষ্ট মুসলিমের গুণ। যার মধ্যে এটি না থাকে কিন্তু ইসলামের অন্যান্য জরুরি বিষয়সমূহ থাকে, সে অবশ্যই মুসলিম থাকবে কিন্তু পরিপূর্ণ ও উৎকৃষ্ট মুসলিম বলে গণ্য হবে না। সুতরাং 'মুসলিম ওই ব্যক্তি'-এর অর্থ পরিপূর্ণ মুসলিম ওই ব্যক্তি। যেমন বলা হয়, পুরুষ তো যায়দ। তার মানে সে একজন উৎকৃষ্ট পুরুষ।

জিহ্বা দ্বারা কাউকে কষ্ট না দেওয়ার ব্যাখ্যা

যার জিহ্বা থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে অর্থাৎ সে তার জিহ্বা দ্বারা তাদেরকে কোনওরকম কষ্ট দেয় না, সে তাদেরকে গালি দেয় না, অভিশাপ দেয় না, গীবত করে না, চুগলখোরী করে না, ঝগড়া-ফাসাদে উস্কানি দেয় না এবং এমনিভাবে মুখের এমন কোনও ব্যবহার করে না, যা দ্বারা কেউ কষ্ট পেতে পারে বা কারও কোনও ক্ষতি হতে পারে। এস্থলে 'কথা দ্বারা কষ্ট দেয় না' –না বলে জিহ্বা দ্বারা কষ্ট না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কেননা জিহ্বা দ্বারা যেমন কথা বলা হয়, তেমনি জিহ্বার এমন ব্যবহারও সম্ভব, যা দ্বারা অন্যে কষ্ট পেতে পারে, যেমন জিহ্বা বের করে ভেংচি কাটা। বোঝা গেল প্রকৃত মুসলিম কথা দ্বারাও কাউকে কষ্ট দেয় না এবং ব্যঙ্গ করে বা ভেংচি কেটেও কাউকে কষ্ট দেয় না।

উল্লেখ্য, যখন থেকে লেখা ও কলমের ব্যবহার শুরু হয়েছে, তখন থেকে এ মাধ্যমটিও জিহ্বার বিকল্প গণ্য হয়ে আসছে। বলা হয়ে থাকে- القلم أحد اللسانين (কলম মানুষের দ্বিতীয় জিহ্বা)।
সুতরাং লেখা বা কলমের ব্যবহার দ্বারা কাউকে কষ্ট দেওয়া হলে তাও এ হাদীছের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ প্রকৃত মুসলিম তার লেখনী শক্তি দ্বারাও কষ্ট দেবে না। চাইলে এটাকে হাতেরও অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যেহেতু লিখতে বা কলম ব্যবহার করতে হাতের প্রয়োজন হয়। সুতরাং কেউ লেখা দ্বারা অন্যের নিন্দা করলে বা কলম দ্বারা অন্যের ওপর অন্যায় আক্রমণ চালালে কিংবা একজনের লেখা দ্বারা অন্যের যে কোনওরকম ক্ষতি হয়ে গেলে সে পরিপূর্ণ মুসলিমরূপে গণ্য হবে না।

হাত দ্বারা কষ্ট না দেওয়ার ব্যাখ্যা

তারপর বলা হয়েছে, তার হাত থেকেও অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে। অর্থাৎ হাত দ্বারাও সে কাউকে কষ্ট দেয় না, কাউকে অন্যায়ভাবে মারধর করে না, যাতায়াত পথে কষ্টদায়ক জিনিস ফেলে না, কারও মাল কেড়ে নেয় না ইত্যাদি।

'হাত' দ্বারা অনেক সময় ক্ষমতা ও প্রভাবও বোঝানো হয়ে থাকে, যেমন বলা হয় এ বিষয়ে আমার কোনও হাত নেই মানে আমার ক্ষমতা নেই বা তার ওপর আমার কোনও হাত নেই অর্থাৎ তার ওপর আমার কোনও প্রভাব নেই। সুতরাং কেউ যদি ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে অন্যের ক্ষতি করে, তাও হাত দ্বারা কষ্ট দেওয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে। তাই প্রকৃত মুসলিম তার ক্ষমতা ও প্রভাবের অপব্যবহার করে না এবং এর দ্বারা অন্যের ক্ষতিসাধন হতে বিরত থাকে।

কেবল জিহ্বা ও হাতের উল্লেখ করার কারণ

অন্যের ক্ষতি করা বা অন্যকে কষ্ট দেওয়ার কাজ কেবল হাত ও মুখ দিয়েই হয় না, অন্যান্য অঙ্গ দ্বারাও হয়। তা সত্ত্বেও হাদীছে কেবল এ দু'টি অঙ্গের কথা বলা হয়েছে এ কারণে যে, বেশিরভাগ কষ্ট দেওয়ার কাজ এ দু'টি অঙ্গ দ্বারাই হয়ে থাকে। সুতরাং এ কথা বোঝা ঠিক হবে না যে, অন্যান্য অঙ্গ দ্বারা কাউকে কষ্ট দিলে তাতে দোষের কিছু নেই। অবশ্যই তা দোষের। প্রধান দুই অঙ্গের উল্লেখ দ্বারা বাকি অঙ্গসমূহকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে ফেলা হয়েছে। প্রধান অঙ্গের উল্লেখ দ্বারা সকল অঙ্গকে বোঝানোর প্রচলন সব ভাষাতেই আছে। কাজেই হাদীছের অর্থ বুঝতে হবে এরকম যে, প্রকৃত মুসলিম সেই ব্যক্তি, যে তার জিহ্বা, হাত এবং অন্য যে-কোনও অঙ্গ দ্বারা মানুষকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকে।

হাত ও জিহ্বার মধ্যেও আবার জিহ্বার কথা আগে বলা হয়েছে। এর কারণ কষ্টদানের ব্যাপারটা হাতেরচে'ও জিহ্বার দ্বারা বেশি হয়ে থাকে। জিহ্বার আওতা অতি বিস্তৃত। হাত দ্বারা কেবল হাতের গণ্ডির মধ্যে থাকা লোককে কষ্ট দেওয়া যায়। কিন্তু জিহ্বা দ্বারা কষ্ট দেওয়া হয়ে থাকে দূর-দুরান্তের লোককেও। গীবত, পরনিন্দা ও অপবাদ দেওয়ার কাজ তো আড়ালেই করা হয়। এমনিভাবে হাত দিয়ে কষ্ট দেওয়া যায় কেবল উপস্থিত লোককে, আর জিহ্বা দিয়ে কষ্ট দেওয়া যায় কেবল উপস্থিত ও বর্তমানকালের লোককেই নয়; বরং অতীতকালের লোকদেরকেও। এমনকি চাইলে ভবিষ্যৎকালের লোকদেরকেও এর আওতায় ফেলা যায়।

এ হাদীছে কেবল মুসলিমদের কষ্টদান থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য হাদীছ দ্বারা জানা যায়, অন্যায়ভাবে কষ্ট দেওয়া কাউকেই জায়েয নয়, তা মুসলিম হোক বা অমুসলিম। এমনকি শুধু শুধু কোনও পশু-পাখি ও পোকা-মাকড়কেও কষ্ট দেওয়া জায়েয নয়। এক হাদীছে জানানো হয়েছে, এক মহিলা একটি বিড়ালকে না খাইয়ে মারার কারণে জাহান্নামী হয়েছে। একবার পিঁপড়ার বাসা আগুনে পুড়ে দেওয়ার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-

إنه لا ينبغي أن يعذب بالنار إلا رب النار

আগুনের সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কারও আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪০১৮; মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৯৪১৪; আত- তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৩৭৪)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো পশু যবাইয়ের ক্ষেত্রেও ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেওয়ার হুকুম করেছেন, যাতে পশুর কষ্ট কিছুটা হলেও কম হয়। পশু পালনের ক্ষেত্রেও তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ আছে যেন ঠিকভাবে তাদের দানাপানি দেওয়া হয় এবং তাদেরকে অহেতুক কষ্ট না দেওয়া হয়। যেখানে পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেও তিনি দয়ার আচরণ করতে বলেছেন, সেখানে মানুষের প্রতি কিভাবে জুলুম করার সুযোগ থাকতে পারে, তা হোক না সে অমুসলিম? সুতরাং আলোচ্য হাদীছেরই কোনও কোনও বর্ণনায় আছেঃ-

المؤمن من أمنه الناس على دمائهم وأموالهم

মুমিন ওই ব্যক্তি, যাকে মানুষ তাদের জান-মালের ব্যাপারে নিরাপদ মনে করে। (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬২৭: মুসনাদুল বাযযার, হাদীছ নং ৮৯৪১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৯৯৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১৮০: মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ২২)

এ হাদীছে সাধারণভাবে সমস্ত মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দানকে মু'মিনের বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। হাদীছের প্রথম অংশে যে বিশেষভাবে মুসলিম ব্যক্তির নিরাপত্তা দানের কথা বলা হয়েছে তা এ কারণে যে, মুসলিমগণ পরস্পর ভাই-ভাই। আর ভাই-ভাই হওয়ার সুবাদে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা মুসলিম ব্যক্তিকে কষ্টদান করা থেকে বিরত থাকার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাছাড়া অমুসলিম রাষ্ট্রের সাথে জিহাদের অবকাশ আসলে তখন যুদ্ধরত অমুসলিমদের জান-মালের নিরাপত্তা বাকি থাকে না। সেদিক থেকে তাদের তুলনায় মুসলিম নর-নারীর জানমালের নিরাপত্তায় ব্যাপকতা রয়েছে।

প্রকাশ থাকে যে, মুসলিম ও অমুসলিম যে-কোনও ব্যক্তিকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার যে শিক্ষা ইসলামে দেওয়া হয়েছে তা থেকে ওইসকল ক্ষেত্র ব্যতিক্রম গণ্য হবে, যেসকল ক্ষেত্রে কষ্ট দেওয়াটা শরী'আতেরই হুকুম, যেমন মদপান করলে শাস্তি দেওয়া, চুরি করলে হাত কাটা এবং এভাবে অন্যান্য হুদূদের বিধান কার্যকর করা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আমাদেরকে হাতের ব্যবহারে সাবধান হতে হবে, যাতে কোনও মুসলিম নর-নারী এর দ্বারা কষ্ট না পায়।

খ. প্রকৃত মুসলিম হতে চাইলে যবানের ব্যবহার করতে হবে সচেতনভাবে, যাতে এর দ্বারা কোনও মুসলিমকে কষ্ট দিয়ে না ফেলি।

গ. পরিপূর্ণ মুসলিম হতে চাইলে ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্বারাও কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।

ঘ. কলমও একরকম যবান। কাজেই এর ক্ষতিকর ব্যবহার থেকেও বিরত থাকতে হবে।

ঙ. প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য এটাও জরুরি যে, নিজের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচেতনভাবে ব্যবহার করা হবে, যাতে কোনও অঙ্গ দ্বারাই কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় বা কষ্ট না পায়।

চ কেবল মুসলিম নর-নারী নয়; আমার দ্বারা যাতে অমুসলিম নর-নারীরও জান, মাল ও ইজ্জতের কোনও ক্ষতি না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ - হাদীস নং ২৫ | মুসলিম বাংলা