মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

হত্যা, অপরাধ ও রক্তপাতের বিধান

হাদীস নং: ১২৩
হত্যা, অপরাধ ও রক্তপাতের বিধান
পরিচ্ছেদ: কাসামা (নিহতের অভিভাবকদের থেকে কসম গ্রহণ) প্রসংগ
১২৩। সাহল ইবন আবু হাসমা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হারিসা বংশের আব্দুল্লাহ ইবন সাহল (রা) তাঁর বংশের কিছু লোকের সাথে খাইবারে খেজুর সংগ্রহ করার জন্য গেলেন। সেখানে আব্দুল্লাহ ইবন সাহল (রা)-কে অত্যাচার করা হল এবং তাঁর ঘাড় ভেঙ্গে ফেলা হল। অতঃপর তাঁকে খাইবারের কোন ঝর্ণার নালায় নিক্ষেপ করা হল। তাঁর সাথীরা তাকে না পেয়ে খুঁজতে লাগল। শেষ পর্যন্ত (সেই নালায়) তাকে পেল। তারা তাঁকে সেখানে দাফন করল। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করল। আব্দুল্লাহ ইবন সাহল (রা)-এর ভাই আব্দুর রহমান ইবন সাহল (রা) এবং তার দু' চাচাত ভাই হুয়ায়্যিসা (রা) ও মুহায়্যিসা (রা) তাঁর সামনে আসলেন। তাঁরা দু'জন আব্দুর রহমান (রা)-এর চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। আর আব্দুর রহমান (রা) তাঁদের থেকে সাহসী এবং রক্তের হকদার ছিলেন। তাই তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে তাঁর দু' চাচাত ভাই হুয়ায়্যিসা ও মুহায়্যিসা (রা)-এর আগে কথা বললেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তুমি তোমার আগে বড়দেরকে কথা বলার সুযোগ দাও। আব্দুর রহমান (রা) পিছনে সরে গেলেন। আর প্রথমে হুয়ায়্যিসা (রা) তারপর মুহায়্যিসা (রা) কথা বললেন, সবশেষে কথা বললেন, আব্দুর রহমান (রা) তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের ভাইকে অত্যাচার করা হয়েছে এবং তাকে হত্যা করা হয়েছে। আর খাইবারের ইহুদীরা ছাড়া আমাদের অন্য কোন শত্রু নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমরা কি এতে রাজি আছ যে, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের রক্তের দায় থেকে মুক্ত হয়ে থাক? তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা ইয়াহুদীদের শপথ গ্রহণ করতে পারিনা। কেননা তারা এ মিথ্যা শপথ অপেক্ষা গুরুতর পাপ কুফরীতে লিপ্ত আছে। তিনি বলেন, শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)র নিজের থেকে তাঁদেরকে তাঁর রক্তপণ হিসেবে একশত উটনী দিলেন। তিনি বলেন, সাহল (রা) বলতেন, আল্লাহর শপথ! আমি তা থেকে একটি লাল বর্ণের তরুণ উটনীকে ভুলিনি, যেটি আমাকে লাথি মেরেছিল- যখন আমি তাদেরকে একত্রিত করে হাঁকাচ্ছিলাম।
(বুখারী, মুসলিম, মালিক, শাফিয়ী, আবূ দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ এবং অন্যরা)
كتاب القتل والجنايات وأحكام الدماء
باب ما جاء فى القسامة
عن بشير بن يسار(6) عن سهل بن أبى حثمة قال خرج عبد الله بن سهل أخو بنى حارثة يعنى فى نفر من بنى حارثة (7) إلى خيبر يمتارون (8) منها تمراً قال فعدى (9) على عبد الله ابن سهل فكسرت عنقه ثم طرح فى منهر (10) من مناهر عيون خيبر وفقده أصحابه فالتمسوه حتى وجدوه فغيبوه (11) قال ثم قدموا على رسول الله صلى الله عليه وسلم، فأقبل أخو عبد الرحمن بن سهل وابنا عمه حويصة ومحيصة (12) وهما كانا أسن من عبد الرحمن وكان عبد الرحمن إذا أقدم (13) القوم وصاحب الدم فتقدم لذلك، فكلم رسول الله صلى الله عليه وسلم قبل ابنى عمه حويصة ومحيصة قال فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم الكبر الكبر (1) فاستأخر عبد الرحمن وتكلم حويصة (2) ثم تكلم محيصة ثم تكلم عبد الرحمن فقالوا يا رسول الله عدى على صاحبنا فقتل وليس بخيبر عدو إلا يهود (3) قال فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم تسمون قاتلكم تحلفون عليه خمسين يميناً ثم نسلمه؟ (4) قال فقالوا يا رسول الله ما كنا لنحلف على مالم نشهد، قال فيحلفون لك خمسين يميناً ويبرءون من دم صاحبكم؟ قالوا يا رسول الله ما كنا لنقبل أيمان يهود، ما هم فيه من الكفر أعظم من أن يحلفوا على إثم، قال فودأه (5) رسول الله صلى الله تبارك وتعالى عليه وعلى آله وصحبه وسلم من عنده مائة ناقة، قال يقول سهل فوالله. ما أنسى بكرة منها حمراء ركضتنى (6) وأنا أحوزها (7)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এটি খায়বার যুদ্ধপরবর্তী একটি ঘটনা। বিভিন্ন হাদীসে ঘটনাটি সংক্ষেপে/ বিস্তারিত বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় সামান্য গরমিলও পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে কিছুটা ব্যাখ্যা সহকারে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হলো।

এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ৭ম সালে। এখানকার অধিবাসীগণ ছিল ইহুদী। যুদ্ধে ইহুদীদের পরাজয় হয়। এখানকার সমস্ত দুর্গ ও জমি-জায়েদাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকারে চলে আসে। তিনি চাইলে সমস্ত ইহুদীকে এখান থেকে বিতাড়িত করতে পারতেন। তা না করে তিনি তাদের প্রতি দয়াপরবশ হন। তাদেরকে এ শর্তে এখানে থাকার অনুমতি দেন যে, তারা মুসলিমদের পক্ষে চাষাবাদের কাজ করবে। তাতে যে ফল ও ফসল উৎপন্ন হবে তার অর্ধেক তাদেরকে দেওয়া হবে। এভাবে বর্গাচাষের চুক্তিতে তারা এখানে অবস্থানের সুযোগ লাভ করে। কিন্তু ফিতনা-ফাসাদ বিস্তার করাই যাদের স্বভাব, তাদের পক্ষ থেকে শান্তিরক্ষার আশা কিভাবে করা যায়? গোপনে তারা একের পর এক দুষ্কৃতি করে যেতে থাকে। ইতিহাস ও হাদীছ গ্রন্থসমূহে তাদের দুষ্কৃতির নানা ঘটনা বর্ণিত আছে। এ হাদীছেও সেরকম একটা ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

ইহুদী এলাকায় একজন মুসলিম হত্যার ঘটনা
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি. ও মুহায়্যিসা ইবন মাস'উদ রাযি. খেজুর কেনার উদ্দেশ্যে খায়বার গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছার পর তারা দু'জন খেজুরের সন্ধানে দুই দিকে চলে যান। পরে মুহায়্যিসা রাযি. সংবাদ পান যে, কে বা কারা আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করে ফেলেছে। সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি ছুটে আসেন। এসে দেখতে পান ঠিকই আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করা হয়েছে। তিনি রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছেন। সেখানকার ইহুদীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের কেউ তাঁকে হত্যা করার কথা স্বীকার করল না। অগত্যা তিনি সেখানে তাঁর দাফন-কাফন সম্পন্ন করে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে আসলেন।

তারপর আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি.-এর ভাই আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. এবং মাস'উদের পুত্রদ্বয় মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. — এ তিনজন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন। তিনজনই একই গোত্রের লোক। সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা অর্থাৎ মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. ছিলেন আব্দুর রহমান রাযি.-এর পিতা সাহলের চাচাতো ভাই।

এদের মধ্যে আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. ছিলেন বয়সে সকলের ছোট। তিনি যেহেতু নিহতের ভাই, তাই বিচার প্রার্থনার জন্য সবার আগে তিনি কথা বলতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে তাঁকে ক্ষান্ত করে দিলেন যে, বড়দের কথা বলতে দাও। সুতরাং তিনি ক্ষান্ত হয়ে গেলেন এবং অপর দু'জন কথা বললেন। বিভিন্ন বর্ণনা সামনে রাখলে বোঝা যায় মৌলিকভাবে কথা বলেছিলেন হুওয়ায়্যিসা রাযি। তিনি বয়সে সকলের বড় ছিলেন। বিভিন্ন বর্ণনায় যে দু'জনই কথা বলেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এ হিসেবে যে, সম্ভবত হুওয়ায়্যিসা রাযি. -এর কথা বলার মাঝে মাঝে প্রয়োজনে মুহায়্যিসা রাযি.-ও দু’-একটি কথা বলেছিলেন।

প্রকাশ থাকে যে, এ ঘটনায় হুওয়ায়্যিসা রাযি. উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন মুহায়্যিসা রাযি.। তবে মামলার মূল বাদী ছিলেন নিহতের ভাই আব্দুর রহমান রাযি। একই খান্দানের হওয়ায় আব্দুর রহমান রাযি.-এর সহযোগী হিসেবে অপর দু'জন উপস্থিত হয়েছিলেন। তাছাড়া মুহায়্যিসা রাযি. তো আব্দুল্লাহ রাযি.-এর সফরসঙ্গীই ছিলেন এবং দাফন-কাফনের কাজও তিনিই সম্পন্ন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়োজ্যেষ্ঠ হুওয়ায়্যিসা রাযি.-কে যে কথা বলতে বলেছিলেন তা মূলত বাদী হিসেবে নয়; বরং কেবলই তাঁর শোনা কথার বর্ণনাদাতা হিসেবে। অর্থাৎ তিনি মুহায়্যিসা রাযি.-এর নিকট যা-কিছু শুনেছেন হুবহু তা বর্ণনা করতে বলেছেন। যখন দাবির পর্যায় আসে, তখন আব্দুর রহমান রাযি.-কেই কথা বলতে বলা হয়েছিল। আবার এমনও হতে পারে যে, আব্দুর রহমান রাযি. তাঁদের দু'জনকে নিজের পক্ষ থেকে ওকিল বানিয়ে দিয়েছিলেন।

যাহোক মামলার পূর্ণ বিবরণ সামনে আসার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, তোমরা কি কসম করবে এবং তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণের অধিকার লাভ করবে?

বিভিন্ন বর্ণনায় বিস্তারিত আছে। সে অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদীপক্ষকে বলেছিলেন— তোমাদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণ গ্রহণের অধিকার পেতে পার। তারা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কিভাবে হতে পারে? আমরা তো নিজ চোখে তা দেখিনি, সুতরাং কিভাবে কসম করব? তখন তিনি বললেন, তাহলে ইহুদীদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে অভিযোগ থেকে মুক্তি লাভ করুক। তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা তো একটি কাফের সম্প্রদায়। অর্থাৎ তারা মিথ্যা কসম করতে দ্বিধাবোধ করবে না। শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে তাদের রক্তপণ পরিশোধ করে দিলেন। তার পরিমাণ ছিল ১০০ উট। পরিভাষায় এ রক্তপণকে দিয়াত বলা হয়।

লক্ষণীয়, এ মামলায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে ফয়সালা দান করেননি। নিহত ব্যক্তি একজন মুসলিম ও সাহাবী। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে ইহুদীদের এলাকায়। স্পষ্ট কথা সন্দেহের তির তাদের দিকেই যায়। তাদেরকে চাপে ফেলার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। দিয়াতের ১০০টি উট সম্মিলিতভাবে তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দিলেন। তিনি দিয়াতের উট নিজের পক্ষ থেকে পরিশোধ করলেন। বাদীপক্ষও বঞ্চিত হলো না এবং বিবাদীরাও হয়রানির শিকার হলো না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

হাদীছটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা নিম্নরূপ :

ক. বয়সে যে বড় তাকে সম্মান দেখানো চাই। তার একটা দিক এইও যে, কথা বলার সময় বড়কে আগে বলার সুযোগ দেওয়া হবে।

খ. চাচাতো ভাই বা চাচাতো ভাতিজা কোনও বিপদের সম্মুখীন হলে 'চাচাতো' বলে পাশ কাটাতে নেই; বরং তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া চাই।

গ. সফরসঙ্গীর একটা হক হলো তার মসিবতে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করা। সফরসঙ্গী মারা গেলে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঘ. বিচারকের উচিত বিচারকার্যে পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দেওয়া এবং উভয়পক্ষের উপর মমত্বপূর্ণ আচরণ করা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ - হাদীস নং ১২৩ | মুসলিম বাংলা