আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

২২. অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার

হাদীস নং: ৪০৯১
অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার
নম্রতা, ধীরস্থিরতা ও সহনশীলতার প্রতি অনুপ্রেরণা
৪০৯১. হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সঙ্গে হাঁটছিলাম, আর এ সময় তিনি নাজরানী করুকার্য খচিত একটি চাদর পরিহিত ছিলেন। তখন এক বেদুইন তাঁর কাছে এসে তাঁর চাদর ধরে স্বজোরে টান দিল। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ঘাড়ে চিহ্নিত দাগের প্রতি তাকালাম। আমি দেখতে পেলাম, সে জোরে টান দেয়ার কারণে তাঁর কাঁধে চাদরের দাগ বসে গেছে। এরপর সে বলল: হে মুহাম্মাদ! আপনার নিকট সংরক্ষিত আল্লাহর সম্পদ থেকে আমাকে কিছু দান করার আদেশ দিন। তখন তিনি তার দিকে তাকালেন এবং হাসলেন এরপর তিনি তাকে কিছু দানের নির্দেশ দিলেন।
(বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত।)
كتاب الأدب
التَّرْغِيب فِي الرِّفْق والأناة والحلم
4091- وَعَن أنس رَضِي الله عَنهُ قَالَ كنت أَمْشِي مَعَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَعَلِيهِ برد نجراني غليظ الْحَاشِيَة فأدركه أَعْرَابِي فَجَذَبَهُ بردائه جذبة شَدِيدَة فَنَظَرت إِلَى صفحة عنق رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَقد أثر بهَا حَاشِيَة الرِّدَاء من شدَّة جذبته ثمَّ قَالَ يَا مُحَمَّد مر لي من مَال الله الَّذِي عنْدك فَالْتَفت إِلَيْهِ فَضَحِك ثمَّ أَمر لَهُ بعطاء

رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসাধারণ ক্ষমাশীলতা ও মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায়। অজ্ঞাতনামা বেদুঈন লোকটি কী অশোভন আচরণ তাঁর সঙ্গে করেছে! তাঁকে শারীরিকভাবে কষ্ট দিয়েছে। শক্ত পাড়ের চাদরটি ধরে এমন জোরে টান দিয়েছে যে, তাঁর ঘাড়ে দাগ বসে গেছে। সেইসঙ্গে কষ্ট দিয়েছে কথা দিয়েও। রূঢ় ও অভদ্র বাক্য তাঁর প্রতি ব্যবহার করেছে। সে বলেছে-
يَا مُحَمَّدُ ، مُرْ لِي مِنْ مَالِ اللَّهِ الَّذِي عِنْدَكَ (হে মুহাম্মাদ! আপনার কাছে আল্লাহর যে মালামাল আছে, তা থেকে আমাকে কিছু দিতে হুকুম করুন)। সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে 'রাসূলুল্লাহ' বলে সম্বোধন করতেন। সরাসরি নাম নিয়ে ডাকতেন না। সেটা বেয়াদবি। নবীর সঙ্গে বেয়াদবি মহাপাপ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
لَا تَجْعَلُوا دُعَاءَ الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُمْ بَعْضًا
তোমরা রাসূলকে ডাকার বিষয়টিকে তোমাদের একে অন্যকে ডাকার মতো (মামুলি) গণ্য করো না। (সূরা নূর (২৪), আয়াত ৬৩)
অর্থাৎ তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে যখন কোনও কথা বলবে, তখন তোমরা নিজেরা একে অন্যকে যেমন ডাক দিয়ে থাক, যেমন হে অমুক! শোনো, তাকেও সেভাবে ডাকবে না। সুতরাং তাকে লক্ষ্য করে 'হে মুহাম্মাদ!' বলবে না। বরং তাঁকে সম্মানের সাথে 'ইয়া রাসূলাল্লাহ!' বলে সম্বোধন করবে।

অন্যত্র ইরশাদ-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
হে মুমিনগণ! নিজের আওয়াজকে নবীর আওয়াজ থেকে উঁচু করো না এবং তার সাথে কথা বলতে গিয়ে এমন জোরে বলো না, যেমন তোমরা একে অন্যের সাথে জোরে বলে থাক, পাছে তোমাদের কর্ম বাতিল হয়ে যায়, তোমাদের অজ্ঞাতসারে। (সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ২)

বেদুঈন লোকটি একে তো তাঁর নাম ধরে ডাক দিয়েছে, তার উপর আবার মাল দেওয়ার আবেদন না জানিয়ে সরাসরি তাঁকে হুকুম করেছে। হুকুমও করেছে উদ্ধত ভাষায়। যেমন এক বর্ণনায় আছে, সে বলেছিল-
فَإِنَّكَ لَا تَحْمِلُ لِيْ مِنْ مَالِكَ وَلَا مِنْ مَالِ أَبِيْكَ
‘তুমি তো আমাকে তোমার নিজের মাল দেবে না এবং তোমার বাবার মালও নয়। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৭৫; সুনানে নাসাঈ ৪৭৭৬; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৬৯৫২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৫২৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮১১৫)

কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ আচরণের বিপরীতে কেমন মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন! হযরত আনাস রাযি. বলেন-
فَالْتَفَتَ إِلَيْهِ، فَضَحِكَ ثُمَّ أَمَرَ لَهُ بِعَطَاء (তিনি তার দিকে ফিরে তাকালেন এবং হেসে দিলেন। তারপর তাকে কিছু দেওয়ার আদেশ করলেন)। তিনি একটুও রাগ করলেন না, ধমক দিলেন না; বরং দুর্ব্যবহারের বিপরীতে মধুর আচরণ করেছেন। তার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন, তার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়েছেন এবং তার চাওয়া পূরণ করেছেন। লোকটির সঙ্গে দু'টি উট ছিল। তিনি একটি উট বোঝাই করে যব দিলেন এবং অন্য উটটি বোঝাই করে দিলেন খেজুর। এ মহানুভবতাই ছিল তাঁর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অস্ত্র। মূলত এর জোরেই তিনি জাযীরাতুল আরব জয় করেছিলেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছটি আমাদেরকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহানুভবতার সঙ্গে পরিচিত করে।

খ. অশিক্ষিত ও গেঁয়ো প্রকৃতির লোকদের আদব-কায়দাবহির্ভূত আচরণকে কঠিনভাবে নিতে নেই।

গ. দুর্ব্যবহারের বদলা দুর্ব্যবহার দ্বারা নয়; বরং উত্তম ব্যবহার দ্বারা দেওয়া চাই।

ঘ. কেউ কোনওরকম সাহায্য চাইলে পারতপক্ষে তাকে ফিরিয়ে দিতে নেই।

ঙ. অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা মুখ ভার করে নয়; বরং হাসিমুখে করাই বাঞ্ছনীয়।

চ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বেয়াদবি হয় এমন যে-কোনও কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা অতীব জরুরি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান