আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

২১. অধ্যায়ঃ সদ্ব্যবহার

হাদীস নং: ৩৯০৪
অধ্যায়ঃ সদ্ব্যবহার
প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার প্রতি ভীতি প্রদর্শন এবং তার অধিকার আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ
৩৯০৪. হযরত জনৈক আনসার সাহাবী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আমার পরিবারসহ নবী (ﷺ)-এর উদ্দেশ্যে বের হলাম। আমি হঠাৎ দেখতে পেলাম তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এবং এক ব্যক্তি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ধারণা করলাম, তাঁর কোন প্রয়োজন আছে। আমি প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। তাঁর দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারণে আমার দয়ার উদ্রেক হল। এরপর তিনি ফিরে আসেন। আমি (তাঁকে দেখে) দাঁড়ালাম, আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! এই লোকটির ব্যাপারে আমার অন্তরে দয়ার উদ্রেক হয়েছে। তিনি বলেন: ইনি কে, তা কি তুমি জান? আমি বললাম না। তিনি বলেনঃ ইনি জিব্রাঈল (আ)। তিনি আমাকে অনবরত প্রতিবেশী সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছিলেন, এমন কি আমি মনে করলাম, অচিরেই প্রতিবেশীকে আমার উত্তরাধিকার বানিয়ে দেওয়া হবে। জেনে রেখ, তুমি যদি তাঁকে সালাম দিতে, তাহলে তিনি তোমার সালামের জবাব দিতেন।
(আহমাদ উত্তম সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেন এবং তাঁর বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত।)
كتاب البر والصلة
التَّرْهِيب من أَذَى الْجَار وَمَا جَاءَ فِي تَأْكِيد حَقه
3904- وَعَن رجل من الْأَنْصَار قَالَ خرجت مَعَ أَهلِي أُرِيد النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَإِذا بِهِ قَائِم وَإِذا رجل مقبل عَلَيْهِ فَظَنَنْت أَن لَهُ حَاجَة فَجَلَست فوَاللَّه لقد قَامَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم حَتَّى جعلت أرثي لَهُ من طول الْقيام ثمَّ انْصَرف فَقُمْت إِلَيْهِ فَقلت يَا رَسُول الله لقد قَامَ بك
هَذَا الرجل حَتَّى جعلت أرثي لَك من طول الْقيام
قَالَ أَتَدْرِي من هَذَا قلت لَا
قَالَ جِبْرِيل صلى الله عَلَيْهِ وَسلم مَا زَالَ يوصيني بالجار حَتَّى ظَنَنْت أَنه سيورثه أما إِنَّك لَو سلمت عَلَيْهِ لرد عَلَيْك السَّلَام

رَوَاهُ أَحْمد بِإِسْنَاد جيد وَرُوَاته رُوَاة الصَّحِيح

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিবেশীর হক যে কত বড়, সেদিকে উম্মতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম একের পর এক তাঁকে প্রতিবেশী সম্পর্কে আদেশ-উপদেশ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁর ধারণা হয়ে যায় যে, প্রতিবেশীকে বুঝি ওয়ারিশই বানিয়ে দেওয়া হবে। ইসলামে মৃত ব্যক্তির মীরাছ ও উত্তরাধিকার লাভ করে তার নিকটাত্মীয়। তো উপর্যুপরি আদেশ-উপদেশের দ্বারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনে হচ্ছিল প্রতিবেশীকেও হয়তো নিকটাত্মীয়ের পর্যায়ভুক্ত বানিয়ে দেওয়া হবে। যদিও বাস্তবে সেরকম করা হয়নি, কিন্তু এর দ্বারা অনুমান করা যায় প্রতিবেশীর মর্যাদা কত উচ্চে এবং তার হক কত বড়।

বিদায় হজ্জের ভাষণেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। হযরত আবূ উমামা রাযি. বলেন-

سمعت رسول الله ﷺ وهو على ناقته الجدعاء في حجة الوداع، يقول: «أوصيكم بالجار حتى أكثر، فقلت: إنه ليورثة

“আমি বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর উটনী আল জাদ’আর উপর সাওয়ার অবস্থায় বলতে শুনেছি- আমি তোমাদেরকে প্রতিবেশী সম্পর্কে অসিয়ত করছি। তিনি এ কথা বার বার বলতে থাকেন। আর আমি মনে মনে বললাম, তিনি প্রতিবেশীকে ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন।১৮

বস্তুত প্রতিবেশীর হক আদায়ে যত্নবান থাকা ও তার প্রতি সদ্ব্যবহার করা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এমনকি এ গুরুত্ব জাহিলী যুগের আরবগণও উপলব্ধি করত। কিন্তু আজ ঈমান ও ইসলামের দাবিদারদের কাছেও এটি এক অবহেলিত বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজত করুন।

এক প্রতিবেশীর উপর অপর প্রতিবেশীর হক হলো সে তার জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতিসাধন হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে। এছাড়া তার অনাহারের কষ্ট দূর করা, বিপদে সাহায্য করা ও রোগ-ব্যাধিতে সেবাযত্ন করাও অবশ্যপালনীয় হক। সে অমুসলিম হলে তাকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়াও তার অধিকার। অবশ্য সে দাওয়াত গ্রহণ করার পক্ষে সদাচরণ বেশি সহায়ক হয়ে থাকে। এ লক্ষ্যে যদি তাকে উপহার উপঢৌকন দেওয়া হয়, তাও নেককাজরূপেই গণ্য হবে। বিশেষত ভালো খাবার-দাবারে তাকে তো শরীক রাখাই চাই। আলোচ্য হাদীছটির বর্ণনাকারী হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, কোনও এক রাতে তাঁর গোলাম একটি ছাগল যবাহ করে তার চামড়া ছাড়াচ্ছিল। তখন ইবন উমর রাযি. তাকে লক্ষ্য করে বলেন, এ ছাগলের গোশত থেকে সর্বপ্রথম একটা অংশ আমাদের ইহুদী প্রতিবেশীকে দিও। তিনি এ কথাটি আরও কয়েকবার বললেন। তখন এক ব্যক্তি বলল, আপনি ইহুদী লোকটির কথা আর কতবার বলবেন? এর উত্তরে তিনি আলোচ্য হাদীছটি বর্ণনা করে শোনান।

প্রতিবেশীকে সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করাও অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তবে ঈমানের দাওয়াত দেওয়া এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার কাজটি হিকমত ও মমত্ববোধের সঙ্গে করা বাঞ্ছনীয়।

প্রতিবেশীর কোনও দোষ জানতে পারলে অপর প্রতিবেশীর কর্তব্য তা গোপন রাখা এবং নম্রতার সঙ্গে বোঝানো যাতে সেই দোষটি আর না করে। বোঝানো সত্ত্বেও সে তা থেকে বিরত না হলে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে তার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দেবে। মোটকথা তাকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার জন্য সম্ভাব্য সকল চেষ্টাই করা চাই।

যেসকল আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় প্রতিবেশী কষ্ট পায়, তা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। অনেকে এমন এমন কাজ করে, যা রীতিমত উত্যক্তকর। এটা ইসলামী প্রতিবেশিত্বের পরিচায়ক নয়।

প্রতিবেশীকে সালাম দেওয়া, হাদিয়া প্রদান করা, দেখা-সাক্ষাতকালে হাসিমুখে কথা বলা, তার খোঁজখবর নেওয়া, তার সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়া এবং এ জাতীয় অন্যান্য কাজ তার প্রতি সদাচরণের অন্তর্ভুক্ত। মুমিন প্রতিবেশীর এগুলো অবশ্যই করা উচিত।

প্রতিবেশীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো শুফ'আ। অর্থাৎ এক প্রতিবেশী যদি তার স্থাবর সম্পদ বিক্রি করতে চায়, তবে শরীআতের দৃষ্টিতে অপর প্রতিবেশী তা ক্রয়ের অগ্রাধিকার রাখে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন الجار أحق بسقبه ‘প্রতিবেশী তার সংলগ্ন ভূমির বেশি হকদার।১৯

এ মর্মে আরও বহু হাদীছ আছে। বিস্তারিত বিধানাবলীর জন্য ফিকহী গ্রন্থাবলী দ্রষ্টব্য।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছটির প্রধান শিক্ষা তো প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে। এর দ্বারা জানা গেল যে, প্রতিবেশীর অধিকার অনেক বড়। প্রত্যেক মুসলিমের তা আদায়ে যত্নবান থাকা চাই।

খ. আরও জানা গেল ধারণামাত্রই খারাপ নয়। যদি কারও সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা হয় তা দোষের নয়। মন্দ ধারণাই দোষের।

গ. অন্তরে যদি কোনও ভালো চিন্তা-ভাবনা জাগ্রত হয়, তবে তা প্রকাশ করা যেতে পারে, তাতে দোষের কিছু নেই।

ঘ. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল উত্তরাধিকার অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। কাজেই এ ব্যাপারে শরীআতের নীতিমালা রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা চাই।

১৮. তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৫২৩; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ২২৫

১৯. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২২৫৮; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৫১৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৭০২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৪৯৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৩৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯৪৬১; মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, হাদীছ নং ১৪৩৮০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ২২৭২৯
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান