আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

২০. অধ্যায়ঃ হদ্দ

হাদীস নং: ৩৫৪২
অধ্যায়ঃ হদ্দ
মুসলমানদের দোষত্রুটি গোপন রাখার প্রতি অনুপ্রেরণা এবং তার মানহানীকর বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও তার ত্রুটি-বিচ্যুতি অন্বেষণের প্রতি ভীতি প্রদর্শন
৩৫৪২. রাজা ইবনে হায়ওয়া (র) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি মাসলামা ইবনে মাখলাদকে বলতে শুনেছি: আমি এক সময়ে মিসরে ছিলাম। একদিন দারোয়ান এসে আমাকে একজন আগন্তুকের প্রবেশ অনুমতির বিষয়ে অবহিত করল। আমি বললাম: আপনি কে? তিনি বললেন: আমি জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্। তিনি বলেন, আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং বললাম, আমি কি আপনার কাছে আসব, না আপনি ঘরে আসবেন? তিনি বললেন: আপনিও নামবেন না আমিও উঠব না। আপনি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) থেকে মুসলমানদের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখার ব্যাপারে যে হাদীস বর্ণনা করেন, তা আমি শুনতে এসেছি। আমি বললাম, আমি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছিঃ "যে ব্যক্তি কোন মু'মিনের দোষ গোপন রাখল, সে যেন জীবন্তকে কবর দেওয়া হতে বাঁচাল।" অবশেষে তিনি উট হাঁকিয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন।
(তাবারানী আসওসাত গ্রন্থে আবু সিনান কাসমালী হতে বর্ণনা করেন।)
كتاب الحدود
التَّرْغِيب فِي ستر الْمُسلم والترهيب من هتكه وتتبع عَوْرَته
3542- وَعَن رَجَاء بن حَيْوَة قَالَ سَمِعت مسلمة بن مخلد رَضِي الله عَنهُ يَقُول بَينا أَنا على مصر فَأتى البواب فَقَالَ إِن أَعْرَابِيًا على الْبَاب يسْتَأْذن فَقلت من أَنْت قَالَ أَنا جَابر بن عبد الله قَالَ فَأَشْرَفت عَلَيْهِ فَقلت أنزل إِلَيْك أَو تصعد قَالَ لَا تنزل وَلَا أصعد حَدِيث بَلغنِي أَنَّك ترويه عَن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فِي ستر الْمُؤمن جِئْت أسمعهُ
قلت سَمِعت رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَقُول من ستر على مُؤمن عَورَة فَكَأَنَّمَا أَحْيَا موءودة فَضرب بعيره رَاجعا

رَوَاهُ الطَّبَرَانِيّ فِي الْأَوْسَط من رِوَايَة أبي سِنَان الْقَسْمَلِي

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিন ব্যক্তির দোষত্রুটি আড়াল করার ফযীলত বয়ান করেছেন।
ফযীলত বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আড়াল পাওয়া। অর্থাৎ তিনি সেদিন বান্দার দোষত্রুটি প্রকাশ না করে তাকে নির্দোষ বান্দারূপে জান্নাতে পাঠিয়ে দেবেন। জাহান্নামের আগুন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এটা এত বড় পুরস্কার, যা পাওয়ার জন্য দুনিয়ায় নিজ প্রাণ বিসর্জন দেওয়াও অতি তুচ্ছ বৈকি।
আখেরাতের সত্যিকার চিন্তা যাদের আছে, তারা এ কাজেও প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ইমাম ইবরাহীম ইবন ইয়াযীদ তাইমী রহ.-এর ঘটনা উল্লেখ করা যায়।
ইবরাহীম তাইমী রহ.-এর অসাধারণ আত্মত্যাগের ঘটনা
হাজ্জাজ ইবন ইয়ুসুফ ইসলামী ইতিহাসের এক নির্মম নিষ্ঠুর শাসক। একবার তার পুলিশ বাহিনী বিখ্যাত ফকীহ ইমাম ইবরাহীম নাখাঈ রহ.-কে ধরার জন্য খুঁজছিল। খুঁজতে খুঁজতে তারা পৌঁছে যায় ইমাম ইবরাহীম তাইমী রহ.-এর কাছে। তাদের তো উদ্দেশ্য ছিল ইবরাহীম নাখাঈ। কিন্তু উভয়ের নাম ও পিতার নাম একই হওয়ায় কে বা কারা যেন ইবরাহীম নাখাঈ রহ.-এর বদলে ইবরাহীম তাইমী রহ.-কেই দেখিয়ে দেয়। তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করল, আপনিই কি ইবরাহীম? তিনি বললেন, হাঁ, আমি ইবরাহীম। তাঁর জানা ছিল তারা সন্ধান করছে ইবরাহীম নাখাঈকে। কিন্তু তিনি ভাবলেন, ইবরাহীম নাখা'ঈ এত বড় এক ইমাম ও ফকীহ, পুলিশ যদি তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং হাজ্জাজের নির্দেশে তাঁকে হত্যা করা হয়, তবে উম্মতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। উম্মতকে সেই ক্ষতি থেকে রক্ষা করা দরকার। সুতরাং তাঁর বদলে তিনি নিজেকেই পুলিশের হাতে সমর্পণ করলেন। পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে গেল। তারপর হাজ্জাজের নির্দেশে তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হল। কারাপ্রাচীরের ভেতর কোনও ছাদযুক্ত ঘর ছিল না। রোদ-বৃষ্টি সবই সরাসরি কারাবন্দীদের উপর দিয়ে যেত। আবার একই শেকলে দু-দু'জন বন্দীকে বেঁধে রাখা হত। কষ্টের কোনও সীমা ছিল না। হাজ্জাজের জিন্দানখানায় সে অবর্ণনীয় কষ্ট তিনি ভোগ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁর শরীর এমনভাবে নষ্ট হয়ে যায় যে, তাঁর মা দেখতে এসে তাঁকে চিনতে পারছিলেন না। তিনি যখন নিজেকে ইবরাহীম বলে পরিচয় দেন, কেবল তখনই বুঝতে পারেন যে, এই তার কলিজার টুকরা। তিনি এরপর আর বেশি দিন বাঁচেননি। এ কারাগারেই তিনি হিজরী ৯২ সনে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুরাতেই হাজ্জাজ স্বপ্নে দেখেছিল কেউ একজন বলছে, আজ রাতে এক জান্নাতী ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।[১] আল্লাহু আকবার! কত বড় কুরবানী! দীনের খাতিরে একজনের প্রাণ রক্ষার্থে এভাবে নিজ প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার মত ত্যাগস্বীকারের কথা আমরা কি কল্পনা করতে পারি? কিভাবে এ মহান বুযুর্গ নিজ জীবনের বিনিময়ে আল্লাহর এক বান্দাকে জালেম শাসকের থেকে আড়াল করলেন!
এ হাদীছে কোনও মুসলিমকে বা তার দোষত্রুটি গোপন করার যে ফযীলত বলা হয়েছে, অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাকেও গোপন রাখবেন, এটা আল্লাহ তাআলার এক বিরাট অনুগ্রহ। আল্লাহ তাআলা সাত্তারুল উয়ূব- দোষত্রুটি গোপনকারী।
তিনি লজ্জাশীল ও মহানুভব। কোনও ব্যক্তির দোষত্রুটি গোপন রাখা লজ্জাশীলতা ও মহানুভবতার পরিচায়ক। বান্দা যখন আল্লাহ তাআলার এ মহাগুণের আচরণ অন্য বান্দার সঙ্গে করে, তখন আল্লাহ তাআলা তার প্রতি খুশি হয়ে যান। তাই তিনিও সে বান্দার প্রতি অনুরূপ আচরণ করবেন। এটা এমন এক প্রাপ্তি, যা প্রত্যেক মুমিনেরই কাম্য। এর মূল্য বুঝে আসবে আখেরাতে, যেদিন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বান্দা অনুরূপ আচরণ লাভ করবে। এক হাদীছে ইরশাদ-

إِنَّ اللهَ يُدْنِي الْمُؤْمِنَ مِنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يَضَعَ كَنَفَهُ عَلَيْهِ، فَيَسْتُرُهُ مِنَ النَّاسِ، فَيَقُولُ: أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا وَكَذَا؟ فَيَقُولُ: نَعَمْ يَا رَبِّ، فَيَقُولُ: أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا وَكَذَا؟ فَيَقُولُ: نَعَمْ يَا رَبِّ، حَتَّى إِذَا قَرَّرَهُ بِذُنُوبِهِ وَظَنَّ فِي نَفْسِهِ أَنَّهُ قَدِ اسْتَوْجَبَ، قَالَ: قَدْ سَتَرْتُهَا عَلَيْكَ مِنَ النَّاسِ ، وَإِنِّي أَغْفِرُهَا لَكَ الْيَوْمَ، وَيُعْطَى كِتَابَ حَسَنَاتِهِ

‘আল্লাহ তাআলা মুমিন ব্যক্তিকে কাছে নিয়ে যাবেন। তারপর পর্দা ফেলে তাকে আড়াল করবেন। তারপর বলবেন, তোমার কি এই অপরাধটির কথা মনে পড়ে? এই অপরাধটির কথা মনে পড়ে? সে বলবে, হাঁ, হে আমার প্রতিপালক। এভাবে তার সবগুলো অপরাধের স্বীকারোক্তি তার থেকে নিয়ে নেবেন। ফলে মনে মনে ভাববে আজ ধ্বংস ছাড়া তো আর গতি নেই। শেষে আল্লাহ বলবেন, আমি দুনিয়ায় তোমার এসব দোষ গোপন রেখেছিলাম, আজও আমি তোমাকে ক্ষমা করলাম। অতঃপর তার আমলনামা তার ডান হাতে দিয়ে দেওয়া হবে।[২]
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রতিও এরকম আচরণ করুন। তিনি সাত্তারুল উয়ূব- বান্দার দোষ গোপনকারী। আমরা তাঁর কাছে উভয় জাহানে আমাদের প্রতি তাঁর এ গুণের প্রকাশ কামনা করি। তিনি আমাদেরকেও তাঁর এ গুণ অর্জনের তাওফীক দিন।
কেউ যদি প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত না হয়; বরং প্রকাশ্যে সে শরীআতের বিধি-বিধান মেনে চলতেই সচেষ্ট থাকে, তবে এরকম ব্যক্তি দ্বারা কোনও ভুলত্রুটি হয়ে গেলে বা গোপনে সে কোনও গুনাহ করে ফেললে তা অবশ্যই গোপন রাখা উচিত। অর্থাৎ কোনও সূত্রে সেকথা কারও কানে পড়লে তার তা অন্য কানে পৌঁছানো উচিত নয়।
এমনকি যে পাপকর্মের জন্য শরীআত সুনির্দিষ্ট শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছে, কেউ যদি সেরকম পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তারপর সে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তা কাউকে জানায়, তবে তারও কর্তব্য তা গেয়ে না বেড়ানো; বরং তাকে তা অন্যত্র প্রকাশ না করে আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা ও ইস্তিগফার করতে উপদেশ দেবে। সে তা শাসক ও বিচারককে পর্যন্ত জানাবে না। হাঁ, কোনওভাবে তা বিচারকের আদালতে পৌঁছে গেলে বিচারকের কর্তব্য তদন্ত করে তার বিচারের ব্যবস্থা করা। নিজে থেকে আদালতকে জানানো তার দায়িত্ব নয়। না জানালে সে গুনাহগার তো হবেই না; বরং তা নেককাজরূপে গণ্য হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ গুনাহগারকে আড়াল করে রাখার তাগিদই করেছেন। যেমন একবার হাযযাল নামক এক সাহাবী এক অপরাধীকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে নিজ অপরাধের কথা স্বীকার করতে বললে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে অপরাধীর বিচার করার পর হাযযাল রাযি.-কে বলেছিলেন-

يَا هَزَّالُ ! لَوْ سَتَرْتَهُ بِرِدَائِكَ كَانَ خَيْرًا لَكَ؟

‘হে হাযযাল! তুমি যদি নিজ চাদর দ্বারা তাকে আড়াল করে রাখতে, সেটাই তোমার জন্য উত্তম হত।[৩]

এর দ্বারা বোঝা গেল অন্যের দোষত্রুটি গোপন করাই কাম্য। তা প্রচার করা নিন্দনীয় কাজ। এরূপ কাজে লিপ্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কুরআন-হাদীছে কঠোর শাস্তির সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। এক আয়াতে ইরশাদ-

إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ

‘স্মরণ রেখ, যারা মুমিনদের সম্পর্কে অশ্লীলতার প্রসার হোক এটা কামনা করে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি। সূরা নূর (২৪), আয়াত ১৯
হযরত আবূ বারযা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلِ الإِيمَانُ قَلْبَهُ لاَ تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ، وَلاَ تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنْ يَتَّبِعْ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ، وَمَنْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِي بَيْتِهِ

‘ওহে সেইসব লোক, যারা মুখে ঈমান এনেছে কিন্তু তাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি, তোমরা মুসলিমদের গীবত করো না এবং তাদের গোপন দোষ সন্ধান করো না। যে ব্যক্তি তাদের গোপন দোষ সন্ধান করবে, আল্লাহ তাআলাও তার গোপন দোষ সন্ধান করবেন। আর আল্লাহ যার গোপন দোষ খুঁজবেন, তাকে তার নিজ ঘরে লাঞ্ছিত করে ছাড়বেন।[৪]
আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করবেন সে আর কোথায় ইজ্জত পেতে পারে? কুরআন মাজীদ বলছে-

وَمَنْ يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُكْرِمٍ إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ

‘আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন তার কোনও সম্মানদাতা নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ করেন যা তিনি চান। সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ১৮
কাজেই মুত্তাকী-পরহেযগারদের দোষত্রুটির পেছনে কিছুতেই পড়া উচিত নয়। অনিচ্ছাকৃতভাবেও তা চোখে পড়ে গেলে তা পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। কিছুতেই তা প্রকাশ করা ঠিক হবে না; বরং গোপন রাখারই চেষ্টা করতে হবে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

أَقِيلُوْا ذَوِي الْهَيْئَاتِ عَثَرَاتِهِمْ

‘তোমরা ভদ্র-শিষ্ট লোকদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করো।[৫]
প্রকাশ থাকে যে, অন্যের দোষত্রুটি গোপন রাখার অর্থ এ নয় যে, তাকে সংশোধন করারও চেষ্টা করা হবে না। ভ্রাতৃত্ববোধ ও কল্যাণকামিতার দাবি হল, কারও কোনও দোষ নজরে আসলে আন্তরিকতার সঙ্গে তার ইসলাহ ও সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। এর পদ্ধতি হচ্ছে, প্রথমে গোপনে একাকী তাকে সতর্ক করা ও সে দোষটির দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে তাকে বোঝানো। তাতেও সংশোধন না হলে সে যাকে সমীহ করে ও মানে এরকম মুরুব্বীস্থানীয় কাউকে তা জানানো। সেইসঙ্গে আল্লাহ তাআলার কাছে তার ইসলাহের জন্য দুআ করতে থাকা।
অবশ্য কেউ যদি এমন কোনও অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকে, যা দ্বারা মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তার সম্পর্কে মানুষকে সাবধান করা অবশ্যকর্তব্য। যেমন কোনও ব্যবসায়ী মালে ভেজাল মেশায় বা ওজনে কম দেয়, তো এরূপ ব্যবসায়ী সম্পর্কে ভোক্তাদের সতর্ক করা দূষণীয় নয়; বরং এটা তাদের প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচায়ক হবে।
এমনিভাবে যারা প্রকাশ্য অপরাধী, যারা মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের তোয়াক্কা করে না, অন্যায়-অপরাধ করাকে যারা বাহাদুরী মনে করে, এদের সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা এবং এদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা নিঃসন্দেহে ঈমান ও নৈতিকতার দাবি। এ হাদীছে এরূপ অপরাধীর অপরাধ গোপন করতে বলা হয়নি; বরং তা গোপন করা জনমানুষের সঙ্গে এক ধরনের খেয়ানত। এরূপ ব্যক্তির দোষত্রুটি গোপন করার দ্বারা তাকে আরও প্রশ্রয় দেওয়া হয়। ফলে সে মানুষের জন্য আরও বেশি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যাহোক নিরপরাধ ব্যক্তিকে জালেম শাসকের থেকে আড়াল করে রাখা এবং যে ব্যক্তির দোষত্রুটি তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, অন্য লোক তা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, তার দোষ গোপন করা অত্যন্ত ফযীলতের কাজ। এর পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তাআলা আখেরাতে অপরাপর মানুষ থেকে তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন। অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

مَنْ سَتَرَ عَلَى مُسْلِمٍ عَوْرَةً فَكَأَنَّمَا أَحْيي مَيْتًا

‘যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের দোষত্রুটি গোপন করল, সে যেন কোনও মৃত ব্যক্তিকে জীবন দান করল।[৬]
মুসলিম ভাইয়ের দোষত্রুটি গোপন করাকে তুলনা করা হয়েছে মৃতব্যক্তিকে জীবনদানের সঙ্গে। তাহলে ভাবা যায় কি এটা কত বড় নেককাজ? এক মরণোন্মুখ তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করিয়ে তার জীবন রক্ষা করার দ্বারা যদি এক পাপী ব্যক্তি জান্নাতের উপযুক্ত হয়ে যায়, তাহলে জীবনদানতুল্য এ নেককাজটি করে যাওয়ার দ্বারা কি আমরা জান্নাতলাভের আশা করতে পারি না, বিশেষত যখন হাদীছে সে সুসংবাদ শোনানোও হয়েছে? এরপরও কি আমরা মানুষের দোষত্রুটি গোপন না করে তা গেয়ে বেড়ানোর মত হীন কাজে লিপ্ত থাকব? আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাজত করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা আমরা মানুষের দোষত্রুটি লুকানোর উৎসাহ পাই।

খ. ইসলাম সাধারণত আখেরাতের পুরস্কার ঘোষণার মাধ্যমে মানুষকে নেককাজের প্রতি উৎসাহ দান করেছে। কাজেই আমাদের কর্তব্য হবে সে পুরস্কার লাভের আশাতেই নেককাজ করা,পার্থিব লাভের আশায় নয়।

[১] যাহাবী, সিয়ারু আ'লামিন নুবালা, জীবনী নং ৬৩৪; ইবনুল জাওযী, সিফাতুস্ সাফওয়া, জীবনী নং ৪১৩

[২] সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭৩৫৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৯০; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ১৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৪৩৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩৫৫: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২৬৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৩২১; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ৩৪২২১

[৩] তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৩০; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭২৩৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৫৮২

[৪] মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯৭৭৬; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৮০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১১৪৪৪; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৬২৭৮

[৫] সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৭৫; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৪৬৫; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৬৬৪৬; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৯৫৬; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৬০৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৯৪

[৬] তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭২৩১
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান