আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
২০. অধ্যায়ঃ হদ্দ
হাদীস নং: ৩৫০৮
অধ্যায়ঃ হদ্দ
অধ্যায়: হদ্দ ও অপরাপর বিষয়।
সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধাজ্ঞার প্রতি অনুপ্রেরণা এবং যে ব্যক্তি এ দু'টি বর্জন করেও তোষামদ করে তার প্রতি ভীতি প্রদর্শন
সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধাজ্ঞার প্রতি অনুপ্রেরণা এবং যে ব্যক্তি এ দু'টি বর্জন করেও তোষামদ করে তার প্রতি ভীতি প্রদর্শন
৩৫০৮. হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: বনী ইসরাঈলের মধ্যে প্রথমে এভাবে দুষ্কৃতি ও অনিষ্টেই অনুপ্রবেশ ঘটে যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সাথে মিলিত হত এবং তাকে বলত। হে অমুক! আল্লাহকে ভয় কর এবং যা করছ তা বর্জন কর, কেননা, একাজ তোমার জন্য বৈধ নয়। পরদিন সেও তার সাথে মিলিত হয়ে তাকে পূর্বাবস্থায় দেখতে পেত। কিন্তু সে আর তাকে নিষেধ করত না। কেননা, ইতোমধ্যে সে তার পানাহার ও ওঠা-বসায় শরীক হয়ে এ অবস্থায় পৌঁছে গেল যে, আল্লাহ তাদের একের অন্তরের দ্বারা অপরের অন্তরকে অন্ধকার করে দিলেন। এরপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন:
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ تَرَى كَثِيرًا مِنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنْفُسُهُمْ أَنْ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونَ وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَكِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ فَاسِقُونَ
"বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করল, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের মুখে অভিসম্মাত করা হল। কেননা, তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং অত্যন্ত বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছিল। তারা পরস্পরকে পাপ কাজ থেকে বিরত রাখা বর্জন করেছিল। অতি গর্হিত কাজই তারা করেছিল। আজ তোমরা এমন অনেক লোক দেখতে পাচ্ছ, যারা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে ও সহযোগিতা করতে ব্যস্ত। নিশ্চয়ই অত্যন্ত খারাপ পরিণামই তাদের সামনে রয়েছে, যার ব্যবস্থা তাদের প্রবৃত্তিসমূহ তাদের জন্য করেছে। আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট এবং তারা চিরস্থায়ী শাস্তির মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে। তারা যদি বাস্তবিক পক্ষে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এবং সেই বস্তুর প্রতি ঈমান আনত, যা তাঁর (নবীﷺ) প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, তবে তারা কখনো কাফিরদেরকে নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করতো না। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোকই ছিল ফাসিক"। (সূরা মায়িদা: ৭৮-৮১) এরপর তিনি বললেন: কখনো নয়। আল্লাহর শপথ, তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করতে থাকবে এবং অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে (মানুষকে) বিরত রাখবে। যালিমদের হাত শক্ত করে ধর এবং তাকে হক পথে টেনে আন ও সত্য ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করো।
(আবু দাউদ (র) নিজ শব্দযোগে এবং তিরমিযী (র) হাসান গরীব সনদ সূত্রে বর্ণনা করেন। ইমাম তিরমিযী (র) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ "বনী ইসরাঈলরা যখন পাপ কাজে লিপ্ত হল, তখন তাদের আলিমগণ তাদেরকে এহেন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলল। কিন্তু তারা বিরত হল না। বরং অলিমগণ তাদের সাথে উঠা-বসা ও পানাহার করতে থাকল। অবশেষে আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে পরস্পরের মধ্যে মিলিয়ে দিলেন। আল্লাহ্ তাদেরকে দাউদ (আ) ও ঈসা ইবনে মারইয়াম (আ)-এর মুখ দিয়ে অভিশাপ দিলেন। কেননা, তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং খুব বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছিল"। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হেলানরত অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসেন এবং বলেন: কখনো নয়, সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার জীবন। তোমরা তাদের হাত ধরে টেনে এনে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত মুক্তি পাবে না।
হাফিয মুনযিরী (র) বলেন: আমি এই হাদীসটি আবু উবায়দা ইবনে আবদুল্লাহ মাসউদ (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছি। তবে তিনি তাঁর পিতা থেকে শুনেন নি। কারো কারো মতে, তিনি তাঁর পিতার সূত্রে শুনেছেন। ইমাম ইবনে মাজাহ (র) আবু উবায়দা সূত্রে মুরসাল সনদে বর্ণনা করেছেন।
تأطروهم তোমরা তাদেরকে টেনে ধরে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত কর।)
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ تَرَى كَثِيرًا مِنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنْفُسُهُمْ أَنْ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونَ وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَكِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ فَاسِقُونَ
"বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করল, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের মুখে অভিসম্মাত করা হল। কেননা, তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং অত্যন্ত বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছিল। তারা পরস্পরকে পাপ কাজ থেকে বিরত রাখা বর্জন করেছিল। অতি গর্হিত কাজই তারা করেছিল। আজ তোমরা এমন অনেক লোক দেখতে পাচ্ছ, যারা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে ও সহযোগিতা করতে ব্যস্ত। নিশ্চয়ই অত্যন্ত খারাপ পরিণামই তাদের সামনে রয়েছে, যার ব্যবস্থা তাদের প্রবৃত্তিসমূহ তাদের জন্য করেছে। আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট এবং তারা চিরস্থায়ী শাস্তির মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে। তারা যদি বাস্তবিক পক্ষে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এবং সেই বস্তুর প্রতি ঈমান আনত, যা তাঁর (নবীﷺ) প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, তবে তারা কখনো কাফিরদেরকে নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করতো না। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোকই ছিল ফাসিক"। (সূরা মায়িদা: ৭৮-৮১) এরপর তিনি বললেন: কখনো নয়। আল্লাহর শপথ, তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করতে থাকবে এবং অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে (মানুষকে) বিরত রাখবে। যালিমদের হাত শক্ত করে ধর এবং তাকে হক পথে টেনে আন ও সত্য ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করো।
(আবু দাউদ (র) নিজ শব্দযোগে এবং তিরমিযী (র) হাসান গরীব সনদ সূত্রে বর্ণনা করেন। ইমাম তিরমিযী (র) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ "বনী ইসরাঈলরা যখন পাপ কাজে লিপ্ত হল, তখন তাদের আলিমগণ তাদেরকে এহেন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলল। কিন্তু তারা বিরত হল না। বরং অলিমগণ তাদের সাথে উঠা-বসা ও পানাহার করতে থাকল। অবশেষে আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে পরস্পরের মধ্যে মিলিয়ে দিলেন। আল্লাহ্ তাদেরকে দাউদ (আ) ও ঈসা ইবনে মারইয়াম (আ)-এর মুখ দিয়ে অভিশাপ দিলেন। কেননা, তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং খুব বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছিল"। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হেলানরত অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসেন এবং বলেন: কখনো নয়, সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার জীবন। তোমরা তাদের হাত ধরে টেনে এনে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত মুক্তি পাবে না।
হাফিয মুনযিরী (র) বলেন: আমি এই হাদীসটি আবু উবায়দা ইবনে আবদুল্লাহ মাসউদ (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছি। তবে তিনি তাঁর পিতা থেকে শুনেন নি। কারো কারো মতে, তিনি তাঁর পিতার সূত্রে শুনেছেন। ইমাম ইবনে মাজাহ (র) আবু উবায়দা সূত্রে মুরসাল সনদে বর্ণনা করেছেন।
تأطروهم তোমরা তাদেরকে টেনে ধরে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত কর।)
كتاب الحدود
كتاب الْحُدُود وَغَيرهَا
التَّرْغِيب فِي الْأَمر بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْي عَن الْمُنكر والترهيب من تَركهمَا والمداهنة فيهمَا
التَّرْغِيب فِي الْأَمر بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْي عَن الْمُنكر والترهيب من تَركهمَا والمداهنة فيهمَا
3508- وَعَن ابْن مَسْعُود رَضِي الله عَنهُ قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِن أول مَا دخل النَّقْص على بني إِسْرَائِيل أَنه كَانَ الرجل يلقى الرجل فَيَقُول يَا هَذَا اتَّقِ الله ودع مَا تصنع بِهِ فَإِنَّهُ لَا يحل لَك ثمَّ يلقاه من الْغَد وَهُوَ على حَاله فَلَا يمنعهُ ذَلِك أَن يكون أكيله وشريبه وقعيده فَلَمَّا فعلوا ذَلِك ضرب الله قُلُوب بَعضهم بِبَعْض ثمَّ قَالَ لعن الَّذين كفرُوا من بني إِسْرَائِيل على لِسَان دَاوُد وَعِيسَى ابْن مَرْيَم ذَلِك بِمَا عصوا وَكَانُوا يعتدون كَانُوا لَا يتناهون عَن مُنكر فَعَلُوهُ لبئس مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ ترى كثيرا مِنْهُم يتولون الَّذين كفرُوا لبئس مَا قدمت لَهُم أنفسهم إِلَى قَوْله فَاسِقُونَ الْمَائِدَة 87 18
ثمَّ قَالَ كلا وَالله لتأمرن بِالْمَعْرُوفِ ولتنهون عَن الْمُنكر ولتأخذن على يَد الظَّالِم ولتأطرنه على الْحق
أطرا
رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَاللَّفْظ لَهُ وَالتِّرْمِذِيّ وَقَالَ حَدِيث حسن غَرِيب وَلَفظه قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لما وَقعت بَنو إِسْرَائِيل فِي الْمعاصِي نَهَاهُم علماؤهم فَلم ينْتَهوا فجالسوهم فِي مجَالِسهمْ وواكلوهم وشاربوهم فَضرب الله قُلُوب بَعضهم بِبَعْض ولعنهم على لِسَان دَاوُد وَعِيسَى ابْن مَرْيَم ذَلِك بِمَا عصوا وَكَانُوا يعتدون فَجَلَسَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَكَانَ مُتكئا فَقَالَ لَا وَالَّذِي نَفسِي بِيَدِهِ حَتَّى تأطروهم على الْحق أطرا
قَالَ الْحَافِظ روينَاهُ من طَرِيق أبي عُبَيْدَة بن عبد الله بن مَسْعُود وَلم يسمع من أَبِيه وَقيل سمع وَرَوَاهُ ابْن مَاجَه عَن أبي عَبدة مُرْسلا
تأطروهم أَي تعطفوهم وتقهروهم وتلزموهم بِاتِّبَاع الْحق
ثمَّ قَالَ كلا وَالله لتأمرن بِالْمَعْرُوفِ ولتنهون عَن الْمُنكر ولتأخذن على يَد الظَّالِم ولتأطرنه على الْحق
أطرا
رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَاللَّفْظ لَهُ وَالتِّرْمِذِيّ وَقَالَ حَدِيث حسن غَرِيب وَلَفظه قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لما وَقعت بَنو إِسْرَائِيل فِي الْمعاصِي نَهَاهُم علماؤهم فَلم ينْتَهوا فجالسوهم فِي مجَالِسهمْ وواكلوهم وشاربوهم فَضرب الله قُلُوب بَعضهم بِبَعْض ولعنهم على لِسَان دَاوُد وَعِيسَى ابْن مَرْيَم ذَلِك بِمَا عصوا وَكَانُوا يعتدون فَجَلَسَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَكَانَ مُتكئا فَقَالَ لَا وَالَّذِي نَفسِي بِيَدِهِ حَتَّى تأطروهم على الْحق أطرا
قَالَ الْحَافِظ روينَاهُ من طَرِيق أبي عُبَيْدَة بن عبد الله بن مَسْعُود وَلم يسمع من أَبِيه وَقيل سمع وَرَوَاهُ ابْن مَاجَه عَن أبي عَبدة مُرْسلا
تأطروهم أَي تعطفوهم وتقهروهم وتلزموهم بِاتِّبَاع الْحق
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে বনী ইসরাঈলের মধ্যে পাপকর্মের সূচনা এবং তাতে বাধাদানের ব্যাপারে তাদের আলেমদের গড়িমসি আর তার পরিণামে তাদের ওপর ব্যাপক আযাব নেমে আসার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে এ উম্মতকে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারাও যদি অন্যায়-অসৎকাজে বাধাদানের দায়িত্ব যথার্থভাবে আঞ্জাম না দেয়, তবে তাদেরও সেরকম শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আছে।
বনী ইসরাঈল হচ্ছে ইয়াহুদী জাতি। এদের পূর্বপুরুষ ছিলেন হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। তাঁর অপর নাম ইসরাঈল। সে হিসেবে তাঁর বংশধরদেরকে বনী ইসরাঈল বা ইসরাঈলের বংশধর বলা হয়।
অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করা
এ হাদীছে জানানো হয়েছে যে, তাদের মধ্যে যখন সর্বপ্রথম অসৎকাজ হতে শুরু করে, তখন সেই অসৎ কার্যকারীর সঙ্গে কারও সাক্ষাৎ হয়ে গেলে সে তাকে আল্লাহর ভয় দেখাত এবং সে কাজটি হারাম ও নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি তার সামনে তুলে ধরত। কিন্তু এতে সেই ব্যক্তির কোনও ভাবান্তর হত না। সে নিজেকে সংশোধন না করে যথারীতি আপন কাজ করে যেত। এ অবস্থায় অন্যদের উচিত ছিল তাকে বয়কট করা এবং তার সঙ্গে লেনদেন, ওঠাবসা ও পানাহারে শরীক না হওয়া, যাতে তার মন- মানসিকতায় এ বয়কটের চাপ পড়ে আর সে চাপের কারণে তার অসৎকাজ ছেড়ে দেয়। কিন্তু তারা তাকে বয়কট করত না। সংশোধন না হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক পুরোপুরি বজায় রাখত।
তার সঙ্গে মিলেমিশে চলার কারণে তার অসৎকর্মের আছর তাদের অন্তরে পড়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে তাদের অন্তর থেকে পাপকাজের প্রতি ঘৃণা লোপ পেয়ে যায় আর এভাবে তাদের গোটা সমাজে অন্যায়-অসৎকাজ বিস্তার লাভ করে। পরিণামে সকলের প্রতি আল্লাহর লা'নত নেমে আসে। সে লা'নতের বর্ণনাই সূরা মায়িদার উল্লিখিত আয়াতসমূহে দেওয়া হয়েছে। এতে হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ও ঈসা আলাইহিস সালামের উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তাঁরা তাদের পাপাচার সীমালঙ্ঘনের কারণে বদদু'আ করেছিলেন। সে বদদু'আর ফলেই তাদের ওপর লা'নত বর্ষিত হয়।
ইমাম আবু হাইয়ান রহ. বর্ণনা করেন যে, হযরত ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, বনী ইসরাঈলকে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের আমলে তাওরাত গ্রন্থে, হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের আমলে যাবুর গ্রন্থে এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আমলে ইন্জীল গ্রন্থে লা'নত করা হয়। অর্থাৎ এসকল নবী যে আপন আপন যুগে তাদের ওপর বদদু'আ করেছিলেন তার উল্লেখ এ গ্রন্থসমূহে আছে।
আয়াতে তাদের এ পরিণতির কারণ বলা হয়েছে-
كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ (79)
তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ।
প্রকাশ্যে পাপকর্ম হওয়া ও তাতে বাধা না দেওয়ার কুফল
অর্থাৎ তাদের মধ্যে দুই অপরাধের সমন্বয় ঘটেছিল। এক তো প্রকাশ্যে অসৎকর্ম করা, দ্বিতীয়ত তাতে বাধাদান না করা। এমনিতে তো অসৎকর্ম কোনও অবস্থায়ই করা উচিত নয়। প্রকাশ্যেও না, গোপনেও না। কেননা আল্লাহ তা'আলা প্রকাশ্য ও গুপ্ত সব অবস্থাই সমানভাবে জানেন। তাঁর অগোচরে থাকে না কোনওকিছুই। তাই বান্দার কর্তব্য সর্বাবস্থায়ই তাঁকে ভয় করা ও তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করা হতে বিরত থাকা। তা সত্ত্বেও গোপনে গুনাহ করা অপেক্ষা প্রকাশ্যে করা অধিকতর মন্দ। কেননা এটা আল্লাহভীতির অভাবের সঙ্গে সঙ্গে নির্লজ্জতা ও ধৃষ্টতার পরিচায়কও বটে। বনী ইসরাঈল এরকম ধৃষ্টতার সাথেই পাপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল। এ তো গেল তাদের এক অপরাধ।
এরকম ধৃষ্টতাপূর্ণ পাপকর্মে কেউ লিপ্ত হলে অর্থাৎ প্রকাশ্যে জনসম্মুখে গুনাহ করলে অন্যদের কর্তব্য তাকে তা হতে বিরত রাখতে চেষ্টা করা, যার একটা পদ্ধতি অপরাধীকে বয়কট করা ও তার সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেওয়া। অন্যথায় তার দ্বারা অন্যরাও পাপাচারে লিপ্ত হতে উৎসাহ পায় আর এভাবে গোটা সমাজে অন্যায়-অনাচার ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বনী ইসরাঈলের 'উলামা তাদেরকে সেই প্রকাশ্য পাপ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেনি। এ ছিল তাদের দ্বিতীয় অপরাধ। এর ফলে তাদের গোটা জাতির মধ্যে অন্যায়-অনাচার বিস্তার লাভ করে। পরিণামে তারা অভিশাপগ্রস্ত হয়।
এর দ্বারা মূলত আমাদেরকে সবক দেওয়া হচ্ছে যে, আমাদের মধ্যে যেন কিছুতেই এ দুই অন্যায়ের মিলন ঘটতে না পারে। আমরা কেউ প্রকাশ্যে পাপকর্ম করব না এবং গোপনেও নয়। আর কেউ প্রকাশ্যে পাপকর্মে লিপ্ত হলে অন্যরা অবশ্যই তা থেকে তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে, প্রয়োজনে তাকে বয়কট করবে, যাতে বনী ইসরাঈলের মত অশুভ পরিণামে শিকার আমাদের না হতে হয়।
কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্বের নিন্দা
এ আয়াতসমূহে বনী ইসরাঈলের আরেকটি অনাচার বলা হয়েছে কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। ইরশাদ হয়েছে-
تَرَى كَثِيرًا مِنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنْفُسُهُمْ أَنْ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونَ (80)
তুমি তাদের অনেককেই দেখছ, কাফিরদেরকে নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে। নিশ্চয়ই তারা নিজেদের জন্য যা সামনে পাঠিয়েছে, তা অতি মন্দ। কেননা (সে কারণে) আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারা সর্বদা শাস্তির ভেতর থাকবে। অর্থাৎ তারা যেহেতু আহলে কিতাব, তাদের কিতাব তাওরাতে শেষ নবী সম্পর্কে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী আছে, সে ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে একজন সত্যনবী ও সর্বশেষ নবী তা তাদের ঢের জানা ছিল, সেহেতু তাদের তো উচিত ছিল তাঁর প্রতি অন্য সকলের আগে ঈমান আনা এবং তাঁকে সত্যনবী বলে বিশ্বাস করে তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেওয়া। কিন্তু তা না করে তারা উল্টো তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে এবং তাদের কিতাবেও যে শিরক ও কুফরের নিন্দা করা হয়েছে, সেই শিরক ও কুফরে লিপ্ত আরব মুশরিকদের সঙ্গে তারা বন্ধুত্ব করছে। বন্ধুত্ব করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেইসঙ্গে তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে তাদেরকে যুদ্ধের উস্কানি দিয়েছে এবং বিভিন্ন যুদ্ধে তাদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছে। তাদের এ আচরণ চরম গর্হিত ও নিতান্তই নিন্দনীয়। এ কারণে দুনিয়ায়ও তাদের প্রতি আল্লাহর ক্রোধ বর্ষিত হয়েছে এবং আখিরাতেও তারা স্থায়ী আযাবে নিপতিত থাকবে। পরের আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَكِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (81)
তারা যদি আল্লাহ, নবী এবং তার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তাতে ঈমান রাখত, তবে তাদেরকে (মূর্তিপূজারীদেরকে) বন্ধু বানাত না। কিন্তু (প্রকৃত ব্যাপার হল) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য। অর্থাৎ তারা যদি আল্লাহর প্রতি যথার্থ ঈমান রাখত এবং তাদের নবী হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাব তাওরাতে বিশ্বাস রাখত, তবে কিছুতেই মুশরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করত না। কেননা নবীর দাওয়াতই হচ্ছে শিরকের বিরুদ্ধে ও তাওহীদের পক্ষে। নবীর প্রতি অবতীর্ণ কিতাবেও শিরক পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর দিকে ডাকা হয়। কাজেই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাওরাত গ্রন্থে তাদের বিশ্বাস থাকলে তারা মুশরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তো করতই না; বরং নিজেরাও শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনত এবং মুশরিকদেরকেও শিরক পরিহার করে তাঁর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানাত। এরূপ না করায় প্রকৃতপক্ষে তারা আপন দীন থেকেও খারিজ হয়ে গেছে। তারা কার্যত হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাওরাত গ্রন্থের অনুসারী থাকেনি।
এর দ্বারাও সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের গুরুত্ব বোঝা যায়। কেননা এ দায়িত্ব পালন করলে তখন পাপী ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করার অবকাশ থাকে না; বরং প্রথমত তাকে পাপকাজ ছেড়ে দেওয়ার হুকুম করতে হয়, তারপর সে হুকুম না মানলে দ্বিতীয় পর্যায়ে তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হয়। বনী ইসরাঈল তা না করে অভিশপ্ত হয়েছে। আমরাও যদি অভিশাপ থেকে বাঁচতে চাই, তবে কর্তব্য হবে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব সাধ্যানুযায়ী পালন করে যাওয়া।
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্টভাবেই আমাদেরকে হুকুম করছেন যে, শরী'আত যে কাজটিকে সৎকর্ম সাব্যস্ত করেছে, তোমরা অবশ্যই মানুষকে তার আদেশ দেবে। আর শরী'আত যে কাজকে অসৎকাজ সাব্যস্ত করেছে, তোমরা অবশ্যই তা থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে। আর যদি কেউ কারও ওপর জুলুম করে তবে তোমরা শক্ত করে তার হাত ধরবে অর্থাৎ বাহুবল দ্বারা তাকে জুলুম করতে বাধা দেবে। যদি বাহুবল দ্বারা বাধা দিতে না পার, তবে মুখের কথা দ্বারা বাধা দেবে। এভাবে জালিম ও অবিচারকারীকে ন্যায় ও সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনবে এবং তাকে এমনভাবে ন্যায় ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখবে, যাতে কিছুতেই সে তার বাইরে যেতে না পারে।
তারপর তিনি সাবধান করছেন যে, তোমরা এ সমস্ত দায়িত্ব পালন না করলে তোমাদের পরস্পরের অন্তরসমূহ একরকম করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ নেককারদের অন্তর গুনাহগারদের অন্তরের মত হয়ে যাবে। গুনাহগারদের অন্তরে যেমন গুনাহের প্রতি ঘৃণাবোধ থাকে না, তেমনি তাদের অন্তর থেকেও ঘৃণাবোধ লোপ করে দেওয়া হবে। এটাও একরকম শাস্তি। অন্তর থেকে পাপ-পুণ্যবোধ মুছে যাওয়া আত্মিক শাস্তি। এর ফলে পাপাচার বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তি ও সমাজ পুরোপুরিভাবে পাপাচারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। পরিণামে দুনিয়ায় নানারকম আযাব-গযব নেমে আসে আর আখিরাতের কঠিন শাস্তি তো আছেই। তা থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব যথারীতি পালন করে যেতে হবে।
হাদীসে আছে- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন, তারপর সোজা হয়ে বসে প্রথমে আল্লাহর কসম করলেন, তারপর শেষের কথাটি বললেন। এর দ্বারা অনুভব করা যায় তাঁর কাছে জালিম ও অপরাধীকে তাদের জুলুম অপরাধ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা এবং আমর বিল- মা'রুফ ও নাহী আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালন করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এর ওপর আমল করার তাওফীক দান করুন - আমীন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কেউ কারও অসৎকর্মে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে জানতে পারলে তার কর্তব্য তাকে আল্লাহর ভয় দেখানো এবং তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা।
খ. উপদেশ দেওয়া সত্ত্বেও অসৎ কর্মকারী তার অসৎকর্ম থেকে বিরত না হলে অন্যদের উচিত তার সঙ্গে একত্রে ওঠাবসা ও পানাহার করা বন্ধ করে দেওয়া, যাতে মানসিক চাপে পড়ে সে অসৎকর্ম ছেড়ে দেয়।
গ. অন্তর থেকে পাপের প্রতি ঘৃণা লোপ পাওয়াটা একরকম আত্মিক শাস্তি। কারও এরকম হলে যথাশীঘ্র তাওবা-ইস্তিগফারে লিপ্ত হওয়া উচিত।
ঘ. কাফের ও পাপী ব্যক্তির সাথে কিছুতেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে নেই।
ঙ. কেউ কারও প্রতি জুলুম করলে আপন ক্ষমতা অনুযায়ী তাকে জুলুম থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা উচিত।
চ. কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিথিলভাবে বলা উচিত নয়। বক্তব্যে দৃঢ়তা প্রকাশের পাশাপাশি ভাবভঙ্গি দ্বারাও তার গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলা উচিত, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুলুমে বাধাদানের আদেশ দেওয়ার সময় হেলান দেওয়া অবস্থা ছেড়ে সোজা হয়ে বসেছেন।
বনী ইসরাঈল হচ্ছে ইয়াহুদী জাতি। এদের পূর্বপুরুষ ছিলেন হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। তাঁর অপর নাম ইসরাঈল। সে হিসেবে তাঁর বংশধরদেরকে বনী ইসরাঈল বা ইসরাঈলের বংশধর বলা হয়।
অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করা
এ হাদীছে জানানো হয়েছে যে, তাদের মধ্যে যখন সর্বপ্রথম অসৎকাজ হতে শুরু করে, তখন সেই অসৎ কার্যকারীর সঙ্গে কারও সাক্ষাৎ হয়ে গেলে সে তাকে আল্লাহর ভয় দেখাত এবং সে কাজটি হারাম ও নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি তার সামনে তুলে ধরত। কিন্তু এতে সেই ব্যক্তির কোনও ভাবান্তর হত না। সে নিজেকে সংশোধন না করে যথারীতি আপন কাজ করে যেত। এ অবস্থায় অন্যদের উচিত ছিল তাকে বয়কট করা এবং তার সঙ্গে লেনদেন, ওঠাবসা ও পানাহারে শরীক না হওয়া, যাতে তার মন- মানসিকতায় এ বয়কটের চাপ পড়ে আর সে চাপের কারণে তার অসৎকাজ ছেড়ে দেয়। কিন্তু তারা তাকে বয়কট করত না। সংশোধন না হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক পুরোপুরি বজায় রাখত।
তার সঙ্গে মিলেমিশে চলার কারণে তার অসৎকর্মের আছর তাদের অন্তরে পড়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে তাদের অন্তর থেকে পাপকাজের প্রতি ঘৃণা লোপ পেয়ে যায় আর এভাবে তাদের গোটা সমাজে অন্যায়-অসৎকাজ বিস্তার লাভ করে। পরিণামে সকলের প্রতি আল্লাহর লা'নত নেমে আসে। সে লা'নতের বর্ণনাই সূরা মায়িদার উল্লিখিত আয়াতসমূহে দেওয়া হয়েছে। এতে হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ও ঈসা আলাইহিস সালামের উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তাঁরা তাদের পাপাচার সীমালঙ্ঘনের কারণে বদদু'আ করেছিলেন। সে বদদু'আর ফলেই তাদের ওপর লা'নত বর্ষিত হয়।
ইমাম আবু হাইয়ান রহ. বর্ণনা করেন যে, হযরত ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, বনী ইসরাঈলকে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের আমলে তাওরাত গ্রন্থে, হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের আমলে যাবুর গ্রন্থে এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আমলে ইন্জীল গ্রন্থে লা'নত করা হয়। অর্থাৎ এসকল নবী যে আপন আপন যুগে তাদের ওপর বদদু'আ করেছিলেন তার উল্লেখ এ গ্রন্থসমূহে আছে।
আয়াতে তাদের এ পরিণতির কারণ বলা হয়েছে-
كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ (79)
তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ।
প্রকাশ্যে পাপকর্ম হওয়া ও তাতে বাধা না দেওয়ার কুফল
অর্থাৎ তাদের মধ্যে দুই অপরাধের সমন্বয় ঘটেছিল। এক তো প্রকাশ্যে অসৎকর্ম করা, দ্বিতীয়ত তাতে বাধাদান না করা। এমনিতে তো অসৎকর্ম কোনও অবস্থায়ই করা উচিত নয়। প্রকাশ্যেও না, গোপনেও না। কেননা আল্লাহ তা'আলা প্রকাশ্য ও গুপ্ত সব অবস্থাই সমানভাবে জানেন। তাঁর অগোচরে থাকে না কোনওকিছুই। তাই বান্দার কর্তব্য সর্বাবস্থায়ই তাঁকে ভয় করা ও তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করা হতে বিরত থাকা। তা সত্ত্বেও গোপনে গুনাহ করা অপেক্ষা প্রকাশ্যে করা অধিকতর মন্দ। কেননা এটা আল্লাহভীতির অভাবের সঙ্গে সঙ্গে নির্লজ্জতা ও ধৃষ্টতার পরিচায়কও বটে। বনী ইসরাঈল এরকম ধৃষ্টতার সাথেই পাপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল। এ তো গেল তাদের এক অপরাধ।
এরকম ধৃষ্টতাপূর্ণ পাপকর্মে কেউ লিপ্ত হলে অর্থাৎ প্রকাশ্যে জনসম্মুখে গুনাহ করলে অন্যদের কর্তব্য তাকে তা হতে বিরত রাখতে চেষ্টা করা, যার একটা পদ্ধতি অপরাধীকে বয়কট করা ও তার সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেওয়া। অন্যথায় তার দ্বারা অন্যরাও পাপাচারে লিপ্ত হতে উৎসাহ পায় আর এভাবে গোটা সমাজে অন্যায়-অনাচার ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বনী ইসরাঈলের 'উলামা তাদেরকে সেই প্রকাশ্য পাপ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেনি। এ ছিল তাদের দ্বিতীয় অপরাধ। এর ফলে তাদের গোটা জাতির মধ্যে অন্যায়-অনাচার বিস্তার লাভ করে। পরিণামে তারা অভিশাপগ্রস্ত হয়।
এর দ্বারা মূলত আমাদেরকে সবক দেওয়া হচ্ছে যে, আমাদের মধ্যে যেন কিছুতেই এ দুই অন্যায়ের মিলন ঘটতে না পারে। আমরা কেউ প্রকাশ্যে পাপকর্ম করব না এবং গোপনেও নয়। আর কেউ প্রকাশ্যে পাপকর্মে লিপ্ত হলে অন্যরা অবশ্যই তা থেকে তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে, প্রয়োজনে তাকে বয়কট করবে, যাতে বনী ইসরাঈলের মত অশুভ পরিণামে শিকার আমাদের না হতে হয়।
কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্বের নিন্দা
এ আয়াতসমূহে বনী ইসরাঈলের আরেকটি অনাচার বলা হয়েছে কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। ইরশাদ হয়েছে-
تَرَى كَثِيرًا مِنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنْفُسُهُمْ أَنْ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونَ (80)
তুমি তাদের অনেককেই দেখছ, কাফিরদেরকে নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে। নিশ্চয়ই তারা নিজেদের জন্য যা সামনে পাঠিয়েছে, তা অতি মন্দ। কেননা (সে কারণে) আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারা সর্বদা শাস্তির ভেতর থাকবে। অর্থাৎ তারা যেহেতু আহলে কিতাব, তাদের কিতাব তাওরাতে শেষ নবী সম্পর্কে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী আছে, সে ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে একজন সত্যনবী ও সর্বশেষ নবী তা তাদের ঢের জানা ছিল, সেহেতু তাদের তো উচিত ছিল তাঁর প্রতি অন্য সকলের আগে ঈমান আনা এবং তাঁকে সত্যনবী বলে বিশ্বাস করে তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেওয়া। কিন্তু তা না করে তারা উল্টো তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে এবং তাদের কিতাবেও যে শিরক ও কুফরের নিন্দা করা হয়েছে, সেই শিরক ও কুফরে লিপ্ত আরব মুশরিকদের সঙ্গে তারা বন্ধুত্ব করছে। বন্ধুত্ব করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেইসঙ্গে তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে তাদেরকে যুদ্ধের উস্কানি দিয়েছে এবং বিভিন্ন যুদ্ধে তাদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছে। তাদের এ আচরণ চরম গর্হিত ও নিতান্তই নিন্দনীয়। এ কারণে দুনিয়ায়ও তাদের প্রতি আল্লাহর ক্রোধ বর্ষিত হয়েছে এবং আখিরাতেও তারা স্থায়ী আযাবে নিপতিত থাকবে। পরের আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَكِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (81)
তারা যদি আল্লাহ, নবী এবং তার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তাতে ঈমান রাখত, তবে তাদেরকে (মূর্তিপূজারীদেরকে) বন্ধু বানাত না। কিন্তু (প্রকৃত ব্যাপার হল) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য। অর্থাৎ তারা যদি আল্লাহর প্রতি যথার্থ ঈমান রাখত এবং তাদের নবী হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাব তাওরাতে বিশ্বাস রাখত, তবে কিছুতেই মুশরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করত না। কেননা নবীর দাওয়াতই হচ্ছে শিরকের বিরুদ্ধে ও তাওহীদের পক্ষে। নবীর প্রতি অবতীর্ণ কিতাবেও শিরক পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর দিকে ডাকা হয়। কাজেই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাওরাত গ্রন্থে তাদের বিশ্বাস থাকলে তারা মুশরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তো করতই না; বরং নিজেরাও শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনত এবং মুশরিকদেরকেও শিরক পরিহার করে তাঁর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানাত। এরূপ না করায় প্রকৃতপক্ষে তারা আপন দীন থেকেও খারিজ হয়ে গেছে। তারা কার্যত হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাওরাত গ্রন্থের অনুসারী থাকেনি।
এর দ্বারাও সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের গুরুত্ব বোঝা যায়। কেননা এ দায়িত্ব পালন করলে তখন পাপী ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করার অবকাশ থাকে না; বরং প্রথমত তাকে পাপকাজ ছেড়ে দেওয়ার হুকুম করতে হয়, তারপর সে হুকুম না মানলে দ্বিতীয় পর্যায়ে তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হয়। বনী ইসরাঈল তা না করে অভিশপ্ত হয়েছে। আমরাও যদি অভিশাপ থেকে বাঁচতে চাই, তবে কর্তব্য হবে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব সাধ্যানুযায়ী পালন করে যাওয়া।
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্টভাবেই আমাদেরকে হুকুম করছেন যে, শরী'আত যে কাজটিকে সৎকর্ম সাব্যস্ত করেছে, তোমরা অবশ্যই মানুষকে তার আদেশ দেবে। আর শরী'আত যে কাজকে অসৎকাজ সাব্যস্ত করেছে, তোমরা অবশ্যই তা থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে। আর যদি কেউ কারও ওপর জুলুম করে তবে তোমরা শক্ত করে তার হাত ধরবে অর্থাৎ বাহুবল দ্বারা তাকে জুলুম করতে বাধা দেবে। যদি বাহুবল দ্বারা বাধা দিতে না পার, তবে মুখের কথা দ্বারা বাধা দেবে। এভাবে জালিম ও অবিচারকারীকে ন্যায় ও সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনবে এবং তাকে এমনভাবে ন্যায় ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখবে, যাতে কিছুতেই সে তার বাইরে যেতে না পারে।
তারপর তিনি সাবধান করছেন যে, তোমরা এ সমস্ত দায়িত্ব পালন না করলে তোমাদের পরস্পরের অন্তরসমূহ একরকম করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ নেককারদের অন্তর গুনাহগারদের অন্তরের মত হয়ে যাবে। গুনাহগারদের অন্তরে যেমন গুনাহের প্রতি ঘৃণাবোধ থাকে না, তেমনি তাদের অন্তর থেকেও ঘৃণাবোধ লোপ করে দেওয়া হবে। এটাও একরকম শাস্তি। অন্তর থেকে পাপ-পুণ্যবোধ মুছে যাওয়া আত্মিক শাস্তি। এর ফলে পাপাচার বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তি ও সমাজ পুরোপুরিভাবে পাপাচারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। পরিণামে দুনিয়ায় নানারকম আযাব-গযব নেমে আসে আর আখিরাতের কঠিন শাস্তি তো আছেই। তা থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব যথারীতি পালন করে যেতে হবে।
হাদীসে আছে- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন, তারপর সোজা হয়ে বসে প্রথমে আল্লাহর কসম করলেন, তারপর শেষের কথাটি বললেন। এর দ্বারা অনুভব করা যায় তাঁর কাছে জালিম ও অপরাধীকে তাদের জুলুম অপরাধ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা এবং আমর বিল- মা'রুফ ও নাহী আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালন করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এর ওপর আমল করার তাওফীক দান করুন - আমীন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কেউ কারও অসৎকর্মে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে জানতে পারলে তার কর্তব্য তাকে আল্লাহর ভয় দেখানো এবং তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা।
খ. উপদেশ দেওয়া সত্ত্বেও অসৎ কর্মকারী তার অসৎকর্ম থেকে বিরত না হলে অন্যদের উচিত তার সঙ্গে একত্রে ওঠাবসা ও পানাহার করা বন্ধ করে দেওয়া, যাতে মানসিক চাপে পড়ে সে অসৎকর্ম ছেড়ে দেয়।
গ. অন্তর থেকে পাপের প্রতি ঘৃণা লোপ পাওয়াটা একরকম আত্মিক শাস্তি। কারও এরকম হলে যথাশীঘ্র তাওবা-ইস্তিগফারে লিপ্ত হওয়া উচিত।
ঘ. কাফের ও পাপী ব্যক্তির সাথে কিছুতেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে নেই।
ঙ. কেউ কারও প্রতি জুলুম করলে আপন ক্ষমতা অনুযায়ী তাকে জুলুম থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা উচিত।
চ. কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিথিলভাবে বলা উচিত নয়। বক্তব্যে দৃঢ়তা প্রকাশের পাশাপাশি ভাবভঙ্গি দ্বারাও তার গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলা উচিত, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুলুমে বাধাদানের আদেশ দেওয়ার সময় হেলান দেওয়া অবস্থা ছেড়ে সোজা হয়ে বসেছেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)