আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১৬. অধ্যায়ঃ বিবাহ সংশ্লিষ্ট বিষয়

হাদীস নং: ৩০৩১
অধ্যায়ঃ বিবাহ সংশ্লিষ্ট বিষয়
পরিচ্ছেদ
৩০৩১. হযরত আনাস (রা) সূত্রে নবী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি দু'টো কন্যা সন্তান বয়োঃপ্রাপ্তা (বালিগা) হওয়া পর্যন্ত প্রতিপালন করবে, সে কিয়ামতের দিন আমার পাশে এভাবে অবস্থান করবে, এই বলে তিনি তাঁর (হাতের) আঙুল গুলো মিলিয়ে নিলেন।
(মুসলিম নিজ শব্দেযোগে বর্ণনা করেন এবং তিরমিযী (র)ও। ইমাম তিরমিযী (র) নিজ শব্দযোগে বর্ণনা করেন যে, "যে ব্যক্তি দু'টো কন্যা প্রতিপালন করবে, আমি এবং সে জান্নাতে এভাবে থাকব এই বলে তিনি তাঁর তর্জনী ও অনামিকা আঙুল গুলো একত্র করেন।"
ইবনে হিব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে নিজ শব্দযোগে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ "যে ব্যক্তি দু'টো কন্যা অথবা তিনটি কন্যা অথবা তিনি বলেছেন, দুই বোন অথবা তিন বোন প্রতিপালন করবে, এমন কি সে তাদের পাত্রস্থ করবে অথবা সে নিজে ইনতিকাল করবে, তাহলে, আমি এবং সে জান্নাতে পাশাপাশি অবস্থান করব। এই বলে তিনি তাঁর তর্জনী ও অনামিকার দিকে ইশারা করে দেখালেন"।)
كتاب النكاح
فصل
3031- وَعَن أنس رَضِي الله عَنهُ عَن النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ من عَال جاريتين حَتَّى تبلغا جَاءَ يَوْم الْقِيَامَة أَنا وَهُوَ وَضم أَصَابِعه

رَوَاهُ مُسلم وَاللَّفْظ لَهُ وَالتِّرْمِذِيّ
وَلَفظه من عَال جاريتين دخلت أَنا وَهُوَ الْجنَّة كهاتين وَأَشَارَ بِأُصْبُعَيْهِ السبابَة وَالَّتِي تَلِيهَا
وَابْن حبَان فِي صَحِيحه
وَلَفظه قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم من عَال ابْنَتَيْن أَو ثَلَاثًا أَو أُخْتَيْنِ أَو ثَلَاثًا حَتَّى يبن أَو يَمُوت عَنْهُن كنت أَنا وَهُوَ فِي الْجنَّة كهاتين وَأَشَارَ بِأُصْبُعَيْهِ السبابَة وَالَّتِي تَلِيهَا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে কন্যাসন্তানকে বালেগা হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করার ফযীলত বলা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে বিবাহ দেওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করার দ্বারাই এ ফযীলত লাভ হয়। বালেগা হওয়া পর্যন্ত বলার কারণ ইসলাম মূলত মেয়েদেরকে বালেগা হওয়ামাত্রই বিবাহ দিতে উৎসাহ দেয়। এ হাদীছেও পরোক্ষভাবে সে উৎসাহই দেওয়া হয়েছে। যেন বলা হচ্ছে, বালেগা হওয়ার পর তুমি তো তাকে বিবাহই দিয়ে দেবে। এরপর দায়িত্ব চলে যাবে স্বামীর হাতে। তখন তার জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সে-ই সরবরাহ করবে। তার আগ পর্যন্ত যেহেতু তোমার কাছে আছে, তাই এখন তার ভার তোমার উপর। তুমি যদি আন্তরিকতার সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন কর, তবে হাদীছে বর্ণিত ফযীলতের অধিকারী হবে।
প্রকাশ থাকে যে, লালন-পালন বলতে কেবল ভাত-কাপড় যোগানোই বোঝায় না। তার ইহজীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ তো করতেই হবে, সেইসঙ্গে তার পরকালীন জীবন যাতে সাফল্যমণ্ডিত হয় সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি। এর জন্য কর্তব্য তাকে জরুরি দীনী ইলম শিক্ষা দেওয়া। অর্থাৎ একজন মুসলিম নারী হিসেবে তার যা-কিছু করণীয় তা সবই তাকে শিক্ষা দেওয়া চাই। যেমন আকীদা- বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, হালাল-হারামের মাসাইল, উত্তম আখলাক-চরিত্র, স্বামী ও সন্তানের প্রতি কর্তব্য, আত্মীয়-স্বজনের হক ইত্যাদি।
কন্যাসন্তান লালন-পালনের এ ফযীলত দ্বারা ধারণা পাওয়া যায় ইসলামে কন্যাসন্তানের কী মর্যাদা। ইসলামের আগে তার এ মর্যাদা ছিল না। কন্যাসন্তান জন্ম নেওয়া পিতার পক্ষে লাঞ্ছনাকর গণ্য হত। তাই জন্ম নেওয়ামাত্র তাকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতেও ফেলা হত। কাউকে তার কন্যাসন্তান জন্মের সংবাদ দেওয়া হলে তার পক্ষে তা চরম বিব্রতকর মনে হত। কুরআন মাজীদে সে চিত্র এভাবে আঁকা হয়েছে-

وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ (58) يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ (59)

‘যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তান ( জন্মগ্রহণ)-এর সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে মনে মনে দুঃখ-ক্লিষ্ট হয়। সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে মানুষ থেকে লুকিয়ে বেড়ায় (এবং চিন্তা করে), হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে। জেনে রেখ, তারা যে সিদ্ধান্ত স্থির করে তা অতি মন্দ!২৯৮
ইসলাম তার অনুসারীদেরকে এ গ্লানি থেকে মুক্ত করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে কন্যাসন্তানের জন্ম লাঞ্ছনাকর নয়; বরং মর্যাদাকর। তার দ্বারা পিতামাতার পক্ষে জান্নাতের পথ সুগম হয়; বরং জান্নাতের উচ্চমর্যাদা লাভ হয়। সুতরাং এ হাদীছে কেবল একটি কন্যাসন্তান নয়, একাধিক কন্যাসন্তানের প্রতি আগ্রহ প্রদান করা হয়েছে। দীনের সহীহ বুঝ যাদের মধ্যে নেই তারা একটি কন্যাসন্তানের জন্মেও মন খারাপ করে ফেলে। এ হাদীছ বলছে, আল্লাহ তাআলা যদি তোমাকে দুটি কন্যাসন্তান দেন আর তুমি উত্তমভাবে তার লালন-পালন কর, তবে তুমি জান্নাতে তাঁর রাসূলের প্রতিবেশী হয়ে থাকবে। অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

مَنْ عَالَ ثَلَاثَ بَنَاتٍ، فَأَدَّبَهُنَّ ، وَزَوَّجَهُنَّ، وَأَحْسَنَ إِلَيْهِنَّ ، فَلَهُ الْجَنَّةُ

‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যাসন্তানের লালন-পালন করে, তাদেরকে দীনী শিক্ষাদান করে, তাদের বিবাহ সম্পন্ন করে এবং তাদের প্রতি সদাচরণ করে, তার জন্য জান্নাত।২৯৯

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, এটি অতি উৎকৃষ্ট হাদীছসমূহের একটি।

جارية-এর মূল অর্থ কিশোরী, তরুণী। কন্যা বোঝানোর জন্য بنت বা ابنة শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আলোচ্য হাদীছে جارية শব্দ ব্যবহার করে বোঝানো হচ্ছে যে, এ ফযীলত নিজের কন্যাকে লালন-পালন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বোন, ভাতিজী, নাতনী বা এরকম যে-কোনও দুই মেয়েকে লালন-পালন করলেও এ ফযীলত অর্জিত হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছাকাছি জান্নাতে থাকা বড়ই সৌভাগ্যের ব্যাপার। সুতরাং এ সৌভাগ্য অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের উচিত অত্যন্ত মায়া-মমতার সাথে মেয়েদের লালন-পালন করা এবং কোনওক্রমেই মেয়ে হল বলে তাদেরকে অবহেলা ও অগ্রাহ্য না করা।

২৯৮. সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৫৮-৫৯

২৯৯. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫৪১৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১১৯২৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১১৫৪২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৫৬; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ৬৩৯
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান