আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১৫. অধ্যায়ঃ ক্রয়-বিক্রয়

হাদীস নং: ২৬৬২
অধ্যায়ঃ ক্রয়-বিক্রয়
জীবিকা উপার্জনে মধ্যম পন্থা ও সাধুতা অবলম্বনের প্রতি উৎসাহ দান এবং লোভ ও অর্থ মোহের নিন্দাবাদ প্রসঙ্গে
২৬৬২. হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ সম্পদের দু'টি বিশাল প্রান্তর যদি আদম সন্তানের মালিকানাধীন হয়ে যায়, তবুও সে এর সাথে আরো একটি প্রান্তর কামনা করবে। আর আদম সন্তানের উদর মাটি ব্যতীত অন্য কিছুই পূর্ণ করতে পারবে না। তবে যে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, আল্লাহ্ তার প্রতি অনুগ্রহ করেন।
(হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন।)
كتاب البيوع
التَّرْغِيب فِي الاقتصاد فِي طلب الرزق والإجمال فِيهِ وَمَا جَاءَ فِي ذمّ الْحِرْص وَحب المَال
2662- وَعَن أنس رَضِي الله عَنهُ قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لَو كَانَ لِابْنِ آدم واديان من مَال لابتغى إِلَيْهِمَا ثَالِثا وَلَا يمْلَأ جَوف ابْن آدم إِلَّا التُّرَاب وَيَتُوب الله على من تَابَ

رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে মানুষের স্বভাবগত অবস্থা বর্ণনার পাশাপাশি তাওবার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। বস্তুত অর্থ-সম্পদের প্রতি মানুষের আসক্তি তার স্বভাবজাত, যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ-

زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآبِ

অর্থ : মানুষের জন্য ওই সকল বস্তুর আসক্তিকে মনোরম করা হয়েছে, যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক অর্থাৎ নারী, সন্তান, রাশিকৃত সোনা-রূপা, চিহ্নিত অশ্বরাজি, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামার। এসব ইহজীবনের ভোগসামগ্রী। (কিন্তু) স্থায়ী পরিণামের সৌন্দর্য কেবল আল্লাহরই কাছে।

আল্লাহপ্রেম ও আল্লাহভীতি যার অন্তরে প্রবল নয় এবং আখিরাতের চিন্তা-চেতনা যার মনে জাগ্রত থাকে না, সে ওই স্বভাবগত আসক্তির কারণে দুনিয়ার অর্থ-সম্পদের পেছনেই দৌড়ঝাঁপ করে। সম্পদ যত বাড়ে, তার লোভ ও আসক্তিও ততই বাড়তে থাকে। বরং বলা যায় সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে সম্পদের ক্ষুধাও যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ে। এই লোভ ও ক্ষুধা মেটানোর জন্য এমনকি সে আখিরাতও ভুলে যায়। সে নেমে পড়ে সম্পদ কুড়ানোর প্রতিযোগিতায়। হালাল-হারাম নির্বিচারে সম্পদ লুটতে থাকে। এভাবে সম্পদ বাড়ানোর প্রচেষ্টায় নানারকম পাপও কুড়াতে থাকে। কিন্তু ক্ষুধা তার কিছুতেই মেটে না। যত পায় ততই তার অন্তরে বাজতে থাকে আরও চাই আরও চাই’-এর হাহাকার। সেই সংগে পাল্লা দিয়ে বাড়ে পাপের বোঝাও। এভাবে সে অন্তহীন ক্ষুধা ও একরাশ পাপ নিয়ে কবরে চলে যায়। পরিশেষে কবরের মাটি দ্বারা তার উদর পূর্ণ হয়। এ হাদীছে সে কথাই ব্যক্ত হয়েছে। কুরআন মাজীদেও ইরশাদ হয়েছে

أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ

অর্থ : (পার্থিব ভোগ সামগ্রীতে) একে অন্যের উপর আধিক্য লাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে পৌঁছ।' এই কবরস্থানে পৌঁছা এবং কবরের মাটি দ্বারা পেট ভরার কথা বলে অর্থলোভী ব্যক্তির চরম লাঞ্ছনা ও দুর্গতির কথাই বোঝানো হয়েছে। সেই দুর্গতির সূচনা কবর থেকে। আর শেষ গন্তব্য জাহান্নাম। তা থেকে বাঁচার উপায় খাঁটি তাওবা করা। অর্থাৎ অন্তর থেকে অর্থ-সম্পদের লোভ ঝেড়ে ফেলে সেখানে আল্লাহপ্রেম ও আখিরাতের আসক্তি জাগ্রত করা। আখিরাতই মু'মিনের প্রকৃত ঠিকানা। তার বিপরীতে দুনিয়ার কোনও মূল্যই নেই, এমনকি একটি মৃত ও গলিত ছাগলছানার সমানও নয়।
আখিরাতের জীবন অন্তহীন। জান্নাতে আছে অকল্পনীয় ও অপরিমিত নি'আমত। সেই নি'আমতের প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্যে আল্লাহ তা'আলার ইরশাদ

قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ

অর্থঃ বল, আমি কি তোমাদেরকে এসব অপেক্ষা উৎকৃষ্ট জিনিসের সংবাদ দেব? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে এমন বাগ-বাগিচা, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত, যেখানে তারা সর্বদা থাকবে এবং (তাদের জন্য আছে) পবিত্র স্ত্রী ও আল্লাহর পক্ষ হতে সন্তুষ্টি। আল্লাহ সকল বান্দাকে ভালোভাবে দেখছেন। সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের অপরিমিত নি'আমত লাভের লক্ষ্যে আমাদের কর্তব্য সৎকর্মের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া এবং ইহজাগতিক এসব তুচ্ছ সম্পদের লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে খাঁটি মনে তাওবা করা, সবরকম শুনাহ থেকে ক্ষান্ত হওয়া এবং হালাল উপায়ে যখন যা অর্জিত হয় তাতে সন্তুষ্ট থাকা। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. লোভ মানুষকে পাপের দিকে পরিচালিত করে। পাপের পরিণাম ধ্বংস।

খ. লোভ পূরণ দ্বারা লোভ কখনও প্রশমিত হয় না; বরং তার মাত্রা আরও বাড়ে। সুতরাং লোভের পেছনে না পড়ে নিজের যা আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকাই শ্রেয়।

গ. লোভ দমনের একটা উপায় তাওবা করা। অর্থাৎ লোভজনিত অতীত পাপের কারণে অনুতপ্ত হয়ে লোভ পূরণ হতে ক্ষান্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে লোভের পেছনে না পড়ার প্রতিজ্ঞা নেওয়া। এর দ্বারা আশা করা যায় আল্লাহ তা'আলা লোভের গুনাহ থেকে আত্মরক্ষা করার তাওফীক দান করবেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান