আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১৪. অধ্যায়ঃ যিকির ও দু‘আ

হাদীস নং: ২৫০৮
অধ্যায়ঃ যিকির ও দু‘আ
ক্ষমা প্রার্থনার প্রতি অনুপ্রেরণা দান
২৫০৮. হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ বলেনঃ হে আদম সন্তান। তুমি আমাকে যত ডাকবে ও আশা পোষণ করবে, আমি তোমার সকল গুনাহ মাফ করে দিব, আর এতে মোটেও পরওয়া করব না। হে আদম সন্তান। তোমার গুনাহরাশি যদি আকাশের মেঘমালা পর্যন্ত গিয়ে পৌছে, তারপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, তবুও আমি তোমাকে মার্জনা করে দিব। আর এতে আমি কোন পরওয়া করব না। হে আদম সন্তান। তুমি যদি পৃথিবী পূর্ণ পাপরাশি নিয়েও আমার সাথে সাক্ষাত কর আর আমার সাথে কোন কিছু শরীক করা ব্যতীত সাক্ষাত কর, তবে আমি পৃথিবীপূর্ণ মাগফিরাত নিয়ে তোমার কাছে আসব।
(হাদীসটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেনঃ এটি হাসান-গরীব হাদীস।)
كتاب الذّكر وَالدُّعَاء
التَّرْغِيب فِي الاسْتِغْفَار
2508- وَعَن أنس رَضِي الله عَنهُ قَالَ سَمِعت رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَقُول قَالَ الله يَا ابْن آدم إِنَّك مَا دعوتني ورجوتني غفرت لَك على مَا كَانَ مِنْك وَلَا أُبَالِي
يَا ابْن آدم لَو بلغت ذنوبك
عنان السَّمَاء ثمَّ استغفرتني غفرت لَك وَلَا أُبَالِي
يَا ابْن آدم إِنَّك لَو أتيتني بقراب الأَرْض خَطَايَا ثمَّ لقيتني لَا تشرك بِي شَيْئا لأتيتك بقرابها مغْفرَة

رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَقَالَ حَدِيث حسن غَرِيب

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটি আল্লাহ তাআলার রহমত ও মাগফিরাত লাভের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার জন্য অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। আল্লাহ তাআলা অসীম দয়ালু, অপরিসীম ক্ষমাশীল। তাঁর রহমত তাঁর ক্রোধের উপর প্রবল। তিনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। তাই বান্দাকে ডাক দিয়ে বলছেন-
إنك ما دعوتني ورجوتني غفرت لك على ما كان منك
(তুমি যতদিন আমাকে ডাকবে ও আমার কাছে আশা করবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করব, তাতে তোমার দ্বারা যা-কিছুই ঘটুক)। অর্থাৎ তোমার দ্বারা ছোট-বড় যে-কোনও পাপই ঘটুক না কেন, আমি ক্ষমা করে দেব। যদি তাওবা-ইস্তিগফার কর, কবীরা গুনাহও মাফ করব। যদি ঈমান আন, শিরক ও কুফরের গুনাহও মাফ করব। দরকার কেবল আমার রহমতের আশাবাদী হয়ে আমাকে একটু ডাকা। তোমার দ্বারা যত বড় পাপই হোক না কেন, যদি আমাকে ডেকে বল হে আমার রব্ব! আমাকে ক্ষমা করে দিন, অবশ্যই ক্ষমা করব। যদি বারবার পাপ হয়ে যায় আর বারবার আমাকে ডাক, তবুও ক্ষমা করব। এভাবে যতদিন ডাকতে থাকবে, ক্ষমা করতে থাকব। মৃত্যুর আলামত প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত ক্ষমা করেই যাব। তাঁর অফুরন্ত রহমত ও মাগফিরাত কোনও বাঁধা মানে না। ঈমান ও ইস্তিগফারের সামনে কোনও বাঁধা টেকে না। পাপের বড়ত্ব ও বিপুলতা বাঁধা হতে পারে না। তাই আল্লাহ বলেন-
ولا أبالي
(আমি কোনও পরওয়া করব না)। অর্থাৎ তোমার আশা যদি সাচ্চা হয়, তবে তোমার পাপ যত বড়ই হোক না কেন আমি মাফ করবই। কেননা, আমার সম্পর্কে আমার বান্দা যেমন বিশ্বাস রাখে, আমি তার প্রতি তেমন আচরণই করে থাকি।

আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করতে যে কতটা ভালোবাসেন, তা বোঝানোর জন্য এ হাদীছে দু'টি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে-
لو بلغت ذنوبك عنان السماء
(তোমার গুনাহ যদি আকাশ পর্যন্তও পৌঁছে যায়)। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যাক গুনাহ শরীরধারী কোনও বস্তু। এ অবস্থায় কোনও ব্যক্তির পাপরাশি স্তূপীকৃত করা হল। আর তার গুনাহের পরিমান এত বেশি হলো যে, স্তূপটি উচ্চতায় আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল। আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
ثم استغفرتني غفرت لك
(তারপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব)। অর্থাৎ তোমার পাপরাশির এতবড় স্তূপও ক্ষমা করা আমার পক্ষে কঠিন হবে না। তুমি যদি সত্যিকারের তাওবা-ইস্তিগফার কর, তবে সহজেই আমি তোমার সে পাপরাশি ক্ষমা করে দেব।

দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে—
إنك لو أتيتني بقراب الأرض خطايا
(তুমি যদি আমার কাছে পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়েও আস)। অর্থাৎ তোমার গুনাহ যদি এতবেশি হয়, যা দ্বারা সারাটা পৃথিবী ভরে যাবে। আমাদের সামনের পৃথিবী কত বিশাল! এর বিস্তৃত বিপুল! গুনাহ যদি শরীরধারী বস্তু হয়, তবে তা দ্বারা এ পৃথিবী ভরে ফেলতে কী পরিমাণ গুনাহের প্রয়োজন হবে? তা তার পরিমাণ যত বেশিই হোক না কেন, আল্লাহ তা'আলার রহমতের পরিমাণ তারচে' অনেক অনেক গুন বেশি। উভয়ের মধ্যে কোনও তুলনাই চলে না। তাই আল্লাহ বলছেন-
ثم لقيتني لا تشرك بي شيئا، لأتيتك بقرابها مغفرة
(এবং এ অবস্থায় আমার সঙ্গে সাক্ষাত কর যে, তুমি আমার সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক কর না, তবে আমিও পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে আসব)। অর্থাৎ তোমার এত বিপুল গুনাহ ক্ষমা করা আমার পক্ষে কঠিন হবে না। আমিও পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার সঙ্গে সাক্ষাত করব। তোমার পাপ আরও বেশি হলে আমি সেই পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার সামনে থাকব। তাতে আমার ক্ষমায় কোনও অভাব পড়বে না। তোমার পাপ যত বেশিই হোক না কেন, সর্বাবস্থায় তা সীমিতই বটে। কিন্তু আমার ক্ষমা অফুরন্ত। হাঁ, ক্ষমা পাওয়ার জন্য একটা শর্ত আছে। তা হল ঈমান। তুমি যদি শিরক ও কুফর নিয়ে আমার সামনে হাজির হও, তবে কিছুতেই ক্ষমা পাবে না। তাই আমার কাছে আসার আগে অবশ্যই তোমাকে শিরক ও কুফর থেকে তাওবা করে খাঁটি মুমিন হয়ে যেতে হবে।

প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ তাআলার রহমত ও ক্ষমার বিপুলতা দেখে কারও এ ধোঁকায় পড়া উচিত হবে না যে, তাহলে যত পারি গুনাহ করে নিই, আল্লাহ তা'আলা তো ক্ষমা করবেনই। কেননা আল্লাহ তা'আলা যেমন ক্ষমাশীল, তেমনি শাস্তিদাতাও বটে। ইরশাদ হয়েছে-
{نَبِّئْ عِبَادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ (49) وَأَنَّ عَذَابِي هُوَ الْعَذَابُ الْأَلِيمُ (50)} [الحجر: 49، 50]
"আমার বান্দাদেরকে জানিয়ে দাও, নিশ্চয় আমিই অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। এবং এটাও জানিয়ে দাও যে, আমার শাস্তিই অতি মর্মন্তুদ শাস্তি।

সুতরাং শাস্তির ভয়ও রাখা চাই। বারবার গুনাহ করতে থাকা আর আল্লাহ ক্ষমা করবেন বলে আশা রাখা একরকম ধৃষ্টতা। অন্তরে আবারও গযবের ভয় থাকা সত্ত্বেও নফসের তাড়নায় গুনাহ হয়ে যাওয়া এক কথা, আর আল্লাহ তাআলার ক্ষমাকে অজুহাত বানিয়ে একের পর এক পাপ করে যাওয়া আরেক কথা। প্রথম অবস্থায় ক্ষমালাভের আশা থাকে। দ্বিতীয় অবস্থাটি ক্ষমার পক্ষে বাধা। ক্ষমা পেতে হলে এরকম ধারণার পরিবর্তন জরুরি। তাই তো কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
{وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ (135) أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ مَغْفِرَةٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَجَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ (136) } [آل عمران: 135 - 137]
"এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনও কোনও অশ্রীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনওভাবে) নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া আর কেইবা আছে, যে গুনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা যা করেছে, জেনেশুনে তা বারবার করে না। এরাই তারা, যাদের পুরস্কার হচ্ছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে মাগফিরাত ও জান্নাত।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নিজ গুনাহ মাফ করানোর জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে ক্ষমার আশাবাদী থেকে দু'আ করতে থাকা চাই।

খ. আসমান এক অস্তিত্বমান শরীরধারী বস্তু। এতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।

গ. মৃত্যুর পর আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সাক্ষাত হবে। এতে কোনও সন্দেহ নেই।

ঘ. মৃত্যুর পর মাগফিরাত লাভের জন্য ঈমান থাকা শর্ত। কাফের ও মুশরিক ব্যক্তি ক্ষমা পাবে না।

ঙ. বান্দা যত বড় গুনাহগারই হোক, ঈমান ও তাওবা-ইস্তিগফার দ্বারা অবশ্যই ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ থাকে। হতাশার কোনও কারণ নেই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান