আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১৪. অধ্যায়ঃ যিকির ও দু‘আ

হাদীস নং: ২৩৫৩
অধ্যায়ঃ যিকির ও দু‘আ
কালেমায়ে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' পাঠের প্রতি উৎসাহ দান ও এর ফযীলত প্রসঙ্গ
২৩৫৩. হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত যে, মুয়ায (রা) একবার রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর হাওদার পিছনে বসা ছিলেন। তিনি বললেন, হে মুয়ায ইবন জাবাল। মুয়ায বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমি হাযির, আমি আপনার ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত। কথাটি মুয়ায তিনবার বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন বললেন। যে কেউ খাঁটি অন্তরে এ কথার সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা'বুদ নেই এবং মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ্ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন। মুয়ায বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। আমি কি লোকদেরকে এ সংবাদ শুনিয়ে দিব না যাতে করে তারা খুশি হয়? তিনি বললেন, এমন করলে তারা তো এর উপরই ভরসা করে বসে থাকবে। মুয়ায পরে মৃত্যুর সময় গুনাহের ভয়ে* এ হাদীসটি বর্ণনা করেছিলেন।
(হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন।) (সংকলক) আবদুল আযীম বলেনঃ যে সকল হাদীসে কালেমায়ে তাওহীদের উপর জান্নাতের প্রতিশ্রুতি অথবা জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে বিজ্ঞ আলিমদের মত হল এই যে, এগুলো ইসলামের প্রাথমিক যুগের সাথে সম্পৃক্ত যখন কেবল তাওহীদ ও ঈমানের প্রতি আহবান করার নির্দেশ ছিল। পরবর্তীতে যখন শরীয়তের বিধি-বিধান তথা ফরয-ওয়াজিব ইত্যাদি নাযিল হয় এবং বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির নির্দেশ আসে, তখন এ হাদীসগুলোর বিধান রহিত হয়ে যায়। এর উপর যথেষ্ট দলীল-প্রমাণ বর্তমান রয়েছে। ইতোপূর্বে সালাত, যাকাত, সাওম ও হজ্জ ইত্যাদি অধ্যায়সমূহে এমন অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যেগুলো আমলের প্রয়োজনীয়তা ও এর গুরুত্বের নিদর্শন বহন করে। সামনেরও বিভিন্ন অধ্যায়ে এ ধরনের অনেক হাদীস আসবে। উল্লিখিত মতের পক্ষে রয়েছেন যাহহাক, যুহরী ও সুফিয়ান সাওরী প্রমুখ আলিমগণ। অন্য একদল আলিম বলেন, এখানে হাদীসগুলো রহিত হয়ে গিয়েছে, এ কথা বলার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা দীনের স্তঞ্জ ও ইসলামের যে কোন বিধানই আল্লাহর একত্ব ও রাসূল-এর রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আবশ্যিক বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত এবং ঈমানের দাবি। সুতরাং কেউ যখন তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদানের পর অস্বীকৃতি অথবা তুচ্ছ জ্ঞান করে কোন ফরয আদায়ে বিরত থাকবে, তখন তার উপর কুফর-এর হুকুম আসবে এবং জান্নাতে প্রবেশ থেকে সে বঞ্চিত হয়ে যাবে। এ মতটিও পূর্বোক্ত মতের কাছাকাছিই। অপর এক দল বলেন, কালেমায়ে তাওহীদ উচ্চারণ জান্নাতে প্রবেশ ও জাহান্নাম থেকে নিরাপদ থাকার দাবি করে। কিন্তু শর্ত এই যে, উচ্চারণকারী ফরযসমূহ আদায় করবে এবং কবীরা গুনাহসমূহ থেকে বেঁচে থাকবে। তাই সে যদি ফরয পালন না করে এবং কবীরা গুনাহসমূহ থেকে বিরত না থাকে, তবে তার এই কালেমা পাঠ জাহান্নামে প্রবেশে অন্তরায় হবে না। এ মতটি পূর্বোক্ত মতের মতই অথবা এটি অবিকল পূর্বোক্ত মতটিই। এ ব্যাপারে আমরা আমাদের কিতাবে ভিন্নমত সহ বিস্তারিত আলোচনা করেছি। মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

*সত্য গোপন করার গুনাহর ভয়ের কথা এখানে উল্লেখিত হয়েছে।
كتاب الذّكر وَالدُّعَاء
التَّرْغِيب فِي قَول لَا إِلَه إِلَّا الله وَمَا جَاءَ فِي فَضلهَا
2353- وَعَن أنس رَضِي الله عَنهُ أَن النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم ومعاذ رديفه على الرحل قَالَ يَا معَاذ بن جبل قَالَ لبيْك يَا رَسُول الله وَسَعْديك ثَلَاثًا
قَالَ مَا من أحد يشْهد أَن لَا إِلَه إِلَّا الله وَأَن مُحَمَّدًا رَسُول الله صدقا من قلبه إِلَّا حرمه الله على النَّار
قَالَ يَا رَسُول الله أَفلا أخبر بِهِ النَّاس فيستبشروا قَالَ إِذا يتكلوا وَأخْبر بهَا معَاذ عِنْد مَوته تأثما

رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم

تأثما أَي تحرجا من الْإِثْم وخوفا مِنْهُ أَن يلْحقهُ إِن كتمه
قَالَ المملي عبد الْعَظِيم وَقد ذهب طوائف من أساطين أهل الْعلم إِلَى أَن مثل هَذِه الإطلاقات الَّتِي وَردت فِيمَن قَالَ لَا إِلَه إِلَّا الله دخل الْجنَّة أَو حرم الله عَلَيْهِ النَّار
وَنَحْو ذَلِك إِنَّمَا كَانَ فِي ابْتِدَاء الْإِسْلَام حِين كَانَت الدعْوَة إِلَى مُجَرّد الْإِقْرَار بِالتَّوْحِيدِ فَلَمَّا فرضت الْفَرَائِض وحدت الْحُدُود نسخ ذَلِك والدلائل على هَذَا كَثِيرَة متظاهرة وَقد تقدم غير مَا حَدِيث يدل على ذَلِك فِي كتاب الصَّلَاة وَالزَّكَاة وَالصِّيَام وَالْحج وَيَأْتِي أَحَادِيث أخر مُتَفَرِّقَة إِن شَاءَ الله وَإِلَى هَذَا القَوْل ذهب الضَّحَّاك وَالزهْرِيّ وسُفْيَان الثَّوْريّ وَغَيرهم وَقَالَت طَائِفَة أُخْرَى لَا احْتِيَاج إِلَى ادِّعَاء النّسخ فِي ذَلِك فَإِن كل مَا هُوَ من أَرْكَان الدّين وفرائض الْإِسْلَام هُوَ من لَوَازِم الْإِقْرَار بِالشَّهَادَتَيْنِ وتتماته فَإِذا أقرّ ثمَّ امْتنع عَن شَيْء من الْفَرَائِض جحدا أَو تهاونا على تَفْصِيل الْخلاف فِيهِ حكمنَا عَلَيْهِ بالْكفْر وَعدم دُخُول الْجنَّة وَهَذَا القَوْل أَيْضا قريب وَقَالَت طَائِفَة أُخْرَى التَّلَفُّظ بِكَلِمَة التَّوْحِيد سَبَب يَقْتَضِي دُخُول الْجنَّة والنجاة من النَّار بِشَرْط أَن يَأْتِي بالفرائض ويجتنب الْكَبَائِر فَإِن لم يَأْتِ بالفرائض وَلم يجْتَنب الْكَبَائِر لم يمنعهُ التَّلَفُّظ بِكَلِمَة التَّوْحِيد من دُخُول النَّار وَهَذَا قريب مِمَّا قبله أَو هُوَ هُوَ
وَقد بسطنا الْكَلَام على هَذَا وَالْخلاف فِيهِ فِي غير مَا مَوضِع من كتبنَا وَالله سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى أعلم

হাদীসের ব্যাখ্যা:

বিখ্যাত সাহাবী হযরত মু'আয ইবনে জাবাল রাযি. একই বাহনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহযাত্রী ছিলেন। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে তিন তিনবার ডাক দেন এবং তিনিও প্রতিবার তাঁর ডাকে সাড়া দেন। তিনবার ডাকার উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলা হবে, সেদিকে তাঁর গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করা এবং সে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য তাঁকে সতর্ক ও সচেতন করে তোলা।

তারপর তিনি কালেমায়ে শাহাদাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা তুলে ধরলেন। বললেন, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল— এ সাক্ষ্য যে ব্যক্তি আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে প্রদান করবে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন। অর্থাৎ কবীরা গুনাহ না থাকলে তো সে আদৌ জাহান্নামে যাবে না; প্রথমেই জান্নাতে চলে যাবে। আর যদি কবীরা গুনাহ থাকে এবং আল্লাহ তা'আলা মাফ না করেন, তবে শুরুতে সেই গুনাহ পরিমাণ শাস্তি ভোগ করতে হবে। তারপর ঈমানের বদৌলতে অবশ্যই মুক্তি পাবে এবং জান্নাতের বাসিন্দা হয়ে যাবে।

কালেমায়ে শাহাদাতের এ গুরুত্ব দ্বারা আমলের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়নি। তাই আমলে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এ কারণেই হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি, যখন খুশি হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি মানুষকে এ সুসংবাদটি কি জানাব না? তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে এই বলে বারণ করলেন যে, না, তাহলে অনেকেই এর উপর ভরসা করে বসে থাকবে। অর্থাৎ তারা মনে করবে যে, কালেমায়ে শাহাদাত পড়লেই যখন জাহান্নাম হারাম হয়ে যায়, তখন আর আমলের প্রয়োজন কী? ব্যস এই ভেবে একদিকে তারা নেক আমল ছেড়ে দেবে, অন্যদিকে পাপকর্ম করতে উৎসাহ পাবে। অথচ পাপকর্ম ত্যাগ করা ও নেক আমলে যত্নবান থাকা অতীব জরুরি। কেননা পাপকর্ম যদি কবীরা গুনাহের পর্যায়ে হয় এবং তাতে লিপ্ত হওয়ার পর তাওবা ছাড়াই মৃত্যু হয়, তবে ঈমান থাকা সত্ত্বেও একটা কাল পর্যন্ত জাহান্নামে থাকার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা না করলে অবশ্যই তাকে শাস্তিভোগ করতে হবে। আর যদি কোনও গুনাহ নাও থাকে, তবুও বেশি বেশি নেক আমল আখিরাতে অনেক কাজে আসবে।

ঈমানের বদৌলতে জান্নাতলাভের পর যার যতো বেশি নেক আমল হবে, তার স্তর ততো বেশি উন্নত হবে। সুতরাং জান্নাতের উচ্চস্তর লাভের জন্য বেশি বেশি নেক আমল অবশ্যই করা চাই। কুরআন ও হাদীছ জান্নাতের উচ্চস্তর লাভের জন্য বিপুল উৎসাহ প্রদান করেছে। জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর হল জান্নাতুল ফিরদাওস। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আমাদেরকে জান্নাতুল ফিরদাওসই প্রার্থনা করতে উৎসাহ দিয়েছেন।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করার কারণে হযরত মু'আয রাযি. এ হাদীছটি সারা জীবন বর্ণনা করেননি। তবে মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় তিনি এটি বর্ণনা করে যান। এ হাদীছে তার কারণ বলা হয়েছে গুনাহের আশঙ্কা। কেননা দীনের কোনও বিষয় গোপন করা কঠিন গুনাহ । আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন–
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ 'নিশ্চয়ই যারা আমার নাযিলকৃত উজ্জ্বল নিদর্শনাবলি ও হিদায়াতকে গোপন করে, যদিও আমি কিতাবে তা মানুষের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছি, তাদের প্রতি আল্লাহ লানত বর্ষণ করেন এবং অন্যান্য লানতকারীগণও লানত বর্ষণ করে।

এ গুনাহ থেকে বাঁচার জন্যই তিনি মৃত্যুর আগে আগে হাদীছটি বর্ণনা করে যান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে যে এটি প্রচার করতে নিষেধ করেছিলেন তা দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল আমসাধারণের কাছে প্রচার করা, খাস লোকদের কাছে প্রচার করা নয়। কেননা খাস লোকদের কাছে প্রচার করলে তারা এর সত্যিকার মর্ম বুঝতে পারবে, ফলে তাদের দ্বারা আমলে শিথিলতা দেখা দেবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তো হাদীছটি তাঁকে (অর্থাৎ হযরত মু'আয রাযি.-কে) বলেছিলেন। তাই তিনিও এটি আমভাবে প্রচার না করে মৃত্যুর আগে আগে উপস্থিত লোকদের কাছে তা প্রকাশ করে যান।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রকাশ করার আগে উপস্থিত লোকদের মনোযোগ আকর্ষণ করা ও বক্তব্য বিষয়ের প্রতি তাদেরকে চৌকান্না করে তোলা চাই ।

খ. গুরুজনের ডাকে আদবের সঙ্গে সাড়া দেওয়া উচিত, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডাকে হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি. লাব্বায়কা ওয়া সা'দায়কা বলে সাড়া দিয়েছিলেন।

গ. কালেমায়ে শাহাদাত পাঠের সঙ্গে মৃত্যুবরণ দ্বারা অবশ্যই জাহান্নাম হারাম হয়ে যায়। তবে এই ভরসায় আমলে কিছুতেই গাফলাতি করা উচিত নয়।

ঘ. যে কথার প্রচার দ্বারা মানুষের মধ্যে আমলের প্রতি শৈথিল্য দেখা দিতে পারে, সাধারণভাবে তা কিছুতেই প্রচার করা উচিত নয়।

ঙ. দীনের জানা বিষয় গোপন করা কঠিন গুনাহ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান