আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
১৩. অধ্যায়ঃ কুরআন পাঠ
হাদীস নং: ২২৬৪
অধ্যায়ঃ কুরআন পাঠ
সূরা বাকারা ও আলে ইমরান পাঠের প্রতি উৎসাহ প্রদান এবং আলে ইমরানের শেষাংশ পাঠ করে যারা চিন্তা-গবেষণা করে না, তাদের প্রসঙ্গ
২২৬৪. হযরত উবায়দ ইবন উমায়ার (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি হযরত আয়েশা (রা)-কে বলেছিলেনঃ আপনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কি ব্যাপারটি দেখেছেন তা আমাদেরকে বলুন। উবায়দ বলেন, তিনি কতক্ষণ চুপ করে থাকলেন। অতঃপর বললেন, কোন এক রাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে বললেন, হে আয়েশা। আমাকে ছেড়ে দাও, আমি আজকের রাতটি আমার প্রতিপালকের ইবাদতে কাটিয়ে দেই। আমি বললাম, আল্লাহর শপথ। আমি আপনার সান্নিধ্যও ভালবাসি এবং আপনি যে জিনিসে খুশি হন, তাও পসন্দ করি। আয়েশা বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন উঠে উযূ করলেন। তারপর সালাতে প্রবৃত্ত হলেন। হযরত আয়েশা বলেন, তিনি (সালাতে) কাঁদতে থাকলেন, এমনকি তিনি তাঁর কোল ভিজিয়ে ফেললেন। তিনি বসা ছিলেন, আবার কাঁদতে থাকলেন, এমনকি দাঁড়ি ভিজিয়ে ফেললেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) আবারও কাঁদতে থাকলেন, এমনকি মাটি ভিজিয়ে ফেললেন। এমন সময় বিলাল (রা) তাঁকে (ফজরের) সালাতের ইত্তিলা দিতে আসলেন। তিনি যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে কান্নারত অবস্থায় দেখতে গেলেন, তখন বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ। আপনি কাঁদছেন। অথচ আল্লাহ্ আপনার পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তিনি বললেন, আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? আজ রাতে আমার প্রতি এমন একটি আয়াত নাযিল হয়েছে যে, যে ব্যক্তি এটি পাঠ করবে অথচ এতে চিন্তা-গবেষণা করবে না, তার জন্য ধ্বংস রয়েছে। আয়াতটি হলঃ إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ "নিশ্চয়ই আসমান-যমীনের সৃজনে জ্ঞানীদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে
(হাদীসটি ইবন হিব্বান তাঁর 'সহীহ' গ্রন্থে এবং অন্যান্যরাও বর্ণনা করেছেন।)
(হাদীসটি ইবন হিব্বান তাঁর 'সহীহ' গ্রন্থে এবং অন্যান্যরাও বর্ণনা করেছেন।)
كتاب قِرَاءَة الْقُرْآن
التَّرْغِيب فِي قِرَاءَة سُورَة الْبَقَرَة وَآل عمرَان وَمَا جَاءَ فِيمَن قَرَأَ آخر آل عمرَان فَلم يتفكر فِيهَا
2264- وَعَن عبيد بن عُمَيْر رَضِي الله عَنهُ أَنه قَالَ لعَائِشَة رَضِي الله عَنْهَا أَخْبِرِينَا بِأَعْجَب شَيْء رَأَيْته من رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ فَسَكَتَتْ ثمَّ قَالَت لما كَانَ لَيْلَة من اللَّيَالِي قَالَ يَا عَائِشَة ذَرِينِي أَتَعبد اللَّيْلَة لرَبي
قلت وَالله إِنِّي أحب قربك وَأحب مَا يَسُرك
قَالَت فَقَامَ فَتطهر ثمَّ قَامَ يُصَلِّي
قَالَت فَلم يزل يبكي حَتَّى بل حجره
قَالَت وَكَانَ جَالِسا فَلم يزل يبكي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم حَتَّى بل لحيته
قَالَت ثمَّ بَكَى حَتَّى بل الأَرْض فجَاء بِلَال يُؤذنهُ بِالصَّلَاةِ فَلَمَّا رَآهُ يبكي قَالَ يَا رَسُول الله تبْكي وَقد غفر الله لَك مَا تقدم من ذَنْبك وَمَا تَأَخّر قَالَ أَفلا أكون عبدا شكُورًا
لقد نزلت عَليّ اللَّيْلَة آيَة ويل لمن قَرَأَهَا وَلم يتفكر فِيهَا إِن فِي خلق السَّمَوَات وَالْأَرْض الْبَقَرَة 461 الْآيَة كلهَا
رَوَاهُ ابْن حبَان فِي صَحِيحه وَغَيره
قلت وَالله إِنِّي أحب قربك وَأحب مَا يَسُرك
قَالَت فَقَامَ فَتطهر ثمَّ قَامَ يُصَلِّي
قَالَت فَلم يزل يبكي حَتَّى بل حجره
قَالَت وَكَانَ جَالِسا فَلم يزل يبكي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم حَتَّى بل لحيته
قَالَت ثمَّ بَكَى حَتَّى بل الأَرْض فجَاء بِلَال يُؤذنهُ بِالصَّلَاةِ فَلَمَّا رَآهُ يبكي قَالَ يَا رَسُول الله تبْكي وَقد غفر الله لَك مَا تقدم من ذَنْبك وَمَا تَأَخّر قَالَ أَفلا أكون عبدا شكُورًا
لقد نزلت عَليّ اللَّيْلَة آيَة ويل لمن قَرَأَهَا وَلم يتفكر فِيهَا إِن فِي خلق السَّمَوَات وَالْأَرْض الْبَقَرَة 461 الْآيَة كلهَا
رَوَاهُ ابْن حبَان فِي صَحِيحه وَغَيره
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে 'ইবাদত-বন্দেগীতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাধনা ও মুজাহাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে তাঁর স্ত্রীগণই, যাঁরা কিনা আমাদের সম্মানিতা মা, সবচে' বেশি জানতেন। এ কারণে সাহাবায়ে কিরাম সে সম্পর্কে জানার জন্য তাঁদের দ্বারস্থ হতেন। তাঁর ব্যক্তিজীবনও উম্মতের জন্য আদর্শ। তাই সে সম্পর্কে জানাও অবশ্যকর্তব্য। তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ অকপটে তা মানুষের কাছে বর্ণনা করতেন।
এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, তিনি রাতের সময়টা কিভাবে কাটাতেন। আম্মাজান 'আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. জানান যে, তিনি রাতে এত লম্বা সময় নামাযে দাঁড়িয়ে থাকতেন, যাতে তাঁর পবিত্র পা ফুলে ও ফেটে যেত। কত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলে পা ফুলে ফেটে যেতে পারে, তা যে-কেউ অনুমান করতে পারে।
সাধারণত ধারণা করা হয়ে থাকে, যার যতবেশি গুনাহ তার ততবেশি ইবাদত করা দরকার, যাতে ইবাদতের অসিলায় তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো নিষ্পাপ ছিলেন। এ হিসেবে তো তাঁর এত বেশি ইবাদত বন্দেগীর প্রয়োজন থাকার কথা নয়। সম্ভবত তাই আম্মাজানের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, মা'সূম হওয়া সত্ত্বেও তিনি ‘ইবাদত-বন্দেগীতে এত কষ্ট কেন করেন? তিনি এর উত্তরে জানান, আমি কি আল্লাহর শোকরগুয়ার বান্দা হওয়া পসন্দ করব না? অর্থাৎ ‘ইবাদত বন্দেগী কেবল গুনাহ মাফের জন্যই নয়, শোকরগুযারীর জন্যও দরকার। আমি সেই শোকরগুযারীর জন্যই এত বেশি ‘ইবাদত-বন্দেগী করে থাকি।
এ হাদীছে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।
এক. এ হাদীছে দেখা যাচ্ছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘ইবাদত বন্দেগীতে স্বাভাবিক পরিমাণ অপেক্ষা বেশি কষ্ট করতেন। এত দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজ পড়তেন, যাতে তাঁর পা ফুলে ফেটে যেত। অথচ এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেছেনঃ-
خذوا من الأعمال ما تطيقون، فإن الله لا يمل حتى تملوا
“তোমরা এ পরিমাণে আমল করবে, যা করার সামর্থ্য তোমরা রাখ। কেননা আল্লাহ প্রতিদান দিতে ক্লান্তিবোধ করেন না (অর্থাৎ ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না), যাবত না তোমরা নিজেরা ক্লান্ত হও (অর্থাৎ আমল ছেড়ে দাও)।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১১৫১, ৫৮৬১, ৬৪৬৫ : সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৭৮২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৭৬২। সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২৩৭: মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪৩২৩, ২৫৪৩৯, ২৬০৩৮
এর দ্বারা বোঝা যায়, 'ইবাদতে মধ্যপন্থা রক্ষা করা উচিত। এত বেশি কষ্ট ও পরিশ্রম করা উচিত নয়, যাতে ক্লান্তি দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে তা ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল দেখা যাচ্ছে তার বিপরীত। তিনি নামাযে পা ফুলে ফেটে যাওয়ার কষ্ট পর্যন্ত স্বীকার করতেন। বাহ্যত এ দুই হাদীছের মধ্যে বিরোধ দেখা যাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে উভয় হাদীছের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা নিষেধ করা হয়েছে এমন কষ্টক্লেশ করতে, যাতে আমলে ক্লান্তি দেখা দেয় ও উদ্যম হারিয়ে যায়। এরূপ অবস্থা আমাদেরই হয়ে থাকে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হত না। নামায সম্পর্কে তিনি নিজের অবস্থা জানানঃ- جعلت قرة عيني في الصلاة “নামাযের মধ্যে আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে।মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২২৯৪; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০১২
কেবল নামাযেই নয়, যে-কোনও ‘ইবাদত-বন্দেগীতেই তাঁর আস্বাদ ও আনন্দ বোধ হত। তাতে মনে শান্তি ও স্বস্তি লাভ করতেন। ফলে শারীরিক যত কষ্টই হোক না কেন,‘ইবাদতে ক্লান্তি বোধ করতেন না ও উদ্যম হারাতেন না। কাজেই ‘ইবাদত-বন্দেগীতে অতিরিক্ত কষ্টক্লেশ করার নিষেধাজ্ঞা তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য কেবল আমাদের জন্য। হাঁ, তাঁর উম্মতের মধ্যে এমন লোকও ছিল, যারা রাতভর নফল নামায ও দিনে একটানা রোযা রেখেও ক্লান্তি বোধ করতেন না। ‘ইবাদত-বন্দেগীতে তাদের মনের প্রশান্তি শারীরিক কষ্টকে ছাপিয়ে যেত। এই শ্রেণির ‘ইবাদতগুয়ার লোকও উল্লিখিত নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত নয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের অন্তরেও ‘ইবাদতের স্বাদ ও আনন্দ দান করুন।
দুই. এ হাদীছে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগের ও পরের সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ ক্ষমার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সূরা ফাত্হে। তাতে ইরশাদ হয়েছেঃ-
إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِينًا لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ
অর্থ : (হে রাসূল!) নিশ্চয়ই আমি তোমাকে প্রকাশ্য বিজয় দান করেছি, যাতে আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত ত্রুটি ক্ষমা করেন।সূরা ফাত্হ, আয়াত ১-২
এর দ্বারা এ কথা মনে করার কোনও অবকাশ নেই যে, তাঁরও বুঝি কোনওরকম গুনাহ হয়ে যেত। কেননা আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল-জামা'আতের বিশ্বাস- নবীগণ মা'সূম হয়ে থাকেন। তাঁরা নবুওয়াতের আগে ও পরে কোনওরকম গুনাহ করেন না। সগীরা গুনাহও না, কবীরা গুনাহও না। আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও আল্লাহর সবচে' প্রিয় বান্দা। তাঁর কোনও গুনাহ করার প্রশ্নই আসে না। তা সত্ত্বেও যে তাঁর সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, এর দ্বারা মূলত ওই সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি বোঝানো উদ্দেশ্য, যা এমনিতে গুনাহ না হলেও তাঁর উচ্চ শান অনুযায়ী সমীচীন ছিল না। বলা হয়ে থাকে, সাধারণ মু'মিনদের জন্য যেসব কাজকে নেক কাজ মনে করা হয়, সেরকম কাজও ঘনিষ্ঠজনদের জন্য অন্যায়রূপে গণ্য হয়। তাদের কাছ থেকে আশা থাকে, তাদের যাবতীয় কাজ হবে আদর্শের উচ্চতর পরিমাপে উত্তীর্ণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সমস্ত কাজ সেই শান মোতাবেক হয়নি, সেদিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা চাইলে সেজন্য তাঁকে পাকড়াও করতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ তা না করে তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
কারও কারও মতে, এর দ্বারা এমনসব ত্রুটিবিচ্যুতি বোঝানো হয়েছে, যেগুলো তাঁর স্বাভাবিক মানবীয় দুর্বলতার কারণে হয়ে যেত। যেমন, নামাযের রাক'আতে ভুল হয়ে যাওয়া, গোসলের কথা ভুলে যাওয়া ইত্যাদি।
আগের ত্রুটিবিচ্যুতি বলতে সম্ভবত ওই সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি বোঝানো হয়েছে, যা ক্ষমার ঘোষণাদানের আগে হয়ে গিয়েছিল। আর পরের ত্রুটিবিচ্যুতি হল সেগুলো, যা ক্ষমার ঘোষণা দানের পরে হওয়ার ছিল। সুফয়ান ছাওরী রহ. বলেন, আগের ত্রুটিবিচ্যুতি হল- নবুওয়াত লাভের আগে যেগুলো হয়েছিল। আর পরের বলতে সেগুলোকে বোঝানো হয়েছে, যা নবুওয়াত লাভের পরে হয়েছিল।
তিন. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এত বেশি ‘ইবাদত-বন্দেগী কেন করেন, তার উত্তরে জানান যে, আমি কি আল্লাহর শোকরগুযার বান্দা হতে পছন্দ করব না? এর দ্বারা জানা গেল, ‘ইবাদত কেবল পাপ মার্জনার উদ্দেশ্যেই করা হয় না; বরং আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করাও ‘ইবাদতের একটি কারণ হতে পারে। সেই হিসেবে যার প্রতি আল্লাহর যতবেশি অনুগ্রহ হয়েছে এবং যে ব্যক্তি তাঁর যতবেশি নি'আমত লাভ করেছে, তার ততবেশি ‘ইবাদত-বন্দেগীতে যত্নবান হওয়া কর্তব্য হয়ে যায়।
বলাবাহুল্য, আল্লাহ তা'আলার নি'আমত সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামই লাভ করেছিলেন। নবুওয়াতের মহামর্যাদা এবং নবুওয়াত সংক্রান্ত বিশেষ গুণাবলি ছাড়াও আল্লাহ তা'আলা তাঁকে এমন বহু নি'আমত দান করেছিলেন, যা আর কারও নসিব হয়নি। এখানে যে তাঁর আগের ও পরের সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমার কথা বলা হচ্ছে, সেটিও তাঁর জন্য এক বিশেষ নি'আমত। এর শোকর আদায় করাও কর্তব্য ছিল। এই বহুবিধ নি'আমতের শোকর আদায়ার্থেই তিনি ‘ইবাদত-বন্দেগীতে এত কষ্টক্লেশ ও সাধনা-মুজাহাদা করতেন।
এর দ্বারা জানা গেল, শোকর আদায়ের একটা পন্থা ‘ইবাদত করাও। মানুষ সাধারণত মুখে কৃতজ্ঞতা জানানো ও আলহামদুলিল্লাহ পড়াকেই শোকর মনে করে থাকে। এটাও শোকর বটে, কিন্তু শোকর এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শোকর আদায় করতে হয় মন দ্বারাও। মনের শোকর হচ্ছে নি'আমতকে আল্লাহর দান বলে বিশ্বাস করা ও তাঁর মূল্য অনুভব করা। তৃতীয় প্রকারের শোকর হচ্ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আমল। তা নামায, রোযা, দান-সদাকা সবই হতে পারে। এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতজেগে 'ইবাদত করাকে শোকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বোঝা গেল শোকর আদায়ের এটাও একটা পন্থা।
এ হাদীছ দ্বারা ইবাদত-বন্দেগীর দুটি কারণ জানা গেল। একটি কারণ হল পাপাচার। অর্থাৎ পাপী ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার কাছে মাগফিরাত ও রহমত লাভের আশায় ‘ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হবে। দ্বিতীয় কারণ নি'আমতের শোকর আদায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনও পাপ ছিল না। তিনি ‘ইবাদত করতেন কেবল নি'আমতের শোকর আদায়ের জন্য। আমাদের পাপের কোনও অভাব নেই। আবার আল্লাহ তা'আলার অগণিত নি'আমতও দিনরাত ভোগ করছি। অর্থাৎ ‘ইবাদতের দুই কারণই আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। সে হিসেবে আমাদের কত বেশি ‘ইবাদত-বন্দেগী করা উচিত? কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে চরম গাফেল। এ হাদীছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের উচিত সব গাফলাতি ঝেড়ে ফেলা এবং পূর্ণ উদ্যমে সাধনা ও মুজাহাদায় লেগে পড়া। ‘ইবাদত-বন্দেগীর সাধনা। মনের অনিচ্ছা ও শরীরের অলসতা উপেক্ষা করে যত্নের সঙ্গে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের মুজাহাদা। এরূপ সাধনা মুজাহাদা করতে পারলে আল্লাহর কাছে গুনাহ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির আশা রাখা যায় এবং কিছুটা হলেও তাঁর শোকর আদায় সম্ভব হয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন, আমীন
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা এভাবে সাধনা ও মুজাহাদার উৎসাহ পাওয়া যায় যে, নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইবাদত-বন্দেগীতে এত কষ্ট স্বীকার করতেন, তখন এ ব্যাপারে আমাদের কতই না শ্রমসাধনা ব্যয় করা উচিত।
খ. এ হাদীছ দ্বারা নি'আমতের শোকর আদায়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
গ. নফল নামায পড়া, বিশেষত রাতজেগে তাহাজ্জুদ পড়া শোকর আদায়ের একটি উত্তম পন্থা।
ঘ. এ হাদীছ দ্বারা তাহাজ্জুদ নামাযের ফযীলতও জানা যায়। অনেক বড় ফযীলতের আমল বলেই তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এত দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে এ নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে ফেটে যেত।
ঙ. এ হাদীছ দ্বারা আরও একটি শিক্ষা পাওয়া যায় যে, দীনের কোনও বিষয়ে মনে খটকা দেখা দিলে আস্থাভাজন ‘আলেমের কাছে গিয়ে তার নিরসন করা উচিত।
এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, তিনি রাতের সময়টা কিভাবে কাটাতেন। আম্মাজান 'আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. জানান যে, তিনি রাতে এত লম্বা সময় নামাযে দাঁড়িয়ে থাকতেন, যাতে তাঁর পবিত্র পা ফুলে ও ফেটে যেত। কত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলে পা ফুলে ফেটে যেতে পারে, তা যে-কেউ অনুমান করতে পারে।
সাধারণত ধারণা করা হয়ে থাকে, যার যতবেশি গুনাহ তার ততবেশি ইবাদত করা দরকার, যাতে ইবাদতের অসিলায় তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো নিষ্পাপ ছিলেন। এ হিসেবে তো তাঁর এত বেশি ইবাদত বন্দেগীর প্রয়োজন থাকার কথা নয়। সম্ভবত তাই আম্মাজানের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, মা'সূম হওয়া সত্ত্বেও তিনি ‘ইবাদত-বন্দেগীতে এত কষ্ট কেন করেন? তিনি এর উত্তরে জানান, আমি কি আল্লাহর শোকরগুয়ার বান্দা হওয়া পসন্দ করব না? অর্থাৎ ‘ইবাদত বন্দেগী কেবল গুনাহ মাফের জন্যই নয়, শোকরগুযারীর জন্যও দরকার। আমি সেই শোকরগুযারীর জন্যই এত বেশি ‘ইবাদত-বন্দেগী করে থাকি।
এ হাদীছে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।
এক. এ হাদীছে দেখা যাচ্ছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘ইবাদত বন্দেগীতে স্বাভাবিক পরিমাণ অপেক্ষা বেশি কষ্ট করতেন। এত দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজ পড়তেন, যাতে তাঁর পা ফুলে ফেটে যেত। অথচ এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেছেনঃ-
خذوا من الأعمال ما تطيقون، فإن الله لا يمل حتى تملوا
“তোমরা এ পরিমাণে আমল করবে, যা করার সামর্থ্য তোমরা রাখ। কেননা আল্লাহ প্রতিদান দিতে ক্লান্তিবোধ করেন না (অর্থাৎ ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না), যাবত না তোমরা নিজেরা ক্লান্ত হও (অর্থাৎ আমল ছেড়ে দাও)।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১১৫১, ৫৮৬১, ৬৪৬৫ : সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৭৮২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৭৬২। সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২৩৭: মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪৩২৩, ২৫৪৩৯, ২৬০৩৮
এর দ্বারা বোঝা যায়, 'ইবাদতে মধ্যপন্থা রক্ষা করা উচিত। এত বেশি কষ্ট ও পরিশ্রম করা উচিত নয়, যাতে ক্লান্তি দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে তা ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল দেখা যাচ্ছে তার বিপরীত। তিনি নামাযে পা ফুলে ফেটে যাওয়ার কষ্ট পর্যন্ত স্বীকার করতেন। বাহ্যত এ দুই হাদীছের মধ্যে বিরোধ দেখা যাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে উভয় হাদীছের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা নিষেধ করা হয়েছে এমন কষ্টক্লেশ করতে, যাতে আমলে ক্লান্তি দেখা দেয় ও উদ্যম হারিয়ে যায়। এরূপ অবস্থা আমাদেরই হয়ে থাকে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হত না। নামায সম্পর্কে তিনি নিজের অবস্থা জানানঃ- جعلت قرة عيني في الصلاة “নামাযের মধ্যে আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে।মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২২৯৪; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০১২
কেবল নামাযেই নয়, যে-কোনও ‘ইবাদত-বন্দেগীতেই তাঁর আস্বাদ ও আনন্দ বোধ হত। তাতে মনে শান্তি ও স্বস্তি লাভ করতেন। ফলে শারীরিক যত কষ্টই হোক না কেন,‘ইবাদতে ক্লান্তি বোধ করতেন না ও উদ্যম হারাতেন না। কাজেই ‘ইবাদত-বন্দেগীতে অতিরিক্ত কষ্টক্লেশ করার নিষেধাজ্ঞা তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য কেবল আমাদের জন্য। হাঁ, তাঁর উম্মতের মধ্যে এমন লোকও ছিল, যারা রাতভর নফল নামায ও দিনে একটানা রোযা রেখেও ক্লান্তি বোধ করতেন না। ‘ইবাদত-বন্দেগীতে তাদের মনের প্রশান্তি শারীরিক কষ্টকে ছাপিয়ে যেত। এই শ্রেণির ‘ইবাদতগুয়ার লোকও উল্লিখিত নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত নয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের অন্তরেও ‘ইবাদতের স্বাদ ও আনন্দ দান করুন।
দুই. এ হাদীছে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগের ও পরের সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ ক্ষমার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সূরা ফাত্হে। তাতে ইরশাদ হয়েছেঃ-
إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِينًا لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ
অর্থ : (হে রাসূল!) নিশ্চয়ই আমি তোমাকে প্রকাশ্য বিজয় দান করেছি, যাতে আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত ত্রুটি ক্ষমা করেন।সূরা ফাত্হ, আয়াত ১-২
এর দ্বারা এ কথা মনে করার কোনও অবকাশ নেই যে, তাঁরও বুঝি কোনওরকম গুনাহ হয়ে যেত। কেননা আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল-জামা'আতের বিশ্বাস- নবীগণ মা'সূম হয়ে থাকেন। তাঁরা নবুওয়াতের আগে ও পরে কোনওরকম গুনাহ করেন না। সগীরা গুনাহও না, কবীরা গুনাহও না। আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও আল্লাহর সবচে' প্রিয় বান্দা। তাঁর কোনও গুনাহ করার প্রশ্নই আসে না। তা সত্ত্বেও যে তাঁর সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, এর দ্বারা মূলত ওই সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি বোঝানো উদ্দেশ্য, যা এমনিতে গুনাহ না হলেও তাঁর উচ্চ শান অনুযায়ী সমীচীন ছিল না। বলা হয়ে থাকে, সাধারণ মু'মিনদের জন্য যেসব কাজকে নেক কাজ মনে করা হয়, সেরকম কাজও ঘনিষ্ঠজনদের জন্য অন্যায়রূপে গণ্য হয়। তাদের কাছ থেকে আশা থাকে, তাদের যাবতীয় কাজ হবে আদর্শের উচ্চতর পরিমাপে উত্তীর্ণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সমস্ত কাজ সেই শান মোতাবেক হয়নি, সেদিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা চাইলে সেজন্য তাঁকে পাকড়াও করতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ তা না করে তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
কারও কারও মতে, এর দ্বারা এমনসব ত্রুটিবিচ্যুতি বোঝানো হয়েছে, যেগুলো তাঁর স্বাভাবিক মানবীয় দুর্বলতার কারণে হয়ে যেত। যেমন, নামাযের রাক'আতে ভুল হয়ে যাওয়া, গোসলের কথা ভুলে যাওয়া ইত্যাদি।
আগের ত্রুটিবিচ্যুতি বলতে সম্ভবত ওই সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি বোঝানো হয়েছে, যা ক্ষমার ঘোষণাদানের আগে হয়ে গিয়েছিল। আর পরের ত্রুটিবিচ্যুতি হল সেগুলো, যা ক্ষমার ঘোষণা দানের পরে হওয়ার ছিল। সুফয়ান ছাওরী রহ. বলেন, আগের ত্রুটিবিচ্যুতি হল- নবুওয়াত লাভের আগে যেগুলো হয়েছিল। আর পরের বলতে সেগুলোকে বোঝানো হয়েছে, যা নবুওয়াত লাভের পরে হয়েছিল।
তিন. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এত বেশি ‘ইবাদত-বন্দেগী কেন করেন, তার উত্তরে জানান যে, আমি কি আল্লাহর শোকরগুযার বান্দা হতে পছন্দ করব না? এর দ্বারা জানা গেল, ‘ইবাদত কেবল পাপ মার্জনার উদ্দেশ্যেই করা হয় না; বরং আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করাও ‘ইবাদতের একটি কারণ হতে পারে। সেই হিসেবে যার প্রতি আল্লাহর যতবেশি অনুগ্রহ হয়েছে এবং যে ব্যক্তি তাঁর যতবেশি নি'আমত লাভ করেছে, তার ততবেশি ‘ইবাদত-বন্দেগীতে যত্নবান হওয়া কর্তব্য হয়ে যায়।
বলাবাহুল্য, আল্লাহ তা'আলার নি'আমত সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামই লাভ করেছিলেন। নবুওয়াতের মহামর্যাদা এবং নবুওয়াত সংক্রান্ত বিশেষ গুণাবলি ছাড়াও আল্লাহ তা'আলা তাঁকে এমন বহু নি'আমত দান করেছিলেন, যা আর কারও নসিব হয়নি। এখানে যে তাঁর আগের ও পরের সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমার কথা বলা হচ্ছে, সেটিও তাঁর জন্য এক বিশেষ নি'আমত। এর শোকর আদায় করাও কর্তব্য ছিল। এই বহুবিধ নি'আমতের শোকর আদায়ার্থেই তিনি ‘ইবাদত-বন্দেগীতে এত কষ্টক্লেশ ও সাধনা-মুজাহাদা করতেন।
এর দ্বারা জানা গেল, শোকর আদায়ের একটা পন্থা ‘ইবাদত করাও। মানুষ সাধারণত মুখে কৃতজ্ঞতা জানানো ও আলহামদুলিল্লাহ পড়াকেই শোকর মনে করে থাকে। এটাও শোকর বটে, কিন্তু শোকর এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শোকর আদায় করতে হয় মন দ্বারাও। মনের শোকর হচ্ছে নি'আমতকে আল্লাহর দান বলে বিশ্বাস করা ও তাঁর মূল্য অনুভব করা। তৃতীয় প্রকারের শোকর হচ্ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আমল। তা নামায, রোযা, দান-সদাকা সবই হতে পারে। এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতজেগে 'ইবাদত করাকে শোকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বোঝা গেল শোকর আদায়ের এটাও একটা পন্থা।
এ হাদীছ দ্বারা ইবাদত-বন্দেগীর দুটি কারণ জানা গেল। একটি কারণ হল পাপাচার। অর্থাৎ পাপী ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার কাছে মাগফিরাত ও রহমত লাভের আশায় ‘ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হবে। দ্বিতীয় কারণ নি'আমতের শোকর আদায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনও পাপ ছিল না। তিনি ‘ইবাদত করতেন কেবল নি'আমতের শোকর আদায়ের জন্য। আমাদের পাপের কোনও অভাব নেই। আবার আল্লাহ তা'আলার অগণিত নি'আমতও দিনরাত ভোগ করছি। অর্থাৎ ‘ইবাদতের দুই কারণই আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। সে হিসেবে আমাদের কত বেশি ‘ইবাদত-বন্দেগী করা উচিত? কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে চরম গাফেল। এ হাদীছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের উচিত সব গাফলাতি ঝেড়ে ফেলা এবং পূর্ণ উদ্যমে সাধনা ও মুজাহাদায় লেগে পড়া। ‘ইবাদত-বন্দেগীর সাধনা। মনের অনিচ্ছা ও শরীরের অলসতা উপেক্ষা করে যত্নের সঙ্গে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের মুজাহাদা। এরূপ সাধনা মুজাহাদা করতে পারলে আল্লাহর কাছে গুনাহ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির আশা রাখা যায় এবং কিছুটা হলেও তাঁর শোকর আদায় সম্ভব হয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন, আমীন
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা এভাবে সাধনা ও মুজাহাদার উৎসাহ পাওয়া যায় যে, নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইবাদত-বন্দেগীতে এত কষ্ট স্বীকার করতেন, তখন এ ব্যাপারে আমাদের কতই না শ্রমসাধনা ব্যয় করা উচিত।
খ. এ হাদীছ দ্বারা নি'আমতের শোকর আদায়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
গ. নফল নামায পড়া, বিশেষত রাতজেগে তাহাজ্জুদ পড়া শোকর আদায়ের একটি উত্তম পন্থা।
ঘ. এ হাদীছ দ্বারা তাহাজ্জুদ নামাযের ফযীলতও জানা যায়। অনেক বড় ফযীলতের আমল বলেই তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এত দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে এ নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে ফেটে যেত।
ঙ. এ হাদীছ দ্বারা আরও একটি শিক্ষা পাওয়া যায় যে, দীনের কোনও বিষয়ে মনে খটকা দেখা দিলে আস্থাভাজন ‘আলেমের কাছে গিয়ে তার নিরসন করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)