আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১২. অধ্যায়ঃ জিহাদ

হাদীস নং: ২০৫৩
আল্লাহ্ তা'আলার পথে জিহাদে উৎসাহিতকরণ ও জিহাদে আহত হওয়া এবং জিহাদের সারিতে দু'আ করার ফযীলত প্রসঙ্গে
২০৫৩. হযরত উবাদা ইবনুস সামিত (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর কাছে ছিলাম। এমন সময় একজন লোক আসল। সে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ। সর্বোত্তম আমল কোনটি? রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: আল্লাহর উপর ঈমান আনা ও তাঁর রাস্তায় জিহাদ করা এবং পুণ্যময় হজ্জব্রত পালন করা। যখন লোকটি ফিরে চলল, তখন তিনি বললেন: তোমার জন্য এর চেয়েও সহজতর কাজ আছে। মানুষকে আহার্য দ্বারা আপ্যায়িত করা, নম্রকথা বলা এবং সদাচার। এবার যখন লোকটি ফিরে চলল, তখন তিনি বললেন, তোমার জন্য এর চেয়ে আরো সহজ কাজ আছে। কোন ব্যাপারে আল্লাহর যে ফয়সালা তোমার বিরুদ্ধে যায়, সে জন্য তার উপর অপবাদ আরোপ করবে না বরং আল্লাহর ফয়সালা (তাকদীর) সন্তুষ্টচিতে মেনে নিবে।
(হাদীসটি আহমদ ও তাবারানী দু'টি সনদে বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে একটি সনদ বিশুদ্ধ। বর্ণিত শব্দমালা তাবারানীর।)
التَّرْغِيب فِي الْجِهَاد فِي سَبِيل الله تَعَالَى وَمَا جَاءَ فِي فضل الْكَلم فِيهِ وَالدُّعَاء عِنْد الصَّفّ والقتال
2053 - وَعَن عبَادَة بن الصَّامِت رَضِي الله عَنهُ قَالَ بَيْنَمَا أَنا عِنْد رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِذْ جَاءَهُ رجل فَقَالَ يَا رَسُول الله أَي الْأَعْمَال أفضل قَالَ إِيمَان بِاللَّه وَجِهَاد فِي سَبيله وَحج مبرور فَلَمَّا ولى الرجل قَالَ وأهون عَلَيْك من ذَلِك إطْعَام الطَّعَام ولين الْكَلَام وَحسن الْخلق فَلَمَّا ولى الرجل قَالَ وأهون عَلَيْك من ذَلِك لَا تتهم الله على شَيْء
قَضَاهُ عَلَيْك

رَوَاهُ أَحْمد وَالطَّبَرَانِيّ بِإِسْنَادَيْنِ أَحدهمَا حسن وَاللَّفْظ لَهُ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

সাহাবায়ে কিরাম সৎকর্মের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। এমনিতে তো তাঁরা কোনও নেক কাজকে অবহেলা করতেন না, তা সত্ত্বেও ইসলামে যে কাজ যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার প্রতি বেশি গুরুত্বদান বাঞ্ছনীয় হওয়ায় তাঁরা সে জাতীয় কাজে বেশি আগ্রহী থাকতেন। তাই জানার প্রয়োজন ছিল ইসলাম তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব দেয় কোন্ কোন্ কাজে। এজন্যই তাঁরা বিভিন্ন সময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেন এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামও পরম মমতায় সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। আলোচ্য হাদীছটি সেরকমই প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত অতি মূলবান এক হাদীছ।

এ হাদীছে হযরত আবূ যার রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুটি প্রশ্ন করেছেন। তার মধ্যে প্রথম প্রশ্ন হল, কোন্ আমল সর্বোত্তম? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উত্তরে দু'টি আমলের কথা বলেছেন। তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান।

সর্বশ্রেষ্ঠ আমল আল্লাহর প্রতি ঈমান

বলা হয়েছে, সর্বশ্রেষ্ঠ আমল হল আল্লাহর প্রতি ঈমান। কেননা এটাই সমগ্র দীন ও শরী'আতের মূল ভিত্তি। আল্লাহর প্রতি ঈমান বলতে আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর একত্ব ও তাঁর গুণাবলির প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকে বোঝায়। তাঁর প্রতি ঈমানের একটা অংশ নবী রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাসও। আর নবী-রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাসের অর্থ হল মানুষের সামনে তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে যা-কিছু পেশ করেছেন তা সত্য বলে বিশ্বাস করা। এভাবে কিতাব, আখিরাত, হিসাবনিকাশ, ফিরিশতা, তাকদীর, জান্নাত-জাহান্নাম প্রভৃতি বিষয় সত্য বলে বিশ্বাস করাও আল্লাহর প্রতি ঈমানের মধ্যে পড়ে যায়। সুতরাং হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত মু'মিন বলতে এমন ব্যক্তিকেই বোঝাবে, যে ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনীত যাবতীয় বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস রাখে।

ঈমান যাবতীয় আমলের ভিত্তি। ঈমান ছাড়া কোনও আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু যাবতীয় আমল গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য ঈমান শর্ত, সেহেতু ঈমানই সর্বশ্রেষ্ঠ আমল বৈ কি।
ঈমানও এক আমল। এটা অন্তরের আমল। অন্তরের আরও অনেক আমল আছে, যেমন ইখলাস, তাকওয়া, আল্লাহর প্রতি সুধারণা, মানুষের কল্যাণকামনা ইত্যাদি। অন্তর এবং বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কিত যত প্রকার আমল আছে, সে সমুদয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আমল হচ্ছে ঈমান। ঈমান যেহেতু শ্রেষ্ঠ আমল, তাই এর প্রতিদানও সর্বশ্রেষ্ঠ। আর তা হচ্ছে স্থায়ী জান্নাত এবং দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টি। এরচে' বড় আর কোনও প্রতিদান হতে পারে না।

জিহাদের ফযীলত

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বোত্তম আমল হিসেবে জিহাদের কথাও উল্লেখ করেছেন। আভিধানিক অর্থে জিহাদ বলতে আল্লাহর পথে যে কোনও মেহনতকে বোঝায়। তবে শরী'আতে সাধারণত জিহাদ বলে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শত্রুর বিরুদ্ধে সসস্ত্র সংগ্রামকে। এর জন্য বিশেষ নিয়মনীতি ও শর্ত আছে। কুরআন ও হাদীছে জিহাদের অনেক ফযিলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদঃ-

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ

অর্থ : বস্তুত আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে এভাবে সারিবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করে, যেন তারা শিশাঢালা প্রাচীর।সূরা সাফ, আয়াত ৪
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছেঃ-

إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

অর্থ : বস্তুত আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও তাদের সম্পদ খরিদ করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে-এর বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। ফলে হত্যা করে ও নিহতও হয়। এটা এক সত্য প্ৰতিশ্ৰুতি, যার দায়িত্ব আল্লাহ তাওরাত ও ইনজীলেও নিয়েছেন এবং কুরআনেও। আল্লাহ অপেক্ষা বেশি প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা আল্লাহর সঙ্গে যে সওদা করেছ, সেই সওদার জন্য তোমরা আনন্দিত হও এবং এটাই মহা সাফল্য।সূরা তাওবা, আয়াত ১১১
জিহাদের ময়দানে কেউ নিহত হলে সে শহীদ বলে গণ্য হয়। শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছেঃ-

وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ فَرِحِينَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَيَسْتَبْشِرُونَ بِالَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُوا بِهِمْ مِنْ خَلْفِهِمْ أَلَّا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ يَسْتَبْشِرُونَ بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُؤْمِنِينَ

অর্থ : এবং (হে নবী!) যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে কখনওই মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত। তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের কাছে রিযিক দেওয়া হয়। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন, তারা তাতে প্রফুল্ল। আর তাদের পরে এখনও যারা (শাহাদাতের মাধ্যমে) তাদের সঙ্গে মিলিত হয়নি, তাদের ব্যাপারে এ কারণে তারা আনন্দ বোধ করে যে, (তারা যখন তাদের সঙ্গে এসে মিলিত হবে, তখন) তাদের কোনও ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। তারা আল্লাহর নি'আমত ও অনুগ্রহের কারণে আনন্দ উদযাপন করে এবং এ কারণেও যে, আল্লাহ মুমিনদের কর্মফল নষ্ট করেন না। সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৬৯-১৭১ ২.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-

والذي نفسي بيده! لولا أن رجالا من المؤمنين لا تطيب أنفسهم أن يتخلّفوا عنّي، ولا أجد ما أحملهم عليه، ما تخلفت عن سرية تغزو في سبيل الله والذي نفسي بيده! لوددت أني أقتل في سبيل الله، ثم أحيا ثم أقتل، ثم أحيا ثم أقتل، ثم أحيا ثم أقتل

“যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! যদি ওইসকল মু'মিন না থাকত, যাদের পক্ষে আমার সঙ্গে যোগদান না করাটা অপ্রীতিকর বোধ হত, আবার আমার কাছে এমন বাহনও নেই, যা তাদেরকে দেব (যাতে তারা আমার সঙ্গে যেতে পারে), তবে আল্লাহর পথে যে সকল যুদ্ধাভিযান চালানো হয়, আমি তার প্রতিটিতে অবশ্যই যোগদান করতাম। যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! আমার তো আকাঙ্ক্ষা হয় আমি আল্লাহর পথে নিহত হয়ে যাই, তারপর আবার আমাকে জীবিত করা হোক। তারপর আবার নিহত হই, তারপর আবার আমাকে জীবিত করা হোক। তারপর আবার নিহত হই, তারপর আবার আমাকে জীবিত করা হোক, তারপর আবার নিহত হই।”সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৭৯৭; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৭৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩৭৯৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯৪৮১
জিহাদের ফযীলত ও শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন মাজীদে বহু আয়াত রয়েছে। এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছও আছে প্রচুর। জিহাদ সম্পর্কিত বইপুস্তকে তা দেখা যেতে পারে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ঈমান যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ আমল, তাই নিজ ঈমানের হেফাজতে সর্বাপেক্ষা বেশি যত্নবান থাকা চাই।

খ. জিহাদের ব্যাপারে মনে মনে এই আশা রাখা জরুরি যে, যখনই যথাযথ শর্তানুযায়ী এর অবকাশ আসবে তাতে জানমাল দিয়ে শরীক থাকব ইনশাআল্লাহ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ২০৫৩ | মুসলিম বাংলা