আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
৮. অধ্যায়ঃ সদকা
হাদীস নং: ১২৩৩
ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি ভীতি প্রদর্শন, ধনী ব্যক্তির ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নেয়া হারাম হওয়া, লোভ-লালসার নিন্দা এবং লোভ-লালসা থেকে পবিত্র থাকা, অল্পে তুষ্টি এবং নিজ হাতে উপার্জিত বস্তু খাওয়ার প্রতি অনুপ্রেরণা
১২৩৩. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: ঐ ব্যক্তি মিসকীন নয়, যাকে দুই-একটি গ্রাস খাদ্য এবং দু'-একটি খেজুর এক দ্বার থেকে অন্য দ্বারে নেয়। বরং প্রকৃত মিসকীন সে-ই, যে অতটুকু সম্পদের অধিকারী নয়, যা তাকে অভাবমুক্ত করতে পারে এবং তার অবস্থাও বুঝা যায় না যে, সে গরীব, যদি বুঝা যেত তবে তাকে সদকা দেয়া হতো, অথচ সে লোকের কাছে সওয়াল করে না।
(বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
(বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
التَّرْهِيب من الْمَسْأَلَة وتحريمها مَعَ الْغنى وَمَا جَاءَ فِي ذمّ الطمع وَالتَّرْغِيب فِي التعفف والقناعة وَالْأكل من كسب يَده
1233 - وَعَن أبي هُرَيْرَة رَضِي الله عَنهُ أَن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ لَيْسَ الْمِسْكِين الَّذِي ترده اللُّقْمَة وَاللُّقْمَتَانِ وَالتَّمْرَة وَالتَّمْرَتَانِ وَلَكِن الْمِسْكِين الَّذِي لَا يجد غنى يُغْنِيه وَلَا يفْطن لَهُ فَيتَصَدَّق عَلَيْهِ وَلَا يقوم فَيسْأَل النَّاس
رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم
رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم
হাদীসের ব্যাখ্যা:
ইয়াতীম, কন্যাসন্তান, সর্বপ্রকার দুর্বল, গরীব-মিসকীন ও দুস্থ লোকদের প্রতি সদয় আচরণ,
তাদের প্রতি অনুগ্রহ ও মায়া-মমতা প্রদর্শন এবং তাদের সঙ্গে নম্র-কোমল আচরণ প্রসঙ্গ
ইয়াতীম, মিসকীন, দুস্থ ও দুর্বল শ্রেণীর লোক সমাজেরই অংশ। একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুষ্ঠু সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তাদেরকে বৃহত্তর সমাজের করে রাখা এবং সমাজনির্মাণে তাদেরকেও ভূমিকা রাখার সুযোগ দান করা জরুরি। এটা জরুরি কেবল দুনিয়াবী শান্তি-শৃঙ্খলার জন্যই নয়, তারচে'ও বেশি আখেরাতের নাজাত ও মুক্তির জন্য।
বলাবাহুল্য, এ দায়িত্ব বর্তায় সমাজের সচ্ছল ও সামর্থ্যবান অংশের উপর। তাদেরই কর্তব্য এদের মৌলিক অধিকারসমূহ সংরক্ষণের পাশাপাশি তাদের জীবনরক্ষা ও মানবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর সুবন্দোবস্ত করে দেওয়া। এ কর্তব্য পালনের উদ্যোগ কেবল তখনই গ্রহণ করা যায়, যখন অন্তরে তাদের প্রতি দয়ামায়া, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। তাই ইসলাম বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে মানুষের অন্তরে এসব গুণ সঞ্চারের চেষ্টা করেছে। ইসলামী শিক্ষায় এর এতবেশি গুরুত্ব যে, পরিপূর্ণ মুমিন ও মুসলিম হওয়ার জন্য এসব গুণ অর্জনকে অপরিহার্য করা হয়েছে এবং একে অতি বড় ছাওয়াবের বিষয় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ইয়াতীম ও বিধবা প্রভৃতির সাহায্য-সহযোগিতা করাকে জান্নাত লাভেরও একটি উপায় বলা হয়েছে। মোটকথা এরকম অসহায় শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা ও তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা আমাদের মহান দীনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক আমল। যেমন কুরআন মাজীদ, তেমনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছসমগ্র এ সম্পর্কিত শিক্ষায় ভরপুর।
المسكين -এর উৎপত্তি سكون থেকে, যার অর্থ স্থিরতা। এর থেকে গঠিত المسكين দ্বারা অতিরিক্ত গরীব বা হতদরিদ্রকে বোঝানো হয়। দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে যেন সে নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ফলে একদম স্থির হয়ে গেছে। যেমন সূরা বালাদে আছে- أَوْ مِسْكِينًا ذَا مَتْرَبَةٍ (অথবা দারিদ্র্য-নিষ্পেষিত নিঃস্বকে)। অর্থাৎ যে গরীব মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, তাকে আহার্য দান করা একটি উৎকৃষ্ট সৎকর্ম, যা দ্বারা জাহান্নামের ঘাঁটি অতিক্রম করা যায়।
মিসকীন যাকাত-সদাকা ব্যয়ের একটি খাত। তাছাড়াও তাদেরকে দান-খয়রাত করা একটি উত্তম নেক আমল, যার প্রতি বিভিন্ন হাদীছে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। লোকে সাধারণত মিসকীন দ্বারা এমনসব গরীবকে বোঝে, যারা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে হাত পেতে বেড়ায় ও ভিক্ষা করে। অনেকেই তাদেরকে দান-খয়রাত করে বা যাকাত দিয়ে মনে করে বাস মিসকীনকে দেওয়া হয়ে গেল। কিন্তু এ ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। কেননা এরাও মিসকীন বটে, কিন্তু প্রকৃত মিসকীন নয়। মানুষের এ ধারণা সংশোধনের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে প্রকৃত মিসকীনের পরিচয় দান করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন- প্রকৃত মিসকীন সেই, যে - (কঠিন অভাব-অনটনেও) কারও কাছে হাত পাতে না। অর্থাৎ যারা দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে বা ভিক্ষা করে বেড়ায়, বাস্তবিকপক্ষে তারা চরম দরিদ্র নাও হতে পারে। যাদের হাত পাতার অভ্যাস হয়ে যায়, তারা সামান্য অভাবেও অন্যের কাছে চাইতে লজ্জাবোধ করে না। এমনও হতে পারে যে, তার কাছে যে পরিমাণ টাকা-পয়সা আছে তা দিয়ে তার কিছুদিন চলে যাবে, কিন্তু তারপর চলবে কী করে সেই ভয়ে আগে থেকেই হাত পাতা শুরু করে দেয়।
দ্বিতীয়ত যারা দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে বা ভিক্ষা করে, তারা চরম পর্যায়ের গরীব হলেও দুয়ারে দুয়ারে ঘোরাটা একটা উপায় বটে, যা দ্বারা তারা ক্ষুধার কষ্ট মিটিয়ে ফেলে, যদিও ইসলামে এটা একটা নিন্দনীয় ও নিকৃষ্ট উপায়।
পক্ষান্তরে এমনকিছু লোক আছে, যারা দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও মানুষের কাছে হাত পাতে না। কেননা অন্যের কাছে হাত পাতার দ্বারা নিজের মনুষ্যত্বের অবমাননা হয়। তারা শত কষ্টেও সে অবমাননা স্বীকার করতে রাজি নয়। তারা ক্ষুধার কষ্ট স্বীকার করে, কিন্তু হাত পেতে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেয় না। এ হাদীছ বলছে, তারাই প্রকৃত মিসকীন।
হাদীছে আছে- إنما المسكين الذي يتعفف 'প্রকৃত মিসকীন সেই, যে (কঠিন অভাব-অনটনেও) কারও কাছে হাত পাতে না। يتعفف ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি عفة থেকে। عفة বলা হয় এমন চারিত্রিক দৃঢ়তাকে, যা ব্যক্তিকে ইন্দ্রিয়পরবশ হওয়া থেকে রক্ষা করে, তাকে মনের খেয়াল-খুশির বশীভূত দেয় না। যে ব্যক্তি সাধনা ও মুজাহাদা দ্বারা এরকম চারিত্রিক দৃঢ়তা অর্জনে সক্ষম হয়, তাকে متعفف বলে। সুতরাং يتعفف দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে, সে অভাবক্লিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও মনের ইচ্ছার বশীভূত হয়ে অন্যের কাছে নিজের অভাব প্রকাশ করে না। যেমন হাদীছে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে ولكن المسكين الذي لا يجد غنى يغنيه، ولا يفطن به فيتصدق عليه، ولا يقوم فيسأل الناس (বরং প্রকৃত মিসকীন সেই, যার এমন সামর্থ্য নেই, যা তার প্রয়োজন মেটাবে। আবার তার সম্পর্কে জানাও যায় না যে, তাকে কিছু দান-সদাকা করা হবে এবং সে উঠে মানুষের কাছে সাওয়ালও করে না)। যে ব্যক্তি অন্যের কাছে সাওয়াল করে, তার তো সাওয়াল দ্বারা প্রয়োজন মিটে যায়। পক্ষান্তরে যে গরীব সাওয়ালও করে না আবার ভাবভঙ্গি দ্বারা অন্যের কাছে নিজ অভাব-অনটন প্রকাশও করে না, তার প্রয়োজন কিভাবে মিটবে? তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন যে, এরূপ ব্যক্তিই প্রকৃত মিসকীন। অর্থাৎ তোমাদের কর্তব্য নিজ উদ্যোগে এরূপ ব্যক্তিদের খুঁজে খুঁজে বের করা এবং আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের অভাব মোচনে সহযোগিতা করা।
এ হাদীছ দ্বারা যারা ভিক্ষা করে বা হাত পাতে, তাদের মিসকীন হওয়াকে অস্বীকার করা হয়নি; বরং মিসকীন হিসেবে দান-খয়রাত পাওয়ার কে বেশি হকদার সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন। স্পষ্টই বোঝা গেল যে, এর বেশি হকদার তারাই, যারা কারও কাছে হাত পাতে না ও অভাবের কথা প্রকাশও করে না; বরং অন্যের কাছ থেকে তা লুকানোর চেষ্টা করে।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণী ভিক্ষাবৃত্তি রোধের এক সুন্দর নির্দেশনা। সচ্ছল মুসলিমগণ যদি প্রকৃত অভাব-অনটনদের খুঁজে খুঁজে সাহায্য সহযোগিতা করতে অভ্যস্ত হত, তবে ভিক্ষুকগণ ক্রমান্বয়ে ভিক্ষা করার উৎসাহ হারাত। একপর্যায়ে সমাজ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল হয়ে যেত। আজ সমাজের সর্বত্র এ নিন্দনীয় কর্মটির বিস্তার ঘটেছে। বলা যায়, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত অধিকাংশ লোকই যেন আপন আপন অবস্থান থেকে এ কর্মে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে কঠোরভাবে এ হাদীছের অনুসরণ করতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ সচ্ছল ব্যক্তিদেরকে প্রকৃত গরীবদের খুঁজে বের করে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করতে উৎসাহ যোগায়।
খ. মুসলিম ব্যক্তি অভাব-অনটনে যতই জর্জরিত হোক না কেন, অন্যের কাছে তার ভিক্ষার হাত বাড়ানো সাজে না। কেননা তাতে ঈমানী ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় ও মনুষ্যত্বের মর্যাদা হয় ভূলুণ্ঠিত।
গ. ভিক্ষুককে খালিহাতে ফেরানো ঠিক নয়। এক-দু'টি খেজুর, এক-দুই লোকমা খাবার তথা সামান্য কিছু হলেও দেওয়া চাই।
তাদের প্রতি অনুগ্রহ ও মায়া-মমতা প্রদর্শন এবং তাদের সঙ্গে নম্র-কোমল আচরণ প্রসঙ্গ
ইয়াতীম, মিসকীন, দুস্থ ও দুর্বল শ্রেণীর লোক সমাজেরই অংশ। একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুষ্ঠু সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তাদেরকে বৃহত্তর সমাজের করে রাখা এবং সমাজনির্মাণে তাদেরকেও ভূমিকা রাখার সুযোগ দান করা জরুরি। এটা জরুরি কেবল দুনিয়াবী শান্তি-শৃঙ্খলার জন্যই নয়, তারচে'ও বেশি আখেরাতের নাজাত ও মুক্তির জন্য।
বলাবাহুল্য, এ দায়িত্ব বর্তায় সমাজের সচ্ছল ও সামর্থ্যবান অংশের উপর। তাদেরই কর্তব্য এদের মৌলিক অধিকারসমূহ সংরক্ষণের পাশাপাশি তাদের জীবনরক্ষা ও মানবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর সুবন্দোবস্ত করে দেওয়া। এ কর্তব্য পালনের উদ্যোগ কেবল তখনই গ্রহণ করা যায়, যখন অন্তরে তাদের প্রতি দয়ামায়া, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। তাই ইসলাম বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে মানুষের অন্তরে এসব গুণ সঞ্চারের চেষ্টা করেছে। ইসলামী শিক্ষায় এর এতবেশি গুরুত্ব যে, পরিপূর্ণ মুমিন ও মুসলিম হওয়ার জন্য এসব গুণ অর্জনকে অপরিহার্য করা হয়েছে এবং একে অতি বড় ছাওয়াবের বিষয় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ইয়াতীম ও বিধবা প্রভৃতির সাহায্য-সহযোগিতা করাকে জান্নাত লাভেরও একটি উপায় বলা হয়েছে। মোটকথা এরকম অসহায় শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা ও তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা আমাদের মহান দীনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক আমল। যেমন কুরআন মাজীদ, তেমনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছসমগ্র এ সম্পর্কিত শিক্ষায় ভরপুর।
المسكين -এর উৎপত্তি سكون থেকে, যার অর্থ স্থিরতা। এর থেকে গঠিত المسكين দ্বারা অতিরিক্ত গরীব বা হতদরিদ্রকে বোঝানো হয়। দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে যেন সে নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ফলে একদম স্থির হয়ে গেছে। যেমন সূরা বালাদে আছে- أَوْ مِسْكِينًا ذَا مَتْرَبَةٍ (অথবা দারিদ্র্য-নিষ্পেষিত নিঃস্বকে)। অর্থাৎ যে গরীব মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, তাকে আহার্য দান করা একটি উৎকৃষ্ট সৎকর্ম, যা দ্বারা জাহান্নামের ঘাঁটি অতিক্রম করা যায়।
মিসকীন যাকাত-সদাকা ব্যয়ের একটি খাত। তাছাড়াও তাদেরকে দান-খয়রাত করা একটি উত্তম নেক আমল, যার প্রতি বিভিন্ন হাদীছে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। লোকে সাধারণত মিসকীন দ্বারা এমনসব গরীবকে বোঝে, যারা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে হাত পেতে বেড়ায় ও ভিক্ষা করে। অনেকেই তাদেরকে দান-খয়রাত করে বা যাকাত দিয়ে মনে করে বাস মিসকীনকে দেওয়া হয়ে গেল। কিন্তু এ ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। কেননা এরাও মিসকীন বটে, কিন্তু প্রকৃত মিসকীন নয়। মানুষের এ ধারণা সংশোধনের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে প্রকৃত মিসকীনের পরিচয় দান করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন- প্রকৃত মিসকীন সেই, যে - (কঠিন অভাব-অনটনেও) কারও কাছে হাত পাতে না। অর্থাৎ যারা দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে বা ভিক্ষা করে বেড়ায়, বাস্তবিকপক্ষে তারা চরম দরিদ্র নাও হতে পারে। যাদের হাত পাতার অভ্যাস হয়ে যায়, তারা সামান্য অভাবেও অন্যের কাছে চাইতে লজ্জাবোধ করে না। এমনও হতে পারে যে, তার কাছে যে পরিমাণ টাকা-পয়সা আছে তা দিয়ে তার কিছুদিন চলে যাবে, কিন্তু তারপর চলবে কী করে সেই ভয়ে আগে থেকেই হাত পাতা শুরু করে দেয়।
দ্বিতীয়ত যারা দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে বা ভিক্ষা করে, তারা চরম পর্যায়ের গরীব হলেও দুয়ারে দুয়ারে ঘোরাটা একটা উপায় বটে, যা দ্বারা তারা ক্ষুধার কষ্ট মিটিয়ে ফেলে, যদিও ইসলামে এটা একটা নিন্দনীয় ও নিকৃষ্ট উপায়।
পক্ষান্তরে এমনকিছু লোক আছে, যারা দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও মানুষের কাছে হাত পাতে না। কেননা অন্যের কাছে হাত পাতার দ্বারা নিজের মনুষ্যত্বের অবমাননা হয়। তারা শত কষ্টেও সে অবমাননা স্বীকার করতে রাজি নয়। তারা ক্ষুধার কষ্ট স্বীকার করে, কিন্তু হাত পেতে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেয় না। এ হাদীছ বলছে, তারাই প্রকৃত মিসকীন।
হাদীছে আছে- إنما المسكين الذي يتعفف 'প্রকৃত মিসকীন সেই, যে (কঠিন অভাব-অনটনেও) কারও কাছে হাত পাতে না। يتعفف ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি عفة থেকে। عفة বলা হয় এমন চারিত্রিক দৃঢ়তাকে, যা ব্যক্তিকে ইন্দ্রিয়পরবশ হওয়া থেকে রক্ষা করে, তাকে মনের খেয়াল-খুশির বশীভূত দেয় না। যে ব্যক্তি সাধনা ও মুজাহাদা দ্বারা এরকম চারিত্রিক দৃঢ়তা অর্জনে সক্ষম হয়, তাকে متعفف বলে। সুতরাং يتعفف দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে, সে অভাবক্লিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও মনের ইচ্ছার বশীভূত হয়ে অন্যের কাছে নিজের অভাব প্রকাশ করে না। যেমন হাদীছে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে ولكن المسكين الذي لا يجد غنى يغنيه، ولا يفطن به فيتصدق عليه، ولا يقوم فيسأل الناس (বরং প্রকৃত মিসকীন সেই, যার এমন সামর্থ্য নেই, যা তার প্রয়োজন মেটাবে। আবার তার সম্পর্কে জানাও যায় না যে, তাকে কিছু দান-সদাকা করা হবে এবং সে উঠে মানুষের কাছে সাওয়ালও করে না)। যে ব্যক্তি অন্যের কাছে সাওয়াল করে, তার তো সাওয়াল দ্বারা প্রয়োজন মিটে যায়। পক্ষান্তরে যে গরীব সাওয়ালও করে না আবার ভাবভঙ্গি দ্বারা অন্যের কাছে নিজ অভাব-অনটন প্রকাশও করে না, তার প্রয়োজন কিভাবে মিটবে? তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন যে, এরূপ ব্যক্তিই প্রকৃত মিসকীন। অর্থাৎ তোমাদের কর্তব্য নিজ উদ্যোগে এরূপ ব্যক্তিদের খুঁজে খুঁজে বের করা এবং আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের অভাব মোচনে সহযোগিতা করা।
এ হাদীছ দ্বারা যারা ভিক্ষা করে বা হাত পাতে, তাদের মিসকীন হওয়াকে অস্বীকার করা হয়নি; বরং মিসকীন হিসেবে দান-খয়রাত পাওয়ার কে বেশি হকদার সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন। স্পষ্টই বোঝা গেল যে, এর বেশি হকদার তারাই, যারা কারও কাছে হাত পাতে না ও অভাবের কথা প্রকাশও করে না; বরং অন্যের কাছ থেকে তা লুকানোর চেষ্টা করে।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণী ভিক্ষাবৃত্তি রোধের এক সুন্দর নির্দেশনা। সচ্ছল মুসলিমগণ যদি প্রকৃত অভাব-অনটনদের খুঁজে খুঁজে সাহায্য সহযোগিতা করতে অভ্যস্ত হত, তবে ভিক্ষুকগণ ক্রমান্বয়ে ভিক্ষা করার উৎসাহ হারাত। একপর্যায়ে সমাজ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল হয়ে যেত। আজ সমাজের সর্বত্র এ নিন্দনীয় কর্মটির বিস্তার ঘটেছে। বলা যায়, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত অধিকাংশ লোকই যেন আপন আপন অবস্থান থেকে এ কর্মে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে কঠোরভাবে এ হাদীছের অনুসরণ করতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ সচ্ছল ব্যক্তিদেরকে প্রকৃত গরীবদের খুঁজে বের করে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করতে উৎসাহ যোগায়।
খ. মুসলিম ব্যক্তি অভাব-অনটনে যতই জর্জরিত হোক না কেন, অন্যের কাছে তার ভিক্ষার হাত বাড়ানো সাজে না। কেননা তাতে ঈমানী ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় ও মনুষ্যত্বের মর্যাদা হয় ভূলুণ্ঠিত।
গ. ভিক্ষুককে খালিহাতে ফেরানো ঠিক নয়। এক-দু'টি খেজুর, এক-দুই লোকমা খাবার তথা সামান্য কিছু হলেও দেওয়া চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
