আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

৮. অধ্যায়ঃ সদকা

হাদীস নং: ১২১৫
ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি ভীতি প্রদর্শন, ধনী ব্যক্তির ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নেয়া হারাম হওয়া, লোভ-লালসার নিন্দা এবং লোভ-লালসা থেকে পবিত্র থাকা, অল্পে তুষ্টি এবং নিজ হাতে উপার্জিত বস্তু খাওয়ার প্রতি অনুপ্রেরণা
১২১৫. হযরত হাকীম ইবন হিযাম (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে কিছু চাইলাম, তিনি আমাকে দান করলেন। আমি আবার চাইলাম, তিনি আমাকে আবার দান করলেন। আমি আবার চাইলাম, তিনি আমাকে আবার দান করলেন। এরপর তিনি বললেনঃ হে হাকীম। এই সম্পদ হচ্ছে সবুজ মিষ্টি ঘাসের ন্যায়, যে তা বিনালোভে গ্রহণ করবে, তাতে তাকে বরকত দেওয়া হবে। আর যে তা লোভের সাথে গ্রহণ করবে, তাতে তাকে বরকত দেওয়া হবে না। সে (প্রকৃতপক্ষে) ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে খায় অথচ তৃপ্ত হয় না। আর উপরের হাত (দাতার হাত) নীচের হাত (গ্রহীতার হাত) অপেক্ষা উত্তম। হাকীম (রা) বলেন, আমি বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর শপথ! যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, আপনার পর দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়া পর্যন্ত আমি কারও কাছে কিছু চেয়ে কাউকে কষ্ট দেব না। হযরত আবূ বকর (রা) হাকীম (রা)-কে দান গ্রহণের জন্য ডাকতেন, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতেন না। অতঃপর উমর (রা) হাকীম (রা)-কে ডেকে দান গ্রহণ করতে বললে তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বললেনঃ হে মুসলিম উম্মাহ! আমি তোমাদের কাছে হাকীমের ব্যাপারে এই মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এই যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, আমি তাকে তার হক দিতে চাইলে সে তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। নবী ((সা) এর ইনতিকালের পর মৃত্যু পর্যন্ত হাকীম (রা) কোন মানুষের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করেন নি।
(হাদীসটি বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং নাসাঈ সংক্ষেপে উদ্ধৃত করেন।)
التَّرْهِيب من الْمَسْأَلَة وتحريمها مَعَ الْغنى وَمَا جَاءَ فِي ذمّ الطمع وَالتَّرْغِيب فِي التعفف والقناعة وَالْأكل من كسب يَده
1215 - وَعَن حَكِيم بن حزَام رَضِي الله عَنهُ قَالَ سَأَلت رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فَأَعْطَانِي ثمَّ سَأَلته فَأَعْطَانِي ثمَّ سَأَلته فَأَعْطَانِي ثمَّ قَالَ يَا حَكِيم هَذَا المَال خضر حُلْو فَمن أَخذه بسخاوة نفس بورك لَهُ فِيهِ وَمن أَخذه بإشراف نفس لم يُبَارك لَهُ فِيهِ وَكَانَ كَالَّذي يَأْكُل وَلَا يشْبع وَالْيَد الْعليا خير من الْيَد السُّفْلى
قَالَ حَكِيم فَقلت يَا رَسُول الله وَالَّذِي بَعثك بِالْحَقِّ لَا أرزأ أحدا بعْدك شَيْئا حَتَّى أُفَارِق الدُّنْيَا فَكَانَ أَبُو بكر رَضِي الله عَنهُ يَدْعُو حكيما ليعطيه الْعَطاء فيأبى أَن يقبل مِنْهُ شَيْئا ثمَّ إِن عمر رَضِي الله عَنهُ دَعَاهُ ليعطيه فَأبى أَن يقبله فَقَالَ يَا معشر الْمُسلمين أشهدكم على حَكِيم أَنِّي أعرض عَلَيْهِ حَقه الَّذِي قسم الله لَهُ فِي هَذَا الْفَيْء فيأبى أَن يَأْخُذهُ وَلم يرزأ حَكِيم أحدا من النَّاس بعد النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم حَتَّى توفّي رَضِي الله عَنهُ

رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم وَالتِّرْمِذِيّ وَالنَّسَائِيّ بِاخْتِصَار

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত হাকীম ইবন হিযাম রাযি. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পরপর তিনবার চেয়েছেন। তিনি তিনবারই তাঁকে দিয়েছেন। তৃতীয়বার দেওয়ার পর তাঁকে অত্যন্ত মূল্যবান নসীহত করেছেন। সে নসীহতে সর্বপ্রথম বলেন-
يَا حَكِيْمُ، إِنَّ هذَا الْمَالَ خَضِرٌ حُلْو (হে হাকীম! এ সম্পদ চাকচিক্যময় ও সুমিষ্ট)। خضِرٌ-এর মূল অর্থ সবুজ, টাটকা, তাজা। حُلْو মানে মিষ্ট। এর দ্বারা দুনিয়ার ধন-সম্পদকে টাটকা, সুমিষ্ট ফলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এরূপ ফল দুই কারণে আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। এক তো তার সজীবতা, দ্বিতীয়ত মিষ্টতা। দুনিয়ার মালামালের মধ্যেও এ দু'টি গুণ আছে। দুনিয়ার ধন-সম্পদ দেখতে মনোহর এবং তা উপভোগ্য। তাই মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়। এ আকর্ষণ মানুষের জন্য পরীক্ষা। লক্ষ করা হয় সে এর আকর্ষণে পড়ে দুনিয়ার প্রতি লোভাতুর হয়ে যায়, নাকি এর আকর্ষণ উপেক্ষা করে আখিরাতমুখী জীবনযাপন করে। ইহজীবনে দুনিয়ার সম্পদ প্রয়োজনীয় বটে, কিন্তু দৃষ্টিকে প্রয়োজন পূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা জরুরি। একে জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানানো কিছুতেই উচিত নয়। লক্ষ্যবস্তু থাকবে আখিরাত। দুনিয়ার প্রতি থাকতে হবে নির্মোহ। সুতরাং পরবর্তী বাক্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
فَمَنْ أَخَذَهُ بِسَخَاوَةِ نَفْسٍ بُورِكَ لَهُ فِيْهِ (যে ব্যক্তি এটা গ্রহন করে মনের ঐশ্বর্যের সঙ্গে, তাকে এতে বরকত দেওয়া হয়)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি সম্পদের লোভে পড়ে না, এর আকর্ষণ থেকে মনকে মুক্ত রাখে, দৃষ্টি থাকে আখিরাতের দিকে, সেদিকে লক্ষ করে দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদকে তুচ্ছ মনে করে এবং প্রয়োজন পূরণের জন্য সম্পদ অর্জনে বৈধতার সীমা রক্ষা করে ও অবৈধতা থেকে দূরে থাকে, আল্লাহ তা'আলা তার উপার্জিত সম্পদে বরকত দান করেন। অর্থাৎ বৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ অল্প হলেও তা দ্বারা তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেন এবং তার ক্ষতি থেকে তাকে রক্ষা করেন।

وَمَنْ أَخَذَهُ بِإِشرَافِ نَفْسٍ لَمْ يُبَارَكْ لَهُ فِيْهِ (আর যে ব্যক্তি এটা গ্রহন করে মনের আসক্তির সঙ্গে, তাকে এতে বরকত দেওয়া হয় না)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি লোভ-লালসার সঙ্গে অর্থ-সম্পদ কামাই করে, তার অর্জিত সম্পদ তার পক্ষে কল্যাণকর হয় না। তা দ্বারা তার চাহিদা মেটে না। যত বেশি কামাই করে, ততোই তার চাহিদা বাড়তে থাকে। ধন-সম্পদ তার বহুবিধ ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
وَكَانَ كَالَّذِي يَأْكُلُ وَلَا يَشْبَعُ (সে ওই ব্যক্তির মতো হয়, যে খায় অথচ পরিতৃপ্ত হয় না)। এটা এক রকম রোগ। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কিছুতেই ক্ষুধা মেটে না। খেতে খেতে তার পেট ভরে যায়, তারপরও খাওয়ার চাহিদা থেকে যায়। ফলে আরও খায়। অতিরিক্ত খাওয়ার দরুন সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, অথচ খাওয়ার চাহিদা যেমনটা তেমনি থেকে যায়। তো এ ব্যক্তির যেমন পেটের ক্ষুধা মেটে না, তেমনি লোভাতুর ব্যক্তিরও চোখের ও মনের ক্ষুধা মেটে না। ফলে সম্পদ তার পক্ষে শান্তি ও স্বস্তির কারণ না হয়ে অশান্তি ও অস্থিরতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য সম্পদের লোভে না পড়ে যুহদ ও নির্মোহ জীবনে অভ্যস্ত হওয়া।

লক্ষণীয়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত হাকীম ইবন হিযাম রাযি.-কে এ উপদেশ দিয়েছেন তৃতীয়বার দেওয়ার পর। অর্থাৎ হযরত হাকীম রাযি. তাঁর কাছে গনীমতের মাল তিনবার চেয়েছেন এবং তিনবারই তিনি তাঁকে তা দিয়েছেন। তৃতীয়বার দেওয়ার পর তাঁকে এ উপদেশটি দিয়েছেন। এটাই উপদেশ দেওয়ার কার্যকর পন্থা। তৃতীয়বার তিনি যদি না দিতেন, তবে হযরত হাকীম রাযি.-এর মনে না পাওয়ার একটা বেদনা থেকে যেত। এ অবস্থায় উপদেশ দিলে তা তাঁর অন্তরে ভালো রেখাপাত করত না। তৃতীয়বার পাওয়ার পর যখন তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন, তখন উপদেশ দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে। তাঁর সন্তুষ্ট মন এখন উপদেশ শুনতে আগ্রহী হবে। সুতরাং তিনি পরম আগ্রহেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপদেশ শুনেছেন এবং যথাযথভাবে তা গ্রহণও করে নিয়েছেন।

বস্তুত অর্থ-সম্পদের লোভ খুবই মন্দ একটি চরিত্র। এর ফলে মনে কৃপণতা জন্ম নেয়। এরূপ চরিত্রের লোক প্রতিযোগিতার সঙ্গে অর্থ সঞ্চয়ে লিপ্ত থাকে। তার পক্ষে কল্যাণকর খাতে তা ব্যয় করা সম্ভব হয় না। সম্পদ বাড়ানোর লক্ষ্যে এমনকি অন্যের কাছে হাত পাততেও সে দ্বিধাবোধ করে না। অথচ অন্যের কাছ থেকে গ্রহণ করার দ্বারা ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। অন্যদিকে কমে যাবে এই ভয়ে জরুরি খাতেও খরচ করতে পারে না। অথচ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে খরচ করার মধ্যেই মানুষের মহত্ত্ব। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খরচের মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে এরপরই ইরশাদ করেন-
وَالْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلى (উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম)। উপরের হাত হল দাতার হাত, আর নিচের হাত গ্রহীতার হাত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- وَالْيَدُ الْعُلْيَا هِيَ الْمُنْفِقَةُ ، وَالسُّفْلَى هِيَ السَّائِلَةُ (উপরের হাত হল দাতার হাত আর নিচের হাত হল যাচনাকারীর হাত) সহীহ বুখারী : ১৪২৯; সহীহ মুসলিম: ১০৩৩; সুনানে নাসাঈ: ২৫৩৩; সুনানে আবু দাউদ: ১৬৪৮; মুসনাদে আহমাদ: ৫৩৪৪; শু'আবুল ঈমান: ৩২২৯; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৬১৪। দান করার সময় দাতার হাত গ্রহীতার হাতের উপরে থাকে, আর গ্রহীতার হাত থাকে নিচে। উপর ও নিচের এ অবস্থাটা কেবল বাহ্যদৃষ্টিতেই নয়; বরং মর্যাদাগত দিক থেকেও বিষয়টা এরকমই। সে কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরের হাতকে অর্থাৎ দাতার হাতকে নিচের হাত বা গ্রহীতার হাতের তুলনায় উত্তম বলেছেন। এর দ্বারা ইঙ্গিত করছেন যে, তুমি দাতা হও, অন্যকে দান-খয়রাত করো, গ্রহীতা হয়ো না ও অন্যের কাছে হাত পেতো না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপদেশ হযরত হাকীম ইবন হিযাম রাযি.-এর অন্তরে দারুণ রেখাপাত করে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেন-
يَا رَسُولَ اللهِ ، وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَا أَرْزَأ أَحَدًا بَعْدَكَ شَيْئًا حَتَّى أفَارِقَ الدُّنْيَا (ইয়া রাসূলাল্লাহ! যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম, আপনার পর আমি অন্য কারও থেকে কিছু গ্রহণ করব না, যাবৎ না আমি দুনিয়া ত্যাগ করি)। رزء -এর মূল অর্থ কমানো। কারও থেকে কিছু গ্রহণ করলে সেই ব্যক্তি থেকে সে পরিমাণ কমে যায়। তাই শব্দটি 'গ্রহণ করা' অর্থেও ব্যবহৃত হয়। হযরত হাকীম রাযি. শপথ করেছেন যে, তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততোদিন কারও কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করবেন না। তিনি তাঁর এ শপথ রক্ষা করেছিলেন, যেমনটা হাদীছটির পরবর্তী অংশ দ্বারা জানা যায়। বায়তুল মাল অর্থাৎ সরকারি কোষাগারে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ভাতা নির্ধারিত ছিল। হযরত হাকীম রাযি.-এরও তা ছিল। সুতরাং এ ভাতা ছিল তাঁর হক বা প্রাপ্য। খলীফাগণ তাঁকে তাঁর সে হক দিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সর্বদাই তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন। ব্যাখ্যাকারগণ বলেন, হক থাকা সত্ত্বেও তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন এ কারণে যে, তিনি হয়তো আশঙ্কা করেছিলেন যে, বায়তুল মাল থেকে গ্রহণ করতে থাকলে হয়তো তিনি গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন। ফলে অনুচিত ক্ষেত্রেও তিনি কারও কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করে ফেলবেন। তাই বায়তুল মাল থেকে নিজের হক গ্রহণ না করে তিনি সে পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বায়তুল মাল থেকে কোনওক্রমেই কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে শেষে উমর রাযি. মানুষকে সাক্ষী রেখে বলেন-
يَا مَعْشَرَ الْمُسْلِمِينَ، أشْهِدُكُمْ عَلَى حَكِيمٍ أَنِّي أَعْرِضُ عَلَيْهِ حَقَّهُ الَّذِي قَسَمَهُ اللَّهُ لَهُ فِي هذَا الْفَيْء فَيَأْبَى أَنْ يَأْخُذَهُ 'হে মুসলিম সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে হাকীম সম্পর্কে সাক্ষী রাখছি যে, ফায় (সরকারি সম্পদ)-এর মধ্যে আল্লাহ তা'আলা তার বণ্টনে যা রেখেছেন, আমি তার সামনে তা পেশ করেছি, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করছেন'। হযরত উমর রাযি. মানুষকে লক্ষ্য করে এ কথা বলেছেন এ কারণে যে, বায়তুল মাল বা সরকারি কোষাগার থেকে হযরত হাকীমকে কিছু নিতে না দেখে লোকে মনে করতে পারে তাকে বুঝি তার হক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এরূপ মনে করলে তা হতো ভুল ধারণা। অন্যের সম্পর্কে ভুল ধারণা করা গুনাহ। কারও কোনও কাজ দ্বারা অন্যের মনে যাতে ভুল ধারণা সৃষ্টি না হয় এবং তারা অহেতুক গুনাহগার না হয়ে পড়ে, সেজন্য বিষয়টা পরিষ্কার করে দেওয়া জরুরি। এ কারণেই হযরত উমর রাযি. হাকীম রাযি.-এর ভাতা গ্রহণ না করার বিষয়টা মানুষের সামনে পরিষ্কার করে দিয়েছেন।

প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছে মূলত নিচের হাত বলে পরোক্ষভাবে নিন্দা করা হয়েছে ওই গ্রহীতাকে, যে অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নেয়। সুতরাং যে ব্যক্তি কারও কাছে কিছু চায় না, আর এ অবস্থায় কেউ খুশিমনে তাকে কিছু দেয়, তবে তা গ্রহণ করতে কোনও দোষ নেই। বরং মনে যদি লোভ না থাকে কিংবা লোভে পড়ার আশঙ্কা না থাকে, তবে এরূপ দানকে গ্রহণ করাই শ্রেয়। কেননা এ দান প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। এ কারণেই এক হাদীছে আছে যে, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উমর ফারুক রাযি.-এর কাছে একটি বস্তু পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু হযরত উমর রাযি. সেটি গ্রহণ না করে ফেরত দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ফেরত দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি আমাদের বলেননি যে, আমাদের পক্ষে কারও কাছ থেকে কিছু গ্রহণ না করাটা উত্তম? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا ذَلِكَ عَنِ الْمَسْأَلَةِ فَأَمَّا مَا كَانَ عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ فَإِنَّمَا هُوَ رِزْقٌ يَرْزُقُكَهُ اللَّهُ
‘সে কথা তো চাওয়ার ক্ষেত্রে। যা বিনা চাওয়াতে আসে, তা তো আল্লাহর রিযিক, যা আল্লাহ তা'আলা তোমাকে দান করেন'।

তখন হযরত উমর রাযি. বললেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি আমি কখনও কারও কাছে কিছু চাব না। আর বিনা চাওয়ায় যা আমার কাছে আসবে আমি তা অবশ্যই গ্রহণ করব।(মুয়াত্তা ইমাম মালিক: ৩৬৬০)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দুনিয়া পরীক্ষার স্থান। এর চাকচিক্য দেখে আখিরাত ভুলতে নেই।

খ. নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কারও কাছে কিছু চাওয়া ঠিক নয়।

গ. জীবিকা উপার্জন করা জরুরি, তবে লোভের সঙ্গে নয়; বরং প্রয়োজন পূরণের তাগিদে সম্পূর্ণ নির্মোহ মনেই তা উপার্জন করতে হবে।

ঘ. লোভের সঙ্গে উপার্জন করলে সে উপার্জনে বরকত হয় না।

ঙ. যে উপার্জন হয় নির্মোহ মনে, তা বরকতময় ও কল্যাণকর হয়।

চ. বৈধ যাচনাকারীকে খালিহাতে ফেরানো উচিত নয়।

ছ. উপদেশ দেওয়ার জন্য সময়-কাল বিবেচনায় রাখা উচিত।

জ. উপদেশদাতার উপদেশ মনোযোগ সহকারে শোনা ও গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

ঝ. দাতার হাত শ্রেষ্ঠ। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য যথাসম্ভব দান-খয়রাত করতে সচেষ্ট থাকা।

ঞ. কোনও বিষয় মানুষের কাছে অধিকতর সুস্পষ্ট করে তোলার জন্য উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষানীতির অংশ।

ট. নিজের কোনও কৃতকর্ম সম্পর্কে যখন জানা যাবে সেটি ইসলামের দৃষ্টিতে পসন্দনীয় নয়, তখন সেটি পুনরায় না করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া চাই।

ঠ. নিজের কোনও কাজ দ্বারা অন্যের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে সে কাজটির প্রকৃত অবস্থা মানুষের সামনে পরিষ্কার করে দেওয়া চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ১২১৫ | মুসলিম বাংলা