আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

৫. অধ্যায়ঃ নামাজ

হাদীস নং: ৭৩৪
পুরুষের পেছনের সারিতে এবং মহিলাদের প্রথম সারিতে দাঁড়ানো এবং সারি বাঁকা করার প্রতি ভীতি প্রদর্শন
৭৩৪. হযরত নু'মান ইবন বশীর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছিঃ তোমরা তোমাদের কাতারসমূহ সোজা রাখবে। অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের চেহারার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দেবেন।
(মালিক, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবন মাজাহ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
বুখারী ব্যতীত অপরাপর হাদীস গ্রন্থসমূহে আছে: রাসুলুল্লাহ ধনুকের কাষ্ঠের ন্যায় আমাদের কাতারগুলো সোজা করে দিতেন। এভাবে করতে করতে এক সময় তিনি দেখলেন, আমরাও এ কাজটি শিখে গিয়েছি। তারপর তিনি একদিন বের হয়ে এসে দাঁড়ালেন। এমন কি তিনি তাকবীর বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় এক গ্রাম্য ব্যক্তিকে দেখলেন তার বুক লাইনের বাইরে বের হয়ে আছে। তিনি বললেনঃ হে আল্লাহর বান্দাগণ! কাতার সোজা করে নাও, অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের চেহারার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দেবেন। আবূ দাউদ ইবন হিব্বানের 'সহীহ' গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) লোকদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন: তোমরা কাতারসমূহ সোজা করে নাও, অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের অন্তরে বিভেদ সৃষ্টি করে দেবেন। তিনি বললেনঃ এরপর আমি দেখতে পেলাম, লোকেরা তাদের সাথীর কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে নিয়েছে, হাঁটুর সাথে হাঁটু এবং টাখনুর সাথে টাখনু মিলিয়ে নিয়েছে।)
التَّرْهِيب من تَأَخّر الرِّجَال إِلَى أَوَاخِر صفوفهم وَتقدم النِّسَاء إِلَى أَوَائِل صفوفهن وَمن اعوجاج الصُّفُوف
734 - وَعَن النُّعْمَان بن بشير رَضِي الله عَنْهُمَا قَالَ سَمِعت رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَقُول لتسون صفوفكم أَو ليخالفن الله بَين وُجُوهكُم رَوَاهُ مَالك وَالْبُخَارِيّ وَمُسلم وَأَبُو دَاوُد وَالتِّرْمِذِيّ وَالنَّسَائِيّ وَابْن مَاجَه
وَفِي رِوَايَة لَهُم خلا البُخَارِيّ أَن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم كَانَ يُسَوِّي صُفُوفنَا حَتَّى كَأَنَّمَا يُسَوِّي بهَا القداح حاى رآنا أَنا قد عقلنا عَنهُ ثمَّ خرج يَوْمًا فَقَامَ حَتَّى كَاد يكبر فرى رجلا باديا صَدره من الصَّفّ فَقَالَ عباد الله لتسون صفوفكم أَو ليخالفن الله بَين وُجُوهكُم
وَفِي رِوَايَة لأبي دَاوُد وَابْن حبَان فِي صَحِيحه أقبل رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم على النَّاس بِوَجْهِهِ فَقَالَ أقِيمُوا صفوفكم أَو لخالفن الله بَين قُلُوبكُمْ قَالَ فَرَأَيْت الرجل يلزق مَنْكِبه بمنكب صَاحبه وركبته بركبة صَاحبه وكعبه بكعبه
القداح بِكَسْر الْقَاف جمع قدح وَهُوَ خشب السهْم إِذا بري قبل أَن يَجْعَل فِيهِ النصل والريش

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নামাযে কাতার সোজা করার প্রতি জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে এবং কাতার সোজা না করার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা যদি নামাযে কাতার সোজা না কর তবে আল্লাহ তা'আলা তোমাদের চেহারাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ সৃষ্টি করে দেবেন।

চেহারার মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ ও বৈপরিত্য সৃষ্টি দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য— সে সম্পর্কে 'উলামায়ে কিরাম বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। একদল 'উলামার মতে বাস্তব আকার-আকৃতিগত পরিবর্তন বোঝানো উদ্দেশ্য। সে হিসেবে কেউ বলেন, এর অর্থ চেহারাকে তার আপন স্থান থেকে ঘুরিয়ে পেছনমুখী করে দেওয়া। এরূপ এক সতর্কবাণী কুরআন মাজীদের এক আয়াতেও উচ্চারিত হয়েছে। তাতে আহলে কিতাবকে শেষ নবীর প্রতি নাযিলকৃত কিতাবে ঈমান আনার আদেশ দিয়ে বলা হয়েছেঃ-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ آمِنُوا بِمَا نَزَّلْنَا مُصَدِّقًا لِمَا مَعَكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَطْمِسَ وُجُوهًا فَنَرُدَّهَا عَلَى أَدْبَارِهَا
অর্থ : হে কিতাবীগণ! তোমাদের কাছে যে কিতাব (পূর্ব থেকে) আছে তার সমর্থকরূপে (এবার) আমি যা (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, তোমরা তাতে ঈমান আন, এর আগে যে, আমি কতক চেহারাকে মিটিয়ে দিয়ে সেগুলোকে তার পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেব। (সূরা নিসা (৪), আয়াত ৪৭)

কেউ বলেন, এর অর্থ চেহারা বিকৃত করে দেওয়া অর্থাৎ মানুষের চেহারার পরিবর্তে অন্য কোনও প্রাণীর চেহারায় পরিণত করে দেওয়া। যেমন বনী ইসরাঈলের একদল অপরাধীকে এরকম শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তাদেরকে মানব আকৃতি পরিবর্তন করে শূকর ও বানরের আকৃতিতে পরিণত করা হয়েছিল।

অপর একদল 'উলামার মতে এর দ্বারা মনের অমিল, শত্রুতা ও পারস্পরিক বিদ্বেষ বোঝানো উদ্দেশ্য। যেমন বলা হয়ে থাকেঃ- تغير وجه فلان 'অমুকের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেছে।' অর্থাৎ তার চেহারায় মনের অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে। মানে তার মনের অবস্থা আগের মত নেই।

এভাবে চেহারা পরিবর্তন দ্বারা মানসিক অবস্থার পরিবর্তন বোঝানো হয়ে থাকে। তো নামাযের কাতারে অমিল হওয়াটা যদিও একটা প্রকাশ্য অমিল, কিন্তু এ প্রকাশ্য অমিল মনের বিরোধ ও আত্মিক অমিল সৃষ্টির একটি বড় কারণ।এই ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায় আবূ দাউদ শরীফের একটি বর্ণনা দ্বারা। তাতে আছেঃ- أو ليخالفن الله بين قلوبكم “তোমরা কাতার সোজা না করলে আল্লাহ তা'আলা তোমাদের অন্তরের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে দেবেন।“

মোটকথা, وجه (চেহারা) শব্দটিকে যদি বিশেষ অঙ্গের অর্থে ধরা হয়, তবে এর পরিবর্তন দ্বারা চেহারাকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়া অথবা মানব আকৃতি পরিবর্তন করে দেওয়া বোঝানো হবে। আর যদি এর অর্থ করা হয় 'ব্যক্তিসত্তা', তবে এর পরিবর্তন দ্বারা পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতির পরিবর্তন তথা নিজেদের মধ্যে কলহ-বিবেদ সৃষ্টি হয়ে যাওয়া বোঝানো হবে।

নামায ঈমানের পর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আমল, যা কায়েম করার মধ্যে গোটা দীন কায়েম করার রহস্য নিহিত। জামাতবদ্ধ নামায যেমন মু'মিনদের বাহ্যিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে, তেমনি জামাতের যাবতীয় আহকাম ও আদব রক্ষার দ্বারা তাদের আত্মিক ঐক্য ও সম্প্রীতিও প্রতিষ্ঠা হয়। কাতার সোজা করা—জামাতে নামায আদায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটা ঠিকঠাকভাবে আদায় না করা হলে বাহ্যিক অনৈক্য সাধিত হয় এবং সে অনৈক্যের পরিণামে মনের মধ্যেও অমিল দেখা দেয়। মু'মিনদের পারস্পরিক অমিল ও অসদ্ভাব তাদের জাতীয় বিপর্যয়ের এক অন্যতম প্রধান কারণ। তা থেকে রক্ষার জন্য। অনৈক্যের প্রতিটি কারণ সম্পর্কে সতর্ক থাকা ও তা থেকে বেঁচে থাকা অতি জরুরি। নামাযে কাতার সোজা না করাও যেহেতু সেরকম এক কারণ, তাই এ হাদীছে কাতার সোজা করার জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে এবং তা না করলে যে পরিণামে চেহারার অমিল তথা আত্মিক অমিল ও অসদ্ভাব দেখা দিতে পারে, সে সম্পর্কে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে।

মুসলিম শরীফের বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক কাতার সোজ করার তদারকিকে তিরের কাঠি সোজা করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি নামাযে কাতার সোজা করার বিষয়টিকে কত গুরুত্ব দিতেন। এর দ্বারা এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ইমামের কর্তব্য নিজ তদারকিতে মুসল্লীদের কাতার সোজা করানো। কেবল কাতার সোজা করার নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হওয়া উচিত নয়। আজকাল এ ব্যাপারে ব্যাপক অবহেলা লক্ষ করা যাচ্ছে।

এর দ্বারা আরও বোঝা যায় কাতার সোজা করার কাজটি আন্তরিক প্রযত্নের সাথেই সম্পন্ন হওয়া উচিত। সেভাবে সম্পন্ন করা হলেই এর কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ তখনই এটা মুসল্লীবৃন্দের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। ইদানীং আমরা এ কাজটিকে একটি অটোমেটিক (স্বয়ংক্রিয়) আমলে পরিণত করে ফেলেছি। মসজিদে কাতারের রেখা টানা থাকে, সেই রেখা বরাবর পা রাখা হয়, ব্যস কাতার সোজা হয়ে যায়। কাতার সোজা করা যে নামাযের একটি অবশ্যকরণীয় কাজ, সে কথা মাথায় রেখে এর প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয় না। রেখা টানা থাকলেও কাতার সোজা করার নিয়তে ও সুন্নতের অনুসরণার্থে মনোযোগ সহকারে সে বরাবর পা রাখা চাই এবং বিনয়-নম্রতার সঙ্গে দু'পাশের মুসল্লীদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া চাই।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা নামাযের কাতার সোজা করার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমরা নামাযে কাতার সোজা করার ব্যাপারে বিশেষভাবে যত্নবান থাকব।

খ. আরও জানা যায় নামাযে কাতার সোজা না করা পারস্পরিক বিরোধ ও অনৈক্যের একটি বড় কারণ।

গ. ইমামের উচিত নিজ তদারকিতে নামাযের কাতার সোজা করানো।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ৭৩৪ | মুসলিম বাংলা