আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

৫. অধ্যায়ঃ নামাজ

হাদীস নং: ৫৬৭
সালাতের প্রতি অনুপ্রেরণা এবং রুকু-সিজদা ও ভীতি-বিহ্বলতার ফযীলত
৫৬৭. রবী'আ ইবন কাব (র) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দিনে নবী (সা) এর খিদমত করতাম এবং রাতে রাসূলুল্লাহ-এর গৃহের দরজায় চলে আসতাম এবং তাঁর সংগে রাত যাপন করতাম। আমি সর্বদা তাঁকে বলতে শুনতাম। সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ এবং সুবহানা রাব্বি। এমনকি আমার জড়তা পেয়ে বসত অথবা চোখ জুড়ে ঘুম আসত। ফলে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। একদিন তিনি আমাকে বললেনঃ হে রবীআ। তুমি আমার কাছে চাও, আমি তোমাকে দান করব। আমি বললামঃ আমাকে সময় দিন, আমি ভেবে দেখি। পৃথিবী ধ্বংসশীল এবং ক্ষণভঙ্গুর আমি একথা স্মরণ করছিলাম। আমি বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমি আপনার কাছে এ দু'আ চাই যেন আল্লাহ আমাকে জাহান্নাম থেকে নাজাত দেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করান। রাসূলুল্লাহ নীরব রইলেন। তারপর তিনি বললেনঃ তোমাকে একথা বলার নির্দেশ কে দিল? আমি বললামঃ আমাকে কেউ নির্দেশ দেয়নি, বরং আমি জানতে পেরেছি পৃথিবী ধ্বংসশীল ও ক্ষণভঙ্গুর। আর আল্লাহর কাছে আপনার রয়েছে মহান মর্যাদা। কাজেই আমি চাই যে, আপনি আল্লাহর কাছে আমার জন্য দু'আ করবেন। তিনি বললেন: আমি তা করব। সুতরাং তুমি তোমার উপর বেশি বেশি সিজদা দিয়ে সহযোগিতা কর।
(ইবন ইসহাক সূত্রে নিজ শব্দযোগে তাবারানী এ হাদীস 'কাবীর' গ্রন্থে উল্লেখ করেন। ইমাম মুসলিম ও আবু দাউদ সংক্ষেপে উল্লেখ করেন। তবে ইমাম মুসলিমের বাক্যাবলী হলোঃ তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) এর সংগে রাত যাপন করতাম। একদা আমি তাঁর উযুর পানি এবং যা প্রয়োজন তা এগিয়ে দিলাম। তখন তিনি আমাকে বললেনঃ তুমি আমার কাছে চাও। আমি বললাম: আমি জান্নাতে আপনার সাহচর্য চাই। তিনি বললেন: এছাড়া অন্য কিছু? আমি বললামঃ আমি এটাই চাই। তিনি বললেন: তাহলে তুমি অধিক সিজদা দ্বারা তোমার নিজের ব্যাপারে আমাকে সাহায্য কর।
التَّرْغِيب فِي الصَّلَاة مُطلقًا وَفضل الرُّكُوع وَالسُّجُود والخشوع
567 - وَعَن ربيعَة بن كَعْب رَضِي الله عَنهُ قَالَ كنت أخدم النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم نهاري فَإِذا كَانَ اللَّيْل آويت إِلَى بَاب رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فَبت عِنْده فَلَا أَزَال أسمعهُ يَقُول سُبْحَانَ الله سُبْحَانَ الله سُبْحَانَ رَبِّي حَتَّى أمل أَو تغلبني عَيْني فأنام فَقَالَ يَوْمًا يَا ربيعَة سلني فأعطيك فَقلت أَنْظرنِي حَتَّى أنظر وتذكرت أَن الدُّنْيَا فانية مُنْقَطِعَة فَقلت يَا رَسُول الله أَسأَلك أَن تَدْعُو الله أَن ينجيني من النَّار ويدخلني الْجنَّة فَسكت رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم ثمَّ قَالَ من أَمرك بِهَذَا قلت مَا أَمرنِي بِهِ أحد وَلَكِنِّي علمت أَن الدُّنْيَا مُنْقَطِعَة فانية وَأَنت من الله بِالْمَكَانِ الَّذِي أَنْت مِنْهُ فَأَحْبَبْت أَن تَدْعُو الله لي قَالَ إِنِّي فَاعل فأعني على نَفسك بِكَثْرَة السُّجُود
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيّ فِي الْكَبِير من رِوَايَة ابْن إِسْحَاق وَاللَّفْظ لَهُ وَرَوَاهُ مُسلم وَأَبُو دَاوُد مُخْتَصرا وَلَفظ مُسلم قَالَ كنت أَبيت مَعَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فآتيه بوضوئه وَحَاجته فَقَالَ لي سلني
فَقلت أَسأَلك مرافقتك فِي الْجنَّة
قَالَ أَو غير ذَلِك قلت هُوَ ذَاك قَالَ فأعني على نَفسك بِكَثْرَة السُّجُود

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত রাবী'আ ইবন কা'ব রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমত করতেন, যেমনটা এ বর্ণনা দ্বারা জানা যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নীতি ছিল, কেউ তাঁর কোনও উপকার করলে তিনি তার উপযুক্ত প্রতিদান দিতেন। তিনি নিজ উম্মতকেও এ নীতি অবলম্বনের শিক্ষা দান করেছেন। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

وَمَنْ صَنَعَ إِلَيْكُمْ مَعْرُوفًا فَكَافِئُوهُ

"কেউ তোমাদের কোনও উপকার করলে তার প্রতিদান দিও। সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ১৬৭২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৬৭; মুসনাদে আহমাদ,হাদীছ নং ৫৭৪৩
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত মহানুভব। হযরত রাবী' আ ইবন কা'ব রাযি.-এর খেদমতকে তিনি নিজের উপকার হিসেবে গ্রহণ করেছেন, যদিও তাঁর খেদমত করতে পারাটা খাদেমের নিজের জন্যই অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। নিজ মহানুভবতার কারণে যেহেতু তিনি সে খেদমতকে নিজ উপকার হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাই তিনি তার প্রতিদান দিতে চাইলেন। বললেন, তুমি কী চাও বল। এরূপ ক্ষেত্রে মানুষ সাধারণত দুনিয়াবী কোনও বিষয় চাওয়ার কথাই বুঝে থাকে। কিন্তু ইনি তো একজন সাহাবী। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্যে থেকে দুনিয়ার হীনতা ও আখিরাতের উৎকৃষ্টতা ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছিলেন। দুনিয়ার মোহ অন্তর থেকে সম্পূর্ণ ঘুচে গিয়েছিল। কাজেই তিনি দুনিয়ার কিছু চাইলেন না। তিনি চাইলেন আখিরাত। তাও অন্যদের মত সাধারণভাবে নয়। সাহাবীসুলভ বিশেষত্বের সঙ্গে চাইলেন। তিনি বললেন, আমি আপনার কাছে চাই জান্নাতে আপনার সঙ্গে থাকতে। অর্থাৎ দুনিয়ায় যেমন আপনার সাহচর্যে আছি, আপনার সঙ্গে সঙ্গে থাকছি, জান্নাতেও যেন তেমনি আপনার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে পারি।
কাউকে জান্নাত দেওয়া না দেওয়াটা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছাধীন। জান্নাতে কে কোথায় থাকবে তাও আল্লাহর ইচ্ছা। এখানে কোনও মাখলুকের কিছুই করার নেই, তাতে সে মাখলুক যত বড় মর্যাদাবানই হোক। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি এ ছাড়া অন্য কিছু চাও, যা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সাহাবী নাছোড়। তিনি বললেন, এটাই আমার চাওয়া। যেন মনে মনে ভাবছেন, আপনি নিজে দিতে না পারেন, সুপারিশ তো করতে পারেন। আপনার সুপারিশ কি বৃথা যাবে? অগত্যা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে তোমার ব্যাপারে (আমি যাতে সুপারিশ করতে পারি, সেজন্য) আমাকে সাহায্য কর বেশি বেশি সিজদা দ্বারা।
বেশি বেশি সিজদা দ্বারা বেশি বেশি নামায পড়া বোঝানো হয়েছে। পেছনে এক হাদীছে বলা হয়েছে, বান্দা নামায় দ্বারাই আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য বেশি অর্জন করতে পারে। আর নামাযের ভেতরেও সিজদাকালেই বান্দা আল্লাহর বেশি নিকটবর্তী থাকে। যেমন, এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ

“বান্দা সিজদা অবস্থায় তার প্রতিপালকের সবচে' বেশি নিকটবর্তী থাকে। সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২১৫
কুরআন মাজীদেও আছে-

وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ

অর্থ : “তুমি সিজদা কর এবং (আল্লাহর) নৈকট্য অর্জন কর।”সূরা 'আলাক, আয়াত ১৯
অর্থাৎ প্রতিটি সিজদাই তোমাকে নৈকট্যের একেকটি স্তরে উন্নীত করতে থাকবে। এভাবে সিজদা করতে করতে বান্দা আল্লাহ তা'আলার এতটা বেশি নৈকট্য অর্জনে সক্ষম হয় যে, তখন বান্দা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তা'আলার হেফাজতে চলে যায় আর তখন বান্দা কেবল তাই করে, যা আল্লাহ তা'আলা তাকে দিয়ে করান। ফলে তার কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে কোনওরূপ গুনাহর কাজ হয় না, শুধু বন্দেগী আর বন্দেগীই হয়। তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, তুমি বেশি বেশি সিজদা দ্বারা তোমার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য কর। যেন বোঝাচ্ছেন, তুমি যখন সিজদার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার এতটা নৈকট্য অর্জন করতে সক্ষম হবে, তখন আমিও আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে পারব, যেন তোমাকে জান্নাতে আমার সঙ্গে রাখেন। আল্লাহ তা'আলা এ সৌভাগ্য আমাদেরকেও দান করুন, আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারাও মুজাহাদার শিক্ষা পাওয়া যায়। বেশি বেশি সিজদা তথা বেশি নামায পড়তে হলে নফসের সাথে কঠিন মুজাহাদার প্রয়োজন হয় বৈ কি।

খ. আল্লাহওয়ালা ও মুরুব্বী শ্রেণির মানুষের খেদমত করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। বিভিন্ন হাদীছে এর অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।

গ. যে ব্যক্তি অন্যের সেবা ও উপকার গ্রহণ করে, তার কর্তব্য সাধ্যমত প্রতিদান দেওয়া। এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত।

ঘ. এ হাদীছ দ্বারা সিজদা ও নামাযের এই ফযীলত জানা যায় যে, এটা জান্নাত ও জান্নাতের উচ্চমর্যাদা লাভের পক্ষে অনেক বেশি সহায়ক।

ঙ. এর দ্বারা আরও জানা যায় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাউকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর ক্ষমতা রাখেন না। হাঁ, তিনি এর সুপারিশ করতে পারবেন এবং সুপারিশকারী হিসেবে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ৫৬৭ | মুসলিম বাংলা