আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
২১- হজ্জ্বের অধ্যায়
১৫৬৯। খালিদ ইবনে মাখলাদ (রাহঃ) ......... আবু আইয়ুব আনসারী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজ্জের সময় মুযদালিফায় মাগরিব এবং ইশা একত্রে আদায় করেছেন।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
আরাফা ও মুযদালিফা ছাড়া অন্যত্র দুই ফরয নামায একত্রে আদায় নিষেধ প্রতিটি নামাযের নির্ধারিত সময় রয়েছে এবং সেই সময়ের মধ্যেই সেই নামায করা অপরিহার্য। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন : إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَّوْقُوتًا “নিশ্চয় নামায মুসলমানদের জন্য উপর ফরয নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।` (নিস ৪ : ১০৩) অবশ্য এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু আরাফা ও মুযদালিফার নামায। কারণ, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) আরাফা ও মুযদালিফায় দুই নামায একই ওয়াক্তে পড়েছেন বলে বিশুদ্ধ হাদীসে প্রমাণ রয়েছে। যথা— عن ابن عمر رضى الله عنه : أَنَّ النَّبِيِّ صَلَّى ﷺ الْمَغْرِبَ وَالْعِشَاءَ بِالْمُزْدَلِفَة جَمِيعًا - كل واحدة منهما باقامة ولم يُسَبِّحَ بَيْنَهُمَا - وَلَا على اثر واحدة منهما - رواه البخاري والنسائي হযরত উমর (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) মুযদালিফায় মাগরিব এবং এশা একই সাথে এক এক ইকামত আদায় করেছেন এবং দু'য়ের মাঝখনে কোন সুন্নাত নামায পড়েননি। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে এটাই অকাট্য সত্য যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রতিটির-ই নির্ধারিত এবং সুনির্দিষ্ট সময় আছে। নামায আদায় করা যেমন আবশ্যক তেমনি সময়মত আদায় করাও অপরিহার্য। এক নামাযকে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য নামাযের সময়ে নিয়ে আদায় করার কোন অবকাশ নেই। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু আরাফা ও মুদালিফার নামায এবং এটা বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত— যা আমরা উপরে পত্রস্থ করেছি। তার এমন কিছু হাদীসও আছে যেগুলের ভাষ্য থেকে বাহ্যত কেউ মনে করতে পারে, দুই নামায বুঝি একই ওয়াক্তে আদায় করার সুযোগ আছে। মূলত বিষয়টি এমন নয়। প্রথমে আমরা এই জাতীয় কয়েকটি বর্ণনা তুলে ধরছি। তারপর এর প্রকৃত মর্মও তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ। عن أنس رضي الله عَنْهُ قَالَ : كَانَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ إِذَا دَخَلَ قَبْلَ أَنَّ تَزِيعَ الشَّمْسُ أَخْرَ الظهر إلى وقت العصر ثُمَّ نَزَلَ يَجْمَعُ بَيْنَهُمَا - فَإِنْ زاغت قبل أن يُرْتَحلَ صلى الظهر ثم ركب . متفق عليه হযরত আনাস (রা) বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন সূর্য হেলে পড়ার পূর্বেই সফরে বের হতেন তখন যুহর নামাযকে আসরের নামাযের সময় পর্যন্ত বিলম্বিত করতেন। অতঃপর সাওয়ারী থেকে নেমে যুহর ও আসর এক সাথে আদায় করতেন। আর সফর শুরু করার পূর্বেই যদি সূর্য হেলে যেত তাহলে যুহর পড়েই সাওয়ারীতে আরোহন করতেন। عنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ للهِ ﷺ : كَانَ فِي السَّفَرِ إِذَا زاغت الشمس في منزله جمع بين الظهر والعصر قبل أن يركب فَإِذَا . لَمْ تَزِغْ لَهُ فِي مَنْزِلِهِ سَارَ حَتَّى إِذَا حَانَتْ الْعَصْرُ نَزَلَ فَجَمَعَ بَيْنَ الظهر وَالْعَصْرِ، وَإِذَا حَانَتْ لَهُ المغرب في منزله جمع بينها وبين العشاء. وَإِذَا لَمْ تَحن في منزله ركب حَتَّى إِذَا كَانَتِ الْعِشَاء نَزَلَ فَجَمَعَ بَيْنَهُما - رواه أحمد ورواه الشافعى في مسنده وقال فيه : وإذا سار قبل أن نزول الشمس أخر الظهر حتى يجمع بينهما وبين العصر في وقت العصر হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ (সা) যখন সফর করতেন তখন ঘরেই যদি সূর্য হেলে যেত তা হলে একই সাথে যুহর এবং আসর পড়ে তারপর সাওয়ার হতেন। আর ঘরে থাকতে সূর্য ঢলে না পড়লে সফরে বেরিয়ে পড়তেন, তারপর আসর নামাযের সময় হলে আসর এবং যুহর এক সাথে আদায় করে নিতেন, আর ঘরে থাকতেই মাগরিবের সময় হয়ে গেলে একই সাথে মাগরিব এবং ইশা পড়ে নিতেন। আর সময় না হলে সফর শুরু করে দিতেন এবং ইশার নামাযের সময় মাগরিব ও ইশা একসাথে পড়ে নিতেন। এখানে আরেকটি বিষয় প্রথমেই স্পষ্ট করে নেয়া প্রয়োজন। তা হলো এই جمع দুই নামায একত্রে পড়ার পদ্ধতি দুই রকম হতে পারে তাকদীম-অর্থাৎ সময় হওয়ার পূর্বেই নামায আদায় করে নেয়া। যেমন যুহর নামাযের সময় আসরও একই সাথে আদায় করে নেয়া। দ্বিতীয়ত তাখীর جمع تأخير – অর্থাৎ নামাযের সময় পার করে তারপর আদায় করা। যেমন আসর নামাযের সময়ে আসর ও যুহর একসাথে আদায় করা। এর মাধ্যে جمع تقديم অর্থাৎ সময় হওয়ার পূর্বেই নামায আদায় করা একমাত্র আরাফা ব্যতিত অন্য কোথাও কোনক্রমেই জায়িয নেই । তবে جمع تأخير জায়িয আছে কিনা সে বিষয়ে মত প্রকাশের পূর্বে আমাদেরকে আরেকটি বিষয় জানতে হবে। তা হলো এই جمع একসাথে দুই ওয়াক্তে নামায পড়া দুই অর্থ হতে পারে। ১. প্রকৃত অর্থেই একসাথে দুই নামায আদায় করা অর্থাৎ جمع حقيقى ২. বাহ্যিক অর্থে جمع صورى দুই নামায একসাথে আদায় করা, নইলে প্রকৃত অর্থে প্রতিটি নামায-ই আদায় হবে তার নির্দিষ্ট সময়ে। আমরা অত্র মাস'আলাটির প্রারম্ভেই উল্লেখ করেছি, পবিত্র কুরআনে পরিষ্কার ভাষায় উল্লিখিত হয়েছে : “নিশ্চয় নামায় মুসলমানদের উপর ফরয নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।" (নিসা, ৪ : ১০৩) অতএব, প্রতিটি নামাযকে তার নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করতে হবে এটা আল্লাহ তা'আলার ঘোষণা।" কাজেই যেসব হাদীসে এর ব্যতিক্রম বর্ণিত হয়েছে তার অর্থ جمع صورى বাহ্যিকভাবে একত্রে আদায় করা—প্রকৃত অর্থে নয় । এ সম্পর্কে ইমাম শাওকানী (র) লিখেছেন : হাদীসে উল্লিখিত দুই নামায একত্রে আদায় করাটা প্রকৃত অর্থে নয় বরং বাহ্যিক صورى অর্থে। যেমন, যুহর নামাযকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিলম্ব করে তার শেষ ওয়াক্তে পড়েছেন আর আসর পড়েছেন তার প্রথম ওয়াক্তে। যদিও আল্লামা নববী (র) এই সম্ভবনা ও ব্যাখ্যাকে বাতিল ও দুর্বল বলেছেন। কিন্তু হানাফী ফকীহগণ এর উত্তরে বলেছেন: নববী এটাকে দুর্বল বললেও ইমাম কুরতুবী এটাকে উত্তম বলেছেন। ইমামুল হারামাইন (র) এটাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইবনুল মাজিশন ও ইমাম তাহাভী (র) এটাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এই মতকে আরও বলিষ্ঠ করে তুলেছেন ইবনু সায়িদিন-নাস। তিনি বলেন হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে যিনি এই হাদীস বর্ণনা করেন। হযরত আবুশ-শা'ছা (র)ও এই মতকে সমর্থন করেছেন। এই বক্তব্যকে একথাও সমর্থন করে যে, এই একত্রে নামায আদায় করণ সম্পর্কিত হাদীসগুলোর সময়ের উল্লেখ নেই। একথা বলেছেন স্বয়ং হাফিয (র)! তাছাড়া যদি এ সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো বাহ্যিক অর্থে ব্যবহার করা হয়। তা হলে বিনা কারণে নামাযকে তার নির্ধারিত সময় থেকে বের করার বৈধতাই অপরিহার্য হয়ে পড়বে। অথচ যদি جمع الصورى এর অর্থে ব্যবহৃত হয় তা হলে একই সাথে সকল হাদীসের উপরই আমল হয়ে যায় এবং পরস্পর সমন্বয় সাধিত হয়। সুতরাং এখানে جمع صورى এর অর্থে হাদীসগুলো গ্রহণ করাই উত্তম। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সফরে এভাবেই দুই নামাযকে একত্রে পড়তেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা বাহ্যত দুই নামাজকে একাত্রে আদায় করণ মনে হলেও প্রত্যেকটি নামাযকে আদায় করা হচ্ছে তার সময়ে। সারকথা হলো, এ সম্পর্কে বর্ণিত সকল হাদীসকে মন্থন করলে একথাই প্রমাণিত হয় শুধু আরাফা ও মুযদালিফা ব্যতিত অন্য কোথাও দুই নামায একত্রে আদায় করার বিধান শরী'আতে নেই । যেসব হাদীসে এরূপ বাহ্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় সেখানে جمع صورى বাহ্যিক একত্র- করণের কথা বলা হয়েছে, প্রকৃত অর্থে না। হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আছে, قال رسول الله ﷺ من جمع بين الصلاتين من غير عذر فقد أتى بابا من أبواب الكبائر - رواه الحاكم “রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, যে ব্যক্তি বিনা ওযরে দুই নামায একত্রে জমা করল সে কবীরা গুনাহসমূহের থেকে একটি দরজায় এসে উপনীত হল"।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন