আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৫৬- দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও হৃদয়গ্রাহী বিষয়াদির বর্ণনা

হাদীস নং: ৭২৩৯
আন্তর্জাতিক নং: ৩০০৫
১৭. অগ্নিকুণ্ডের অধিপতি এবং যাদুকর, পাদ্রী ও বালকের ঘটনা
৭২৩৯। হাদ্দাব ইবনে খালিদ (রাহঃ) ......... সুহায়ব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ তোমাদের পূর্ববর্তী যুগে এক বাদশাহ ছিল। তাঁর ছিল এক যাদুকর। বার্ধক্যে উপনীত হয়ে সে বাদশাকে বলল, আমি তো বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি, সুতরাং একজন কিশোরকে আপনি আমার নিকট পাঠিয়ে দিন, যাকে আমি যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিব। তখন যাদুবিদ্যা শিক্ষা দেয়ার জন্য বাদশাহ তাঁর নিকট এক কিশোর (বালক) কে পাঠাল। বালকের যাত্রাপথে ছিল এক পাদ্রী। বালক তাঁর নিকট বসল এবং তাঁর কথা শুনল। তাঁর কথা বালকের পছন্দ হল। অতঃপর বালক যাদুকরের নিকট যাত্রাকালে সর্বদাই পাদ্রির নিকট যেত এবং তাঁর নিকট বসত।

এরপর সে যখন যাদুকরের নিকট যেত তখন সে তাকে প্রহার করত। অবশেষে যাদুকরের ব্যাপারে সে পাদ্রির নিকট অভিযোগ করল। তখন পাদ্রি বলল, তোমার যদি যাদুকরের ব্যাপারে আশঙ্কা হয় তবে বলবে, আমার পরিবারের লোকেরা আমাকে আসতে বাঁধা দিয়েছে, আর যদি তুমি তোমার পরিবারের লোকদের ব্যাপারে আশঙ্কাবোধ কর তবে বলবে, যাদুকর আমাকে আসতে বাঁধা দিয়েছে।

এমনি একদিন হঠাৎ সে একটি ভয়ানক হিংস্র প্রাণীর সম্মুখীন হল, যা লোকদের পথ আটকিয়ে রেখেছিল। এ অবস্থা দেখে সে বলল, আজই জানতে পারব, যাদুকর উত্তম না পাদ্রী উত্তম। অতঃপর একটি পাথর হাতে নিয়ে সে বলল, হে আল্লাহ! যদি যাদুকরের তরীকার তুলনায় পাদ্রীর তরীকা আপনার নিকট প্রিয় হয়, পছন্দনীয় হয়, তবে এই প্রস্তারাঘাতে এই হিংস্র প্রাণীটি নিহত করে দিন, যেন লোকজন চলাচল করতে পারে। অতঃপর সে তাঁর প্রতি পাথরটি নিক্ষেপ করল এবং উহাকে মেরে ফেলল। ফলে লোকজন আবার যাতায়াত আরম্ভ করল।

এরপর সে পাদ্রীর নিকট এসে সে সম্পর্কে পাদ্রীকে সংবাদ দিল। পাদ্রী বলল, বৎস আজ তুমি তো আমার থেকেও শ্রেষ্ঠ হয়ে গিয়েছ। তোমার মর্যাদা এ পর্যন্ত পৌঁছেছে যা আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে অচিরেই তুমি পরীক্ষার সুম্মুখীন হবে। যদি পরীক্ষার মুখোমুখি হও তবে আমার কথা বলবে না। এ দিকে বালক জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য এবং লোকদের সমুদয় রোগ ব্যাধির চিকিৎসা করতে লাগল। বাদশাহের পরিষদবর্গের এক ব্যক্তি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর সংবাদ সে শুনতে পেয়ে বহু উপহার ও উপঢৌকন নিয়ে তাঁরা তাঁর কাছে আসল এবং তাকে বলল, তুমি যদি আমাকে আরোগ্য দান করতে পার তবে এ সব মাল আমি তোমাকে দিয়ে দিব। এ কথা শুনে বালক বলল, আমি তো কাউকে আরোগ্য দান করতে পারি না। আরোগ্য তো দেন আল্লাহ তাআলা। আপনি যদি আল্লাহর উপন ঈমান আনয়ন করেন তবে আমি আল্লাহর নিকট দুআ করব, আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করবেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করলেন, আল্লাহ তাআলা তাকে রোগমুক্ত করে দিলেন।

অতঃপর সে বাদশাহের নিকট এসে অন্যান্য সময়ের ন্যায় এবারও বসল। বাদশাহ তাকে বললেন, তোমার দৃষ্টিশক্তি কে ফিরিয়ে দিয়েছেন? সে বলল, আমার প্রতিপালক। এ কথা শুনে বাদশাহ বলল, আমি ব্যতিত তোমার অন্য কোন প্রতিপালকও আছে কি? সে বলল, আমার ও আপনার সকলের প্রতিপালকই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। অতঃপর বাদশাহ তাকে পাকড়াও করে অব্যাহতভাবে শাস্তি দিতে লাগল। অবশেষে সে বালকের কথা বলে দিন। তখন বালককে আনা হল। বাদশাহ তাকে বললেন, হে বৎস! তুমি তো যাদুতে এত দক্ষ হয়েছ যে, তুমি জন্মান্ধকে ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করে দাও এবং এই কর সেই কর ...। সে বলল, আমি কাউকে নিরাময় করি না। আল্লাহই শিফা দান করেন।

তখন বাদশাহ তাকেও পাকড়াও করে শাস্তি দিতে থাকল। অবশেষে সে পাদ্রীর কথা বলে দিল। এবার পাদ্রীকে ধরে আনা হল এবং তাকে বলা হল তুমি তোমার দ্বীন পরিত্যাগ কর। সে অস্বীকার করল, ফলে তাঁর মাথার তালুতে করাত রেখে তাকে বিদীর্ণ করে ফেল হল। এতে তাঁর দেহ দুই খণ্ড হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। অতঃপর বাদশাহর পরিষদকে আনা হল এবং তাকে বলা হল তোমার দ্বীন থেকে ফিরে আস। সে তা অস্বীকার করলে তার মাথার মাঝখানে করাত রাখল এবং তাকেও দুই টুকরা করল। পরিশেষে ঐ বালকটিকে আনা হল এবং তাকেও একই কথা বলা হল যে তুমি তোমার দ্বীন থেকে ফিরে আসো। সেও অস্বীকার করল। অতঃপর বাদশাহ তাকে তাঁর করিপয় সহযোগী (কর্মচারী)’র হাওলা করে দিয়ে বলল, তোমরা তাকে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে সহ পাহাড়ে আরোহণ কর। পর্বত শৃঙ্গে পৌছার পর সে যদি তাঁর দ্বীন থেকে ফিরে আসে (তবে ভাল)। অন্যথা তাকে সেখান থেকে ছুঁড়ে মারবে।

তারপর তাঁরা তাকে নিয়ে গেল এবং তাকে সহ পাহাড়ে আরোহণ করল। তখন সে দুআ করে বলল, হে আল্লাহ! আপনার যেভাবে ইচ্ছা তাদের ব্যাপারে আমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান (আমাকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করুন) তৎক্ষণাৎ তাদেরকে সহ পর্বত প্রকম্পিত হতে লাগল। ফলে তাঁরা পাহাড় হতে গড়িয়ে পড়ল। আর সে হেঁটে হেঁটে বাদশাহের নিকট চলে এলো। এ দেখে বাদশাহ তাকে বলল তোমরা সঙ্গীরা কোথায়? সে বলল, আল্লাহ আমার জন্য তাদের ব্যাপারে যথেষ্ট হয়েছে (আমাকে তাদের কবল থেকে রক্ষা করেছেন)।

আবার বাদশাহ তাকে তাঁর কতিপয় সহচরের হাওলা করে বলল, তোমরা তাকে নিয়ে যাও এবং ক্ষুদ্র নৌকায় উঠিয়ে তাকে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে যাও। অতঃপর সে যদি তাঁর দ্বীন থেকে ফিরে আসে তবে ভাল, অন্যথা তোমরা তাকে সমুদ্রে ফেলে দাও। তাঁরা তাকে সমুদ্রে নিয়ে গেল। এবারও সে দুআ করে বলল, হে আল্লাহ! আপনার যেভাবে ইচ্ছা তাদের ব্যাপারে আমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান (আমাকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করুন)। তৎক্ষণাৎ নৌকাটি তাদেরকে সহ উল্টে গেল। ফলে তাঁরা সকেলেই পানিতে ডুবে গেল আর ছেলেটি হেঁটে হেঁটে বাদশাহের নিকট চলে এলো।

বাদশাহ তাকে বলল, তোমার সাথিরা কোথায়? সে বলল, আল্লাহ তাদের ব্যাপারে আমার জন্য যথেষ্ট হয়েছে (আমাকে তাদের কবল থেকে রক্ষা করেছেন)। অতঃপর সে বাদশাহকে বলল, তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না যে পর্যন্ত না তুমি আমার নির্দেশিত পদ্ধতি মুতাবিক কাজ করবে। বাদশাহ বলল, সে আবার কি? বালক বলল, একটি ময়দানে তুমি লোকদেরকে সমবেত কর, তারপর একটি কাঠের শূলীতে আমাকে উঠিয়ে আমার তীরদানি হতে একটি তীর নিয়ে তা ধনুকের মাঝে রাখ, এরপর بِاسْمِ اللَّهِ رَبِّ الْغُلاَمِ (বালকের পালনকর্তা আল্লাহর নামে) বলে আমার দিকে তীর ছুঁড়ে মার। এ যদি কর তবে তুমি আমাকে হত্যা করতে সক্ষম হবে।

তাঁর কথা মোতাবেক বাদশাহ লোকদেরকে এক ময়দানে সমবেত করল এবং তাকে একটি কাঠের শূলীতে চড়াল, অতঃপর তাঁর তীরদানী হতে একটি তীর নিয়ে তা ধনুকের মাঝে রেখে বিসমিল্লাহি রাব্বুল আলামিন বলে তাঁর দিকে ছুঁড়ে মারল। তীর তাঁর কানপট্টিতে গিয়ে বিধল। অতঃপর সে (বালক) কানপট্টিতে তীরের স্থানে নিজের হাত রাখল এবং মারা গেল। এ দেখে সমবেত লোকজন বলে উঠলآمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ “আমরা এই বালকের রবের প্রতি ঈমান আনলাম”।

এই সংবাদ বাদশাহকে জানানো হল এবং তাকে বলা হল লক্ষ্য করেছেন কি? আপনি যে পরিস্থিতি হতে আশঙ্কা করছিলেন, আল্লাহর কসম! সে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতই আপনার মাথার উপর চেপে বসেছে। সমস্ত মানুষই বালকের রবের উপর ঈমান আনয়ন করেছে। তখন বাদশাহ রাস্তার মাথায় গর্ত খননের নির্দেশ দিল। গর্ত খনন করা হল এবং তাদের অগ্নি প্রজ্বলিত করা হল। অতঃপর বাদশাহ হুকুম করল যে, যে ব্যক্তি তাঁর ধর্মমত বর্জন না করবে তাকে তাতে নিক্ষেপ করব, অথবা সে বলল, তাকে বলবে সে যেন অগ্নিতে প্রবেশ করে। লোকেরা তাই করল।

অবশেষে এক মহিলা আসল, তাঁর সঙ্গে ছিল এক শিশু। সে অগ্নিতে পতিত হবার ব্যাপারে ইতস্তত করছিল, এ দেখে শিশু তাকে বলল, হে আম্মাজান, ধৈর্যধারণ করুন, আপনি তো সত্য দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত।
باب قِصَّةِ أَصْحَابِ الأُخْدُودِ وَالسَّاحِرِ وَالرَّاهِبِ وَالْغُلاَمِ
حَدَّثَنَا هَدَّابُ بْنُ خَالِدٍ، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، حَدَّثَنَا ثَابِتٌ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ، أَبِي لَيْلَى عَنْ صُهَيْبٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " كَانَ مَلِكٌ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ وَكَانَ لَهُ سَاحِرٌ فَلَمَّا كَبِرَ قَالَ لِلْمَلِكِ إِنِّي قَدْ كَبِرْتُ فَابْعَثْ إِلَىَّ غُلاَمًا أُعَلِّمْهُ السِّحْرَ . فَبَعَثَ إِلَيْهِ غُلاَمًا يُعَلِّمُهُ فَكَانَ فِي طَرِيقِهِ إِذَا سَلَكَ رَاهِبٌ فَقَعَدَ إِلَيْهِ وَسَمِعَ كَلاَمَهُ فَأَعْجَبَهُ فَكَانَ إِذَا أَتَى السَّاحِرَ مَرَّ بِالرَّاهِبِ وَقَعَدَ إِلَيْهِ فَإِذَا أَتَى السَّاحِرَ ضَرَبَهُ فَشَكَا ذَلِكَ إِلَى الرَّاهِبِ فَقَالَ إِذَا خَشِيتَ السَّاحِرَ فَقُلْ حَبَسَنِي أَهْلِي . وَإِذَا خَشِيتَ أَهْلَكَ فَقُلْ حَبَسَنِي السَّاحِرُ . فَبَيْنَمَا هُوَ كَذَلِكَ إِذْ أَتَى عَلَى دَابَّةٍ عَظِيمَةٍ قَدْ حَبَسَتِ النَّاسَ فَقَالَ الْيَوْمَ أَعْلَمُ آلسَّاحِرُ أَفْضَلُ أَمِ الرَّاهِبُ أَفْضَلُ فَأَخَذَ حَجَرًا فَقَالَ اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ أَمْرُ الرَّاهِبِ أَحَبَّ إِلَيْكَ مِنْ أَمْرِ السَّاحِرِ فَاقْتُلْ هَذِهِ الدَّابَّةَ حَتَّى يَمْضِيَ النَّاسُ . فَرَمَاهَا فَقَتَلَهَا وَمَضَى النَّاسُ فَأَتَى الرَّاهِبَ فَأَخْبَرَهُ فَقَالَ لَهُ الرَّاهِبُ أَىْ بُنَىَّ أَنْتَ الْيَوْمَ أَفْضَلُ مِنِّي . قَدْ بَلَغَ مِنْ أَمْرِكَ مَا أَرَى وَإِنَّكَ سَتُبْتَلَى فَإِنِ ابْتُلِيتَ فَلاَ تَدُلَّ عَلَىَّ . وَكَانَ الْغُلاَمُ يُبْرِئُ الأَكْمَهَ وَالأَبْرَصَ وَيُدَاوِي النَّاسَ مِنْ سَائِرِ الأَدْوَاءِ فَسَمِعَ جَلِيسٌ لِلْمَلِكِ كَانَ قَدْ عَمِيَ فَأَتَاهُ بِهَدَايَا كَثِيرَةٍ فَقَالَ مَا هَا هُنَا لَكَ أَجْمَعُ إِنْ أَنْتَ شَفَيْتَنِي فَقَالَ إِنِّي لاَ أَشْفِي أَحَدًا إِنَّمَا يَشْفِي اللَّهُ فَإِنْ أَنْتَ آمَنْتَ بِاللَّهِ دَعَوْتُ اللَّهَ فَشَفَاكَ . فَآمَنَ بِاللَّهِ فَشَفَاهُ اللَّهُ فَأَتَى الْمَلِكَ فَجَلَسَ إِلَيْهِ كَمَا كَانَ يَجْلِسُ فَقَالَ لَهُ الْمَلِكُ مَنْ رَدَّ عَلَيْكَ بَصَرَكَ قَالَ رَبِّي . قَالَ وَلَكَ رَبٌّ غَيْرِي قَالَ رَبِّي وَرَبُّكَ اللَّهُ . فَأَخَذَهُ فَلَمْ يَزَلْ يُعَذِّبُهُ حَتَّى دَلَّ عَلَى الْغُلاَمِ فَجِيءَ بِالْغُلاَمِ فَقَالَ لَهُ الْمَلِكُ أَىْ بُنَىَّ قَدْ بَلَغَ مِنْ سِحْرِكَ مَا تُبْرِئُ الأَكْمَهَ وَالأَبْرَصَ وَتَفْعَلُ وَتَفْعَلُ . فَقَالَ إِنِّي لاَ أَشْفِي أَحَدًا إِنَّمَا يَشْفِي اللَّهُ . فَأَخَذَهُ فَلَمْ يَزَلْ يُعَذِّبُهُ حَتَّى دَلَّ عَلَى الرَّاهِبِ فَجِيءَ بِالرَّاهِبِ فَقِيلَ لَهُ ارْجِعْ عَنْ دِينِكَ . فَأَبَى فَدَعَا بِالْمِئْشَارِ فَوَضَعَ الْمِئْشَارَ فِي مَفْرِقِ رَأْسِهِ فَشَقَّهُ حَتَّى وَقَعَ شِقَّاهُ ثُمَّ جِيءَ بِجَلِيسِ الْمَلِكِ فَقِيلَ لَهُ ارْجِعْ عَنْ دِينِكَ . فَأَبَى فَوَضَعَ الْمِئْشَارَ فِي مَفْرِقِ رَأْسِهِ فَشَقَّهُ بِهِ حَتَّى وَقَعَ شِقَّاهُ ثُمَّ جِيءَ بِالْغُلاَمِ فَقِيلَ لَهُ ارْجِعْ عَنْ دِينِكَ . فَأَبَى فَدَفَعَهُ إِلَى نَفَرٍ مِنْ أَصْحَابِهِ فَقَالَ اذْهَبُوا بِهِ إِلَى جَبَلِ كَذَا وَكَذَا فَاصْعَدُوا بِهِ الْجَبَلَ فَإِذَا بَلَغْتُمْ ذُرْوَتَهُ فَإِنْ رَجَعَ عَنْ دِينِهِ وَإِلاَّ فَاطْرَحُوهُ فَذَهَبُوا بِهِ فَصَعِدُوا بِهِ الْجَبَلَ فَقَالَ اللَّهُمَّ اكْفِنِيهِمْ بِمَا شِئْتَ . فَرَجَفَ بِهِمُ الْجَبَلُ فَسَقَطُوا وَجَاءَ يَمْشِي إِلَى الْمَلِكِ فَقَالَ لَهُ الْمَلِكُ مَا فَعَلَ أَصْحَابُكَ قَالَ كَفَانِيهِمُ اللَّهُ . فَدَفَعَهُ إِلَى نَفَرٍ مِنْ أَصْحَابِهِ فَقَالَ اذْهَبُوا بِهِ فَاحْمِلُوهُ فِي قُرْقُورٍ فَتَوَسَّطُوا بِهِ الْبَحْرَ فَإِنْ رَجَعَ عَنْ دِينِهِ وَإِلاَّ فَاقْذِفُوهُ . فَذَهَبُوا بِهِ فَقَالَ اللَّهُمَّ اكْفِنِيهِمْ بِمَا شِئْتَ . فَانْكَفَأَتْ بِهِمُ السَّفِينَةُ فَغَرِقُوا وَجَاءَ يَمْشِي إِلَى الْمَلِكِ فَقَالَ لَهُ الْمَلِكُ مَا فَعَلَ أَصْحَابُكَ قَالَ كَفَانِيهِمُ اللَّهُ . فَقَالَ لِلْمَلِكِ إِنَّكَ لَسْتَ بِقَاتِلِي حَتَّى تَفْعَلَ مَا آمُرُكَ بِهِ . قَالَ وَمَا هُوَ قَالَ تَجْمَعُ النَّاسَ فِي صَعِيدٍ وَاحِدٍ وَتَصْلُبُنِي عَلَى جِذْعٍ ثُمَّ خُذْ سَهْمًا مِنْ كِنَانَتِي ثُمَّ ضَعِ السَّهْمَ فِي كَبِدِ الْقَوْسِ ثُمَّ قُلْ بِاسْمِ اللَّهِ رَبِّ الْغُلاَمِ . ثُمَّ ارْمِنِي فَإِنَّكَ إِذَا فَعَلْتَ ذَلِكَ قَتَلْتَنِي . فَجَمَعَ النَّاسَ فِي صَعِيدٍ وَاحِدٍ وَصَلَبَهُ عَلَى جِذْعٍ ثُمَّ أَخَذَ سَهْمًا مِنْ كِنَانَتِهِ ثُمَّ وَضَعَ السَّهْمَ فِي كَبِدِ الْقَوْسِ ثُمَّ قَالَ بِاسْمِ اللَّهِ رَبِّ الْغُلاَمِ . ثُمَّ رَمَاهُ فَوَقَعَ السَّهْمُ فِي صُدْغِهِ فَوَضَعَ يَدَهُ فِي صُدْغِهِ فِي مَوْضِعِ السَّهْمِ فَمَاتَ فَقَالَ النَّاسُ آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ . فَأُتِيَ الْمَلِكُ فَقِيلَ لَهُ أَرَأَيْتَ مَا كُنْتَ تَحْذَرُ قَدْ وَاللَّهِ نَزَلَ بِكَ حَذَرُكَ قَدْ آمَنَ النَّاسُ . فَأَمَرَ بِالأُخْدُودِ فِي أَفْوَاهِ السِّكَكِ فَخُدَّتْ وَأَضْرَمَ النِّيرَانَ وَقَالَ مَنْ لَمْ يَرْجِعْ عَنْ دِينِهِ فَأَحْمُوهُ فِيهَا . أَوْ قِيلَ لَهُ اقْتَحِمْ . فَفَعَلُوا حَتَّى جَاءَتِ امْرَأَةٌ وَمَعَهَا صَبِيٌّ لَهَا فَتَقَاعَسَتْ أَنْ تَقَعَ فِيهَا فَقَالَ لَهَا الْغُلاَمُ يَا أُمَّهِ اصْبِرِي فَإِنَّكِ عَلَى الْحَقِّ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে সবর সম্পর্কে একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি আমাদের পূর্ববর্তী জাতির। অর্থাৎ হযরত ঈসা আলাইহিস-সালামের অনুসারী খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের, যেহেতু এর ভেতর এক রাহিবের উল্লেখ আছে। আর রাহিব বলা হয় খৃষ্টান সন্ন্যাসীকে। তবে সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না ঠিক কখন এটি ঘটেছিল। তা জানা না গেলেও ঈমানের উপর অবিচলতা ও ঈমানী পরীক্ষায় ধৈর্যধারণ সম্পর্কে অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এর দ্বারা পাওয়া যায়।

বলা হয়েছে, পূর্বকালে এক রাজার একজন জাদুকর ছিল। সেকালে রাজা-বাদশার কাছে জাদুকরদের খুব খাতির ছিল। তখন জাদুবিদ্যারও খুব প্রসার ছিল। মানুষের বিশ্বাস ছিল, জাদুকর ভূত ও ভবিষ্যত এবং শুভ-অশুভ জানে। জাদুকরগণও মানুষের এ বিশ্বাসের খুব সুযোগ নিত। রাজা-বাদশাগণ যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাজকীয় কাজকর্মে তাদের পরামর্শ নিত। কোন কাজের পরিণাম শুভ এবং কোন কাজের পরিণাম অশুভ, তা তাদের জিজ্ঞেস করত। তারা তাদের ভোজভাজি ও শাস্ত্রীয় তেলেসমাতির ভিত্তিতে একটা কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করে দিত। যে জাদুকর যতবেশি ভোজভাজি জানত, তার ততবেশি কদর হত। খুব বেশি দক্ষতা থাকলে রাজদরবারেও স্থান হয়ে যেত। ঠিক রাজ-কবির মত তখন রাজ-জাদুকরেরও একটা পদ ছিল। বর্ণিত এ ঘটনায়ও রাজার একজন রাজ-জাদুকর ছিল। রাজ-জাদুকর বুড়ো হয়ে গেলে রাজার কাছ থেকে একটি বালক চেয়ে নিল, যাতে তাকে জাদুবিদ্যা শিখিয়ে তার জায়গায় বসাতে পারে আর তার মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে সে রাজ-জাদুকরের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারে।
বলা হয়েছে, জাদুকরের কাছে বালকটির যাতায়াতপথে এক রাহিব (খৃষ্টান সন্ন্যাসী) ছিলেন। একদিন বালকটি তার কাছে বসে যখন তার কথাবার্তা শুনল, তাতে খুব মুগ্ধ হয়ে গেল। তা মুগ্ধ হওয়ারই কথা। কারণ তার কথাবার্তা কাঁচাবয়সী বালকের বাইরের প্রভাবমুক্ত স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল। সব শিশুই তো স্বভাবধর্ম তথা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর আনুগত্যের স্বভাব নিয়ে জন্ম নেয়। যতক্ষণ পর্যন্ত বাইরের দূষিত চিন্তা-ভাবনা দ্বারা তার বিশুদ্ধ স্বভাব নষ্ট না হয়ে যায়, ততক্ষণ তাওহীদ ও ইসলামের শিক্ষা সে খুব কবুল করে। বালকটি যদিও নষ্ট পরিবেশে প্রতিপালিত হচ্ছিল, তদুপরি জাদুকরের শিরকী শিক্ষা তার স্বভাবধর্মকে বিকৃত করে ফেলার প্রয়াস পাচ্ছিল, কিন্তু বয়স অল্প হওয়ায় এবং ওই বিকৃত শিক্ষা গ্রহণে সদ্য অবতীর্ণ হওয়ায় তার স্বভাবধর্ম এখনও পুরোপুরি নষ্ট হতে পারেনি। এখনও পর্যন্ত তা সুস্থ ও শুদ্ধ শিক্ষা গ্রহণের পক্ষে প্রস্তুতই ছিল। সুতরাং সে তা গ্রহণ করে নিল। তাওহীদের শিক্ষা তার অন্তরে বেশ ভালোভাবেই শিকড় গেড়ে নিল। সে একজন পাক্কা ঈমানদার হয়ে উঠল। তার সে ঈমান কতটা পরিপক্ক ছিল, পরবর্তী ঘটনাবলীই তার প্রমাণ।

জাদুকরের কাছে আসা-যাওয়ার পথে রাহিবের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করতে গিয়ে সে জাদুকর ও নিজ পরিবার উভয়দিক থেকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। জাদুকরের কাছে উপস্থিত হতে দেরি হলে জাদুকর তাকে মারধর করত, আবার জাদুকরের কাছ থেকে ছুটির পর পরিবারের কাছে পৌঁছতে দেরি হলেও জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হত। এই জটিলতা থেকে মুক্তির জন্যে রাহিব তাকে এই কৌশল শিক্ষা দিলেন যে, জাদুকরকে বলবে আমার বাড়ি থেকে বের হতে দেরি হয়েছে আর পরিবারকে বলবে, জাদুকরের কাছ থেকে ছুটি দেরিতে হয়েছে। সুস্পষ্ট অসত্য কথা। প্রশ্ন হতে পারে, রাহিব তাকে অসত্য বলতে শিক্ষা দিলেন যে? এর উত্তর হল, এখানে দুই মন্দের ভেতরে অপেক্ষাকৃত সহজ মন্দকে অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাকে বলা হয় মন্দের ভালো। অর্থাৎ মিথ্যা বলাটাও পাপ। কিন্তু শিরক ও জাদুশিক্ষা আরও কঠিন পাপ। এই মিথ্যা বলে যদি সে নিজেকে রক্ষা না করে, তবে তাদের জুলুম-নির্যাতনে নির্ঘাত শিরকে লিপ্ত হতে হবে। সেই শিরক থেকে বাঁচার লক্ষে এই সাময়িক মিথ্যার আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। বড় স্বার্থ ও অধিকতর কল্যাণ রক্ষার্থে এরকম কৌশল অবলম্বনের অবকাশ আছে। উদাহরণস্বরূপ- বিবদমান দুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসার জন্যে যদি মিথ্যা বলার প্রয়োজন পড়ে. শরী'আতের পক্ষ থেকে তা বলার অনুমতি আছে। এমনিভাবে কাউকে অন্যের জুলুম থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলার প্রয়োজন দেখা দিলে তাও বলার অবকাশ আছে।

বলা হয়েছে, একটি বিরাট প্রাণী মানুষের যাতায়াত বন্ধ করে দিল। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কোথা থেকে একটি সিংহ এসে রাস্তায় বসে গিয়েছিল। সিংহের ভয়ে সেই পথে মানুষ চলাচল করার সাহস পাচ্ছিল না। মানুষকে এই বিপদ থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে বালকটি এগিয়ে আসল। এর জন্য সে এমন একটি পন্থা বেছে নিল, যাতে একই সংগে মানুষ সিংহের কবল থেকে বাঁচতে পারে আবার রাহিব ও জাদুকরের মধ্যে কে সত্যের উপর আছে তাও প্রমাণিত হয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা তার ইচ্ছা পূরণ করলেন। তার ছোঁড়া পাথরের আঘাতে সিংহটি মেরে ফেলে মানুষের চলাচল পথও মুক্ত করে দিলেন, সেইসংগে এটাও প্রমাণ করে দিলেন যে, রাহিবই সত্যের উপর আছে, তার পথই সঠিক।

বস্তুত তার এ ঘটনাটি সেই এলাকায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল। অভিজ্ঞ রাহিব বুঝতে পেরেছিলেন সামনে বালকটির কঠিন দিন আসছে। তাকে ঈমানের অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। কেননা নবী-রাসূলগণের ইতিহাস তো আছেই, তাছাড়াও যুগে-যুগে যারা আল্লাহর পথে মানুষকে দা'ওয়াত দিয়েছেন, যারা শিরক ও বিদ'আত এবং কুসংস্কারের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন, যারা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিপরীত কথা বলেছেন, তাদেরকে নিজ জাতির পক্ষ থেকেই কঠিন জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছে। রাজা-বাদশা ও সমাজপতিগণ তাদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে। স্বার্থান্বেষী মহল তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে চেয়েছে। প্রথমত নানারকম প্রলোভন দিয়ে তাদেরকে ক্ষান্ত করার চেষ্টা করেছে। তাতে ব্যর্থ হলে শক্তি আরোপ করেছে। নানারকম কষ্ট দিয়েছে। এমনকি শহীদ পর্যন্ত করে দিয়েছে। বস্তুত দীনী দাওয়াতের পথ কখনওই মসৃণ হয় না। কঠিন ত্যাগ স্বীকার ছাড়া এ পথে সফলতা লাভ হয় না। তো এই বালকের যখন দীনের সত্যতা বুঝে এসে গেছে এবং হিংস্র পশুটিকে হত্যার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে তার উচ্চ মর্যাদারও ইশারা পাওয়া গেছে, তখন সে এই সত্যের পতাকা নিয়ে সামনে অগ্রসর হবেই হবে। কোনও শক্তি তাকে নিরস্ত করতে পারবে না। তাকে কঠিন জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে এ উদ্যমী বালক তাতে দমার পাত্র নয়। রাহিব এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, ঈমানী দৃঢ়তায় বালকটি তারচে' অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যত কঠিন পরীক্ষাই হোক, তাতে সে অবশ্যই উত্তীর্ণ হবে। তিনি চাচ্ছিলেন যেন তার নিজের সেরকম পরীক্ষায় পড়তে না হয়। কেননা জুলুম-নির্যাতনের মুখে নিজেকে সত্যের উপর ধরে রাখা খুব সহজ কথা নয়। সে ক্ষেত্রে ঈমান মস্তবড় ঝুঁকিতে পড়ে যায়। তিনি সেই ঝুঁকি এড়াতে চাচ্ছিলেন। তাই তাকে বলে দিলেন, তুমি যদি পরীক্ষায় পড়ে যাও, ঈমানের কারণে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হও এবং কে তোমাকে এই পথ দেখিয়েছে তোমার কাছে তা জানতে চাওয়া হয়, তবে সাবধান! আমার নাম কিন্তু বলে দিও না।

ঈমানদার বালকটি আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করত। তার চিকিৎসায় জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত লোক ভালো হয়ে যেত। তারা ভালো হত আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাতেই। বালকের নিজস্ব কোনও ক্ষমতা ছিল না। তা কারও থাকেও না। রোগ ভালো হয় দেখে কেউ যাতে বিভ্রান্তিতে না পড়ে, সে লক্ষ্যে বালকটি পরিষ্কারই বলে দিত আমি কাউকে নিরাময় করি না, নিরাময় করেন আল্লাহ তা'আলাই। আমি কেবল আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আই করতে পারি। আমার দু'আ কবুল করে আল্লাহ তা'আলা রোগ ভালো করে দেন।

রোগীর জন্য দু'আ করা ও তাতে রোগ ভালো হয়ে যাওয়া বালকটির পক্ষ থেকে ছিল সৃষ্টির এক বিরাট সেবা। সৃষ্টির সেবা দ্বারা যেমন বিপুল ছওয়াব লাভ হয়, তেমনি মানুষের ভেতর ভালোবাসা ও সম্প্রীতিও প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সম্প্রীতি ও ভালোবাস দীনী দাওয়াতের ক্ষেত্র তৈরি করে। ঈমানে উজ্জীবিত এই বালক এভাবে দেবর মাধ্যমে ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিল এবং মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিল। তার দাওয়াত কবুল করে একের পর এক পথহারা মানুষ আল্লাহর পথে ফিরে আসছিল। সবশেষে রাজার মন্ত্রীও তার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে আল্লাহর পথে ঈমান এনে ফেলে। আর তখনই শুরু হয়ে যায় পরীক্ষা, যার বিবরণ এ হাদীছে দেওয়া হয়েছে।

রাজার তো উচিত ছিল অন্ধ মন্ত্রীকে চক্ষুষ্মান দেখে বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগানো। নিজেকে রব্ব ও প্রতিপালক গণ্য করা এমনিতেও চরম নির্বুদ্ধিতা। আল্লাহর পথের ডাক শুনে তার কর্তব্য ছিল নিজ নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। মন্ত্রীর ইসলামগ্রহণ দ্বারা আল্লাহ তা'আলা তাকে সচেতন হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদীরা কোথায় কখন সচেতন হয়েছে? স্বার্থরক্ষার ধান্ধায় তারা চরম অন্ধ ও বধির হয়ে যায়। তাদের সে অন্ধত্ব ও বধিরতা কোনও কিছুতেই ঘোচে না। বস্তুত তারা তা ঘোচাতে চায়ও না। বরং যে সত্যের ধ্বনি তা ঘোচানোর চেষ্টা করে, সেই সত্যকেই যারা স্তব্ধ করে দেওয়ার পায়তারা চালায়। এ রাজাও সেই কায়েমী স্বার্থবাদীদের একজন ছিল। তাই যখন তার পাঠানো পেয়াদারা পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেল কিন্তু বালকটির কিছুই হল না, সে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় হেঁটে হেঁটে রাজার কাছে ফিরে আসল, তখনও তার চোখ খুলল না। যখন তার পাঠানো লোকেরা সাগরে ডুবে মারা গেল কিন্তু বালকটির কিছুই হল না; বরং সহী-সালামতে রাজার কাছে ফিরে আসল, তখনও তার হুঁশ হল না। যখন বালকটি নিজে থেকে তাকে হত্যা করার কৌশল শিখিয়ে দিল এবং তাতে আল্লাহর নাম উচ্চারণেরও পরামর্শ দিল, তখনও তার অন্তরে কৌতূহল জাগল না। এমনকি যখন আল্লাহর নাম নিয়ে তীর ছুঁড়ল এবং তাতে বিদ্ধ হয়ে বালকটি শহীদ হয়ে গেল, তখনও তার চৈতন্যোদয় হল না। তখনও তার ভাববার অবকাশ হল না যে, প্রকৃতপক্ষে সেই আল্লাহই সবকিছু করেন, যাঁর প্রতি এ বালকটি ঈমান আনার দা'ওয়াত দিচ্ছে। অথচ এই ঘটনা উপস্থিত লোকজনের অন্তরে ঠিকই নাড়া দিয়েছিল। তারা তখনই দলে দলে ঈমান এনেছিল। তারা সমস্বরে বলে উঠেছিল, আমরা এই বালকের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলাম। অন্ততপক্ষে তাদের ঈমান আনয়ন দেখেও সে বিবেকের একটু তাড়া বোধ করতে পারত। কিন্ত তাও করল না। উল্টো তাদেরকে নির্যাতন করল এবং আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করল।

যাদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিল, তাদের মধ্যে এক মহিলা ও তার শিশুও ছিল। শিশুটি ছিল খুবই ছোট। তখনও তার কথা বলার বয়স হয়নি। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তার বয়স ছিল মাত্র সাত মাস। তার মা যখন আগুনে পড়তে ইতস্তত করছিল, তখন শিশুটি তার মাকে ডেকে সাহস যোগায়। সে বলে ওঠে, মা তুমি ধৈর্য ধর। কেননা তুমি সত্যের উপর আছ ধৈর্যধারণ করলে আল্লাহর কাছে প্রভৃত ছওয়াবের অধিকারী হবে।

এই শিশুর কথা বলাটা ছিল একটি অলৌকিক ঘটনা। কথা বলার বয়স হওয়ার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে শিশুর আল্লাহ তা'আলা ক্ষণিকের জন্যে বাকশক্তি আগেই শিশুর মুখে বাকশক্তি দান করা আল্লাহ তা'আলার পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে শিশুরমুখে আল্লাহ্ তা'আলা ক্ষণিকের জন্য বাকশক্তি দান করেছেন। ইমাম জালালুদ্দীন সুতী রহ এরকম দশটি শিশুর উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে এই শিশুও একটি। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের পরপরই কথা বলার ঘটনা তো সকলেরই জানা। কুরআন মাজীদেও তা বর্ণিত হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছের প্রধান শিক্ষা তো ধৈর্য সম্পর্কে। বিশেষত দীনের পথে শত্রুদের পক্ষ থেকে যে জুলুম-নির্যাতন আসে, তাতে ধৈর্যধারণ করা এবং ঈমান ও সত্যের উপর অবিচলিত থাকা নবীগণের শান। প্রত্যেক মু'মিন ও দাওয়াতদাতার কর্তব্য এই শান ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করা।

খ. বালক-বয়সেই দীন শিক্ষায় মনোনিবেশ করা উচিত। শৈশবের শিক্ষা মনে গভীর রেখাপাত করে এবং তা বেশি দিন স্মরণ থাকে। তাছাড়া শৈশবের সুশিক্ষা মানুষের স্বভাবগত গুণের মত হয়ে যায়। ফলে কর্মজীবনে সেই শিক্ষা অনুযায়ী চলা তার পক্ষে সহজ হয়।

গ. বালকের পাথর নিক্ষেপে সিংহের মৃত্যু দ্বারা প্রমাণ হয় বুযুর্গানে দীনের কারামত সত্য। বিভিন্ন
রোগীকে ভালো করাও ছিল তার কারামত।

ঘ. কারও কোনও কাজে অন্যের বিভ্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকলে তার উচিত বিষয়টা পরিষ্কার করে দেওয়া, যাতে লোকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পায়, যেমন বালকটি রোগ নিরাময়ের বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট বলে দিয়েছে যে, এটা আমি করি না, আল্লাহ তা'আলাই করেন (আমি কেবল আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আই করে থাকি)।

ঙ. শত্রুর জুলুম-নির্যাতনে সত্যে অবিচলিত থাকার ব্যাপারে কারও নিজের প্রতি যদি পুরোপুরি আস্থা না থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে তার জুলুম-নির্যাতন এড়ানোর পথ খোঁজা জায়েয আছে। যার হিম্মত ও মনোবল উঁচু, বলাবাহুল্য সে তো প্রাণ দিতেও কুণ্ঠিত হবে না। এটা 'আযীমাত বা আমলের উচ্চতর স্তর। বালকটির আমল ছিল এই স্তরের। প্রথমটি অবকাশের স্তর। সে স্তর অবলম্বনেও দোষ নেই। যেমন নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদার মুসায়লিমা আল-কাযযাব নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুজন সাহাবীকে পাকড়াও করে একজনকে বলেছিল, মুহাম্মাদ সম্পর্কে তুমি কী বল? সাহাবী উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি আল্লাহর রাসূল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, আমার সম্পর্কে কী বল? তিনি বলেছিলেন, তুমিও। সে তখন তাকে ছেড়ে দেয়। অন্যজনকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি মুহাম্মাদ সম্পর্কে কী বল? তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর রাসূল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, আমার সম্পর্কে কী বল? তিনি বলেছিলেন, জানি না। সে একের পর এক ওই প্রশ্ন করতে থাকে। তিনি প্রতিবারই বলতে থাকেন, আমি জানি না। শেষে মুসায়লিমা তার একেকটি অঙ্গ কাটতে শুরু করে। কিন্তু তিনি ঈমানে অবিচল থাকেন। তাদের এ বৃত্তান্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, তাদের একজন আল্লাহ প্রদত্ত অবকাশকে গ্রহণ করেছে, আর দ্বিতীয় জন সত্যের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দিয়েছে। তাকে সাধুবাদ জানাই। ইবন কাছীর রহঃ এ হাদীছ উল্লেখ করেছেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
rabi
বর্ণনাকারী: