আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
২০- যাকাতের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১৪৯৬
৯৪৫. ধনীদের থেকে সাদ্কা গ্রহণ করা এবং যে কোন স্থানের অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা।
১৪০৯। মুহাম্মাদ ইবনে মুকাতিল (রাহঃ) ......... ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মু’আয ইবনে জাবাল (রাযিঃ) কে ইয়ামানের (শাসক নিয়োগ করে) পাঠানোর সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বলেছিলেনঃ তুমি আহলে কিতাবের কাছে যাচ্ছ। কাজেই তাদের কাছে যখন পৌঁছবে, তখন তাদেরকে এ কথার দিকে দাওয়াত দিবে তারা যেন সাক্ষ্য দিয়ে বলে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল। যদি তারা তোমার এ কথা মেনে নেয় তবে তাদের বলবে যে, আল্লাহ তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যদি তারা এ কথাও মেনে নেয় তবে তাদের বলবে যে, আল্লাহ তাদের উপর সাদ্কা (যাকাত) ফরয করেছেন- যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে এবং অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হবে। তোমার এ কথা যদি তারা মেনে নেয়, তবে (কেবল) তাদের উত্তম মাল গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে এবং মযলুমের বদদুআকে ভয় করবে। কেননা, তার (বদদুআ) এবং আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি.-কে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরী ১০ম সালে ইয়ামানের গভর্নর করে পাঠিয়েছিলেন। তাঁকে সেখানে পাঠানোর সময় তিনি যে উপদেশ ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন, এ হাদীছে তার অংশবিশেষ বর্ণিত হয়েছে। তিনি তাঁকে বলেছিলেনঃ-
إنك تأتي قوما من أهل الكتاب
'তুমি যাচ্ছ আহলে কিতাবের একটি সম্প্রদায়ের কাছে।'
আহলে কিতাব মানে আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী সম্প্রদায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবকালে এমন সম্প্রদায় ছিল দু'টিই- ইয়াহুদী ও নাসারা। ইয়াহুদী সম্প্রদায় তাওরাত গ্রন্থে বিশ্বাসী, যা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি নাযিল হয়েছিল। আর নাসারা সম্প্রদায় ইন্জীল গ্রন্থে বিশ্বাসী, যা নাযিল হয়েছিল হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি। অবশ্য এ কিতাবদু'টি তারা বিকৃত করে ফেলেছিল। তারা যাকে তাওরাত ও ইনজীল বলে, তা মূলত হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি নাযিলকৃত আসল কিতাব নয়; বরং তাদের হাতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা বিকৃত কিতাব।
দাওয়াতের ক্ষেত্রে মাদ'উর অবস্থা বিবেচনায় রাখা
হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি.-কে যখন ইয়ামানে পাঠানো হয়, তখন সেখানে বেশিরভাগ ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়ের লোক বাস করত। পৌত্তলিকদের সংখ্যা তুলনামূলক কম ছিল। এ কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে সচেতন করছেন যে, তুমি যাচ্ছ আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের কাছে। অর্থাৎ তাদের কাছে আসমানী কিতাবের কিছু না কিছু জ্ঞান আছে। আর কিতাবের মধ্যে পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটানোর সুবাদে তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি ও যুক্তি-তর্কের কিছু না কিছু চর্চাও আছে। কাজেই তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার আগে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের অবস্থা অনুযায়ী তাদের সাথে কথা বলতে হবে। কেননা দাওয়াত যাতে ফলপ্রসূ হয় সেজন্য মাদ'ঊ (অর্থাৎ যাকে দাওয়াত দেওয়া হয়)-এর অবস্থা বিবেচনায় রাখা জরুরি।
মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারে কুরআন মাজীদের নির্দেশনা হচ্ছেঃ-
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়। (সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১২৫)
এই হিকমত ও সদুপদেশ এবং উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক করার বিষয়টি সবার সঙ্গে একরকম হয় না। শিক্ষিত লোকদের সঙ্গে একরকম, অজ্ঞদের সাথে অন্যরকম; চালাক চতুর লোকের সঙ্গে একরকম, সহজ-সরল লোকের সাথে অন্যরকম; আবার যারা আহলে কিতাব তাদের সঙ্গে হবে একরকম, আর যারা পৌত্তলিক বা নাস্তিক তাদের সাথে হবে অন্যরকম। প্রত্যেকের সাথে কথা বলার সময় তার সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় রাখতে হয়, অন্যথায় দাওয়াত ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি.-কে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, তার দাওয়াতী কার্যক্রম হবে আহলে কিতাবের মধ্যে। তাদের সার্বিক অবস্থা মাথায় রেখেই যেন তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
দাওয়াতের পর্যায়ক্রম
নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি.-কে যেসকল নির্দেশনা দান করেছিলেন তার মধ্যে একটা হচ্ছে দাওয়াতের পর্যায়ক্রম। অর্থাৎ দা'ঈ কি ইসলামের যাবতীয় বিষয় একইসঙ্গে মাদ'উর সামনে তুলে ধরবে, না পর্যায়ক্রমে এক-একটি করে উল্লেখ করবে? এ হাদীছ জানাচ্ছে, একই সঙ্গে সব উল্লেখ করবে না। কেননা তাতে মাদ'উর কাছে ইসলামের শিক্ষা অনেক ভারী ও কঠিন মনে হবে। ফলে সে দাওয়াত গ্রহণে উৎসাহ পাবে না। তাই দা'ঈর কর্তব্য মাদ'উর সামনে ইসলামের শিক্ষাসমূহ পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা।
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, প্রথমে তাদেরকে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য দিতে বলবে। এটা মেনে নিলে দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের কথা বলবে। যদি তাও মেনে নেয়, তবে তৃতীয় পর্যায়ে বলবে যাকাতের কথা।
লক্ষ করা যাচ্ছে, পর্যায়ক্রমিকভাবে দাওয়াতের ক্ষেত্রেও 'আল আহাম্ম্ ফাল আহাম্ম্' অর্থাৎ বিষয়বস্তুর গুরুত্বের পর্যায়ক্রম রক্ষার প্রতিও ইশারা করা হয়েছে। সর্বপ্রথম দাওয়াত দেবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের। তারপর দাওয়াত দেবে সেই বিষয়ের, যার গুরুত্ব অন্যগুলোর চেয়ে বেশি। তারপর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের। তারপর চতুর্থ, তারপর পঞ্চম এভাবে।
যেহেতু ঈমানের গুরুত্ব সবচে' বেশি এবং তার মধ্যেও সবচে' বেশি গুরুত্ব তাওহীদের, তাই বলা হয়েছে যে- فادعهم إلى شهادة أن لا إله إلا الله وأني رسول الله অর্থাৎ তাদেরকে আহ্বান জানাবে যেন তারা এ সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল।
লক্ষণীয় যে, ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায় আসমানী ধর্মের অনুসারী। সব আসমানী ধর্মই তাওহীদের শিক্ষা দিয়ে থাকে। সে হিসেবে ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়ের এক আল্লাহতে বিশ্বাস থাকারই কথা। তা সত্ত্বেও যখন তাদেরকে এ সাক্ষ্য দিতে বলা হচ্ছে, তখন বোঝা যাচ্ছে এরা আসমানী শিক্ষার ওপর নেই। তারা তাদের কিতাব ও নবীর শিক্ষা থেকে সরে গিয়ে আল্লাহর সঙ্গে অন্যদের শরীক করছে। নাসারাদের সম্পর্কে তো সকলেই জানে তারা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস করে। ইয়াহুদীদের মধ্যেও একরকম পৌত্তলিকতা ঢুকে গিয়েছিল। তাদের একটি দল তো আল্লাহর নবী হযরত উযাইর আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্রই সাব্যস্ত করেছিল। এভাবে যেহেতু এ সম্প্রদায়দু'টি তাওহীদের বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তাই তাদেরকে আবার সেদিকে ফিরে আসার আহ্বান জানাতে বলা হয়েছে।
এক আল্লাহর প্রতি সাক্ষ্যদানের পাশাপাশি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আল্লাহর রাসূল, এ কথার সাক্ষ্যদান করাও জরুরি। তা না হলে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস সাব্যস্ত হয় না। এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ- أتدرون ما الإيمان بالله وحده؟ 'তোমরা কি জান এক আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ কী?' তারা বলেছিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তখন তিনি বলেনঃ- شهادة أن لا إله إلا الله وأن محمدا رسول الله 'এক আল্লাহর প্রতি ঈমান হচ্ছে এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল।' (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৭: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৮: বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২০: ত্বহাবী, শারহু মাআনিল আছার, হাদীছ নং ৫৪২২; মুসনাদ আবূ দাউদ তয়ালিসী, হাদীছ নং ২৮৭০)
ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায় যেহেতু হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর রাসূল বলে স্বীকার করে না, তাই এমনিতেও এক আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান যথার্থ নয়। তাই তাদেরকে সত্যিকার অর্থে এক আল্লাহর প্রতি ঈমানের আহ্বান জানাতে বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, তাদেরকে এ সাক্ষ্য দেওয়ারও আহ্বান জানাবে যে, আমি আল্লাহর রাসূল।
মোটকথা, পৌত্তলিক, নাস্তিক ও আহলে কিতাব নির্বিশেষে যে-কোনও মাদ'উকে দাওয়াত দেওয়ার সময় সর্বপ্রথম তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্যদান করার আহ্বান জানানো চাই। কেননা এর ওপরই অন্যসব আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী এবং শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধের ভিত্তি। এ সাক্ষ্যদান করলেই বাকিগুলো মানার প্রশ্ন আসে এবং তা মানা গ্রহণযোগ্য হয়। পক্ষান্তরে কেউ যদি সবকিছু মেনে নেয় কিন্তু তাওহীদ ও রিসালাত না মানে, তবে তার কোনও কিছুই ধর্তব্য নয়। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি.-কে সর্বপ্রথম তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্যদান করার প্রতি আহ্বান জানাতে বলেছেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদেরকে রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামায সম্পর্কে অবহিত করতে বলেছেন। বলা হয়েছেঃ-
فإن هم أطاعوا لذلك، فأعلمهم أن الله قد افترض عليهم خمس صلوات في كل يوم وليلة
'যদি তারা এটা মেনে নেয় তবে তাদেরকে শিক্ষা দেবে যে, আল্লাহ তাআলা প্রতি দিবারাত্রে তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন।' অর্থাৎ তারা যদি এ সাক্ষ্যদান করে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, তবে তারা মু'মিন সাব্যস্ত হল। এখন কর্তব্য হবে ইসলামী শরী'আত মেনে চলা। শরী'আতের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিধান হচ্ছে নামায। মু'মিন ব্যক্তির ওপর প্রত্যহ দিবারাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয। যেহেতু ঈমানের পর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিধান হচ্ছে নামায, তাই দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদেরকে নামায সম্পর্কে জানাতে বলা হয়েছে।
তাদেরকে নামায সম্পর্কে জানাতে বলা হয়েছে কেবল তখনই, যখন তারা প্রথমেই ঈমান আনবে। পক্ষান্তরে তারা যদি ঈমানই না আনে, তখন নামায এবং শরী'আতের অন্যান্য বিধান সম্পর্কে তাদেরকে জানানোর প্রশ্ন আসে না। বরং তখন কর্তব্য তাদেরকে জিযিয়া আদায়ের আদেশ করা। তা আদায় করলে তারা মুসলিম রাষ্ট্রে মুসলিম জনগণের মত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু তারা যদি জিযিয়া দিতে সম্মত না হয়, তখন জিহাদের হুকুম প্রযোজ্য হয়। অন্যান্য হাদীছে এর বিস্তারিত বিবরণ আছে।
তৃতীয় পর্যায়ে বলা হয়েছেঃ-
فإن هم أطاعوا لذلك، فأعلمهم أن الله قد افترض عليهم صدقة
অর্থাৎ তারা যদি রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামায মেনে নেয়, তবে তাদেরকে সদাকা (যাকাত) সম্পর্কে অবহিত করবে। নামায মেনে নেওয়ার শর্ত এজন্য যে, যে ব্যক্তি নামায ফরয বলে মানবে না সে মু'মিন বলে গণ্য হবে না। আর যে ব্যক্তি মু'মিন নয় তার ওপর যাকাত বা শরী'আতের অন্য কোনও বিধান প্রযোজ্য হয় না।
শরী'আতের কোনও ফরয বিধানকে ফরয বলে স্বীকার করা ঈমানের অঙ্গ। যে ব্যক্তি তা স্বীকার করে না সে মু'মিন নয়। হাঁ, কেউ তা স্বীকার করার পর যদি কার্যত পালন না করে অর্থাৎ সে মানে ও বিশ্বাস করে যে নামায ফরয, কিন্তু নামায পড়ে না, তবে তাকে মু'মিন বলে স্বীকার করা হবে। অবশ্য নামায না পড়ার কারণে সে ফাসেক সাব্যস্ত হবে। এ অবস্থায় ইসলামী সরকারের কর্তব্য তাকে নামায পড়তে বাধ্য করা।
এ হাদীছে যাকাতকে ‘সদাকা' শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীছে যাকাত অর্থে সদাকা শব্দের ব্যবহার ব্যাপক। যাকাতকে সদাকা বলা হয় এ কারণে যে, যাকাত দেওয়ার দ্বারা ব্যক্তির ঈমানের সত্যতা সাব্যস্ত হয়। সদাকা শব্দের মূল ধাতুর মধ্যে ‘সত্যতা’-এর অর্থ আছে।
যাকাত সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ-
تؤخذ من أغنيائهم فترد على فقرائهم
‘যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করে তাদের গরীবদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।'
‘তাদের ধনী' বলে মুমিনদের মধ্যে যারা ধনী তাদেরকে আর 'তাদের গরীব' বলে মুমিনদের মধ্যে যারা গরীব তাদেরকে বোঝানো হয়েছে। এটা প্রমাণ করে যাকাত কেবল মুমিনের ওপরই ফরয। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের থেকে যাকাত গ্রহণ করা যাবে না। আরও প্রমাণ করে যাকাতের অর্থ কেবল গরীব মুসলিমদেরকেই দেওয়া যায়। অমুসলিম গরীবদের মধ্যে যাকাত বিতরণ জায়েয নয়।
এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় যাকাত গরীবের হক। গরীবদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য ধনীদের ওপর এটা ফরয করা হয়েছে। ফরয হওয়ার অর্থ এটা তাদেরকে অবশ্যই দিতে হবে। না দিলে কঠিন পাপ হবে এবং সেজন্য আখিরাতে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। সেই পাপ ও তার কঠিন শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই যাকাতদাতার কর্তব্য যাকাত দেওয়া। সুতরাং যাকাত দেওয়াটা গরীবের প্রতি ধনীর কোনও অনুগ্রহ নয়; বরং নিজের মুক্তিলাভের ব্যবস্থা। তাই যাকাত দিতে হবে ইখলাসের সাথে, কেবলই আল্লাহ তা'আলাকে রাজি-খুশি করার জন্য। দিতে হবে বিনয় নম্রতার সাথে এবং যাকে দেওয়া হবে তার ইজ্জত-সম্মান রক্ষার সাথে। এ ব্যাপারে ব্যাপক অবহেলা লক্ষ করা যায়। সে অবহেলা যেমন আল্লাহর কাছে যাকাত কবূল হওয়ার পক্ষে বাধা, তেমনি এর পার্থিব সুফল তথা পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি সৃষ্টির পক্ষেও অন্তরায়। আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।
তারপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকাতদাতার নিকট থেকে যাকাত উশুলের ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেনঃ- فإن هم أطاعوا لذلك، فإياك وكرائم أموالهم 'যদি তারা এটা মেনে নেয়, তবে (যাকাত হিসেবে) তাদের উৎকৃষ্ট সম্পদ গ্রহণ করা হতে বিরত থাকবে।' অর্থাৎ বেছে বেছে তাদের উৎকৃষ্ট মাল গ্রহণ করবে না। তখন আরবদের প্রধান মাল ছিল গবাদি পশু- উট ও ছাগল। গবাদি পশু তিন রকম হয়ে থাকে- উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট ও মধ্যম। যদি গরীবদের মধ্যে বিতরণের জন্য যাকাতদাতার নিকট থেকে তার উৎকৃষ্ট পশু বেছে বেছে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে যাকাতের ইহলৌকিক ফায়দা ব্যহত হবে। যাকাতের একটা ফায়দা হচ্ছে গরীব-ধনীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল নেওয়া হলে তা তো প্রতিষ্ঠিত হবেই না, উল্টো গরীবের প্রতি ধনীর মনে বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে। যাকাতের আরেক ফায়দা হচ্ছে গরীবের প্রয়োজন মেটানো। কাজেই যদি নিকৃষ্ট মাল দ্বারা যাকাত আদায় করা হয়, তবে গরীবের সে প্রয়োজন মিটবে না। তাই কর্তব্য মধ্যম স্তরের মাল গ্রহণ করা। তাতে গরীবের প্রয়োজনও মিটবে এবং ধনীও গরীবের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে যাকাত দিতে আগ্রহী হবে।
উল্লেখ্য, মালের মধ্যে এ মানগত পার্থক্য কেবল গবাদি পশু এবং ফল ও ফসলের মধ্যেই হয়ে থাকে। টাকা-পয়সার মধ্যে এ পার্থক্য নেই। কাজেই টাকা-পয়সা দ্বারা যাকাত আদায় করা হলে এ বিষয়টি বিবেচনার প্রশ্ন আসে না।
যাকাত ও দান-সদাকা প্রদানে ইসলামের মেযাজ
প্রকাশ থাকে যে, বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল না নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেই ব্যক্তিকে, যে সরকারের পক্ষ থেকে যাকাত উশুলের দায়িত্বে নিয়োজিত। পক্ষান্তরে যাকাতদাতা নিজেই যদি বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল দেয়, তবে তা প্রশংসনীয় বৈ কি। যদিও এটা ঐচ্ছিক বিষয়, কিন্তু ইসলাম এতে উৎসাহ দিয়ে থাকে এবং ইসলামের মেযাজও এটাই যে, মানুষ তার উৎকৃষ্ট মাল থেকেই দান-সদাকা করবে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ
“হে মুমিনগণ! তোমরা যা-কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা-কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৬৭)
দান-সদাকার ক্ষেত্রে ইসলামের মেযাজ কেবল উৎকৃষ্ট বস্তুর মধ্যে সীমিত নয়; বরং কুরআন মাজীদ তারও উপরে প্রিয়বস্তু দান-খয়রাত করতে উৎসাহ দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
'তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে। তোমরা যা কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।' (সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ৯২)
এ আয়াত নাযিল হলে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে তাদের সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু দান সদাকা করার ধুম পড়ে যায়। হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. মসজিদে নববী সংলগ্ন তাঁর একটি বাগান সদাকা করে দেন। এ বাগানের ভেতর 'বী-রাহা' নামে একটি কুয়া ছিল। সেই কুয়ার নামে পরিচিত তাঁর এ বাগানটিই ছিল তাঁর সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ও সবচে' প্রিয় সম্পদ।
হযরত যায়দ ইব্ন হারিছা রাযি, তাঁর সবচে' প্রিয় ঘোড়াটি সঙ্গে নিয়ে হাজির হন এবং আরয করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই ঘোড়াটি আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ, আমি এটি আল্লাহর পথে দান করে দিতে চাই। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটি তাঁর কাছ থেকে নিয়ে তাঁর পুত্র উসামা রাযি.-কে দিয়ে দেন। এতে হযরত যায়দ ইব্ন হারিছা রাযি, খুশি হতে পারলেন না। কারণ তাঁর দান করা ঘোড়া তাঁর ঘরেই ফিরে আসল। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দিলেন যে, তোমার দান আল্লাহ তা'আলা কবূল করে নিয়েছেন।
হযরত উমর ফারূক রাযি, তাঁর সবচে' প্রিয় দাসীটি আল্লাহর ওয়াস্তে আযাদ করে দেন। তাঁর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ রাযি.-ও তাঁর সবচে' পছন্দের দাসীটিকে আযাদ করে দিয়েছিলেন। সাহাবায়ে কিরামের এ জাতীয় ঘটনার অভাব নেই। তাদের বিশ্বাস ছিল আল্লাহর পথে যা দান করা হবে তাই তার জন্য জমা থাকবে এবং আখিরাতে তা পাওয়া যাবে। তাই সবচে' দামী ও সবচে' বেশি প্রিয় সম্পদ দান করতেই তারা উৎসাহ বোধ করতেন।
আমাদেরও কর্তব্য তাদের অনুসরণে যাকাত ও দান-সদাকায় উৎকৃষ্ট ও প্রিয় সম্পদই দিয়ে দেওয়া। মধ্যম মানের সম্পদ গ্রহণের যে আদেশ করা হয়েছে, সে আদেশ তো সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করবে তার জন্য, যাতে তার পক্ষ থেকে জুলুম না হয়ে যায়। যাকাতদাতাকে এ আদেশ করা হয়নি যে, তুমি যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রেও মধ্যমটি বেছে নিও। বরং তাকে সবচে' উৎকৃষ্ট ও সবচে' পছন্দেরটি দিতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, যদিও মধ্যম মানেরটি দিলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
জুলুম পরিহার ও মজলূমের বদদুআ থেকে বাঁচার হুকুম
সবশেষে ইরশাদ হয়েছেঃ-
واتق دعوة المظلوم؛ فإنه ليس بينها وبين الله حجاب
'আর মাজলূমদের দুআকে (অর্থাৎ বদদুআকে) ভয় করবে, কেননা তার ও আল্লাহর মাঝখানে কোনও আড়াল থাকে না।'
এ উপদেশটি দেওয়া হয়েছে যাকাতদাতার নিকট থেকে বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল নিতে নিষেধ করা প্রসঙ্গে। কেননা বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল নিলে তার প্রতি জুলুম করা হয় আর জুলুম করা জায়েয নয়। সুতরাং সাবধান! যাকাতদাতার নিকট থেকে বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল আদায় করে তার প্রতি জুলুম করবে না।
তবে এ উপদেশটি দেওয়া হয়েছে ব্যাপক শব্দে। অর্থাৎ সর্বপ্রকার জুলুমই পরিহার করে চলবে। যাকাতদাতার প্রতিও জুলুম করবে না এবং অন্য কারও প্রতিও নয়। কেননা তুমি যার প্রতিই জুলুম কর না কেন, সেই তো মাজলূম হবে। আর মাজলূম ব্যক্তি যদি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায় এবং জালেমের বিরুদ্ধে তাঁর কাছে দু'আ করে, তবে তা অবশ্যই কবূল হয়। তার দু'আ ও আল্লাহর মাঝখানে কোনও আড়াল না থাকা দ্বারা দু'আ কবূলের অনিবার্যতা বোঝানো হয়েছে।
মজলুম ব্যক্তি যেমনই হোক না কেন, তার বদদুআ কবূল হয়-ই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-
دعوة المظلوم مستجابة وإن كان فاجرا ففجوره على نفسه
'মজলূমের দুআ অবশ্যই কবুল হয়, যদিও সে পাপিষ্ঠ হয়। তার পাপাচারের দায় তার নিজের।' (মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭৮০। মুসনাদ আবূ দাউদ ওয়ালিসী, হাদীছ নং ২৪৫০)
কেউ প্রশ্ন করতে পারে, আমরা তো অনেক সময় দেখি মজলূম ব্যক্তি বদদু‘আ করছে অথচ জালেমের কিছুই হচ্ছে না?
এর উত্তর এই যে, বান্দা দু'আ করে তার নিজ বুঝ অনুযায়ী আর আল্লাহ তা'আলা তা কবূল করেন নিজ শান অনুযায়ী। সুতরাং বান্দার কল্যাণার্থে কখনও তিনি বান্দা যা চায় তাই দিয়ে দেন, কখনও তা না দিয়ে অন্যকিছু দেন, হয়তো তার থেকে কোনও বিপদ দূর করেন অথবা তা আখিরাতের জন্য সঞ্চিত রাখেন। বান্দা আখিরাতে সেই সঞ্চিত দু'আর প্রতিদান দেখে এই বলে আক্ষেপ করবে যে, আহা, দুনিয়ায় যদি আমার কোনও দু‘আই কবূল না হত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য আঞ্চলিক শাসকদেরকে দীন প্রচারে ভূমিকা রাখতে উৎসাহ দেওয়া।
খ. আঞ্চলিক শাসকগণ যাতে জনগণের ওপর জুলুম অবিচার না করে সে ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক করাও রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব।
গ. দা'ঈর কর্তব্য আগে মাদ'উর অবস্থা বিচার-বিশ্লেষণ করা, তারপর সে অনুযায়ী তাকে দাওয়াত দেওয়া।
ঘ. দাঈির কর্তব্য দাওয়াতের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমিকতার নীতি অনুসরণ করা। অর্থাৎ অমুসলিমকে প্রথম ঈমানের দাওয়াত দেবে, তারপর নামায, তারপর যাকাত এবং এভাবে গুরুত্বের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী একটির পর আরেকটি সম্পর্কে অবহিত করবে।
ঙ. তহসিলদারের কর্তব্য যাকাত আদায়কারী থেকে যাকাত হিসেবে মধ্যম মানের মাল গ্রহণ করা। যাকাতদাতা নিজেই যদি উৎকৃষ্ট মাল দেয় সেটা তার নিজের ইচ্ছা।
চ. মজলূমের বদদু'আ অবশ্যই কবুল হয়। তাই প্রত্যেকের সতর্ক থাকা উচিত, যাতে তার পক্ষ থেকে কারও প্রতি কোনওভাবেই জুলুম না হয়ে যায়।
إنك تأتي قوما من أهل الكتاب
'তুমি যাচ্ছ আহলে কিতাবের একটি সম্প্রদায়ের কাছে।'
আহলে কিতাব মানে আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী সম্প্রদায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবকালে এমন সম্প্রদায় ছিল দু'টিই- ইয়াহুদী ও নাসারা। ইয়াহুদী সম্প্রদায় তাওরাত গ্রন্থে বিশ্বাসী, যা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি নাযিল হয়েছিল। আর নাসারা সম্প্রদায় ইন্জীল গ্রন্থে বিশ্বাসী, যা নাযিল হয়েছিল হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি। অবশ্য এ কিতাবদু'টি তারা বিকৃত করে ফেলেছিল। তারা যাকে তাওরাত ও ইনজীল বলে, তা মূলত হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি নাযিলকৃত আসল কিতাব নয়; বরং তাদের হাতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা বিকৃত কিতাব।
দাওয়াতের ক্ষেত্রে মাদ'উর অবস্থা বিবেচনায় রাখা
হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি.-কে যখন ইয়ামানে পাঠানো হয়, তখন সেখানে বেশিরভাগ ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়ের লোক বাস করত। পৌত্তলিকদের সংখ্যা তুলনামূলক কম ছিল। এ কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে সচেতন করছেন যে, তুমি যাচ্ছ আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের কাছে। অর্থাৎ তাদের কাছে আসমানী কিতাবের কিছু না কিছু জ্ঞান আছে। আর কিতাবের মধ্যে পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটানোর সুবাদে তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি ও যুক্তি-তর্কের কিছু না কিছু চর্চাও আছে। কাজেই তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার আগে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের অবস্থা অনুযায়ী তাদের সাথে কথা বলতে হবে। কেননা দাওয়াত যাতে ফলপ্রসূ হয় সেজন্য মাদ'ঊ (অর্থাৎ যাকে দাওয়াত দেওয়া হয়)-এর অবস্থা বিবেচনায় রাখা জরুরি।
মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারে কুরআন মাজীদের নির্দেশনা হচ্ছেঃ-
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়। (সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১২৫)
এই হিকমত ও সদুপদেশ এবং উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক করার বিষয়টি সবার সঙ্গে একরকম হয় না। শিক্ষিত লোকদের সঙ্গে একরকম, অজ্ঞদের সাথে অন্যরকম; চালাক চতুর লোকের সঙ্গে একরকম, সহজ-সরল লোকের সাথে অন্যরকম; আবার যারা আহলে কিতাব তাদের সঙ্গে হবে একরকম, আর যারা পৌত্তলিক বা নাস্তিক তাদের সাথে হবে অন্যরকম। প্রত্যেকের সাথে কথা বলার সময় তার সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় রাখতে হয়, অন্যথায় দাওয়াত ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি.-কে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, তার দাওয়াতী কার্যক্রম হবে আহলে কিতাবের মধ্যে। তাদের সার্বিক অবস্থা মাথায় রেখেই যেন তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
দাওয়াতের পর্যায়ক্রম
নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি.-কে যেসকল নির্দেশনা দান করেছিলেন তার মধ্যে একটা হচ্ছে দাওয়াতের পর্যায়ক্রম। অর্থাৎ দা'ঈ কি ইসলামের যাবতীয় বিষয় একইসঙ্গে মাদ'উর সামনে তুলে ধরবে, না পর্যায়ক্রমে এক-একটি করে উল্লেখ করবে? এ হাদীছ জানাচ্ছে, একই সঙ্গে সব উল্লেখ করবে না। কেননা তাতে মাদ'উর কাছে ইসলামের শিক্ষা অনেক ভারী ও কঠিন মনে হবে। ফলে সে দাওয়াত গ্রহণে উৎসাহ পাবে না। তাই দা'ঈর কর্তব্য মাদ'উর সামনে ইসলামের শিক্ষাসমূহ পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা।
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, প্রথমে তাদেরকে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য দিতে বলবে। এটা মেনে নিলে দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের কথা বলবে। যদি তাও মেনে নেয়, তবে তৃতীয় পর্যায়ে বলবে যাকাতের কথা।
লক্ষ করা যাচ্ছে, পর্যায়ক্রমিকভাবে দাওয়াতের ক্ষেত্রেও 'আল আহাম্ম্ ফাল আহাম্ম্' অর্থাৎ বিষয়বস্তুর গুরুত্বের পর্যায়ক্রম রক্ষার প্রতিও ইশারা করা হয়েছে। সর্বপ্রথম দাওয়াত দেবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের। তারপর দাওয়াত দেবে সেই বিষয়ের, যার গুরুত্ব অন্যগুলোর চেয়ে বেশি। তারপর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের। তারপর চতুর্থ, তারপর পঞ্চম এভাবে।
যেহেতু ঈমানের গুরুত্ব সবচে' বেশি এবং তার মধ্যেও সবচে' বেশি গুরুত্ব তাওহীদের, তাই বলা হয়েছে যে- فادعهم إلى شهادة أن لا إله إلا الله وأني رسول الله অর্থাৎ তাদেরকে আহ্বান জানাবে যেন তারা এ সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল।
লক্ষণীয় যে, ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায় আসমানী ধর্মের অনুসারী। সব আসমানী ধর্মই তাওহীদের শিক্ষা দিয়ে থাকে। সে হিসেবে ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়ের এক আল্লাহতে বিশ্বাস থাকারই কথা। তা সত্ত্বেও যখন তাদেরকে এ সাক্ষ্য দিতে বলা হচ্ছে, তখন বোঝা যাচ্ছে এরা আসমানী শিক্ষার ওপর নেই। তারা তাদের কিতাব ও নবীর শিক্ষা থেকে সরে গিয়ে আল্লাহর সঙ্গে অন্যদের শরীক করছে। নাসারাদের সম্পর্কে তো সকলেই জানে তারা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস করে। ইয়াহুদীদের মধ্যেও একরকম পৌত্তলিকতা ঢুকে গিয়েছিল। তাদের একটি দল তো আল্লাহর নবী হযরত উযাইর আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্রই সাব্যস্ত করেছিল। এভাবে যেহেতু এ সম্প্রদায়দু'টি তাওহীদের বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তাই তাদেরকে আবার সেদিকে ফিরে আসার আহ্বান জানাতে বলা হয়েছে।
এক আল্লাহর প্রতি সাক্ষ্যদানের পাশাপাশি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আল্লাহর রাসূল, এ কথার সাক্ষ্যদান করাও জরুরি। তা না হলে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস সাব্যস্ত হয় না। এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ- أتدرون ما الإيمان بالله وحده؟ 'তোমরা কি জান এক আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ কী?' তারা বলেছিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তখন তিনি বলেনঃ- شهادة أن لا إله إلا الله وأن محمدا رسول الله 'এক আল্লাহর প্রতি ঈমান হচ্ছে এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল।' (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৭: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৮: বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২০: ত্বহাবী, শারহু মাআনিল আছার, হাদীছ নং ৫৪২২; মুসনাদ আবূ দাউদ তয়ালিসী, হাদীছ নং ২৮৭০)
ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায় যেহেতু হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর রাসূল বলে স্বীকার করে না, তাই এমনিতেও এক আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান যথার্থ নয়। তাই তাদেরকে সত্যিকার অর্থে এক আল্লাহর প্রতি ঈমানের আহ্বান জানাতে বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, তাদেরকে এ সাক্ষ্য দেওয়ারও আহ্বান জানাবে যে, আমি আল্লাহর রাসূল।
মোটকথা, পৌত্তলিক, নাস্তিক ও আহলে কিতাব নির্বিশেষে যে-কোনও মাদ'উকে দাওয়াত দেওয়ার সময় সর্বপ্রথম তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্যদান করার আহ্বান জানানো চাই। কেননা এর ওপরই অন্যসব আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী এবং শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধের ভিত্তি। এ সাক্ষ্যদান করলেই বাকিগুলো মানার প্রশ্ন আসে এবং তা মানা গ্রহণযোগ্য হয়। পক্ষান্তরে কেউ যদি সবকিছু মেনে নেয় কিন্তু তাওহীদ ও রিসালাত না মানে, তবে তার কোনও কিছুই ধর্তব্য নয়। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি.-কে সর্বপ্রথম তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্যদান করার প্রতি আহ্বান জানাতে বলেছেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদেরকে রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামায সম্পর্কে অবহিত করতে বলেছেন। বলা হয়েছেঃ-
فإن هم أطاعوا لذلك، فأعلمهم أن الله قد افترض عليهم خمس صلوات في كل يوم وليلة
'যদি তারা এটা মেনে নেয় তবে তাদেরকে শিক্ষা দেবে যে, আল্লাহ তাআলা প্রতি দিবারাত্রে তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন।' অর্থাৎ তারা যদি এ সাক্ষ্যদান করে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, তবে তারা মু'মিন সাব্যস্ত হল। এখন কর্তব্য হবে ইসলামী শরী'আত মেনে চলা। শরী'আতের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিধান হচ্ছে নামায। মু'মিন ব্যক্তির ওপর প্রত্যহ দিবারাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয। যেহেতু ঈমানের পর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিধান হচ্ছে নামায, তাই দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদেরকে নামায সম্পর্কে জানাতে বলা হয়েছে।
তাদেরকে নামায সম্পর্কে জানাতে বলা হয়েছে কেবল তখনই, যখন তারা প্রথমেই ঈমান আনবে। পক্ষান্তরে তারা যদি ঈমানই না আনে, তখন নামায এবং শরী'আতের অন্যান্য বিধান সম্পর্কে তাদেরকে জানানোর প্রশ্ন আসে না। বরং তখন কর্তব্য তাদেরকে জিযিয়া আদায়ের আদেশ করা। তা আদায় করলে তারা মুসলিম রাষ্ট্রে মুসলিম জনগণের মত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু তারা যদি জিযিয়া দিতে সম্মত না হয়, তখন জিহাদের হুকুম প্রযোজ্য হয়। অন্যান্য হাদীছে এর বিস্তারিত বিবরণ আছে।
তৃতীয় পর্যায়ে বলা হয়েছেঃ-
فإن هم أطاعوا لذلك، فأعلمهم أن الله قد افترض عليهم صدقة
অর্থাৎ তারা যদি রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামায মেনে নেয়, তবে তাদেরকে সদাকা (যাকাত) সম্পর্কে অবহিত করবে। নামায মেনে নেওয়ার শর্ত এজন্য যে, যে ব্যক্তি নামায ফরয বলে মানবে না সে মু'মিন বলে গণ্য হবে না। আর যে ব্যক্তি মু'মিন নয় তার ওপর যাকাত বা শরী'আতের অন্য কোনও বিধান প্রযোজ্য হয় না।
শরী'আতের কোনও ফরয বিধানকে ফরয বলে স্বীকার করা ঈমানের অঙ্গ। যে ব্যক্তি তা স্বীকার করে না সে মু'মিন নয়। হাঁ, কেউ তা স্বীকার করার পর যদি কার্যত পালন না করে অর্থাৎ সে মানে ও বিশ্বাস করে যে নামায ফরয, কিন্তু নামায পড়ে না, তবে তাকে মু'মিন বলে স্বীকার করা হবে। অবশ্য নামায না পড়ার কারণে সে ফাসেক সাব্যস্ত হবে। এ অবস্থায় ইসলামী সরকারের কর্তব্য তাকে নামায পড়তে বাধ্য করা।
এ হাদীছে যাকাতকে ‘সদাকা' শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীছে যাকাত অর্থে সদাকা শব্দের ব্যবহার ব্যাপক। যাকাতকে সদাকা বলা হয় এ কারণে যে, যাকাত দেওয়ার দ্বারা ব্যক্তির ঈমানের সত্যতা সাব্যস্ত হয়। সদাকা শব্দের মূল ধাতুর মধ্যে ‘সত্যতা’-এর অর্থ আছে।
যাকাত সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ-
تؤخذ من أغنيائهم فترد على فقرائهم
‘যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করে তাদের গরীবদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।'
‘তাদের ধনী' বলে মুমিনদের মধ্যে যারা ধনী তাদেরকে আর 'তাদের গরীব' বলে মুমিনদের মধ্যে যারা গরীব তাদেরকে বোঝানো হয়েছে। এটা প্রমাণ করে যাকাত কেবল মুমিনের ওপরই ফরয। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের থেকে যাকাত গ্রহণ করা যাবে না। আরও প্রমাণ করে যাকাতের অর্থ কেবল গরীব মুসলিমদেরকেই দেওয়া যায়। অমুসলিম গরীবদের মধ্যে যাকাত বিতরণ জায়েয নয়।
এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় যাকাত গরীবের হক। গরীবদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য ধনীদের ওপর এটা ফরয করা হয়েছে। ফরয হওয়ার অর্থ এটা তাদেরকে অবশ্যই দিতে হবে। না দিলে কঠিন পাপ হবে এবং সেজন্য আখিরাতে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। সেই পাপ ও তার কঠিন শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই যাকাতদাতার কর্তব্য যাকাত দেওয়া। সুতরাং যাকাত দেওয়াটা গরীবের প্রতি ধনীর কোনও অনুগ্রহ নয়; বরং নিজের মুক্তিলাভের ব্যবস্থা। তাই যাকাত দিতে হবে ইখলাসের সাথে, কেবলই আল্লাহ তা'আলাকে রাজি-খুশি করার জন্য। দিতে হবে বিনয় নম্রতার সাথে এবং যাকে দেওয়া হবে তার ইজ্জত-সম্মান রক্ষার সাথে। এ ব্যাপারে ব্যাপক অবহেলা লক্ষ করা যায়। সে অবহেলা যেমন আল্লাহর কাছে যাকাত কবূল হওয়ার পক্ষে বাধা, তেমনি এর পার্থিব সুফল তথা পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি সৃষ্টির পক্ষেও অন্তরায়। আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।
তারপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকাতদাতার নিকট থেকে যাকাত উশুলের ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেনঃ- فإن هم أطاعوا لذلك، فإياك وكرائم أموالهم 'যদি তারা এটা মেনে নেয়, তবে (যাকাত হিসেবে) তাদের উৎকৃষ্ট সম্পদ গ্রহণ করা হতে বিরত থাকবে।' অর্থাৎ বেছে বেছে তাদের উৎকৃষ্ট মাল গ্রহণ করবে না। তখন আরবদের প্রধান মাল ছিল গবাদি পশু- উট ও ছাগল। গবাদি পশু তিন রকম হয়ে থাকে- উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট ও মধ্যম। যদি গরীবদের মধ্যে বিতরণের জন্য যাকাতদাতার নিকট থেকে তার উৎকৃষ্ট পশু বেছে বেছে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে যাকাতের ইহলৌকিক ফায়দা ব্যহত হবে। যাকাতের একটা ফায়দা হচ্ছে গরীব-ধনীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল নেওয়া হলে তা তো প্রতিষ্ঠিত হবেই না, উল্টো গরীবের প্রতি ধনীর মনে বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে। যাকাতের আরেক ফায়দা হচ্ছে গরীবের প্রয়োজন মেটানো। কাজেই যদি নিকৃষ্ট মাল দ্বারা যাকাত আদায় করা হয়, তবে গরীবের সে প্রয়োজন মিটবে না। তাই কর্তব্য মধ্যম স্তরের মাল গ্রহণ করা। তাতে গরীবের প্রয়োজনও মিটবে এবং ধনীও গরীবের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে যাকাত দিতে আগ্রহী হবে।
উল্লেখ্য, মালের মধ্যে এ মানগত পার্থক্য কেবল গবাদি পশু এবং ফল ও ফসলের মধ্যেই হয়ে থাকে। টাকা-পয়সার মধ্যে এ পার্থক্য নেই। কাজেই টাকা-পয়সা দ্বারা যাকাত আদায় করা হলে এ বিষয়টি বিবেচনার প্রশ্ন আসে না।
যাকাত ও দান-সদাকা প্রদানে ইসলামের মেযাজ
প্রকাশ থাকে যে, বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল না নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেই ব্যক্তিকে, যে সরকারের পক্ষ থেকে যাকাত উশুলের দায়িত্বে নিয়োজিত। পক্ষান্তরে যাকাতদাতা নিজেই যদি বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল দেয়, তবে তা প্রশংসনীয় বৈ কি। যদিও এটা ঐচ্ছিক বিষয়, কিন্তু ইসলাম এতে উৎসাহ দিয়ে থাকে এবং ইসলামের মেযাজও এটাই যে, মানুষ তার উৎকৃষ্ট মাল থেকেই দান-সদাকা করবে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ
“হে মুমিনগণ! তোমরা যা-কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা-কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৬৭)
দান-সদাকার ক্ষেত্রে ইসলামের মেযাজ কেবল উৎকৃষ্ট বস্তুর মধ্যে সীমিত নয়; বরং কুরআন মাজীদ তারও উপরে প্রিয়বস্তু দান-খয়রাত করতে উৎসাহ দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
'তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে। তোমরা যা কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।' (সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ৯২)
এ আয়াত নাযিল হলে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে তাদের সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু দান সদাকা করার ধুম পড়ে যায়। হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. মসজিদে নববী সংলগ্ন তাঁর একটি বাগান সদাকা করে দেন। এ বাগানের ভেতর 'বী-রাহা' নামে একটি কুয়া ছিল। সেই কুয়ার নামে পরিচিত তাঁর এ বাগানটিই ছিল তাঁর সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ও সবচে' প্রিয় সম্পদ।
হযরত যায়দ ইব্ন হারিছা রাযি, তাঁর সবচে' প্রিয় ঘোড়াটি সঙ্গে নিয়ে হাজির হন এবং আরয করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই ঘোড়াটি আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ, আমি এটি আল্লাহর পথে দান করে দিতে চাই। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটি তাঁর কাছ থেকে নিয়ে তাঁর পুত্র উসামা রাযি.-কে দিয়ে দেন। এতে হযরত যায়দ ইব্ন হারিছা রাযি, খুশি হতে পারলেন না। কারণ তাঁর দান করা ঘোড়া তাঁর ঘরেই ফিরে আসল। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দিলেন যে, তোমার দান আল্লাহ তা'আলা কবূল করে নিয়েছেন।
হযরত উমর ফারূক রাযি, তাঁর সবচে' প্রিয় দাসীটি আল্লাহর ওয়াস্তে আযাদ করে দেন। তাঁর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ রাযি.-ও তাঁর সবচে' পছন্দের দাসীটিকে আযাদ করে দিয়েছিলেন। সাহাবায়ে কিরামের এ জাতীয় ঘটনার অভাব নেই। তাদের বিশ্বাস ছিল আল্লাহর পথে যা দান করা হবে তাই তার জন্য জমা থাকবে এবং আখিরাতে তা পাওয়া যাবে। তাই সবচে' দামী ও সবচে' বেশি প্রিয় সম্পদ দান করতেই তারা উৎসাহ বোধ করতেন।
আমাদেরও কর্তব্য তাদের অনুসরণে যাকাত ও দান-সদাকায় উৎকৃষ্ট ও প্রিয় সম্পদই দিয়ে দেওয়া। মধ্যম মানের সম্পদ গ্রহণের যে আদেশ করা হয়েছে, সে আদেশ তো সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করবে তার জন্য, যাতে তার পক্ষ থেকে জুলুম না হয়ে যায়। যাকাতদাতাকে এ আদেশ করা হয়নি যে, তুমি যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রেও মধ্যমটি বেছে নিও। বরং তাকে সবচে' উৎকৃষ্ট ও সবচে' পছন্দেরটি দিতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, যদিও মধ্যম মানেরটি দিলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
জুলুম পরিহার ও মজলূমের বদদুআ থেকে বাঁচার হুকুম
সবশেষে ইরশাদ হয়েছেঃ-
واتق دعوة المظلوم؛ فإنه ليس بينها وبين الله حجاب
'আর মাজলূমদের দুআকে (অর্থাৎ বদদুআকে) ভয় করবে, কেননা তার ও আল্লাহর মাঝখানে কোনও আড়াল থাকে না।'
এ উপদেশটি দেওয়া হয়েছে যাকাতদাতার নিকট থেকে বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল নিতে নিষেধ করা প্রসঙ্গে। কেননা বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল নিলে তার প্রতি জুলুম করা হয় আর জুলুম করা জায়েয নয়। সুতরাং সাবধান! যাকাতদাতার নিকট থেকে বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল আদায় করে তার প্রতি জুলুম করবে না।
তবে এ উপদেশটি দেওয়া হয়েছে ব্যাপক শব্দে। অর্থাৎ সর্বপ্রকার জুলুমই পরিহার করে চলবে। যাকাতদাতার প্রতিও জুলুম করবে না এবং অন্য কারও প্রতিও নয়। কেননা তুমি যার প্রতিই জুলুম কর না কেন, সেই তো মাজলূম হবে। আর মাজলূম ব্যক্তি যদি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায় এবং জালেমের বিরুদ্ধে তাঁর কাছে দু'আ করে, তবে তা অবশ্যই কবূল হয়। তার দু'আ ও আল্লাহর মাঝখানে কোনও আড়াল না থাকা দ্বারা দু'আ কবূলের অনিবার্যতা বোঝানো হয়েছে।
মজলুম ব্যক্তি যেমনই হোক না কেন, তার বদদুআ কবূল হয়-ই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-
دعوة المظلوم مستجابة وإن كان فاجرا ففجوره على نفسه
'মজলূমের দুআ অবশ্যই কবুল হয়, যদিও সে পাপিষ্ঠ হয়। তার পাপাচারের দায় তার নিজের।' (মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭৮০। মুসনাদ আবূ দাউদ ওয়ালিসী, হাদীছ নং ২৪৫০)
কেউ প্রশ্ন করতে পারে, আমরা তো অনেক সময় দেখি মজলূম ব্যক্তি বদদু‘আ করছে অথচ জালেমের কিছুই হচ্ছে না?
এর উত্তর এই যে, বান্দা দু'আ করে তার নিজ বুঝ অনুযায়ী আর আল্লাহ তা'আলা তা কবূল করেন নিজ শান অনুযায়ী। সুতরাং বান্দার কল্যাণার্থে কখনও তিনি বান্দা যা চায় তাই দিয়ে দেন, কখনও তা না দিয়ে অন্যকিছু দেন, হয়তো তার থেকে কোনও বিপদ দূর করেন অথবা তা আখিরাতের জন্য সঞ্চিত রাখেন। বান্দা আখিরাতে সেই সঞ্চিত দু'আর প্রতিদান দেখে এই বলে আক্ষেপ করবে যে, আহা, দুনিয়ায় যদি আমার কোনও দু‘আই কবূল না হত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য আঞ্চলিক শাসকদেরকে দীন প্রচারে ভূমিকা রাখতে উৎসাহ দেওয়া।
খ. আঞ্চলিক শাসকগণ যাতে জনগণের ওপর জুলুম অবিচার না করে সে ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক করাও রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব।
গ. দা'ঈর কর্তব্য আগে মাদ'উর অবস্থা বিচার-বিশ্লেষণ করা, তারপর সে অনুযায়ী তাকে দাওয়াত দেওয়া।
ঘ. দাঈির কর্তব্য দাওয়াতের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমিকতার নীতি অনুসরণ করা। অর্থাৎ অমুসলিমকে প্রথম ঈমানের দাওয়াত দেবে, তারপর নামায, তারপর যাকাত এবং এভাবে গুরুত্বের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী একটির পর আরেকটি সম্পর্কে অবহিত করবে।
ঙ. তহসিলদারের কর্তব্য যাকাত আদায়কারী থেকে যাকাত হিসেবে মধ্যম মানের মাল গ্রহণ করা। যাকাতদাতা নিজেই যদি উৎকৃষ্ট মাল দেয় সেটা তার নিজের ইচ্ছা।
চ. মজলূমের বদদু'আ অবশ্যই কবুল হয়। তাই প্রত্যেকের সতর্ক থাকা উচিত, যাতে তার পক্ষ থেকে কারও প্রতি কোনওভাবেই জুলুম না হয়ে যায়।
