আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
২০- যাকাতের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১৪৭৭
৯৩৫. মহান আল্লাহর বাণীঃ তারা মানুষের কাছে নাছোড় হয়ে ভিক্ষা করেনা। (২:২৭৩)
১৩৯১। ইয়াকুব ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) ......... শা‘বী (রাহঃ) থেকে বর্ণিত যে, মুগীরা ইবনে শু‘বা (রাযিঃ) এর কাতিব (একান্ত সচিব) বলেছেন, মুআবিয়া (রাযিঃ) মুগীরা ইবনে শু‘বা (রাযিঃ) এর কাছে লিখে পাঠালেন যে, নবী (ﷺ) এর কাছ থেকে আপনি যা শুনেছেন তার কিছু আমাকে লিখে জানান। তিনি তাঁর কাছে লিখলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তোমাদের তিনটি কাজ অপছন্দ করেন, (১) অনর্থক কথাবার্তা, (২) সম্পদ নষ্ট করা এবং (৩) অত্যধিক চাওয়া।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
অনর্থক কথা বলা
قيل وقال (অনর্থক কথা বলা)। উলামায়ে কেরাম এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন কেউ বলেন, এর অর্থ অতিরিক্ত কথা বলা। বেশি কথা বললে বেশি ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এটা নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া অহেতুক বেশি কথা বললে মন শক্ত হয়ে যায়। সে কারণেও এটা নিষেধ। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে لا تكثروا الكلام بغير ذكر الله، فإن كثرة الكلام بغير ذكر الله قسوة للقلب، وإن أبعد الناس من الله القلب القاسي 'তোমরা আল্লাহর যিকর ছাড়া বেশি কথা বলো না। কেননা আল্লাহর যিকর ছাড়া অন্য কথা বেশি বললে মন শক্ত হয়ে যায়। যার মন শক্ত, সে আল্লাহর রহমত থেকে সর্বাপেক্ষা বেশি দূরে থাকে।
কারও মতে এর অর্থ অন্যের কথা বলে বেড়ানো। অর্থাৎ কারও কাছ থেকে কোনও কথা শুনেই তা যাচাই-বাছাই করা ছাড়া প্রচার করতে থাকা। যেমন- শুনেছ, অমুকে এই এই কথা বলেছে। এটাও সম্পূর্ণ নিষেধ। কেননা শোনা কথাটি সত্য নাও হতে পারে। এর দ্বারা অন্যের মানহানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর ফলে সমাজে নানারকম অশান্তির সৃষ্টি হয়। তাই কুরআন-হাদীছ যাচাই-বাছাই ছাড়া শোনা কথার পেছনে পড়তে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ হে মুমিনগণ! কোনও ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনও সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনও সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বস। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন كفى بالمرء كذبا أن يحدث بكل ما سمع “কোনও ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যাই শোনে তাই বলে বেড়াবে।
কারও মতে এর অর্থ কুরআন, হাদীছ ও দীনী বিষয়ে বাগবিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়া। যেমন কুরআন মাজীদের মুতাশাবিহ আয়াত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা, তাকদীর সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা করা, দীনের যে বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। সে বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা ইত্যাদি। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে এসে দেখেন কয়েকজন সাহাবী তাকদীর নিয়ে আলোচনা করছে। তিনি তাতে খুবই নাখোশ হন। তাঁর চেহারা রক্তিম হয়ে যায়। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেন أبهذا أمرتم، أم بهذا أرسلت إليكم؟ إنما هلك من كان قبلكم حين تنازعوا في هذا الأمر، عزمت عليكم ألا تتنازعوا فيه 'তোমাদেরকে কি এরই আদেশ করা হয়েছে, নাকি আমাকে তোমাদের কাছে এ নিয়ে পাঠানো হয়েছে? জেনে রেখ, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণেই ধ্বংস হয়েছে। কাজেই আমি তোমাদের কঠোর নির্দেশ দিচ্ছি তোমরা এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে না।
অনেকেরই অভ্যাস দীনী বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব মত তুলে ধরা। অথচ সে সম্পর্কে তাদের বিশেষ ধারণা নেই। এর ফলে পরস্পরে তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। এমনকি সামাজিক কলহ-বিবাদও শুরু হয়ে যায়। এর থেকে সকলেরই বিরত থাকা উচিত। দীনের যে বিষয় সম্পর্কে জানা নেই, সে বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করা গুরুতর অপরাধ। যে-কোনও অজানা বিষয়ে কথা বলাই অপরাধের মধ্যে পড়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার পেছনে পড়ো না। জেনে রেখ, কান, চোখ ও অন্তর এর প্রতিটি সম্পর্কে (তোমাদেরকে) জিজ্ঞেস করা হবে।
সম্পদ নষ্ট করা
وإضاعة المال (এবং সম্পদ নষ্ট করা)। অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এর অর্থ করেছেন অপচয় করা। কেউ কেউ হারাম খাতে খরচ করাও বলেছেন। এমনিভাবে যদি অর্থ-সম্পদের যথাযথ হেফাজত না করা হয় আর এ কারণে তা চুরি হয়ে যায়। বা রোদ-বৃষ্টিতে কিংবা অন্য কোনওভাবে নষ্ট হয়ে যায়, তবে তাও সম্পদ নষ্ট করার অন্তর্ভুক্ত হবে।
বস্তুত ইচ্ছাকৃত সম্পদ নষ্ট করে ফেলা কিংবা শরীআত যে খাতে খরচ করার অনুমতি দেয়নি, তা দুনিয়াবী বিষয় হোক বা দীনী বিষয় হোক, সে খাতে অর্থ-সম্পদ খরচ করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কেননা আল্লাহ তাআলা অর্থ-সম্পদকে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর উপকরণ বানিয়েছেন। অপব্যয় ও অপচয় দ্বারা প্রয়োজন মেটানো ব্যাহত হয়। যে ব্যক্তি অপব্যয় করে, তার নিজের ক্ষতি তো হয়ই, অনেক সময় তাতে অন্যেরও ক্ষতি হয়। তাই কুরআন মাজীদ পরিমিত ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا “এবং যারা ব্যয় করার সময় না করে অপব্যয় এবং না করে কার্পণ্য; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান।
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا “(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং (অপব্যয়ী হয়ে) তা সম্পূর্ণরূপে খুলে রেখ না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দাযোগে ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়তে হবে।
পরিমিত ব্যয়ের নির্দেশদানের পাশাপাশি অপব্যয় ও অপচয়ের প্রতি সরাসরিও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ‘আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক আদায় করো এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও (তাদের হক প্রদান করো)। আর নিজেদের অর্থ-সম্পদ অপ্রয়োজনীয় কাজে উড়াবে না। জেনে রেখ, যারা অপ্রয়োজনীয় কাজে অর্থ উড়ায়, তারা শয়তানের ভাই।
আখেরাতে পুরস্কার পাওয়ার আশায় যদি দীনের বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত খরচ করা হয় তবে তা দূষণীয় নয়, যদি না তাতে দীনের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অতিরিক্ত খরচের বিষয়টি তিন রকম হতে পারে।
এক. যেসকল খাতে খরচ করা শরীআতে নিন্দনীয়, সেসকল খাতে ব্যয় করা। এটা নিঃসন্দেহে নিষেধ।
দুই. যেসকল খাতে খরচ করা শরীআতে পসন্দনীয়, সেসকল খাতে বেশি বেশি খরচ করা কাম্য বটে, তবে শর্ত হলো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যাহত না হওয়া।
তিন. মুবাহ ও জায়েয খাতে খরচ করা। অর্থাৎ এমন খাতে, মৌলিকভাবে যে খাতে খরচ করলে ছাওয়াবও নেই, গুনাহও নেই। যেমন সাধ-আস্বাদ মেটানোর পেছনে ব্যয় করা। এটা আবার দু'প্রকার হতে পারে- ক. এমন মাত্রায় খরচ করা, যা খরচকারীর আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটা অপব্যয় নয়। খ. এমন পরিমাণ খরচ করা, যা তার আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়; বরং তার বেশি। এটা যদি বর্তমান বা সম্ভাব্য ক্ষতি রোধ করার জন্য হয়ে থাকে, তবে তা অপব্যয় নয়। আর সেরকম না হলে অপব্যয় বলে গণ্য হবে।
প্রকাশ থাকে যে, কষ্ট-ক্লেশে যার ধৈর্যধারণের ক্ষমতা আছে সে যদি তার সবটা মাল দীনী কাজে খরচ করে ফেলে, তবে তা দূষণীয় নয়। এটা দূষণীয় ওই ব্যক্তির পক্ষে, যার কষ্ট-ক্লেশ বরদাশত করার ক্ষমতা নেই।
ঘর-বাড়ির পেছনে প্রয়োজনের বেশি খরচ করা কিছুতেই পসন্দনীয় নয়।
অতিরিক্ত সুওয়াল করা
وكثرة السؤال (এবং অতিরিক্ত সুওয়াল করা)। সুওয়াল করা অর্থ প্রশ্ন করা, চাওয়া, যাচনা করা ইত্যাদি। অতিরিক্ত সুওয়াল করা দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য বা কী বোঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে। কেউ বলেন এর অর্থ মানুষের খবরাখবর ও সময়ের অবস্থাদি সম্পর্কে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা। কেননা অনেক সময়ই এটা অহেতুক পেরেশানির কারণ হয়। তাছাড়া এ জাতীয় প্রশ্ন একটা বেহুদা কাজও বটে এবং এর ফলে অহেতুক সময় নষ্ট তো হয়ই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه 'কোনও ব্যক্তির ইসলামের একটি সৌন্দর্য হলো নিরর্থক সবকিছু পরিত্যাগ করা।
কারও মতে অতিরিক্ত সুওয়াল করার অর্থ বিশেষ কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর নেওয়া। যেমন সে কী করে, কোথায় থাকে, কত রোজগার করে, কোথায় বিয়ে করেছে, ছেলে-মেয়ে কী, ছেলে-মেয়েরা কে কী করে ইত্যাদি। এ জাতীয় খোঁজখবর নেওয়ার অভ্যাস অনেকেরই আছে। যার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয় তার পক্ষে এটা বিব্রতকর। অনেকে এটা পসন্দ করে না। অন্যকে অহেতুক বিব্রত করা শরীআতসম্মত কাজ নয়। বিশেষত যদি অন্যের গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবে তা হবে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এটা নিষিদ্ধ ছিদ্রান্বেষণের অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে وَلَا تَجَسَّسُوا “তোমরা কারও গোপন ত্রুটির অনুসন্ধানে পড়বে না।
কেউ বলেন, এর অর্থ যা ঘটা সম্ভব নয় কিংবা কদাচ ঘটে এমন বিষয় সম্পর্কে শরীআতের মাসআলা জানতে চাওয়া। কোনও কোনও হাদীছে এ জাতীয় প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. বলেন, যারা দীনী বিষয়ে অহেতুক খোঁড়াখুঁড়িতে লিপ্ত হয়, তাদের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে বেশি কঠোর আর কাউকে দেখিনি। তাঁর পরে এ শ্রেণীর লোকের উপর আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর চেয়ে বেশি কঠোর আর কাউকে দেখিনি। আমি উমরকে দেখেছি এদের ব্যাপারে খুব বেশি ভয় করতেন।
কারও মতে এর অর্থ ধাঁধা বলা ও বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করা। হযরত মুআবিয়া রাখি, বলেন نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الأغلوطات “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করতে নিষেধ করেছেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. শোনা কথায় কান দিতে নেই এবং তা গেয়ে বেড়ানোও উচিত নয়।
খ. অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রশ্ন করা একটি নিন্দনীয় কাজ। আমাদেরকে তা পরিহার করতে হবে।
গ. ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ। চরম অপারগ অবস্থা না হলে অন্যের কাছে হাত পাতা উচিত নয়।
ঘ. ইচ্ছাকৃত অর্থ-সম্পদ নষ্ট করা এবং অপচয় ও অপব্যয় করা জায়েয নয়।
قيل وقال (অনর্থক কথা বলা)। উলামায়ে কেরাম এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন কেউ বলেন, এর অর্থ অতিরিক্ত কথা বলা। বেশি কথা বললে বেশি ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এটা নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া অহেতুক বেশি কথা বললে মন শক্ত হয়ে যায়। সে কারণেও এটা নিষেধ। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে لا تكثروا الكلام بغير ذكر الله، فإن كثرة الكلام بغير ذكر الله قسوة للقلب، وإن أبعد الناس من الله القلب القاسي 'তোমরা আল্লাহর যিকর ছাড়া বেশি কথা বলো না। কেননা আল্লাহর যিকর ছাড়া অন্য কথা বেশি বললে মন শক্ত হয়ে যায়। যার মন শক্ত, সে আল্লাহর রহমত থেকে সর্বাপেক্ষা বেশি দূরে থাকে।
কারও মতে এর অর্থ অন্যের কথা বলে বেড়ানো। অর্থাৎ কারও কাছ থেকে কোনও কথা শুনেই তা যাচাই-বাছাই করা ছাড়া প্রচার করতে থাকা। যেমন- শুনেছ, অমুকে এই এই কথা বলেছে। এটাও সম্পূর্ণ নিষেধ। কেননা শোনা কথাটি সত্য নাও হতে পারে। এর দ্বারা অন্যের মানহানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর ফলে সমাজে নানারকম অশান্তির সৃষ্টি হয়। তাই কুরআন-হাদীছ যাচাই-বাছাই ছাড়া শোনা কথার পেছনে পড়তে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ হে মুমিনগণ! কোনও ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনও সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনও সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বস। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন كفى بالمرء كذبا أن يحدث بكل ما سمع “কোনও ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যাই শোনে তাই বলে বেড়াবে।
কারও মতে এর অর্থ কুরআন, হাদীছ ও দীনী বিষয়ে বাগবিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়া। যেমন কুরআন মাজীদের মুতাশাবিহ আয়াত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা, তাকদীর সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা করা, দীনের যে বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। সে বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা ইত্যাদি। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে এসে দেখেন কয়েকজন সাহাবী তাকদীর নিয়ে আলোচনা করছে। তিনি তাতে খুবই নাখোশ হন। তাঁর চেহারা রক্তিম হয়ে যায়। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেন أبهذا أمرتم، أم بهذا أرسلت إليكم؟ إنما هلك من كان قبلكم حين تنازعوا في هذا الأمر، عزمت عليكم ألا تتنازعوا فيه 'তোমাদেরকে কি এরই আদেশ করা হয়েছে, নাকি আমাকে তোমাদের কাছে এ নিয়ে পাঠানো হয়েছে? জেনে রেখ, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণেই ধ্বংস হয়েছে। কাজেই আমি তোমাদের কঠোর নির্দেশ দিচ্ছি তোমরা এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে না।
অনেকেরই অভ্যাস দীনী বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব মত তুলে ধরা। অথচ সে সম্পর্কে তাদের বিশেষ ধারণা নেই। এর ফলে পরস্পরে তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। এমনকি সামাজিক কলহ-বিবাদও শুরু হয়ে যায়। এর থেকে সকলেরই বিরত থাকা উচিত। দীনের যে বিষয় সম্পর্কে জানা নেই, সে বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করা গুরুতর অপরাধ। যে-কোনও অজানা বিষয়ে কথা বলাই অপরাধের মধ্যে পড়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার পেছনে পড়ো না। জেনে রেখ, কান, চোখ ও অন্তর এর প্রতিটি সম্পর্কে (তোমাদেরকে) জিজ্ঞেস করা হবে।
সম্পদ নষ্ট করা
وإضاعة المال (এবং সম্পদ নষ্ট করা)। অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এর অর্থ করেছেন অপচয় করা। কেউ কেউ হারাম খাতে খরচ করাও বলেছেন। এমনিভাবে যদি অর্থ-সম্পদের যথাযথ হেফাজত না করা হয় আর এ কারণে তা চুরি হয়ে যায়। বা রোদ-বৃষ্টিতে কিংবা অন্য কোনওভাবে নষ্ট হয়ে যায়, তবে তাও সম্পদ নষ্ট করার অন্তর্ভুক্ত হবে।
বস্তুত ইচ্ছাকৃত সম্পদ নষ্ট করে ফেলা কিংবা শরীআত যে খাতে খরচ করার অনুমতি দেয়নি, তা দুনিয়াবী বিষয় হোক বা দীনী বিষয় হোক, সে খাতে অর্থ-সম্পদ খরচ করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কেননা আল্লাহ তাআলা অর্থ-সম্পদকে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর উপকরণ বানিয়েছেন। অপব্যয় ও অপচয় দ্বারা প্রয়োজন মেটানো ব্যাহত হয়। যে ব্যক্তি অপব্যয় করে, তার নিজের ক্ষতি তো হয়ই, অনেক সময় তাতে অন্যেরও ক্ষতি হয়। তাই কুরআন মাজীদ পরিমিত ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا “এবং যারা ব্যয় করার সময় না করে অপব্যয় এবং না করে কার্পণ্য; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান।
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا “(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং (অপব্যয়ী হয়ে) তা সম্পূর্ণরূপে খুলে রেখ না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দাযোগে ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়তে হবে।
পরিমিত ব্যয়ের নির্দেশদানের পাশাপাশি অপব্যয় ও অপচয়ের প্রতি সরাসরিও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ‘আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক আদায় করো এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও (তাদের হক প্রদান করো)। আর নিজেদের অর্থ-সম্পদ অপ্রয়োজনীয় কাজে উড়াবে না। জেনে রেখ, যারা অপ্রয়োজনীয় কাজে অর্থ উড়ায়, তারা শয়তানের ভাই।
আখেরাতে পুরস্কার পাওয়ার আশায় যদি দীনের বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত খরচ করা হয় তবে তা দূষণীয় নয়, যদি না তাতে দীনের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অতিরিক্ত খরচের বিষয়টি তিন রকম হতে পারে।
এক. যেসকল খাতে খরচ করা শরীআতে নিন্দনীয়, সেসকল খাতে ব্যয় করা। এটা নিঃসন্দেহে নিষেধ।
দুই. যেসকল খাতে খরচ করা শরীআতে পসন্দনীয়, সেসকল খাতে বেশি বেশি খরচ করা কাম্য বটে, তবে শর্ত হলো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যাহত না হওয়া।
তিন. মুবাহ ও জায়েয খাতে খরচ করা। অর্থাৎ এমন খাতে, মৌলিকভাবে যে খাতে খরচ করলে ছাওয়াবও নেই, গুনাহও নেই। যেমন সাধ-আস্বাদ মেটানোর পেছনে ব্যয় করা। এটা আবার দু'প্রকার হতে পারে- ক. এমন মাত্রায় খরচ করা, যা খরচকারীর আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটা অপব্যয় নয়। খ. এমন পরিমাণ খরচ করা, যা তার আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়; বরং তার বেশি। এটা যদি বর্তমান বা সম্ভাব্য ক্ষতি রোধ করার জন্য হয়ে থাকে, তবে তা অপব্যয় নয়। আর সেরকম না হলে অপব্যয় বলে গণ্য হবে।
প্রকাশ থাকে যে, কষ্ট-ক্লেশে যার ধৈর্যধারণের ক্ষমতা আছে সে যদি তার সবটা মাল দীনী কাজে খরচ করে ফেলে, তবে তা দূষণীয় নয়। এটা দূষণীয় ওই ব্যক্তির পক্ষে, যার কষ্ট-ক্লেশ বরদাশত করার ক্ষমতা নেই।
ঘর-বাড়ির পেছনে প্রয়োজনের বেশি খরচ করা কিছুতেই পসন্দনীয় নয়।
অতিরিক্ত সুওয়াল করা
وكثرة السؤال (এবং অতিরিক্ত সুওয়াল করা)। সুওয়াল করা অর্থ প্রশ্ন করা, চাওয়া, যাচনা করা ইত্যাদি। অতিরিক্ত সুওয়াল করা দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য বা কী বোঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে। কেউ বলেন এর অর্থ মানুষের খবরাখবর ও সময়ের অবস্থাদি সম্পর্কে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা। কেননা অনেক সময়ই এটা অহেতুক পেরেশানির কারণ হয়। তাছাড়া এ জাতীয় প্রশ্ন একটা বেহুদা কাজও বটে এবং এর ফলে অহেতুক সময় নষ্ট তো হয়ই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه 'কোনও ব্যক্তির ইসলামের একটি সৌন্দর্য হলো নিরর্থক সবকিছু পরিত্যাগ করা।
কারও মতে অতিরিক্ত সুওয়াল করার অর্থ বিশেষ কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর নেওয়া। যেমন সে কী করে, কোথায় থাকে, কত রোজগার করে, কোথায় বিয়ে করেছে, ছেলে-মেয়ে কী, ছেলে-মেয়েরা কে কী করে ইত্যাদি। এ জাতীয় খোঁজখবর নেওয়ার অভ্যাস অনেকেরই আছে। যার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয় তার পক্ষে এটা বিব্রতকর। অনেকে এটা পসন্দ করে না। অন্যকে অহেতুক বিব্রত করা শরীআতসম্মত কাজ নয়। বিশেষত যদি অন্যের গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবে তা হবে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এটা নিষিদ্ধ ছিদ্রান্বেষণের অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে وَلَا تَجَسَّسُوا “তোমরা কারও গোপন ত্রুটির অনুসন্ধানে পড়বে না।
কেউ বলেন, এর অর্থ যা ঘটা সম্ভব নয় কিংবা কদাচ ঘটে এমন বিষয় সম্পর্কে শরীআতের মাসআলা জানতে চাওয়া। কোনও কোনও হাদীছে এ জাতীয় প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. বলেন, যারা দীনী বিষয়ে অহেতুক খোঁড়াখুঁড়িতে লিপ্ত হয়, তাদের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে বেশি কঠোর আর কাউকে দেখিনি। তাঁর পরে এ শ্রেণীর লোকের উপর আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর চেয়ে বেশি কঠোর আর কাউকে দেখিনি। আমি উমরকে দেখেছি এদের ব্যাপারে খুব বেশি ভয় করতেন।
কারও মতে এর অর্থ ধাঁধা বলা ও বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করা। হযরত মুআবিয়া রাখি, বলেন نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الأغلوطات “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করতে নিষেধ করেছেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. শোনা কথায় কান দিতে নেই এবং তা গেয়ে বেড়ানোও উচিত নয়।
খ. অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রশ্ন করা একটি নিন্দনীয় কাজ। আমাদেরকে তা পরিহার করতে হবে।
গ. ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ। চরম অপারগ অবস্থা না হলে অন্যের কাছে হাত পাতা উচিত নয়।
ঘ. ইচ্ছাকৃত অর্থ-সম্পদ নষ্ট করা এবং অপচয় ও অপব্যয় করা জায়েয নয়।
