আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
২০- যাকাতের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১৪৬৯
৯৩২. যাচনা (সওয়াল করা) থেকে বিরত থাকা।
১৩৮৪। আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ (রাহঃ) ......... আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, কিছুসংখ্যক আনসারী সাহাবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নিকট কিছু চাইলে তিনি তাঁদের দিলেন, পুনরায় তাঁরা চাইলে তিনি তাঁদের দিলেন। এমনকি তাঁর নিকট যা ছিল সবই শেষ হয়ে গেল। এরপর তিনি বললেনঃ আমার নিকট যে মাল থাকে, তা তোমাদের না দিয়ে আমার নিকট জমা রাখি না। তবে, যে যাচনা থেকে বিরত থাকে, আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রাখেন আর যে পরমুখাপেক্ষী না হয়, আল্লাহ তাকে অভাবমুক্ত রাখেন। যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহ তাকে সবর দান করেন। সবরের চাইতে উত্তম ও ব্যাপক কোন নিআমত কাউকে দেওয়া হয়নি।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
সবর সম্পর্কে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ। কিছু সংখ্যক সাহাবীর সওয়ালকে কেন্দ্র করে এ মূল্যবান হাদীছটি তিনি ইরশাদ করেছিলেন। এ সওয়ালকারী কে কে ছিল সে সম্পর্কে হাফেজ ইবন হাজার রহ. বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে আমি তাদের নাম জানতে পারিনি। অবশ্য নাসাঈ শরীফের একটি বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. নিজেও তাদের মধ্যে ছিলেন। যাহোক তারা যখন কিছু চাইলেন, তিনি তাদের তা দিলেন। একথা তো সকলেরই জানা যে, সাহাবায়ে কিরাম নিতান্তই গরীব ছিলেন। অত্যন্ত কষ্ট-ক্লেশের ভেতর তাদের দিন কাটত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজেরও সচ্ছলতা ছিল না। তাঁর চুলায়ও দিনের পর দিন আগুন জ্বলত না। সে কথা সাহাবায়ে কিরামেরও জানা ছিল। ফলে নেহাত অপারগ অবস্থা না হলে তারা তাঁর কাছে কিছু চাইতেন না। এই ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা বার বার চেয়েছেন। বোঝা যায় তখন তারা কঠিন অর্থসংকটে ছিলেন। ফলে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তখন সামান্য যা ছিল তা দিতে থাকলেন। দিতে দিতে এক পর্যায়ে সবটা শেষ হয়ে গেল। তাঁর তো 'না' বলার অভ্যাস ছিল না। নিজে ক্ষুধায় কষ্ট করতেন। পেটে পাথর পর্যন্ত বাঁধতেন। তা সত্ত্বেও কেউ এসে কিছু চাইলে অবশ্যই দেওয়ার চেষ্টা করতেন এবং দিতে না পারলে অন্যের কাছে সুপারিশ করতেন। দিতে পারব না' এমন কথা কখনও বলতেন না। এজন্যই কবি তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, 'লা ইলাহা’-এর ‘লা’ না থাকলে হয়তো তিনি কখনওই 'লা' বলতেন না।
হাতে যা ছিল সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি প্রথমে ভূমিকাস্বরূপ বললেন, আমার কাছে কিছু থাকলে তোমাদের না দিয়ে তা কখনও নিজের জন্যে জমা করে রাখব না। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদ জমা করা তাঁর স্বভাব নয়। গরীব হয়ে থাকাই তাঁর পসন্দ ছিল। আর গরীব আনসারগণ ছিলেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। দানের ক্ষেত্রে তারাই ছিলেন তাঁর অবিবেচ্য। সুতরাং যতক্ষণ তাঁর হাতে থাকে, ততক্ষণ তাদের দেবেন এটাই স্বাভাবিক। এটা তাঁর মহত্তম চরিত্রের ব্যাপার। কিন্তু দাতার উদার চরিত্রের বিপরীতে গ্রহীতারও দরকার উন্নত চরিত্রের অধিকারী হওয়া। সেই প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এস্থলে তিনটি চারিত্রিক শিক্ষা প্রদান করেছেন। তা নিম্নরূপ
বান্দার কাছে চাওয়া-পাওয়ার আশা পরিহার
এক. ইসতি'ফাফ (استعفاف)। এর অর্থ অন্যের কাছে চাওয়া থেকে এবং অন্যের কাছে যা আছে তা পাওয়ার আশা করা থেকে বিরত ও পবিত্র থাকার চেষ্টা। অন্যের কাছে কিছু চাওয়া বা পাওয়ার আশা করা এক প্রকারের নীচতা। আল্লাহ তা'আলাই সবকিছুর মালিক। তিনিই প্রকৃত দাতা। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রকৃত বান্দা ও খাঁটি বিশ্বাসী হবে, তার যাবতীয় চাওয়া-পাওয়ার স্থান তো হবে কেবল তাঁরই সত্তা। সে তাঁর কাছেই চাবে এবং তাঁরই কাছে আশা করবে, অন্য কারও কাছে নয়। অন্যের কাছে কিই বা আছে আর কিই বা দিতে পারে? কাজেই তাদের কাছে চাওয়ার দ্বারা বান্দার বন্দেগীসুলভ মহিমা ক্ষুণ্ন হয় এবং আবদিয়াতের পবিত্রতা নষ্ট হয়। আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল একজন খাঁটি বান্দার কর্তব্য সর্বাবস্থায় তার আবদিয়াতের পবিত্রতা রক্ষা করা। এ হাদীছ বলছে যে ব্যক্তি তা রক্ষার চেষ্টা করবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে পবিত্র করে অর্থাৎ তিনি তাঁর অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে তাকে এ পরিমাণ রিযিক দান করবেন, যাতে তার কারও কাছে হাত পাততে না হয়। বিশেষত তাকে আত্মিক ঐশ্বর্য দান করবেন। ফলে তার যা আছে তাতে সে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকবে। তার নসীবে আল্লাহ তা'আলা যা রেখেছেন তাকেই সে নিজের জন্যে যথেষ্ট মনে করবে। অন্যের কাছে হাত পাতার প্রয়োজনই বোধ করবে না। কোনও বান্দার কাছে সে কখনও আশাবাদী হবে না।
মানুষের কাছে অভাব প্রকাশ থেকে বিরত থাকা ও প্রকৃত ঐশ্বর্য
দুই. ইসতিগনা (استغناء)। এর অর্থ সচ্ছলতা ও ঐশ্বর্য প্রকাশ। অর্থাৎ আচার আচরণ ও ভাবভঙ্গিতে এমন দেখানো, যেন তার কোনও অভাব নেই এবং যেন তার যথেষ্ট আছে। এটা এক প্রকার শোকর ও কৃতজ্ঞতা। আল্লাহ তা'আলাই মানুষের রিযিক বণ্টন করেন। তাতে প্রত্যেকের ভাগে যা পড়ে, তার কর্তব্য তাতে সন্তুষ্ট থাকা। সেই সন্তুষ্টিই কৃতজ্ঞতা। সচ্ছলতা ভাব দেখানোর অর্থ আল্লাহ তা'আলা আমাকে যা দিয়েছেন। আমি তাতে সন্তুষ্ট। অন্যের কি আছে তা দেখার কোনও প্রয়োজন আমার নেই। আমার ছেঁড়া বা মোটা কাপড় আছে, আমি মোটা ভাত খাই বা রোজ একবেলা খাই, তাতে আমার কোনও অভিযোগ নেই; বরং এতেই আমার গৌরব। কারণ এটা আমার প্রতিপালকের বণ্টন। আমি আমার প্রতিপালকের বণ্টনে খুশি। এই বোধ ও অনুভূতিকে বলে মনের ঐশ্বর্য। এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ যার রাযি.-কে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেন-
يا أبا ذر أترى كثرة المال هي الغنى ؟ قال : قلت نعم يا رسول الله هي الغنى قال : وترى أن قلة المال هي الفقر ؟ قال : قلت نعم يا رسول الله هي الفقر قال : ليس كذلك إنما الغنى غنى القلب و الفقر فقر القلب
"হে আবূ যার! তুমি কি মনে কর সম্পদ বেশি হওয়াটাই ঐশ্বর্য? হযরত আবূ যার বাযি. বললেন, জী হাঁ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এবং তুমি কি মনে কর অর্থ-সম্পদ কম থাকাই দৈন্য? তিনি বললেন, হাঁ ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন, ব্যাপারটা সেরকম নয়। মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য আর মনের দীনতাই প্রকৃত দীনতা।
তো যেই ব্যক্তি ইসতিগনা অবলম্বন করবে, অর্থাৎ অন্যের যা আছে সেদিকে না তাকিয়ে নিজের যা আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকবে এবং সেই সন্তুষ্টিভাব নিজ আচার আচরণে প্রকাশ করবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে ঐশ্বর্যশালী করে রাখবেন। অর্থাৎ বাহ্যিকভাবেও তাকে কোনও মাখলুকের মুখাপেক্ষী করবেন না এবং আত্মিকভাবেও তাকে বেনিয়ায় করে রাখবেন। সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতে সে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকবে।
মনের বিরুদ্ধে ধৈর্য রক্ষার চেষ্টা
তিন. তাসাব্বুর (تصبُّر)। এর অর্থ মনের বিপরীতে সবরের ভাবভঙ্গী অবলম্বন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি মূলত ধৈর্যশীল নয় সে যদি এ গুণ অর্জনের লক্ষ্যে সবরের ভান ধরে এবং মনের বিপরীতে ধৈর্য রক্ষার চেষ্টা করে, তবে সেই অবস্থাকে তাসাব্বুর বলে। এ হাদীছে জানানো হয়েছে যে, কোনও ব্যক্তি অর্থসংকটে বা পার্থিব বিপদ-আপদে ভান ভনিতার সংগে হলেও ধৈর্যধারণ করে, অন্যের কাছে প্রকাশ না করে দুঃখ-কষ্ট হজম করতে থাকে এবং মনের সকল বেদনা কেবল আল্লাহ তা'আলার কাছেই প্রকাশ করে, তবে আল্লাহ তা'আলা প্রকৃত সবর তাকে দিয়ে দেবেন। ফলে কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করা তার পক্ষে সহজ হয়ে যাবে। তার মন যে-কোনও পরিস্থিতি মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। আর এভাবে তার ‘রিযা বিল-কাযা' তথা আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকার মানসিকতা অর্জিত হয়ে যাবে।
প্রকাশ থাকে যে, ইসতিফাফ ও ইসতিগনা অবলম্বনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ধৈর্যশক্তির দরকার পড়ে। সে শক্তি আপনা-আপনিই অর্জিত হয়ে যায় না, সাধনা ও মুজাহাদার মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হয়। তাই তৃতীয় পর্যায়ে তাসাব্বুরের কথা বলা হয়েছে। এর দ্বারা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, তুমি ভান-ভনিতার সংগে হলেও ধৈর্যধারণ করে যাও। । এক পর্যায়ে ধৈর্য তোমার স্বভাবগুণে পরিণত হয়ে যাবে। তখন সকল ক্ষেত্রেই সহজে ধৈর্যধারণ করতে পারবে।
সবশেষে ধৈর্যের ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে আল্লাহ তা'আলা মানুষকে টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ, শক্তি-ক্ষমতা প্রভৃতি যত নি'আমত দান করেছেন, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও প্রশস্ত নি'আমত হচ্ছে সবর। কেননা এটা সমস্ত উৎকৃষ্ট গুণের ধারক। এ গুণ ছাড়া কোনও মহৎ গুণই অর্জন করা সম্ভব হয় না। একজন লোক যখন ধৈর্যশীল হয়, তখন সে যে-কোনও পরিস্থিতিকে উঠতে পারে। শয়তান যদি তাকে কোনও হারাম কাজে প্ররোচনা দেয়, সে নিজেকে তা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। যখন আল্লাহর কোনও আদেশ পালনের ডাক আসে, তখন যতই কষ্ট হোক না কেন, তাতে সাড়া দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। সে যত বড় বিপদ-আপদের সম্মুখীন হোক না কেন, তাতে বেসামাল হয়ে পড়ে না। একজন ধৈর্যশীল লোককে যদি কেউ গালি দেয় কিংবা সে কারও থেকে অপ্রীতিকর কোনও আচরণ পায়, আপনি তারে সে ক্ষেত্রে শান্ত-সমাহিতই দেখতে পাবেন। সে শত্রুতার বিরুদ্ধে শত্রুতা করে না, গালির বিরুদ্ধে গালি দেয় না; বরং সে অসৎ ব্যবহারের জবাবে ভালো ব্যবহার করে কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ
'তুমি মন্দকে প্রতিহত কর এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা মহাভাগ্যবান।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. উদারচিত্তে দান-খয়রাত করা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণ। এ গুণ অর্জনে সচেষ্ট হওয়া প্রত্যেক মু'মিনের কর্তব্য।
খ. অন্যের অভাব-অনটন দেখেও নিজে অর্থ-সম্পদ জমা করে রাখা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী।
গ. হাজার অভাব-অনটন সত্ত্বেও অন্যের কাছে হাত পাতা এমনকি অন্যের কাছে আশাবাদী হওয়া থেকে বিরত থাকা একটি মহৎ চরিত্র।
ঘ. মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য। নিজের যা-ই আছে তাকে আল্লাহর মহা নি'আমত গণ্য করে পরিতুষ্ট ও শোকরগুজার হয়ে থাকাই মনের ঐশ্বর্য।
ঙ. সবর একটি মহামূল্যবান নি'আমত। প্রত্যেক মু'মিনের উচিত এ নি'আমত অর্জনের জন্যে সাধনা ও মুজাহাদা করা।
হাতে যা ছিল সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি প্রথমে ভূমিকাস্বরূপ বললেন, আমার কাছে কিছু থাকলে তোমাদের না দিয়ে তা কখনও নিজের জন্যে জমা করে রাখব না। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদ জমা করা তাঁর স্বভাব নয়। গরীব হয়ে থাকাই তাঁর পসন্দ ছিল। আর গরীব আনসারগণ ছিলেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। দানের ক্ষেত্রে তারাই ছিলেন তাঁর অবিবেচ্য। সুতরাং যতক্ষণ তাঁর হাতে থাকে, ততক্ষণ তাদের দেবেন এটাই স্বাভাবিক। এটা তাঁর মহত্তম চরিত্রের ব্যাপার। কিন্তু দাতার উদার চরিত্রের বিপরীতে গ্রহীতারও দরকার উন্নত চরিত্রের অধিকারী হওয়া। সেই প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এস্থলে তিনটি চারিত্রিক শিক্ষা প্রদান করেছেন। তা নিম্নরূপ
বান্দার কাছে চাওয়া-পাওয়ার আশা পরিহার
এক. ইসতি'ফাফ (استعفاف)। এর অর্থ অন্যের কাছে চাওয়া থেকে এবং অন্যের কাছে যা আছে তা পাওয়ার আশা করা থেকে বিরত ও পবিত্র থাকার চেষ্টা। অন্যের কাছে কিছু চাওয়া বা পাওয়ার আশা করা এক প্রকারের নীচতা। আল্লাহ তা'আলাই সবকিছুর মালিক। তিনিই প্রকৃত দাতা। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রকৃত বান্দা ও খাঁটি বিশ্বাসী হবে, তার যাবতীয় চাওয়া-পাওয়ার স্থান তো হবে কেবল তাঁরই সত্তা। সে তাঁর কাছেই চাবে এবং তাঁরই কাছে আশা করবে, অন্য কারও কাছে নয়। অন্যের কাছে কিই বা আছে আর কিই বা দিতে পারে? কাজেই তাদের কাছে চাওয়ার দ্বারা বান্দার বন্দেগীসুলভ মহিমা ক্ষুণ্ন হয় এবং আবদিয়াতের পবিত্রতা নষ্ট হয়। আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল একজন খাঁটি বান্দার কর্তব্য সর্বাবস্থায় তার আবদিয়াতের পবিত্রতা রক্ষা করা। এ হাদীছ বলছে যে ব্যক্তি তা রক্ষার চেষ্টা করবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে পবিত্র করে অর্থাৎ তিনি তাঁর অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে তাকে এ পরিমাণ রিযিক দান করবেন, যাতে তার কারও কাছে হাত পাততে না হয়। বিশেষত তাকে আত্মিক ঐশ্বর্য দান করবেন। ফলে তার যা আছে তাতে সে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকবে। তার নসীবে আল্লাহ তা'আলা যা রেখেছেন তাকেই সে নিজের জন্যে যথেষ্ট মনে করবে। অন্যের কাছে হাত পাতার প্রয়োজনই বোধ করবে না। কোনও বান্দার কাছে সে কখনও আশাবাদী হবে না।
মানুষের কাছে অভাব প্রকাশ থেকে বিরত থাকা ও প্রকৃত ঐশ্বর্য
দুই. ইসতিগনা (استغناء)। এর অর্থ সচ্ছলতা ও ঐশ্বর্য প্রকাশ। অর্থাৎ আচার আচরণ ও ভাবভঙ্গিতে এমন দেখানো, যেন তার কোনও অভাব নেই এবং যেন তার যথেষ্ট আছে। এটা এক প্রকার শোকর ও কৃতজ্ঞতা। আল্লাহ তা'আলাই মানুষের রিযিক বণ্টন করেন। তাতে প্রত্যেকের ভাগে যা পড়ে, তার কর্তব্য তাতে সন্তুষ্ট থাকা। সেই সন্তুষ্টিই কৃতজ্ঞতা। সচ্ছলতা ভাব দেখানোর অর্থ আল্লাহ তা'আলা আমাকে যা দিয়েছেন। আমি তাতে সন্তুষ্ট। অন্যের কি আছে তা দেখার কোনও প্রয়োজন আমার নেই। আমার ছেঁড়া বা মোটা কাপড় আছে, আমি মোটা ভাত খাই বা রোজ একবেলা খাই, তাতে আমার কোনও অভিযোগ নেই; বরং এতেই আমার গৌরব। কারণ এটা আমার প্রতিপালকের বণ্টন। আমি আমার প্রতিপালকের বণ্টনে খুশি। এই বোধ ও অনুভূতিকে বলে মনের ঐশ্বর্য। এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ যার রাযি.-কে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেন-
يا أبا ذر أترى كثرة المال هي الغنى ؟ قال : قلت نعم يا رسول الله هي الغنى قال : وترى أن قلة المال هي الفقر ؟ قال : قلت نعم يا رسول الله هي الفقر قال : ليس كذلك إنما الغنى غنى القلب و الفقر فقر القلب
"হে আবূ যার! তুমি কি মনে কর সম্পদ বেশি হওয়াটাই ঐশ্বর্য? হযরত আবূ যার বাযি. বললেন, জী হাঁ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এবং তুমি কি মনে কর অর্থ-সম্পদ কম থাকাই দৈন্য? তিনি বললেন, হাঁ ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন, ব্যাপারটা সেরকম নয়। মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য আর মনের দীনতাই প্রকৃত দীনতা।
তো যেই ব্যক্তি ইসতিগনা অবলম্বন করবে, অর্থাৎ অন্যের যা আছে সেদিকে না তাকিয়ে নিজের যা আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকবে এবং সেই সন্তুষ্টিভাব নিজ আচার আচরণে প্রকাশ করবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে ঐশ্বর্যশালী করে রাখবেন। অর্থাৎ বাহ্যিকভাবেও তাকে কোনও মাখলুকের মুখাপেক্ষী করবেন না এবং আত্মিকভাবেও তাকে বেনিয়ায় করে রাখবেন। সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতে সে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকবে।
মনের বিরুদ্ধে ধৈর্য রক্ষার চেষ্টা
তিন. তাসাব্বুর (تصبُّر)। এর অর্থ মনের বিপরীতে সবরের ভাবভঙ্গী অবলম্বন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি মূলত ধৈর্যশীল নয় সে যদি এ গুণ অর্জনের লক্ষ্যে সবরের ভান ধরে এবং মনের বিপরীতে ধৈর্য রক্ষার চেষ্টা করে, তবে সেই অবস্থাকে তাসাব্বুর বলে। এ হাদীছে জানানো হয়েছে যে, কোনও ব্যক্তি অর্থসংকটে বা পার্থিব বিপদ-আপদে ভান ভনিতার সংগে হলেও ধৈর্যধারণ করে, অন্যের কাছে প্রকাশ না করে দুঃখ-কষ্ট হজম করতে থাকে এবং মনের সকল বেদনা কেবল আল্লাহ তা'আলার কাছেই প্রকাশ করে, তবে আল্লাহ তা'আলা প্রকৃত সবর তাকে দিয়ে দেবেন। ফলে কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করা তার পক্ষে সহজ হয়ে যাবে। তার মন যে-কোনও পরিস্থিতি মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। আর এভাবে তার ‘রিযা বিল-কাযা' তথা আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকার মানসিকতা অর্জিত হয়ে যাবে।
প্রকাশ থাকে যে, ইসতিফাফ ও ইসতিগনা অবলম্বনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ধৈর্যশক্তির দরকার পড়ে। সে শক্তি আপনা-আপনিই অর্জিত হয়ে যায় না, সাধনা ও মুজাহাদার মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হয়। তাই তৃতীয় পর্যায়ে তাসাব্বুরের কথা বলা হয়েছে। এর দ্বারা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, তুমি ভান-ভনিতার সংগে হলেও ধৈর্যধারণ করে যাও। । এক পর্যায়ে ধৈর্য তোমার স্বভাবগুণে পরিণত হয়ে যাবে। তখন সকল ক্ষেত্রেই সহজে ধৈর্যধারণ করতে পারবে।
সবশেষে ধৈর্যের ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে আল্লাহ তা'আলা মানুষকে টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ, শক্তি-ক্ষমতা প্রভৃতি যত নি'আমত দান করেছেন, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও প্রশস্ত নি'আমত হচ্ছে সবর। কেননা এটা সমস্ত উৎকৃষ্ট গুণের ধারক। এ গুণ ছাড়া কোনও মহৎ গুণই অর্জন করা সম্ভব হয় না। একজন লোক যখন ধৈর্যশীল হয়, তখন সে যে-কোনও পরিস্থিতিকে উঠতে পারে। শয়তান যদি তাকে কোনও হারাম কাজে প্ররোচনা দেয়, সে নিজেকে তা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। যখন আল্লাহর কোনও আদেশ পালনের ডাক আসে, তখন যতই কষ্ট হোক না কেন, তাতে সাড়া দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। সে যত বড় বিপদ-আপদের সম্মুখীন হোক না কেন, তাতে বেসামাল হয়ে পড়ে না। একজন ধৈর্যশীল লোককে যদি কেউ গালি দেয় কিংবা সে কারও থেকে অপ্রীতিকর কোনও আচরণ পায়, আপনি তারে সে ক্ষেত্রে শান্ত-সমাহিতই দেখতে পাবেন। সে শত্রুতার বিরুদ্ধে শত্রুতা করে না, গালির বিরুদ্ধে গালি দেয় না; বরং সে অসৎ ব্যবহারের জবাবে ভালো ব্যবহার করে কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ
'তুমি মন্দকে প্রতিহত কর এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা মহাভাগ্যবান।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. উদারচিত্তে দান-খয়রাত করা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণ। এ গুণ অর্জনে সচেষ্ট হওয়া প্রত্যেক মু'মিনের কর্তব্য।
খ. অন্যের অভাব-অনটন দেখেও নিজে অর্থ-সম্পদ জমা করে রাখা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী।
গ. হাজার অভাব-অনটন সত্ত্বেও অন্যের কাছে হাত পাতা এমনকি অন্যের কাছে আশাবাদী হওয়া থেকে বিরত থাকা একটি মহৎ চরিত্র।
ঘ. মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য। নিজের যা-ই আছে তাকে আল্লাহর মহা নি'আমত গণ্য করে পরিতুষ্ট ও শোকরগুজার হয়ে থাকাই মনের ঐশ্বর্য।
ঙ. সবর একটি মহামূল্যবান নি'আমত। প্রত্যেক মু'মিনের উচিত এ নি'আমত অর্জনের জন্যে সাধনা ও মুজাহাদা করা।


বর্ণনাকারী: