আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

২০- যাকাতের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১৪১৯
৮৯২. সুস্থ কৃপণের সাদ্‌কা দেওয়ার ফযীলত।
এ পর্যায়ে আল্লাহর বাণীঃ আমি তোমাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তোমরা তা হতে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে ….. শেষ পর্যন্ত। (৬৩:১০)
আরো ইরশাদ হয়েছেঃ হে মু’মিনগণ! আমি যা তোমাদেরকে দিয়েছি তা থেকে তোমরা ব্যয় কর সেদিন আসার পূর্বে যেদিন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব এবং সুপারিশ থাকবেনা….. শেষ পর্যন্ত। (২:২৫৪)
১৩৩৬। মুসা ইবনে ইসমা‘ঈল (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন সাদ্‌কার সাওয়াব বেশী পাওয়া যায়? তিনি বললেনঃ কৃপণ অবস্থায় তোমার সাদ্‌কা করা, যখন তুমি দারিদ্রের আশঙ্কা করবে ও ধনী হওয়ার আশা রাখবে। সাদ্‌কা করতে দেরী করবে না। অবশেষে যখন প্রাণবায়ু কন্ঠাগত হবে, আর তুমি বলতে থাকবে, অমুকের জন্য এতটুকু, অমুকের জন্য এতটুকু, অথচ তা অমুকের জন্য হয়ে গেছে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ বর্ণনায় আছে, জনৈক সাহাবী দান-সদাকার শ্রেষ্ঠ সময় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। ইনি কে তা জানা যায় না। তবে হাফিজ ইব্ন হাজার আসকালানী রহ সম্ভাবনা ব্যক্ত করেন যে, ইনি হযরত আবূ যর গিফারী রাযি. হতে পারেন। কেননা মুসনাদে আহমাদ ও তবারানীর বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে, তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ জাতীয় প্রশ্ন করেছিলেন। তো সাহাবীর প্রশ্নের জবাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দানখয়রাতের শ্রেষ্ঠ সময়ের কথা বলে দিয়েছেন। বলেছেন যে, ওই সময়ের দান শ্রেষ্ঠ যখন তুমি সুস্থ ও সবল। এই সময় দান করা শ্রেষ্ঠ এজন্য যে, এ সময়কার দানখয়রাতে ইখলাস বেশি থাকে। যে-কোনও আমলে ইখলাস যত বেশি থাকে, ছাওয়াবও তত বেশি হয়।
সুস্থ অবস্থায় ইখলাস বেশি থাকে এ কারণে যে, তখন বেঁচে থাকার আশা প্রবল থাকে। সুস্থ-সবল শরীরে মনে হয় অনেকদিন বাঁচব। অনেক দিন বাঁচলে অনেক সম্পদের দরকার হয়। তাই এ সময় টাকাপয়সা হাত থেকে ছাড়তে ইচ্ছা হয় না। কারণ টাকাপয়সা যদি না থাকে আর আমি বেঁচে থাকি, তখন চলবে কী করে? অর্থের অভাবে কষ্ট ভোগ করতে হবে। সে কষ্ট যাতে ভোগ করতে না হয় তাই বেশি বেশি সঞ্চয় করে রাখা দরকার। তাই এ সময় মানুষ খুব সঞ্চয় করে। এ কারণে মালের প্রতি মহব্বতও বেড়ে যায়। ফলে এ অবস্থায় দানখয়রাত করতে খুব কষ্ট বোধ হয়। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। মালের মহব্বত ছাড়তে হয়। তা সত্ত্বেও যদি দানখয়রাত করে, তবে প্রমাণ হয় সে মালের মহব্বতের উপর আল্লাহর মহব্বতকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং দুনিয়ার উপর আখিরাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এটা ইখলাসের পরিচায়ক। এজন্যই সুস্থাবস্থায় দানখয়রাত করলে ছাওয়াব বেশি হয়।
এ হাদীসের একটি শব্দ হল شحيح ।এ শব্দটি الشح থেকে নির্গত। যার অর্থ লোভলালসার কারণে কৃপণতা। অর্থাৎ অর্থসম্পদের প্রতি লোভ থাকার কারণে তা খরচ করতে না চাওয়া ও কৃপণতা করা।
কোনও ব্যক্তি যদি সুস্থ-সবল থাকে আবার তখন অর্থসম্পদের প্রতি তার অন্তরে লোভলালসাও থাকে, যে কারণে তা আল্লাহর পথে খরচ করতে মন একদম প্রস্তুত হয় না, যখনই খরচের কোনও ক্ষেত্র আসে তখনই মালের লোভ ও কৃপণতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তার পক্ষে খরচ করা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কেননা এ অবস্থায় আল্লাহর পথে খরচ করতে হলে মনের সঙ্গে লড়াই করতে হয় এবং লোভ ও কৃপণতার বাধা দূর করতে হয়। অনেকেই তা করতে সক্ষম হয় না। ফলে দানখয়রাতের ছাওয়াব থেকে সে বঞ্চিত থেকে যায়। এ হাদীছে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যে, তোমরা যদি দানখয়রাতের বিপুল ছাওয়াবের অধিকারী হতে চাও, তবে বিলম্ব না করে সুস্থ অবস্থায় যখন অন্তরে মালের লোভ ও কৃপণতা থাকে, তখন মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে হলেও দানখয়রাতে রত হও।
হাদীছে বলা হয়েছে- যখন দারিদ্র্যের ভয় হয় ও সচ্ছলতার আশা করা হয়, তখনকার দানখয়রাতে ছাওয়াব বেশি হয়। কেননা এ অবস্থায়ও দানখয়রাত করতে হলে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। শয়তান প্ররোচনা দেয় যে, দানখয়রাত করলে তুমি গরীব হয়ে যাবে। পরে কী খেয়ে বাঁচবে? কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الفَقْرَ অর্থ : শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায়। সূরা বাকারা, আয়াত ২৬৮
শয়তান এ ভয় দেখায় মানুষ যখন সুস্থ-সবল থাকে। যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন তো মৃত্যুভয় প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে কবরে কিছু পুণ্য নিয়ে যাওয়ার আশায় তখন দানখয়রাত করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। তখন শয়তান ধোঁকা দিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। তার ধোঁকা সফল হয় মানুষের সুস্থতাকালে। আল্লাহ তা'আলা বড় মেহেরবান। তিনি বান্দাদের সতর্ক করছেন যে, তোমরা ওর ধোঁকায় পড়ো না। আল্লাহর উপর ভরসা করে দানখয়রাত করতে থাক। তাহলে তাঁর কাছে মাগফিরাত লাভ করতে পারবে এবং তিনি তোমাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করবেন। তাঁর অনুগ্রহে তোমরা দানখয়রাতের কারণে অভাব-অনটনে পড়বে না। আল্লাহর ভাণ্ডার অফুরন্ত । তোমরা যদি তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর পথে খরচ কর, তবে তিনি তাঁর অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে তোমাদেরকে তোমাদের কল্পনার বাইরে বদলা দান করবেন। দুনিয়া ও আখিরাত সব জায়গায় তোমাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। সুতরাং তিনি ইরশাদ করেনঃ-

وَاللَّهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

অর্থ : আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ ঐশ্বর্যময়, সর্বজ্ঞানী।সূরা বাকারা, আয়াত ২৬৮
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- তোমাদের প্রাণ যখন তোমাদের কণ্ঠনালিতে পৌঁছে যাবে অর্থাৎ যখন মৃত্যু উপস্থিত হবে, সেইসময় পর্যন্ত বিলম্ব করে না। কেননা সেই সময়কার দানখয়রাতে বিশেষ মূল্য নেই। তখন তো মানুষ জীবন থেকে হতাশ হয়ে যায়। ফলে অর্থসম্পদের কোনও মহব্বত তখন থাকে না। সে জানে সারা জীবন যা-কিছু সঞ্চয় করেছে, এখন তা সব ছেড়েই কবরে চলে যেতে হবে, কিছুই সঙ্গে নেওয়া যাবে না। যা সঙ্গে নেওয়া যাবে না তা দান করতে কোনও ত্যাগের প্রশ্ন নেই। তাই এ দান মনের দানশীলতা থেকে হয় না। নেহাত বাধ্য হয়েই তা করে থাকে। তাই এ দানের বিশেষ ফযীলত নেই। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ-

لأن يتصدق المرء في حياته وصحته بدرهم خير له من أن يتصدق بمئة درهم عند موته

“সুস্থ-সবল অবস্থায় কোনও ব্যক্তির এক দিরহাম দান করা মৃত্যুকালে তার একশ’দিরহাম দান করা অপেক্ষাও উত্তম।সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩৩৪। সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ২৮৬৬.
অপর এক হাদীছে আছে

مثل الذي يعتق عند الموت، كمثل الذي يهدي إذا شبع.

“যে ব্যক্তি মৃত্যুকালে গোলাম আযাদ করে সে ওই ব্যক্তির মত, যে পেট ভরে খাওয়ার পর হাদিয়া দেয়।সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৩৯৬৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৫৩২; জামে তিরমিযী,হাদীছ নং ২১২৩.
বরং মৃত্যুকালীন কোনও কোনও দান জায়েযও হয় না। এ সময় সে কেবল পারে ঋণ পরিশোধ করতে এবং তিনভাগের একভাগ সম্পদের মধ্যে অসিয়ত করতে। এর বাইরে আর কিছু করার অধিকার তার থাকে না। কেননা তখন তাতে ওয়ারিশদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তাই দানখয়রাত করে ছাওয়াব পেতে চাইলে মৃত্যুকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না; বরং তার আগেই সুস্থাবস্থায় করতে হবে।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- মৃত্যুকালে তুমি যদি বল ‘অমুকের এতটুকু এবং অমুকের এতটুকু’, তার কী ফায়দা? তা তো অমুকের এমনিই হয়ে যায়। অর্থাৎ তুমি মারা গেলে তোমার ওয়ারিশগণ সে সম্পদ এমনিই পেয়ে যাবে। আর কেউ যদি পাওনাদার থাকে, তবে সেও তোমার সম্পদ থেকে তার প্রাপ্য অংশ পেয়ে যাবে। কাজেই এ সময় ‘অমুকের এত অমুকের এত’ বলার কোনও সার্থকতা থাকে না। যা দান করবার তা আগেই করে ফেল। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ

অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থসম্পদ ও তোমাদের সন্তানসন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। যারা এ রকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে) তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত। আমি তোমাদেরকে যে রিয্ক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় কর, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে আর তখন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কিছুকালের জন্য সুযোগ দিলে না কেন, তাহলে আমি দান-সদাকা করতাম এবং নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম! যখন কারও নির্ধারিত কাল এসে যাবে তখন আল্লাহ তাকে কিছুতেই অবকাশ দেবেন না। আর তোমরা যা-কিছু কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবহিত। সূরা মুনাফিকূন, আয়াত ৯-১১

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছও ‘ইবাদত-বন্দেগী ও দানখয়রাতে অগ্রগামী হওয়ার শিক্ষা দেয়।

খ. এর দ্বারা আরও শিক্ষা পাওয়া যায়, সুস্থ অবস্থায় দানখয়রাত করাই প্রকৃত দানশীলতা। মৃত্যুকালে তো অর্থসম্পদ এমনিতেই হাতছাড়া হয়ে যায়।

গ. মৃত্যুকালে দানখয়রাতে সতর্কতা জরুরি, যাতে ওয়ারিশদেরকে তাদের হক থেকে বঞ্চিত করা না হয়।

ঘ. মানুষ যত বড় ধনীই হোক, মৃত্যুকালে সমস্ত ধনসম্পদ ফেলে রেখে একাকী কবরে যেতে হয়। প্রত্যেকের উচিত আগেভাগে সে ধনসম্পদ আল্লাহর পথে খরচ করে কবরের সঙ্গী যোগার করে নেওয়া।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন