আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৪৮- সদ্ব্যবহার,আত্নীয়তা রক্ষা (মুআশারা) ও বিবিধ শিষ্টাচার

হাদীস নং: ৬৩০৯
১০. মুসলমানের উপর যুলুম করা, তাকে অপদস্থ করা, তুচ্ছ জ্ঞান করা হারাম এবং তার খুন, ইযযত-আবরু ও মালও (অমর্যাদাপূর্ণ হারাম)
৬৩০৯। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসলামা ইবনে কানাব (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমরা পরস্পরে হিংসা পোষণ করো না, পরস্পর ধোঁকাবাজী করো না, পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করো না। একে অপরের (ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে) পশ্চাতে শক্রতা করো না এবং একের বেচাকেনার উপর অন্যে বেচা-কেনার চেষ্টা করবে না। তোমরা আল্লাহর বান্দা রূপে ভাই ভাই হয়ে থাক।

এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না, তাকে অপদস্থ করবে না এবং হেয় করবে না। তাকওয়া এইখানে, এই কথা বলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার সীনার প্রতি ইশারা করলেন তিনবার। একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে হেয় করে। কোন মুসলমানের উপর (প্রত্যেক) মুসলমানের সবকিছু জান-মাল ও ইযযত-আবরু হারাম।
باب تَحْرِيمِ ظُلْمِ الْمُسْلِمِ وَخَذْلِهِ وَاحْتِقَارِهِ وَدَمِهِ وَعِرْضِهِ وَمَالِهِ
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مَسْلَمَةَ بْنِ قَعْنَبٍ، حَدَّثَنَا دَاوُدُ، - يَعْنِي ابْنَ قَيْسٍ - عَنْ أَبِي، سَعِيدٍ مَوْلَى عَامِرِ بْنِ كُرَيْزٍ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " لاَ تَحَاسَدُوا وَلاَ تَنَاجَشُوا وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَدَابَرُوا وَلاَ يَبِعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا . الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ . التَّقْوَى هَا هُنَا " . وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ " بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আখলাক-চরিত্রের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আখলাক-চরিত্র ইসলামী শিক্ষার অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এক হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنَّمَا بُعِثْتُ لأتمم صالح الأخلاق
'আমাকে পাঠানো হয়েছে ভালো চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য।[১]
আখলাক-চরিত্রের কিছু আছে ভালো দিক, যাকে 'আখলাকে হামীদাহ' বলে। কিছু আছে মন্দ দিক, যাকে 'আখলাকে যামীমাহ' বা 'রাযীলাহ' বলে। সব মানুষের মধ্যেই উভয়প্রকার চরিত্রই নিহিত আছে। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য মন্দ চরিত্র দমন ও উত্তম চরিত্রের বিকাশ সাধনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন মুজাহাদা ও সাধনা চালানো। কোন কোন চরিত্র মন্দ এবং কোনগুলো ভালো, তার অনেকটাই আল্লাহপ্রদত্ত বোধ-বুদ্ধি দ্বারা নিরূপণ করা যায়। আবার কোনও কোনওটি বোঝার জন্য আসমানী শিক্ষার প্রয়োজন হয়। তবে মহান ইসলাম বিষয়টাকে কেবল মানববৃদ্ধির উপর ছেড়ে দেয়নি; বরং সুনির্দিষ্টভাবে প্রত্যেকটি স্পষ্ট করে দিয়েছে। যেসব গুণ ভালো, তা অর্জনের আদেশ করেছে এবং তার ফযীলত ও মাহাত্ম্য বর্ণনাপূর্বক তা অর্জনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। অপরদিকে যেগুলো মন্দ, তা বর্জন ও দমনের হুকুম দিয়েছে এবং তার ক্ষতি ও কদর্যতার উল্লেখপূর্বক তা পরিহারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। আলোচ্য হাদীছে বিশেষ কয়েকটি মন্দ চরিত্রের উল্লেখ আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেগুলোর প্রতি নিষেধাজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ কেউ যাতে সেসব চরিত্রপ্রসূত আচরণ কারও সঙ্গে না করে, সে ব্যাপারে তাগিদ করেছেন। তার মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে হাসাদ। তিনি বলেন-

একে অন্যকে হাসাদ না করা
لا تحاسدوا 'তোমরা একে অন্যের প্রতি হাসাদ করো না'। হাসাদ অর্থ অন্যের প্রাপ্ত নিআমত যাতে তার থেকে দূর হয়ে যায় সেই কামনা করা। এর পাশাপাশি আরেকটি স্বভাবের নাম হচ্ছে 'গিবতা'। গিবতা অর্থ অন্যের প্রাপ্ত নিআমত নিজের জন্যও কামনা করা। এটা দূষণীয় নয়, যদি তার থেকে তা হাতছাড়া হওয়ার কামনা না থাকে। সেরকম কামনা থাকলে তখন আর এটা গিবতা নয়; বরং হাসাদ হয়ে যাবে। কখনও কখনও গিবতা অর্থেও হাসাদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন এক হাদীছে আছে,
لاَ حَسَدَ إِلَّا فِي اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ القُرْآنَ فَهُوَ يَتْلُوهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا فَهُوَ يُنْفِقُهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ
‘হাসাদ বৈধ নয়, তবে দুই ব্যক্তি ব্যতিক্রম (অর্থাৎ, তাদের প্রতি হাসাদ করা যায়)। এক ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা কুরআন দিয়েছেন আর সে তা দিবারাত্রির মুহূর্তগুলোতে তিলাওয়াত করে। দ্বিতীয়ত ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা অর্থ- সম্পদ দিয়েছেন আর সে তা দিবারাত্রির মুহূর্তগুলোতে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে।[২]

হাসাদ করা অতি কঠিন পাপ। এর দ্বারা নিজের নেক আমল বরবাদ হয়ে যায়। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ ، فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ
‘হাসাদ পরিহার করো। কেননা হাসাদ নেকীসমূহ খেয়ে ফেলে, যেমন আগুন কাষ্ঠ খেয়ে ফেলে।[৩]

হাসাদ অতি নিকৃষ্ট খাসলাত। হাসাদকারীর যেন আল্লাহর প্রতি আপত্তি— কেন তিনি অমুক ভালো জিনিসটি তাকে না দিয়ে আরেকজনকে দিলেন। সে কেবল আপত্তি করেই ক্ষান্ত হয় না; বরং সে ভালো জিনিসটি তার থেকে বিলুপ্ত করার ও তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা চালায়। যার প্রতি তার হাসাদ সে তো তার মুসলিম ভাই। সে হিসেবে কর্তব্য ছিল তার প্রাপ্তিতে খুশি হওয়া এবং তার জন্য তা স্থায়ী হোক সেই কামনা করা। ঈমানের দাবি হল নিজের জন্য যা ভালোবাসা হয়ে থাকে, অন্যের জন্যও তা ভালোবাসতে হবে। কিন্তু এ কেমন লোক, যে ভালো জিনিসটি নিজের জন্য তো পসন্দ করছে, কিন্তু মুসলিম ভাইয়ের জন্য তা পসন্দ করছে না; বরং তার তা অর্জিত হওয়ায় অন্তর্জালা বোধ করছে? এক তো সে মুসলিম ভাইয়ের জন্য তা পসন্দ না করে তার হক নষ্ট করছে, অধিকন্তু তার প্রাপ্তিতে অহেতুক অন্তর্দাহে ভুগছে। যদি তা বিলোপেরও চেষ্টা করে, তবে তা নিতান্তই পণ্ডশ্রম। এতকিছু কদর্যতা যে খাসলাতের ভেতর, তা কতইনা নিকৃষ্ট !

এ নিকৃষ্ট খাসলাত ব্যক্তির শান্তিই নষ্ট করে না; পরিবার ও সমাজকেও অশান্ত করে। এর ফলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কোন্দল হয়, পরিবারে পরিবারে কলহ দেখা দেয় এবং সামাজিক ঐক্য ও সংহতি হুমকিতে পড়ে যায়।

হাসাদের কদর্যতা
মূলত এটা ইবলীসের খাসলাত। হযরত আদম আলাইহি সালামের শ্রেষ্ঠত্ব দেখে তার অন্তরে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। সেই হিংসার বশবর্তীতে সে আল্লাহ তাআলার হুকুম অমান্য করে। ফিরিশতাগণ সিজদা করলেন, কিন্তু সে সিজদা করল না। কেবল সিজদা না করেই ক্ষান্ত হল না; বরং সে হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও সন্তানদের চিরশত্রুতে পরিণত হয়ে গেল। এমনই হয় হাসাদের কুফল। পেয়েছিল কাবীলকে। এর বশবর্তীতে সে তার ভাই হাবীলকে হত্যা করল। এভাবে পৃথিবীর প্রথম হত্যাকাণ্ডের পেছনে এ বদগুণটি সক্রিয় ছিল। হাসাদের কারণেই হযরত ইয়ুসুফ আলাইহিস সালামের ভাইয়েরা তাঁর শত্রু হয়ে গিয়েছিল। মানুষের ইতিহাসে এরকম হাজারও পাপ ও বড় বড় অঘটন হাসাদের কারণেই সংঘটিত হয়েছিল।

হাসাদ এমনই এক মন্দ স্বভাব, যা মানুষের জন্য সত্য গ্রহণের পক্ষে বাধা হয়। এমনকি ঈমান আনা থেকেও বঞ্চিত হয়। ইহুদীরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান আনেনি এই ঈর্ষার কারণে যে, তাঁকে কেন আরবদের মধ্যে পাঠানো হল । কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
أَمْ يَحْسُدُونَ النَّاسَ عَلَى مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ
‘নাকি তারা এই কারণে মানুষের প্রতি ঈর্ষা করে যে, তিনি তাদেরকে নিজ অনুগ্রহ দান করেন (কেন?)। সূরা নিসা (৪), আয়াত ৫৪

ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে তারা যে কেবল নিজেরাই ঈমান আনা থেকে বিরত থেকেছে তাই নয়; বরং তাদের একান্ত কামনা ছিল যারা ঈমান এনেছে তারাও ঈমান ত্যাগ করে কুফরীর পথে ফিরে যাক। অথচ তারা জানত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য নবী, তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কুরআনও সত্য এবং তিনি যে দীনের প্রতি দাওয়াত দেন তাও সত্য দীন। আল্লাহ তাআলা জানাচ্ছেন-
وَدَّ كَثِيرٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يَرُدُّونَكُمْ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِكُمْ كُفَّارًا حَسَدًا مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْحَقُّ
‘(হে মুসলিমগণ!) কিতাবীদের অনেকেই তাদের কাছে সত্য পরিস্ফুট হওয়ার পরও তাদের অন্তরের ঈর্ষাবশত কামনা করে, যদি তোমাদেরকে তোমাদের ঈমান আনার পর পুনরায় কাফের বানিয়ে দিতে পারত! সূরা বাকারা (২), আয়াত ১০৯

হাসাদের মন্দত্ব বোঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা হাসাদকারীর অনিষ্ট থেকে বাচার জন্য তাঁর আশ্রয় গ্রহণের হুকুম করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ
এবং (আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি) হিংসুকের অনিষ্ট হতে, যখন সে হিংসা করে। সূরা ফালাক (১১৩), আয়াত ৫

কাজেই হাজারও পাপের উদ্বোধক এহেন মন্দ খাসলাত দমন ও পরিহার করা প্রত্যেকের অবশ্যকর্তব্য।

হাসাদের প্রকারভেদ ও গিবতা
হাসাদ কয়েক প্রকার-
ক. অন্যের প্রাপ্তি অসহ্য বোধ হওয়ার পাশাপাশি তার থেকে তা বিলুপ্ত করে নিজে হস্তগত করা বা নিজ পসন্দের কাউকে পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। এটা হাসাদের নিকৃষ্টতম প্রকার এবং অতি কঠিন পাপ ।

খ. অন্যের ভালো কিছু দেখলে ভালো না লাগা, তবে তার থেকে তা বিলুপ্তির কামনা ও চেষ্টাও না করা। এটা পাপ নয় বটে, তবে এ স্বভাবটি ভালো নয়। এর সংশোধন জরুরি। সংশোধনের চেষ্টা না করলে তা বাড়তে থাকার আশঙ্কা থাকে। একপর্যায়ে অন্যের থেকে নিআমত বিলুপ্তির চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে পড়াও অসম্ভব নয় ।

গ. অন্যের নিআমত দেখে অসহ্য বোধ হওয়ার পাশাপাশি যদি তার বিলুপ্তি কামনা করা হয় কিন্তু বিলুপ্তির চেষ্টা না করা হয়, তবে এটা প্রথম প্রকারের মত নিকৃষ্টতম না হলেও নিন্দনীয় অবশ্যই। ইচ্ছাকৃতভাবে বিলুপ্তি কামনা করা অন্তরের একটি মন্দ কাজ। এটা একপর্যায়ের পাপও বটে। কাজেই অন্তর থেকে এ কামনা দূর করার সাধনা ও মুজাহাদা চালানো অতি জরুরি, নচেৎ একপর্যায়ে তা কামনার স্তর পার হয়ে বাহ্যিক কর্মে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

অন্যের যে নিআমতের কারণে হাসাদ দেখা দেয় তা যদি দীনী নিআমত হয়ে থাকে, তবে তো সে ক্ষেত্রে হাসাদ জায়েয না হলেও গিবতা জায়েয, যেমন অন্যের সুন্দর নামায দেখে নিজের জন্যও সেরকম নামাযের তাওফীক কামনা করা, কোনও বড় আলেম দেখে নিজের জন্যও তার মত ইলম কামনা করা, আল্লাহর পথে অন্যের দান-খয়রাত দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ দান-খয়রাতের আগ্রহ কামনা করা, অন্যের দীনী মেহনত-মুজাহাদা দেখে নিজের জন্যও তা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা করা ইত্যাদি। বরং এসকল ক্ষেত্রে গিবতা করাই কাম্য, যেমন পূর্বোক্ত হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও শহীদদের ফযীলতের কারণে নিজের জন্য শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন।

বিষয়টা যদি দুনিয়াবী হয় যেমন, অন্যের ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা- পদমর্যাদা ইত্যাদি, তবে এক্ষেত্রে হাসাদ তো জয়ের নয়ই, গিবতা করাও পসন্দনীয় নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ
‘যা দ্বারা আমি তোমাদের কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, তার আকাঙ্ক্ষা করো না।সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩২

ঈমানদারদের দৃষ্টি থাকবে কেবলই আখেরাতের মুক্তি ও সফলতার প্রতি দুনিয়াবী শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি নয়। তাদের কাম্যবস্তু তো কেবলই আখেরাতের পুরস্কার। কারুনের ঘটনায় কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে-
فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَالَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (79) وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ (80)
‘অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল । যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারুনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত! বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান। আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে! (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়! আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই । সূরা কাসাস (২৮), আয়াত নং ৭৯, ৮০

বস্তুত দুনিয়াবী শ্রেষ্ঠত্বের প্রকৃত কোনও মূল্য নেই। আখেরাতের শ্রেষ্ঠত্বই প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব। তা অর্জনের জন্য কেবল গিবতাই নয়; অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকা চাই। আল্লাহ তাআলার হুকুম হচ্ছে-
وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ
‘প্রতিযোগীদের উচিত এরই জন্য প্রতিযোগিতা করা। সূরা মুতাফফীফীন (৮৩), আয়াত নং ২৬

সে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বশর্ত হাসাদ পরিত্যাগ করা। যে ব্যক্তি হাসাদ দমন করতে পারে, সেই জান্নাতের উপযুক্ততা লাভ করে। জান্নাতবাসীর বৈশিষ্ট্য হাসাদের মলিনতা থেকে মুক্ত থাকা। ইরশাদ হয়েছে-
وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِمْ مِنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَى سُرُرٍ مُتَقَابِلِينَ
‘আমি তাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ অপসারণ করি। তারা ভাই-ভাইরূপে মুখোমুখি হয়ে উঁচু আসনে আসীন হবে। সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৪৭

জনৈক আনসারী সাহাবীর ঘটনা
এ প্রসঙ্গে জনৈক আনসারী সাহাবী রাযি.-এর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে বসা। তখন তিনি ইরশাদ করেন, এখনই তোমাদের সামনে এক জান্নাতী ব্যক্তির আগমন হবে। এরই মধ্যে জনৈক আনসারী ব্যক্তি উপস্থিত হলেন। তার দাড়ি থেকে ওযূর পানি ঝরছিল। তার জুতা বা’হাতে ধরা। এর পরের দিনও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এখনই তোমাদের সামনে এক জান্নাতী ব্যক্তির আগমন হবে। এদিনও সেই আনসারী ব্যক্তি একই অবস্থায় হাজির হলেন। পরের দিনও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই কথা বললেন এবং সেই সাহাবীও একইভাবে উপস্থিত হলেন। এদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে যাওয়ার পর আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. ওই আনসারী সাহাবীর অনুগামী হলেন। তিনি তাঁকে বললেন, আমি কসম করেছি তিন রাত আমার বাবার কাছে যাব না। আপনি কি এ তিন রাত আমাকে আশ্রয় দেবেন, যাতে আমি আমার কসম পূর্ণ করে নিতে পারি? তিনি তাতে সম্মত হলেন। সুতরাং হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. তিন রাত তাঁর কাছে থাকলেন। তিনি জানান, এ তিন রাতে তিনি তাঁকে জাগতে দেখেননি। শুধু এতটুকু হয়েছে যে, যখনই বিছানায় পাশ ফিরেছেন, আল্লাহর যিকির করেছেন ও তাকবীর বলেছেন। ফজরের সময় হলে তিনি উঠে ওযূ করেছেন (এবং ফজরের নামায আদায় করেছেন)। আব্দুল্লাহ রাযি. বলেন, অতিরিক্ত শুধু এতটুকুই ছিল যে, তিন দিন আমি তাঁকে ভালো ছাড়া কোনও মন্দ কথা বলতে শুনিনি। তিন রাত শেষ হলে আমার কাছে তাঁর আমল তুচ্ছ মনে হল। কাজেই আমি তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! প্রকৃতপক্ষে আমার ও আমার পিতার মধ্যে কোনও রাগ ও মনোমালিন্যের ঘটনা ঘটেনি। আমি কেবল আপনার আমল দেখার জন্য আপনার সঙ্গে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু আপনাকে বেশি কিছু আমল করতে দেখলাম না। তাহলে আপনার এমন কী ব্যাপার আছে, যে কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কথা বললেন? তিনি বললেন, ব্যাপার কিছুই নেই, বাস তুমি যা দেখেছ তাই। আব্দুল্লাহ রাযি বলেন, আমি ফিরে চললাম। কিছুদূর আসার পর তিনি আমাকে ডাকলেন, তারপর বললেন, তুমি যা দেখলে এর বেশি কোনও ব্যাপার নেই, তবে এতটুকু কথা যে, আমি আমার অন্তরে কোনও মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং আল্লাহ তাআলা তাকে যা দিয়েছেন সে কারণে তার প্রতি ঈর্ষা বোধ করি না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাযি. বলেন, রহস্য এই-ই, যা আপনাকে ওই স্তরে পৌঁছিয়েছে। আর এটাই সেই গুণ, যা আমরা অর্জন করতে পারছি না।[৪]

হাসাদ দমনের উপায়
হাসাদ দমনের উপায় দু'টি। একটি জ্ঞানমূলক, অপরটি কর্মমূলক। জ্ঞানমূলক উপায় হচ্ছে হাসাদের দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে চিন্তা করা। যেমন, এটা ব্যক্তির শান্তি নষ্ট করে, পরিবারে কলহ সৃষ্টি করে, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ধ্বংস করে ইত্যাদি। এমনিভাবে এটা এক চরিত্র-বিধ্বংসী খাসলাত। এর কারণে আল্লাহর কাছে নিজ মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। এমনকি একজন হিংসুক হিসেবে সমাজচোখেও ঘৃণ্য সাব্যস্ত হতে হয়। তাছাড়া এ খাসলাতের কারণে আরও নানারকম বড় বড় গুনাহ হয়ে যায়। এর কারণে নিজ জবানের অপব্যবহার করা হয়, বিভিন্ন কুচিন্তা করা হয় এবং অন্যের জান-মালের ক্ষতি করার জন্য বিভিন্ন অপতৎপরতা চালানো হয়। ফলে আমলনামায় গুনাহের তালিকা বাড়তেই থাকে। এর কারণে অন্যের উপর যে জুলুম ও অবিচার করা হয় আখেরাতে তার বিনিময়ে নিজের অর্জিত নেকী দিয়ে দিতে হবে। তাতে পুরোপুরি বদলা না হলে মজলুমের গুনাহ নিজের কাঁধে চেপে যাবে। এ ক্ষতি অপূরণীয়। যে স্বভাবের কারণে এতসব ক্ষতি হয় আমি কেন তা বদলাব না? নিয়মিত এ ধ্যান ও চিন্তা করতে থাকলে ইনশাআল্লাহ কিছু না কিছু পরিবর্তন আসবেই।

কর্মমূলক উপায় হল, যার প্রতি হাসাদ ও ঈর্ষা দেখা দেয় মনের সঙ্গে লড়াই করে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে থাকা। কৃত্রিমভাবে হলেও তাকে দেখে মুখে হাসি ফোটানো ও তাকে সাদর সম্ভাষণ জানানো। মাঝেমধ্যে তাকে হাদিয়া তোহফা দেওয়া। তাকে দাওয়াত করে খাওয়ানো ও তার দাওয়াতে অংশগ্রহণ করা। তার কল্যাণের জন্য আল্লাহ তাআ'লার কাছে দোয়া করা। বিশেষত তার যে নেআমতের কারণে হাসাদ হয় তা যেন তার থেকে বিলুপ্ত না হয়, বরং স্থায়ীভাবে থাকে সে দোয়াও করা। সেই সঙ্গে একান্তমনে আল্লাহ তাআ'লার কাছে দোয়া করা যেন তিনি অন্তর থেকে এ মন্দ খাসলাতটি দূর করে দেন। আল্লাহ তাআ'লা আমাদের অন্তর থেকে এটি দূর করেই দিন-আমীন।

প্রতারণামূলক দালালী করার নিষেধাজ্ঞা
আরেকটি মন্দ খাসলাত হচ্ছে প্রতারণামূলক দালালী । এটাও পাপকর্ম। ইসলাম এটা করতে নিষেধ করেছে। যেমন এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ولا تناجشوا 'তোমরা প্রতারণামূলক দালালী করো না। تناجشوا ক্রিয়াটির উৎপত্তি النجش থেকে। ইমাম নববী রহ. এর ব্যাখ্যা করেছেন- বাজারে বা অন্য কোথাও যে পণ্য বিক্রির জন্য তোলা হয়, তার দাম অন্যের বলা দামের চেয়ে বেশি বলা, উদ্দেশ্য তা নিজে কেনা নয়; বরং কেবলই অন্যকে ধোঁকা দেওয়া। অর্থাৎ তার বলা দাম শুনে অন্যে মনে করবে পণ্যটির দাম সে যা ভেবেছে তারচে' আরও বেশি। তখন সে আরও বেশি দামে সেটি কিনে নেবে আর এভাবে প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি দামে কিনে সে প্রতারিত হবে। এটা সুস্পষ্টই ধোঁকা। আর ধোঁকা দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম।

এরকম দালালী অনেক সময় বিক্রেতার সঙ্গে যোগসাজশ করে হয়। আবার অনেক সময় স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবেও করা হয়। উভয়টাই হারাম ও নাজায়েয। কেননা এতে ভোক্তাসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যের ক্ষতি হয় এমন যে-কোনও তৎপরতা কল্যাণকামিতার পরিপন্থী। অথচ মুসলিম ভাইয়ের প্রতি কল্যাণ কামনা করা দীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য।

النجش সম্পর্কে উল্লিখিত আলোচনা ইমাম নববী রহ.-কৃত ব্যাখ্যার আলোকে করা হল। তার মত ব্যাখ্যা আরও অনেকে করেছেন। আবার কেউ কেউ এর ব্যাখ্যা করেছেন আরও ব্যাপকভাবে। তারা বলেছেন, النجش এর আভিধানিক অর্থ কাউকে ধোঁকা ও প্রতারণামূলক পন্থায় কোনও জিনিসের প্রতি প্ররোচিত করা। ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দালালকে এ কারণেই الناجش বলা হয় যে, সেও ধোঁকা দিয়ে ক্রেতাকে বেশি মূল্যে পণ্যক্রয়ে প্ররোচিত করে। কখনও বিক্রেতাকেও কম মূল্যে বিক্রির প্ররোচনা দেয়। শিকারীকেও الناجش বলা হয়। কারণ সেও শিকারকে তার ধোঁকার ফাঁদে ফেলে। এ হিসেবে ولا تناجشوا অর্থ হবে- তোমরা একে অন্যকে ধোঁকা দিও না এবং একে অন্যের প্রতি প্রতারণামূলক আচরণ করো না। সুতরাং বেচাকেনাসহ যে-কোনও লেনদেনে যে-কোনওরকম প্রতারণা এ নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে, যেমন মালে ভেজাল মেশানো, ভালো মাল দেখিয়ে মন্দ মাল বিক্রি, পণ্যের দোষত্রুটি গোপন করা, সরলসোজা ভোক্তাকে চালাকি করে মন্দ মাল গছিয়ে দেওয়া বা অতিরিক্ত বেশি দামে তার কাছে মাল বিক্রি করা কিংবা অতিরিক্ত কম দামে তার থেকে কিনে নেওয়া। এমনিভাবে ইজারা, আমানত, বিবাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও এ জাতীয় প্রতারণা আলোচ্য নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে।

ধোঁকা ও প্রতারণার উদ্দেশ্য থাকে অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। কোনও মুসলিমকে ক্ষতিগ্রস্ত করা সম্পূর্ণ হারাম। আখেরে এর দ্বারা প্রতারক ব্যক্তি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আখেরাতে তো হয়ই, দুনিয়ায়ও তার ধোঁকা ও প্রতারণার কথা যখন প্রকাশ হয়ে যায়,তখন সকলেই তাকে এড়িয়ে চলে। ফলে সামাজিক নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে সে বঞ্চিত হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَلَا يَحِيقُ الْمَكْرُ السَّيِّئُ إِلَّا بِأَهْلِهِ
‘অথচ কূট-চক্রান্ত খোদ তার উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করে নেয়। সূরা ফাতির (৩৫), আয়াত ৪৩

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَلْعُونٌ مَنْ صَارٌ مُؤْمِنًا أَوْ مَكَرَ بِه
‘ওই ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে কোনও মুমিনকে কষ্ট দেয় বা তার সঙ্গে প্রতারণা করে।[৫]

বাজারে গেলে লক্ষ করা যায়, বিক্রেতা স্তুপের উপর দিকে ভালো ভালো মাল রাখে। তা দেখে ক্রেতা আকৃষ্ট হয়। কিন্তু নিচের দিকে থাকে নিম্নমানের মাল। যারা উপরের ভালোটা দেখে তা কেনে, তারা প্রতারিত হয়। ফলমূল, তরি-তরকারি, মাছ- মাংস ইত্যাদি সবরকম পণ্যের বিক্রেতাদেরকেই ব্যাপকভাবে এরকম কাণ্ড করতে দেখা যায়। জাহিলী যুগেও মানুষ এরকম করত। যারা নতুন নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাদের কেউ কেউ পুরোপুরি সংশোধনের আগে এরকম কাণ্ড করে ফেলত। একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাজারে গিয়ে এক বিক্রেতার খাদ্যস্তুপের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি অনুভব করলেন নিচের দিকের মাল ভেজা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ওহে বিক্রেতা, এটা কী? সে বলল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। তখন তিনি ইরশাদ করলেন-
أَفَلَا جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ حَتَّى يَرَاهُ النَّاسُ، ثُمَّ قَالَ: مَنْ غَش فَلَيْسَ مِنَّا
‘তুমি তা (অর্থাৎ ভেজাটা) খাদ্যশস্যের উপরে রাখতে পারলে না, যাতে মানুষ তা দেখতে পায়? যে ধোঁকা দেয় সে আমাদের একজন নয়।[৬]

পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণের অবৈধতা
এমনিভাবে ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণও একটি মন্দ স্বভাব। এটাও হারাম ও কঠিন পাপ। ইসলাম যেসকল মন্দ স্বভাব পরিহারের তাগিদ করেছে, ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণও তার একটি। যেমন আলোচ্য হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ولا تباغضوا 'তোমরা ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করো না। تباغضوا ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি بغض থেকে। এর অর্থ ঘৃণা করা। কাউকে ঘৃণা করা যদি আল্লাহ তাআলার জন্য না হয়, তবে তা সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহ তাআলার জন্য ঘৃণা করার অর্থ কেউ যদি আল্লাহ তাআলার দীন ও শরীআতের বিরোধিতা করে, তবে সে বিরুদ্ধাচরণের জন্য তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করা। এটা ঈমানের অঙ্গ। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيْمَانَ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য দান করে এবং আল্লাহর জন্য দান করা হতে বিরত থাকে, সে তার ঈমান পরিপূর্ণ করল।[৭]

কিন্তু ঘৃণা করা যদি আল্লাহর জন্য না হয়, তবে তা সম্পূর্ণ নাজায়েয। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি হল এক মুসলিম অপর মুসলিমকে ভালোবাসবে, ব্যক্তিগত কোনও কারণে বা পার্থিব কোনও স্বার্থে তাকে ঘৃণা করবে না। এমনকি দীনী বিষয়েও যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে শরীআতবিরোধিতা প্রমাণ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ঘৃণার কোনও সুযোগ নেই। কাজেই মাযহাবী মতভেদের ভিত্তিতে কাউকে ঘৃণা করা যাবে না। কেননা বিপরীত মাযহাবও কুরআন-সুন্নাহ'র ভিত্তিতেই গঠিত। এক পক্ষের কাছে যেমন দলীল আছে, তেমনি দলীল অন্য পক্ষের কাছেও আছে। এরূপ ক্ষেত্রে অন্য মাযহাবকে শরীআতবিরোধী ঠাওরানো আর এর ভিত্তিতে তার অনুসারীকে ঘৃণার চোখে দেখা নিতান্তই ভুল; বরং এটা নিষিদ্ধ এর অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে সকলের সতর্ক হওয়া অতীব জরুরি। ইদানীং বিভিন্ন মহলকে এ জাতীয় ঘৃণা বিস্তারে তৎপর দেখা যায়। তাদের উচিত নিজেদের কর্মপন্থা বিচার- বিশ্লেষণ করা।

পরস্পর সম্পর্কচ্ছেদ করা ও একের থেকে অন্যের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার নিষেধাজ্ঞা
আরও একটি মন্দ স্বভাব হচ্ছে একের থেকে অন্যের বিমুখ হওয়া, পরস্পর সম্পর্ক ছিন্ন করা ও দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করে দেওয়া। ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিতকারী ইসলাম এ জাতীয় আচরণ কখনও অনুমোদন করে না। ইসলামে এটা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ।

যেমন আলোচ্য হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ولا تدابروا ‘তোমরা একের থেকে অন্যে মুখ ফিরিয়ে নিও না'।تدابروا ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি الدبر থেকে। এর অর্থ নিতম্ব ও পেছন দিক। কেউ যখন কারও প্রতি অসন্তুষ্ট হয় ও তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতে না চায়, তখন তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় ও তার দিকে নিতম্ব বা পেছন ফিরিয়ে দেয়। কাজেই মুখ ফেরানো ও পেছন দিক ঘুরিয়ে দেওয়ার দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য দেখা-সাক্ষাত ও মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেওয়া।

দুই মুসলিম পরস্পর মুখ দেখাদেখি ও দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করা জায়েয নয়। এটা কঠিন পাপ। কোনও কারণে পরস্পর মনোমালিন্য হলে যথাসম্ভব শীঘ্র মিটমাট করে ফেলা চাই। সে মনোমালিন্যকে দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। ঘটনাক্রমে অবস্থা সে পর্যায়ে পৌঁছে গেলে তিন দিনের মধ্যে অবশ্যই মিলেমিশে যেতে হবে। তিন দিনের বেশি দেখা-সাক্ষাত বন্ধ রাখা সম্পূর্ণ হারাম। হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাযি. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقِ ثَلَاثٍ، يَلْتَقِيَانِ فَيَصُدُّ هَذَا وَ يَصُدُّ هَذَا وَخَيْرُهُمَا الَّذِي يَبْدَأُ بِالسَّلَامِ
‘কোনও মুসলিমের জন্য তার ভাইকে তিন দিনের বেশি পরিত্যাগ করা বৈধ নয় যে, পরস্পর সাক্ষাত হলে এ ওকে উপেক্ষা করবে এবং সে একে উপেক্ষা করবে। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সে, যে প্রথম সালাম দেয়।[৮]

হযরত আবূ খিরাশ সুলামী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ هَجَرَ أَخَاهُ سَنَةٌ فَهُوَ كَسَفْكِ دَمِهِ
‘কেউ তার ভাইকে এক বছর পরিত্যাগ করে রাখলে তা তাকে হত্যা করার মত (অপরাধ)।[৯]

পরস্পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ করার এ অপরাধ কেবল তখনই, যখন তা দুনিয়াবী কারণে হয়। পক্ষান্তরে তা যদি হয় দীনী কোনও কারণে, তবে তা কেবল বৈধই নয়; ক্ষেত্রবিশেষ কাম্যও। যেমন কেউ যদি আকীদাগত কোনও বিদআতে লিপ্ত থাকে এবং বোঝানো সত্ত্বেও সে তা থেকে ফিরে না আসে, তবে তার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখাই শ্রেয়। এমনিভাবে সন্তান, ছাত্র বা নিজের অধীন কাউকে সংশোধনের উদ্দেশ্যেও তার সঙ্গে কথাবার্তা ও দেখা-সাক্ষাত বন্ধ রাখা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি, যাতে মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা না হয়ে যায়। কেননা তাতে আরও বেশি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যে-কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় আন্তরিকতার স্পর্শ থাকা দরকার।

একজনের বেচাকেনার উপর আরেকজনের বেচাকেনায় লিপ্ত হওয়ার নিষিদ্ধতা
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরেকটি নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে ولا يبع بعضكم على بيع بعض তোমরা একজনের বেচাকেনার উপর আরেকজন বেচাকেনা করো না'। একজনের বেচাকেনার উপর আরেকজনের বেচাকেনায় লিপ্ত হওয়ার অর্থ- কেউ কারও কাছে কোনও মাল বিক্রি করার পর বিক্রেতাকে গিয়ে এ কথা বলা যে, তুমি তার কাছে বিক্রি বাতিল করে দাও, আমি আরও বেশি দামে তোমার কাছ থেকে কিনব। অথবা ক্রেতার কাছে গিয়ে বলা যে, তুমি এ ক্রয় বাতিল করে দাও, আমি এরকম মাল আরও সস্তায় তোমাকে দেব। এটা সম্পূর্ণ নিষেধ। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। ভ্রাতৃত্বের দাবি হচ্ছে নিজের জন্য যা পসন্দ করা হয়, অন্যের জন্যও তা পসন্দ করা। এমনিভাবে ভ্রাতৃত্বের দাবি প্রত্যেক মুসলিমের কল্যাণ কামনা করা। এ জাতীয় কাজ সে দাবির পরিপন্থী। কেননা প্রথম অবস্থায় ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর দ্বিতীয় অবস্থায় বিক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনও মুসলিমকে ক্ষতিগ্রস্ত করা সম্পূর্ণ হারাম। এমনকি অকারণে কোনও অমুসলিমেরও ক্ষতি করা জায়েয নয়।

ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর তৃতীয় ব্যক্তি কর্তৃক তা বাতিল করার প্রস্তাব নাজায়েয তো বটেই, এমনকি ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হওয়ার আগে যখন ক্রেতা- বিক্রেতার মধ্যে দরদাম চলে, তখনও সেই দরদামের মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তির ঢুকে পড়া জায়েয নয়। উদাহরণত, এক ব্যক্তির একটা বস্তু পসন্দ হল। সে বিক্রেতাকে একটা দামও বলল। বিক্রেতা সে দামে বিক্রি করতে রাজি হল না। ক্রেতা ভাবছে আরও বেশি দাম বলবে কি না। সে মালটি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানাল না। ঠিক ওই মুহূর্তে আরেকজন সেটি কেনার আগ্রহ দেখাল এবং একটা দামও বলে ফেলল। এভাবে একজনের দরদামের উপর আরেকজনের দরদাম করার এ কাজটি একরকম অশিষ্টতা। এটা একরকম স্বার্থপরতাও বটে, যা ইসলামী নীতি-নৈতিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا يَسم الْمُسْلِمُ عَلَى سَوْمِ الْمُسْلِم وَلَا يَخْطُبُ عَلَى خِطبته
‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের দরদাম করার উপর দরদাম করবে না এবং তার বিবাহের প্রস্তাবের উপর বিবাহের প্রস্তাব করবে না।[১০]

বেচাকেনার দরদামের মতই কারও গাড়ি ভাড়ার কথাবার্তার সময় একই গাড়ি ভাড়া নেওয়ার জন্য অন্য ব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা কিংবা শ্রমিক নিয়োগের কথাবার্তাকালে একই শ্রমিক নেওয়ার জন্য অন্য ব্যক্তির আগ্রহ দেখানো এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসে যায়। এমনিভাবে যে-কোনও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আলোচনাকালে অপর ব্যক্তি তাতে ঢুকে পড়া ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী ও নাজায়েয। এ ব্যাপারে আমাদের অনেকেরই সতর্কতা নেই। কোনও বস্তুতে চোখ পড়ল, অমনি তাতে প্রস্তাব দিয়ে বসে, অথচ তখন তার লেনদেন সম্পর্কে দু'জনের মধ্যে কথা চলছে। এটা কিছুতেই ইসলামের শেখানো শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। ইসলামের সামাজিক শিক্ষা অনেক মূল্যবান ও পূর্ণাঙ্গ। মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য তা শিখে নিয়ে সে অনুযায়ী চলতে সচেষ্ট থাকা।

তোমরা ভাই ভাই হয়ে যাও
উপরের পাঁচটি নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দান করেন- وكونوا عباد الله اخوانا ‘আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা ভাই ভাই হয়ে থাকো'। অর্থাৎ তোমাদের পরস্পরের মধ্যে যে পাঁচটি কাজ করতে নিষেধ করা হল, এগুলো ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। ভ্রাতৃত্বের দাবি এসব কাজে লিপ্ত না হওয়া। কাজেই তোমরা যদি ভাই ভাই হয়ে থাক, তবে কিছুতেই তোমাদের দ্বারা এগুলো সংঘটিত হবে না। অথবা এর অর্থ- তোমরা যদি পাঁচটি কাজ বর্জন কর, তবে তোমাদের মধ্যে সত্যিকার ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তোমরা এগুলো পরিহার করে চলো।

বস্তুত ইসলামে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি অত্যন্ত মূল্যবান। এটা আল্লাহ তাআলার এক বিরাট নিআমতও বটে। আল্লাহ তাআলা সেই নিআমতের কথা স্মরণ করিয়ে ইরশাদ করেন-
وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا
‘আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা স্মরণ রাখ। একটা সময় ছিল, যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহকে জুড়ে দিলেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেলে। সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১০৩

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব যখন আল্লাহ তাআলার এক বিরাট দান ও অতি বড় নিআমত, তাই এটা রক্ষা করাও অতি জরুরি। যেসব কর্মকাণ্ড দ্বারা এটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিছুতেই তাতে লিপ্ত হওয়া যাবে না। কারও কোনও আচরণে দু'জনের সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হলে অন্যদের কর্তব্য তাদের মধ্যে মিলমিশ করে দেওয়া, যাতে অসদ্ভাব স্থায়ী হতে না পারে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ
‘প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহকে ভয় কর। সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১০

তারপর আলোচ্য হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِم : لا يَظْلِمُهُ، وَلَا يَحْقِرُهُ، وَلَا يَخْذلُهُ، التَّقْوَى هَاهُنَا وَيُشِيرُ إِلى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ بِحَسْبِ امْرِى مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ، كُلُّ الْمُسْلِم عَلَى الْمُسْلِم حَرَامٌ، دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ
‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করে না, তাকে তুচ্ছ গণ্য করে না এবং তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেয় না। তাকওয়া এখানে- তিনি নিজ বুকের দিকে ইঙ্গিত করে এ কথাটি তিনবার বললেন। কোনও ব্যক্তির মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে। এক মুসলিমের সবকিছু অপর মুসলিমের প্রতি হারাম- তার রক্ত, তার সম্পদ ও তার ইজ্জত।

এ অংশে এক মুসলিমের প্রতি অপর মুসলিমের কয়েকটি হক উল্লেখ করা হয়েছে। তার আগে অন্তরে চেতনা সঞ্চার করা হয়েছে যে, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। আর সে ভ্রাতৃত্বের দাবি হল তারা এসকল হক সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। কোনও অবস্থায়ই তা নষ্ট করবে না।

পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা করা
ولا يخذله সে তাকে অসহায় ছেড়ে দেয় না'। অর্থাৎ যেসকল বৈধ ক্ষেত্রে তার সাহায্য প্রয়োজন, সেসকল ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই সাহায্য করে বৈধ ক্ষেত্রে সাহায্য করা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ “তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না।সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ২
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ- وَإِنِ اسْتَنْصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ “হাঁ, দ্বীনের কারণে তারা তোমাদের সাহায্য চাইলে (তাদেরকে) সাহায্য করা তোমাদের অবশ্যকর্তব্য। সূরা আনফাল (৮), আয়াত ৭২
কোনও মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য করা একটি বড় নেক আমল। এ নেক আমলের বিনিময়ে আখেরাতের পুরস্কারের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সাহায্য করার সুসংবাদ আছে। অপরদিকে সাহায্য করার শক্তি-ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সাহায্য না করা একটি কঠিন গুনাহ। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের পরিপন্থী। এ গুনাহে লিপ্ত হলে কেবল আখেরাতেই নয়; দুনিয়ায়ও তার অশুভ পরিণাম ভোগের আশঙ্কা রয়েছে। হাদীছ শরীফে সেরকম সতর্কবাণীও করা হয়েছে। হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. ও হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ما من امرئ مسلم يخذل امرأ مسلما في موضع تنتهك فيه حرمته وينتقص فيه من عرضه إلا خذله الله في موطن يحب فيه نصرته، وما من امرئ ينصر مسلما في موضع ينتقص فيه من عرضه وينتهك فيه من حرمته إلا نصره الله في موطن يحب فيه نصرته “যে-কোনও মুসলিম ব্যক্তি এমন স্থানে অপর কোনও মুসলিম ব্যক্তির সাহায্য করা হতে বিরত থাকে, যেখানে তার সম্মান নষ্ট করা হয় ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয়, আল্লাহ তাআলা এমন স্থানে তার সাহায্য করা হতে বিরত থাকবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য কামনা করে। অপরদিকে যে-কোনও মুসলিম ব্যক্তি এমন স্থানে অপর কোনও মুসলিম ব্যক্তির সাহায্য করে, যেখানে তার সম্মান নষ্ট করা হয় ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয়, আল্লাহ তাআলা এমন স্থানে তার সাহায্য করবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য কামনা করে।
হযরত সাহল ইব্ন সা'দ রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- من أذل عنده مؤمن فلم ينصره وهو يقدر على أن ينصره أذله الله على رؤوس الخلائق يوم القيامة 'যার সামন কোনও মুমিন ব্যক্তির অবমাননা করা হয় আর সে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তার সাহায্য না করে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন সমস্ত মাখলুকের সামনে তাকে লাঞ্ছিত করবেন।
হযরত ইমরান ইব্ন হুসাইন রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন من نصر أخاه بالغيب وهو يستطيع نصره، نصره الله في الدنيا والآخرة 'যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার সাহায্য করে এবং সে তার সাহায্য করার ক্ষমতাও রাখে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার সাহায্য করবেন।
উল্লেখ্য, মানুষের সাহায্য কখনও দুনিয়াবী বিষয়েও প্রয়োজন হয় এবং কখনও প্রয়োজন হয় দীনী বিষয়েও। দুনিয়াবী বিষয়ে, যেমন মজলুম ব্যক্তির প্রয়োজন তার থেকে জুলুম প্রতিহত করা, অসুস্থ ব্যক্তির প্রয়োজন তার চিকিৎসা ও সেবা করা, অভুক্ত লোকের প্রয়োজন তার ক্ষুধা মেটানোর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। আর দীনী বিষয়ে সাহায্যের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেখানে কুরআন শিক্ষা বা দীনী ইলম শিক্ষার ব্যবস্থা নেই সেখানে তার ব্যবস্থা করে দেওয়া, কাউকে সঠিক মাসআলা জানা না থাকায় ভুল আমল করতে দেখলে তাকে সঠিক মাসআলা শেখানো, কেউ সঠিক মাসআলা বলে বিপদের সম্মুখীন হলে তার পাশে দাঁড়ানো ও তাকে সমর্থন করা ইত্যাদি।
দীনী সাহায্যের প্রয়োজন দুনিয়াবী সাহায্যের প্রয়োজন অপেক্ষা কোনও অংশেই কম নয়; বরং এর গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। কেননা কাউকে পার্থিব সাহায্য না করলে তাতে সে হয়তো দু'দিনের দুনিয়ায় কষ্টের সম্মুখীন হবে। পক্ষান্তরে যার দীনী সাহায্যের প্রয়োজন, তাকে যদি যথাযথ সাহায্য করা না হয়, তবে তার পরিণামে সে পরকালীন জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে ক্ষতির কোনও সীমা নেই এবং সেখানে তার কোনও প্রতিকারেরও ব্যবস্থা নেই। কাজেই মানুষের দীনী সাহায্যের ক্ষেত্রে কিছুতেই শিথিলতা করা উচিত নয়।
যাই হোক, মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দাবি হচ্ছে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী অপর মুসলিমের এ উভয়রকম সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া এবং কাউকে দীনী ও দুনিয়াবী কোনও ক্ষেত্রেই নিঃসঙ্গ ও অসহায় ছেড়ে না দেওয়া। কাউকে সেরকম ছেড়ে না দেওয়াকে এ হাদীছে মুসলিম ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে। বোঝানো উদ্দেশ্য তুমি প্রকৃত মুসলিম হয়ে থাকলে অপর মুসলিমের দিকে দীনী ও দুনিয়াবী উভয়রকমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। কোনও মুসলিমকে অসহায় ছেড়ে দেবে না।

একে অন্যের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তাদান
তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- كل المسلم على المسلم حرام عرضه وماله ودمه ‘এক মুসলিমের সবই অপর মুসলিমের উপর হারাম তার মান-সম্ভ্রম, তার ধন-সম্পদ ও তার রক্ত'। হাদীছের এ অংশে আমাদেরকে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি বলে দেওয়া হয়েছে। তা এই যে, ঈমান ও ইসলামের কারণে এক মুসলিমের সবকিছুই নিরাপদ হয়ে যায়। তার কোনও কিছুতেই অন্যায় হস্তক্ষেপ করা কারও জন্য বৈধ নয়।
এতে প্রথমে 'সবকিছুই হারাম বলার পর তার ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছে তার মান-সম্ভ্রম, তার ধন-সম্পদ ও তার রক্ত। অর্থাৎ এ তিনটিই হচ্ছে তার সবকিছু। প্রকৃতপক্ষে একজন মানুষের মূল বিষয় এ তিনটিই তার জান, তার মাল ও তার ইজ্জত। জান বা রক্ত হচ্ছে তার অস্তিত্ব, মাল ও সম্পদ তার অস্তিত্ব রক্ষার উপকরণ আর ইজ্জত-সম্মান হচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য, যা দ্বারা অন্যান্য জীবজন্তু হতে তার পার্থক্য নিরূপিত হয়। অস্তিত্ব সকল জীবেরই আছে। কোনও না কোনও ধরনের মালও তাদের আছে। কিন্তু ইজ্জত-সম্মান কেবল মানুষেরই বিশেষত্ব। এর দ্বারা তার মানবিক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ইজ্জত-সম্মানবিহীন মানুষ পশুতুল্য। তাই ইসলাম মানুষের ইজ্জত-সম্মানকে তার অস্তিত্ব ও সম্পদের সমান মর্যাদা দিয়েছে। এর প্রত্যেকটিকেই অন্যদের জন্য হারাম ও মর্যাদাপূর্ণ করেছে, যা ক্ষুণ্ণ করা কারও জন্য জায়েয নয়। কারও প্রতি এমন কোনও আচরণ করা জায়েয নয়, যা দ্বারা তার সম্মানের হানি হতে পারে। কারও অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করা বা তাতে কোনওরকম খেয়ানত করা সম্পূর্ণ অবৈধ। এমনিভাবে কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, শারীরিক আঘাত করা বা কোনও অঙ্গহানি ঘটানো কঠিন পাপ ও নাজায়েয।
প্রকৃতপক্ষে অন্যের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা রক্ষা করা তাকওয়ার মাধ্যমেই সম্ভব। যার মধ্যে আল্লাহভীতি আছে, কেবল সেই অন্যের এ তিন বিষয়ের উপর আঘাত করা হতে বিরত থাকতে পারে। যার মধ্যে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি নেই, তার দ্বারা কোনও না কোনওভাবে অন্যের হক নষ্ট হয়েই যায়। হয়তো সে শারীরিকভাবে কাউকে কষ্ট দেবে, কিংবা অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভোগ করবে অথবা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অন্যের ইজ্জত-সম্মানের উপর আঘাত করবে। এর প্রত্যেকটিই কঠিন পাপ। এ পাপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রত্যেকের কর্তব্য তাকওয়ার অধিকারী হওয়া। তাকওয়ার এ গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-

তাকওয়ার প্রয়োজনীয়তা
التقوى هاهنا 'তাকওয়া এখানে। অর্থাৎ মুসলিম ব্যক্তির এই যে তিনটি বিষয় তোমাদের সকলের জন্য হারাম, তোমরা এর উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে পারবে কেবল তখনই, যখন তোমাদের অন্তরে তাকওয়া থাকবে। তাকওয়া ও আল্লাহভীতি হারামে লিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচার প্রাণশক্তি। তাই তোমাদের কর্তব্য এ শক্তি অর্জনে সচেষ্ট থাকা। অপর এক হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- إن في الجسد لمضغة، إذا صلحت صلح الجسد كله وإذا فسدت فسد الجسد كله، ألا وهي القلب “নিশ্চয়ই শরীরের ভেতর একটি মাংসপিণ্ড আছে। তা যখন ঠিক থাকে তখন সবটা শরীরই ঠিক থাকে, আর তা যখন নষ্ট হয়ে যায় তখন সবটা শরীরই নষ্ট হয়ে যায়। শোন, তা হচ্ছে অন্তকরণ
অন্তকরণ ঠিক থাকার অর্থ তাতে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি থাকা। তাতে আল্লাহভীতি থাকলেই হাত, পা, চোখ, কান ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিক থাকে অর্থাৎ তা দ্বারা কোনও পাপকর্ম সংঘটিত হয় না। মুত্তাকী ব্যক্তি কারও সঙ্গে খেয়ানত করে না, মিথ্যা কথা বলে না এবং তার সাহায্যের হাত গুটিয়ে রাখে না। সে অপর মুসলিমের জান, মাল ও ইজ্জতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। ফলে তার দ্বারা কেউ শারীরিকভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয় না। সে অন্যায়ভাবে কারও অর্থ-সম্পদ গ্রাস করে না। এরূপ ব্যক্তির দ্বারা কারও সম্মানহানিরও আশঙ্কা থাকে না।
التقوى هاهنا বলে এদিকেও ইঙ্গিত করা হতে পারে যে, তাকওয়া ও পরহেযগারী যেহেতু অন্তরের বিষয়, তাই কে প্রকৃত মুত্তাকী ও পরহেযগার তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আর আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হয় তাকওয়ার দ্বারা। ইরশাদ হয়েছেঃ- إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ‘প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী। সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১৩
এক বর্ণনায় ইরশাদ হয়েছেঃ- المسلمون إخوة، لا فضل لأحد على أحد إلا بالتقوى “সমস্ত মুসলিম ভাই ভাই। একজনের উপর অন্যজনের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয় কেবলই তাকওয়ার দ্বারা।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ- من أكرم الناس ‘শ্রেষ্ঠতম মানুষ কে’? তিনি উত্তর দেন- أتقاهم لله 'যে ব্যক্তি আল্লাহকে বেশি ভয় করে।
তো মানুষের প্রকৃত মর্যাদা যেহেতু তাকওয়া দ্বারা নির্ণিত হয়, আর কারও তাকওয়ার মাত্রা যেহেতু আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না, তাই হতে পারে কেউ কাউকে টাকা-পয়সা, বিদ্যা-বুদ্ধি ও পেশিশক্তিতে দুর্বল দেখে তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না, তার দৃষ্টিতে সে নিজের তুলনায় নিম্নস্তরের লোক, ফলে তার জান, মাল ও ইজ্জতের প্রতি তার কোনও শ্রদ্ধা নেই। শ্রদ্ধা না থাকায় তার প্রতি তার দ্বারা বিভিন্নভাবে জুলুম অবিচার হয়ে যায় এবং এটাকে সে বিশেষ কিছু মনেও করে না। তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ হাদীছ তাকে সতর্ক করছে যে, তুমি যাকে অশ্রদ্ধাবশে জুলুম-নিপীড়ন করছ, হতে পারে তার অন্তরে তাকওয়ার পরহেযগারী বেশি থাকায় আল্লাহ তাআলার কাছে তার মর্যাদাও তোমার চেয়ে অনেক বেশি। সে নিজ তাকওয়া দ্বারা আল্লাহ তাআলার কাছে মর্যাদাবান সাব্যস্ত হয়েছে। এমনকি সে আল্লাহর ওলী ও বন্ধু হয়ে গেছে। বাহ্যিক শান-শওকত না থাকায় আল্লাহর এ ওলীর প্রতি জুলুম-নির্যাতন করে তুমি তো নিজের উপর গযব ডেকে আনছ। এক হাদীছে কুদসীতে আছেঃ- من عادى لي وليا آذنته بالحرب “যে ব্যক্তি আমার ওলীর সঙ্গে দুশমনী করে, তার সঙ্গে আমার যুদ্ধ।

কোনও মুসলিমকে তুচ্ছ মনে না করা
তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন এক ব্যক্তির মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ গণ্য করবে'। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার কোনও মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ গণ্য করে সে নেহাৎ মন্দ। কিভাবে কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে তুচ্ছ গণ্য করা যেতে পারে, যখন আল্লাহ তাআলা তাকে সুন্দরতম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এর মধ্যকার যাবতীয় বিষয়কে তার সেবায় নিয়োজিত করে দিয়েছেন, তাকে মুসলিম, মুমিন ও বান্দা নামে অভিহিত করেছেন এবং তার স্বজাতীয়দের মধ্য থেকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম বান্দা তথা নবী-রাসূল মনোনীত করেছেন? কিছুতেই তা করা যায় না। তা করা অহংকারেরই নামান্তর। অহংকার করা কঠিন পাপ। হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- الكبر بطر الحق وغمط الناس “অহংকার হচ্ছে সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা।

অহংকারের পরিণাম জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়ে যাওয়া। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করেনঃ- لا يدخل الجنة من كان في قلبه مثقال ذرة من كبر 'যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
তাকওয়াই যখন মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি, তখন কাউকে ছোট মনে করার সুযোগ কই? কেউ টাকা-পয়সার কমতি দ্বারা ছোট হয়ে যায় না। ছোট হয় না চেহারা সুরতের ঘাটতি দ্বারাও। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানিয়ে দিয়েছেনঃ- إن الله لا ينظر إلى صوركم وأموالكم ولكن ينظر إلى قلوبكم وأعمالكم 'আল্লাহ তোমাদের চেহারা-সুরত ও অর্থ-সম্পদ দেখেন না, তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল।
তিনি যখন অন্তর ও আমল দেখেন, চেহারা-সুরত ও অর্থ-সম্পদ নয়, তখন কর্তব্য নিজ অন্তর ও আমল ভালো করার সাধনায় লিপ্ত থাকা। অন্যের চেহারা-সুরত ও সম্পদের কমতি দেখে ধোঁকায় পড়া উচিত নয়। হযরত বিলাল হাবশী রাযি. হযরত আতা ইব্ন আবী রাবাহ রহ. এবং এরকম হাজারও আল্লাহওয়ালা দুনিয়া ও আখেরাতের মর্যাদা কুঁড়িয়েছিলেন অন্তরের তাকওয়া ও বিশুদ্ধ আমল দ্বারাই। চেহারা সুরত ও অর্থ-সম্পদে তারা লাখও মানুষের চেয়ে পেছনে ছিলেন। সে পেছনে থাকাটা আল্লাহর কাছে তাদের এগিয়ে থাকা ও মর্যাদালাভে বাধা হয়নি। এখনও তা কারও জন্য বাধা নয়। কাজেই কাউকে এ ক্ষেত্রে পেছনে দেখলে সে-যে তাকওয়া পরহেযগারী দ্বারা আমার চেয়ে এগিয়ে নয় তা কী করে বলা যাবে? সে এগিয়ে থাকা ব্যক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা নিজেকেই ধোঁকা দেওয়ার নামান্তর।
সুতরাং কোনও অন্ধ, খঞ্জ, বিকলাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গকে শারীরিক ত্রুটির কারণে তুচ্ছ মনে করার কোনও সুযোগ নেই। কোনও গরীব বা অশিক্ষিতকেও ছোট মনে করার অবকাশ নেই। এমনকি কোনও পাপীকেও নিজের চেয়ে ক্ষুদ্র ভাবার বৈধতা নেই। এরা সকলেই সহানুভূতি ও সহমর্মিতা পাওয়ার হকদার। এক মুমিন আরেক মুমিনের আয়না। তাই পাপীর ক্ষেত্রে কর্তব্য দরদী মন নিয়ে তাকে পাপ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা, পাপের কারণে তাকে ঘৃণা করা নয়। শারীরিক বা কর্মগত ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে কারও প্রতি অপ্রীতিকর আচার-আচরণ বাঞ্ছনীয় নয়। তারা বয়সে বড় হলে তো শ্রদ্ধাই তাদের প্রাপ্য। বয়সে ছোট হলে তারা স্নেহের পাত্র। যদি তারা সমবয়সী হয়, তবে তাদের প্রতি ভাইয়ের মত আচরণই সমীচীন।
ইয়াহইয়া ইব্ন মুআয রহ, বড় সুন্দর বলেছেন- তোমার কাছ থেকে মুমিন ব্যক্তির প্রাপ্য তিনটি : তুমি তার উপকার করতে না পারলে অন্তত ক্ষতি করবে না; তাকে আনন্দ দিতে না পারলে অন্তত দুঃখ দেবে না; তার প্রশংসা করতে না পারলে অন্তত নিন্দা করবে না।
এ হাদীছের সারকথা হচ্ছে, প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য সে প্রত্যেক মুমিন-মুসলিমকে নিজের চেয়ে উৎকৃষ্ট গণ্য করবে। বয়সে যে ছোট তাকে উত্তম মনে করবে এ কারণে যে, সে হয়তো গুনাহ করেইনি অথবা তারচে' কম করেছে, বড়কে এ কারণে যে, সে তারচে বেশি ইবাদত-বন্দেগী করেছে। আলেমকে উৎকৃষ্ট মনে করবে তার ইলমের কারণে আর বে-আলেমকে এ কারণে যে, সে গুনাহ করে ফেলেছে অজ্ঞতার কারণে, জেনেশুনে নয়। আমি আলেম হয়ে থাকলে জেনেশুনে কত পাপ করি, যা তুলনামূলকভাবে বেশি অন্যায়। এমনকি কাফের ব্যক্তির ক্ষেত্রেও তো শেষটায় ঈমান ও তাওবার সম্ভাবনা আছে। তাকেইবা ঘৃণা করার অবকাশ কই? আসল ধর্তব্য তো শেষ অবস্থাই। আল্লাহ তাআলা আমাদের শেষ অবস্থা শুভ করুন ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু দান করুন, আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. পরস্পর হাসাদ করা নাজায়েজ ও কঠিন পাপ। এর থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।

খ. প্রতারণামূলক দালালি করা জায়েজ নয়। কাজেই কোনও মুসলিম ব্যক্তির এরূপ কাজে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই।

গ. দুনিয়াবী বিষয়ে একের প্রতি অন্যের ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করা সম্পূর্ণ হারাম। প্রত্যেক মুসলিমের এর থেকে বিরত থাকা চাই।

ঘ. পরস্পর মুখ দেখাদেখি ও দেখাসাক্ষাত বন্ধ করা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয়দানকারীকে এর থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।

ঙ. দুজন ব্যক্তির পারস্পরিক বেচাকেনা ও দরদাম করার মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ করা কিছুতেই উচিত নয়। এটা নাজায়েয কাজ।

চ. নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরূক রাখার প্রচেষ্ট অব্যাহত রাখা চাই। এর দ্বারা হিংসা বিদ্বেষমূলক কাজকর্ম থেকে বেঁচে থাকা যায়।

ছ. ইসলামে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেসব কর্মকাণ্ড দ্বারা তা ক্ষুণ্ণ হয় তা পরিহার করে চলা অবশ্য কর্তব্য।

[১] মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৯৫২; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ২৭৩; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২০৭৮৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৬০৯; শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৬২২; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ৩১৭৭৩

[২] সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭৫২৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮১৫; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৩৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৪২০৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৫৫০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ১২৫; বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৮২৬; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৮১৯; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ৩০২৮১

[৩] সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯০৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২১০; মুসান্নাফ ইবন আবূ শাইবা, হাদীছ নং ২৬৫৯৪; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৬১৮৪; আল খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক, হাদীছ নং ৭২২

[৪] নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১০৬৩৩

[৫] জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৪১; তাবারানী, আল-মুজামুল আওসাত, হাদীছ নং ৯৩১২; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮২১৫

[৬] সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৩১৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৪৫২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২২২৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৯২১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১০৭৩৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২১২০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭২৯০; সুনানুদ্ দারিমী, হাদীছ নং ২৫৮৩

[৭] সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৬৮১; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ৩৪৭৩০; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৬১৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৬০৫; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৬৯

[৮] সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬২৩৭; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৬০; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯১১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৩২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৮৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৬৬৯; মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ১৫৮৫১; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ২৫৩৬৮

[৯] সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯১৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৭৯৩৫; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৪০৪; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৭৯; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৬২০৭

[১০] সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৪১৩, ১৫১৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৫০২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১০৮৯৬; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২০৯৫; মুসনাদ আবু ইয়া'লা, হাদীছ নং ৬৫১৪
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন